তিনি একাধারে কবি, চিত্রশিল্পী, নাট্যকার, সম্পাদক,গদ্যকার, অনুবাদক, চলচ্চিত্রকার, মুক্তিযুদ্ধা সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে এবং প্রগতিশীল চিন্তাধারায় শীতলক্ষ্যার কলতানে বেড়ে ওঠা মাহবুব কামরান যেন আলোকিত মানুষের অবয়ব।
স্ত্রী নাজমা কামরান আর দুই পুত্র কাহলিল জিবরান তীর্থ ও কাহলিন ইরাবান দীপ্তকে নারায়ণগঞ্জে বসবাস করছেন ।
মাহবুব কামরান যখনই দেখেছেন সমাজের অবক্ষয়িত রূঢ়তা, তখনই সচেতনার সঙ্গে কাজ করেছেন। চেয়েছেন মহাকালের মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কে ঠেকাতে। সংস্কৃতির যে মাধ্যমেই তিনি এসব অবক্ষয়কে প্রতিহত করাকে যথার্থ মনে করেছেন, তখনই সঠিক কর্মপদ্ধতিতে তা প্রতিহত করতে চেয়েছেন।
প্রতিদিন নিজকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে সৃষ্টি করেন বিমুগ্ধতা; কবিতায়, চিত্রে, গল্পে, অনুবাদে, চিত্রকলায়, নাটকে, চলচ্চিত্রে । বাস্তব -অবাস্তব এর আলেয়ায় অভিজ্ঞ - এসেছে পরিপূর্ণতা;শিল্প-সাহিত্যের নানান বিষয়ে সত্তায় সত্য ও সুন্দরের গভীর শিকড়টি তুলে আনতে সামাজিক বৈকল্য ও অবক্ষয় বাজিয়ে তুলেন অনায়েসে - যা আমাদেরকে একটি সুন্দর পৃথিবীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেয়। নেপথ্যচারী, অন্তর্মুখী এবং উপেক্ষিত অথচ নিভৃত্তে তার সৃষ্টিসত্তায় উল্লেখযোগ্য কাজের ব্যাপ্তী ঈর্ষান্বিত করার মতো। সওর দশকের ভিন্ন ধারার অন্যতম মেজাজী কবি-ই শুধু নন চিত্রকর মাহবুব কামরান; মাক্সীয় রাজনীতির ছায়া প্রচছায়ায় কাটিয়েছেন দীর্ঘদিন। সংগোপনে সঞ্চিত হয়েছে দ্রোহ এবং অনিবার্য রনাঙ্গনে স্বাধীনতার সূর্য চোখে নির্ভীক; চিত্রকরের শিল্প দর্শন ও চিত্রকলার রীতি প্রতিবাদের ইজেলে প্রতিভাসিত হয় । নির্ভরতার গভীর সম্পর্কের বুনোটে কবি কামরান উচ্চারন করেন : বিষন্ন রাত্রির ফোটা ঝড়ে পাখির পালকে ।
 |
মাহবুব কামরান - তাহের ম. শায়েখ
|
তারপর ক্রমাগত শিল্পের ভূবনে হেটে বেড়ানো অশংকিত। বাস্তব -অবাস্তব সীমানার ধ্বনির অবছা আলো আধারির নিরন্তর বেদনা ক্রমশ প্রলুব্ধ হতে হতে উদ্ভুত সৃষ্টির অন্বেষায় বেড়ে উঠে ভিন্নমুখী অজ্ঞতা। যার অনুপ্রেরনা আর ফেলে আসা বেদনার উদ্যানে খোজ মিলে মানব সভ্যতার এক স্বচ্ছল বুনিয়াদ। যা থেকে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত মানুষ জেগে উঠে আবার ঘুমিয়ে যায় প্রন্তরের অলিগলিতে। সীমাবদ্ধতার অন্তরের আস্তরের জমিনে ক্রমশ ঘটে থাকে সৃষ্টির লীলা ।
জীবনের দ্বীপ শিখার ইতিবৃত্তে বারবার জ্বলে উঠে মানুষ; অগনিত মানুষ। যারা এ দিগন্তে রেখে গেছে তাদের প্রাপ্য, ভাগ্য আর অসম বন্টনের অধিকার। মানুষ আবলীলায় ফিরে পেতে চায় তার বিশ্বাস; ফিরে পেতে চায় নব জন্মান্তরের কৃষ্টি, বাঙালী সংস্কৃতির আবাহন আর প্রকৃতির নীলম্বরের ঋজুতে বেজে ওঠে ঘন্টাধ্বনি- যা সময়ের প্রতি পদে এগিয়ে আসে মহানন্দ। মানুষের বেড়ে ওঠার প্রাথমিক শর্ত- মানুষের সততা। মানুষের জেগে ওঠার মূল ভিত্তি সামাজিক-সংস্কৃতির স্বচ্ছতা আর নিজস্বতা। প্রয়োজন শুধু রাজনীতির শুদ্ধচর্চায় বাস্তব সময়ের অসীম প্রগাঢ় আর নিরবিচ্ছন্ন একাগ্রতা ... যা থেকে ধীরে ধীরে প্রজ্জ্বলিত হবে এ দেশের আপামর আদল, প্রস্ফুটিত হবে নানাবিধ কর্মের প্রান্তর।
