৩০.৬.০৮

মন্দিরাকে বুকে আঁকড়ে ফিরে যাব চাঁদের শহরে, অ্যালসেশনের মতো ড. আকবর লিখুন কালের ইতিহাস

মন্দিরাকে বুকে আঁকড়ে ফিরে যাব চাঁদের শহরে, অ্যালসেশনের মতো ড. আকবর লিখুন কালের ইতিহাস


পীর হাবিবুর রহমান: সুনামগঞ্জের দেখার হাওরে আষাঢ়ে পূর্ণিমা রাতে চাঁদের আছড়েপড়া রূপের সঙ্গে জলতরঙ্গের খেলা উপভোগ করতে অনেকেই আগ্রহী। হাওরে জ্যোৎøায় অঙ্গ ভিজিয়ে গল্প করতে দেশ-বিদেশ থেকে অনেকে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আমি ওয়ান-ইলেভেনের কট্টর সমর্থক। পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা আমার বুকে হাওরের ঢেউয়ের মতো আঘাত হানে। আমি তাই বারবার বলি কোথাও আমার হাত-পা বাঁধা নেই। তবু আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল। আমার চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছা করে, ফিরিয়ে দাও আমার সাদা-কালো যুগের রাজনীতি। বন্ধ করো রাজনীতির রঙিন ছবি।
ওয়ান-ইলেভেনের লক্ষ্য অর্জিত না হলে আমার মতো অনেকেই স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ব্যথিত হতাশ হবেন। ওয়ান-ইলেভেন বিজয়ী হলে জনগণ জিতবে। হারলে জনগণ পরাজিত হবে। তাই ওয়ান-ইলেভেনের উদ্যোক্তা, সমর্থকদের বলবো বিবেকের কারফিউ ভেঙে সত্যকে সত্য বলুন। সবাইকে শোনাই নজরুলের কবিতার পঙক্তিÑ ‘দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার/লঙ্ঘিত হবে রাত্রিÑ নিশীতে যাত্রীরা হুশিয়ার/ দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ/ ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ? কে আছে জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ। এ তুফান ভারি দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার’। কোথায় চলেছে স্বদেশ, তা নিয়ে আমার এই কবিতাটি স্মরণ।
বারবার বলেছি ২৭ ও ২৪ বছরের রাজনৈতিক নেতৃত্বে যোগ্যতা প্রমাণে দুই নেত্রী যথেষ্ট সময় পেয়েছেন। বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণতন্ত্রের বদলে তারা প্রতিহিংসার অসুস্থ রাজনীতি দিয়েছেন। তারা অবসর নিলেই আমি আনন্দিত। রাজনীতিতে ফিরে আসবে কি দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবারতন্ত্র? সন্ত্রাসী, গডফাদার ও লুটেরা দুর্নীতিবাজ? খালেদা জিয়া যখন জনগণের কাছে তার পুত্র, হাওয়া ভবন ও সরকারের দুর্নীতির মহোৎসবের গ¬ানি উপেক্ষা করে লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে বলেন তার ছেলেরা অন্যায় করেনি তখন রীতিমতো ভয় হয়। প্রশ্ন জাগে, তবে কি তারা আবার ফিরে আসবে দানবের বেশে?
আমার লেখার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অনেক কিছুই পাই ফোনে ও ই-মেইলে। ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ’ লেখাটি পড়ে মুগ্ধ মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম টেলিফোনে বলেছেন, জাতির মঙ্গল কামনার পথ থেকে হয়তো পথিক সরেছে, তবে তাদের বেরিয়ে যাওয়ার পথ হারায়নি। আমার তখন টিআইবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের কথা কানে বাজে, নেতাদের ‘জি নেত্রী জি নেত্রী’ সব শেষ হয়ে গেল।
আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় দেশে কি আজ একজন নেতাও নেই যারা শেখ মুজিবের অঙ্গুলি হেলন থেকে কোনো যোগ্যতা অর্জন করেননি? কর্মীদের সুরে নেতা কথা বলবেন নাকি নেতার সুরে কর্মী কথা বলবেন? ভাসানীর ‘খামোশ’ শব্দটি থেকে একজন সাহসী নেতার জš§ হয়নি ভাবলে অবাক হই। ঊনসত্তর যে তোফায়েলের হাতে তুলে দিয়েছিল হ্যামিলনের বাঁশি, মাথায় পরিয়েছিল নায়কের খেতাব, তিনি আমার কতটা স্বজন পাখিরাও জেনে গেছে। তার বাড়ির মধুর আড্ডা, ভোলার মিষ্টি, ভাবীর অতিথেয়তা আর তোফায়েলের রোমান্টিক হাসি আমাকে মুগ্ধ করে। একবার তাকে নিয়ে আমাদের সময়ে লিখলে অনেকে বলেছিলেন, আবেগ থামাও। গায়ে মাখিনি, আজ যখন তাকে দেখি মতিয়া চৌধুরীর উদ্ধৃতি