অনুশীলন আর সামাজিক দায়বদ্ধতার ভেতর দিয়ে-ই শুরু হয় একজন শিল্পির জীবন এমন বিশ্বাস, প্রত্যাশার উর্বরতায় মূর্ত, বিমূর্ত, বাস্তবধর্মী, প্রকাশবাদ, রূপকবাদ স্মৃতির প্রতিবিম্বের জমিন ভরেছেন কামরান। দ্বিতীয় প্রদর্শনীটি হয় ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটের নভেরা গ্যালারিতে। ‘স্মৃতির প্রতিবিম্ব’ শিরোনামে এই চিত্র প্রদর্শনীটি ছিল তাঁর পরিণত বয়সের অপার আলিঙ্গন। মৃত্যুর তিন দিন আগে তাঁর তৃতীয় প্রদর্শনীর চিত্রগুলো অঙ্কনের কাজ শেষ করেছিলেন মাত্র। তাঁর এবারের কাজগুলো ছিল বিষয় ও মাধ্যমে ‘মিথ পুরাণ’, কালি-কলমে।
স্বাধীনতা উত্তর এদেশ থেকে যে দু’চার জন সাংস্কৃতিক কর্মী ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে পড়ার সুযোগ কামরান তাদের অন্যতম। তিনি সেখানে নাটক চিত্রকলায় উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। দেশে প্রথম কার্টুন প্রদর্শনী করেন, বাংলাদেশের তৃতীয় ধারা নাটকের প্রবর্তক তিনি। সিনেপল চলচ্চিত্র সংসেদর সাধারন সম্পাদক ছিলেন, থিয়েটার কমিউনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ''দেয়াল” নির্মানের মাধ্যমে স্বল্পৈদর্ঘ্য চলচ্চিত্র নতুন পথের সন্ধান দেন ”সুপার এইট।”
বোহমিয়ান জীবনের মায়া- শিল্পের অন্বেষন, নিরিক্ষা, নিজেকে আরো নির্মানের অভিপ্রায়ে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশ- দেশান্তে। চীন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, কম্বোডিয়া , ভিয়েতনাম, নেপাল,ভূটান, প্রভৃতি। উপমহাদেশর প্রখ্যাত গণসংঙ্গীত শিল্পী হেমঙ্গ বিশ্বাস, থার্ড থিয়েটারের জনক বাদল সরকার, স্বনামধন্য চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক, খ্যাতিমান মকবুল ফিদা হুসেনসহ অনেক গুনীজনের সংর্স্পশে আসেন। বাংলাদেশে অনেকের মধ্যে খ্যাতমান কথা সাহিত্যিক শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও আহেমদ ছফা’র প্রিয়ভাজন কামরান যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা ভারত নাটক নিয়ে, শিল্পকলার নতুন নতুন পথের সন্ধানে।
তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে:
- পাচটি প্রর্দশনী
- পাচটি নাটক
নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য,
- ছেঁড়া তালির গল্প
- রাজা আসে রাজা যায়
- আবদুল্লাদের সবাক ছবি
- দুটি কবিতার বই
- বিষন্ন রাত্রির ফোটা ঝড়ে পাখির পালকে

- বরফের আচকান গায়ে এঁটে হেঁটে যায় কবি
এবং অগণিত কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে আসছে সত্তরের দশক থেকে।
তার কয়েকটি গ্রন্থ:
- কাহলিল জিবরানের: সেন্ড এন্ড
ফোম:
- বুলগেরিয়ার প্রতিবাদী কবি পিটার
এন্টাসবের বাছাই কবিতা
- থিয়েটারের রাজনীতি - রাজনীতিরে
থিয়েটার
- লরেন্সের শ্রেষ্টগল্প
- ‘চে’র ডায়েরি’ চে
গুয়েভারা রচনা সমগ্র
- আখতারুজ্জামান ইলিয়াছ –এর স্মারক
গ্রন্থ ও ডায়োরি
- বিষয় চিত্রকলা
- বিমূর্ত কলা
- কবি ও চিত্রশিল্পী কাহলিল জিবরান
- চিত্রশিল্পী ও পটচিত্রী শম্ভূ আচার্য
- শিশু কিশোর চিত্রকলা শিক্ষার ক্রমবিকাশ
- আদিবাসী সংস্কৃতি সভ্যতার সংকট আদিবাসী চিত্রকলা ও পরিপ্রেক্ষিত
- সবার জন্য সহজ ভাষায় চিত্রকলা শিক্ষা,
- রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা
- জয়নুল আবেদিনের রঙ ও রেখা
- ফরাসি বিপ্লবের ২০০ বছর
- নির্বাচিত মালায়ালাম গল্প
- সালমান রুশদির গল্প - ইস্ট ওয়েস্ট
- এনকাউন্টার অব ফিডেল
- বিল্টু মিয়া পল্টি মারে
- একটি আমের গপ্প
- শেয়াল চাচা কোথায় যাচ্ছ,
- রঙ
- বাটালি পাহাড়ের জাদুকর
- পির মাহিন
- পিচ্চি ব্যাঙ টাউটের অধম
- আমাদের হাতী শুভ্রা
- ধীমন ও একটি বালিকা
- বরফ ঝড়া দিনে
- দশ ইদুরের বাক্স বদল
- রবির স্বপ্ন বাস্তব হয়
- আনাফ্রাঙ্ক রচনা সগম্র
- বয়লা
- বুড়ী তাজেল ও ভানু কুমির
- পড়ায় পড়ায় আনন্দ
- ফিরে দেখা সারা জীবন
- সিরাজ সিকদার রচনাসমগ্র
- গল্প আন্তর্জাতিক এশিয়া
আফ্রিকা ইউরোপ
- থিয়েটারের রাজনীতি রাজনীতির
থিয়েটার
- জলের ভাঁজে ডুবে যায় সভ্যতার
টারবাইন (কাহলিল জিবরান)
- ফরাসী কবিতার বিশ শতক ও ছয়জন
কবি
- তিনটি নাটক-ম্যাক্সিম গোর্কি
- এক্সপ্রেসিনিজম
- শিল্পী তরুন ঘোষ ও বেহুলা
- চিত্রশিল্পী কাজী হাসান হাবীব
- সফল অসফল পিকাসো
- পক্ষী ও আদম
- প্রেম শর্তে সূচীপত্র :: হাবীব
সিদ্দিকী
:: এ ড্রীম অব শম্ভূ আচারিয়া::
দেশের একমাত্র পটশিল্পী
শম্ভূ আচার্যের ওপর তথ্যচিত্র
::আশ্রয়::
লোকজ সামাজিক প্রতিচ্ছবি
::দেয়াল::
মানুষের গান:: মাটিবর্তী লোকায়ত বাংলার চিরায়িত জনগান।
প্রতিষ্ঠান :
স্কুল অব আর্ট এন্ড পেইটিং: নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন শেষ পর্যন্ত ; পাশাপাশি অগ্রসর মানুষের বিকাশের পূর্নতায় সম্পাদনা করছেন বিষয় ভিত্তিক মাসিক .: ছাপ :.।
দেশের একমাত্র প্রথাবিরোধী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘ঘাস ফুল নদী’র অন্যতম কর্ণধার ছিলেন।
ছাপ - চারুকলার সব বিষয়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। ‘
ছাপ- নামে চারুকলা বিষয়ক বস্তুনিষ্ঠ পত্রিকাও প্রকাশ করেছেন।
ছাপ- নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানও গড়ে গেছেন।
পুরস্কার:
চিত্রকলায় তাঁর সৃজনশৈলী কর্মের জন্য বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ প্রশংসিত হয়েছেন। পুরস্কৃতও হয়েছেন।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পুরস্কার:
- অনুবাদ সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ‘লেখাপ্রকাশ সাহিত্য পুরস্কার ২০০৮’,
- মুক্তধারায় পর পর তিনবার প্রচ্ছদশিল্পী পুরস্কার, \
- দীর্ঘ কবিতার কাব্যগ্রন্থ ‘বিষন্ন রাত্রির ফোটা ঝড়ে পাখির পালকে ’র জন্য কলকাতার গণশিল্পী সংগঠন থেকে সম্মানজনক পুরস্কার,
- শিশুসাহিত্যের কভার ডিজাইনের জন্য নাইজেরিয়ান বেস্ট অ্যাওয়ার্ড,
- পোস্টার ডিজাইনের জন্য ডানলপ পুরস্কার (ভারত),
- জার্মানিতে আন্তর্জাতিক থিয়েটার উত্সবে ‘আবদুল্লাদের সবাক ছবি’ নাটকের পোস্টারের জন্য বেস্ট অ্যাওয়ার্ড
- অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ‘অটোমান’ পাবলিকেশন্সের স্থায়ী প্রচ্ছদশিল্পী
ইতিমধ্যে পেরিয়ে যায় কাল সময় সমাজ বাস্তবতা। রক্তাক্ত হৃদয়ে স্মৃতির কুয়াশা নামে- শিল্পির ইজেলে ফিরে ফিরে হানা দেয় প্রানের জোয়ার জেগে উঠে হিরণদ্যূতি ভোর। বন্ধ্যা সময়ে এক লক্ষে জেগে ওঠেন এক শিল্পী নিমগ্ন প্রতিভাবান মাহবুব কামরান। আধুনিক শিল্পের ইজেলে আজো হয়ে পথকৎৃ আছেন মৌলিকত্বে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে, বিষয়-বিশ্লেষণে। - তাহের ম. শায়েখ