দিয়ে বক্তব্য রাখেন তখন মনে হয়, আজ একি শুনি মন্থরার মুখে? সত্তর ও আশির দশকের ছাত্রনেতাদের মনে মনে খুঁজি, কোথায় মাহমুদুর রহমান মান্না, ফজলুর রহমান, আখতারুজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ, জিয়াউদ্দিন বাবলু, বাহালুল মজুনন চুন্নু, আবদুল মান্নান, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, ফজলে হোসেন বাদশা, খ ম জাহাঙ্গীর, মুকুল বোস, মনির উদ্দিন আহমদ, হাসিব খান, শিরিন আখতার, ডা. মোশতাক হোসেন, জিয়ার শার্টের কলার ধরতে যাওয়া হাবিবুর রহমান খান, তোমরা সাহসী হও। প্রতিটি শহরে-গ্রামে তোমাদের কত অনুসারী-ভক্ত। বিবেকের কারফিউ ভেঙে কড়া নাড়ো মানুষের দরজায়।
বঙ্গবন্ধু মানুষের দরজায় কড়া নেড়ে সামন্তবাদী মুসলিম লীগ আর পাকিস্তানি শাসকদের একসঙ্গে পদ্মা-যমুনায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। জনতার শক্তির চেয়ে বড় কোনো শক্তি আজো পৃথিবীতে আসেনি। জনতার অন্ধ আবেগে কড়া নাড়ো, তাদের চোখ খুলে দেয়ার দায়িত্ব নাও। যদি সংস্কার ও রাজনীতি এবং প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়া বিষ ঝেড়ে না ফেলে নির্বাচন হয় তাহলে তা দেশকে ওয়ান-ইলেভেনের পূর্বে নিয়ে যাবে। এখনই বলাবলি হচ্ছে রাজনীতি ওয়ান-ইলেভেনের আগের জায়গায় যেতে ধীর লয়ে পিছু হটছে।
যদি এমন হয়, বলি, ‘জাগো বাহে কোণ্ঠে সবাই’। যদি এমন হয় তাহলে আমি চলে যাব আমার শহরে। মার মন্দিরাকে বুকে আঁকড়ে ধরে টিনের ঘরে মুষলধারে নেমে আসা বৃষ্টির শব্দ শুনব। হাওর দেখব জ্যোৎøা রাতের বজরায়। বারান্দায় মুখোমুখি বসে নির্মলেন্দু গুণের কবিতা শোনাবÑ ‘শুধু একবার তোমাকে ছোঁব/ ঐ আনন্দে কেটে যাবে সহস্র জীবন/ শুধু একবার তোমাকে ছোঁব/ অহংকারে মুছে যাবে সকল দীনতা/ শুধু একবার তোমাকে ছোঁব/ শুধু একবার পেতে চাই অমৃত আস্বাদ/ শুধু একবার তোমাকে ছোঁব/ অমরত্ব বন্দি হবে হাতের মুঠোয়/ শুধু একবার তোমাকে ছোঁব/ তারপর হব ইতিহাস। যদি এটা ভালো লাগে তাহলে বলবÑ ‘হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে/ মন বাড়িয়ে ছুঁই/ দুই কে আমি এক করি না/ এককে করি দুই/ হেমের মাঝে শুই না যবে/ প্রেমের মাঝে শুই/ তুই কেমন করে যাবি? পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া/ আমাকে তুই পাবি। তবুও আমি আর ওই লুটপাট রক্তপাত, দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি দেখতে এই ঢাকা ছেড়ে চলে যাব আমার আঁতুড়ঘরে। তোমরা যারা রাজমহলের কৃতদাসদের সঙ্গসুখ নিয়ে রাজনীতি করার মানসিকতা রাখো, তারা দেশ শোষণ করো। ১৫ কোটি মানুষের দেশ থেকে যদি নৈতিক মনোবল, দৃঢ় সাহসী ও সৎ একজন নেতা দেশের শূন্য নেতৃত্ব পূরণে বেরিয়ে আসতে না পারে, পুনর্বহাল হয় দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবারতন্ত্র তাহলে আমি গ্রামের ছেলে. কবিয়াল লড়াই বাউলের আসরে ডুবে যাব।
২. তিরুনেল¬াই নারায়ণাইয়ার শেষণ (টিএন শেষণ) ১৯৯০ সালে ভারতের মুখ্য নির্বাচন আধিকারিকের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তার আগে ’৫৪ সালে আইএএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে সরকারি প্রশাসনে যুক্ত হন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা সচিব, প্রতিরক্ষা সচিব ও কেবিনেট সচিবের দায়িত্বও পালন করেন। নয়টি ভাষায় কথা বলতে পারেন। ভালবাসেন কর্তব্যনিষ্ঠ জীবন ও নীরব কর্মপ্রবাহের পরিবেশ শব্দ সন্ধান করতে। ব¬্যাক টি পানে আসক্ত শেষণ কর্ণাটকি সঙ্গীতের একজন মুগ্ধ শ্রোতা। নিজেকে রহস্য করে শেষণ বলেন, ‘অ্যালসেশন’। কেন বলেন তা খোলাসা করেননি। তার লেখা ‘ভারতের অধঃপতন’ বইটি পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি। ভূমিকায় তিনি বলেছেন, বইটি লিখতে গিয়ে তিনি বহু বিনিদ্র রজনী ভেবেছেন, তার দেশের চারিত্রিক অবনতির কথা ভেবে, যেন তাদের চরিত্রশক্তি আবার পুনরুজ্জীবন হয় এবং এর জন্য তিনি কি করতে পারেন।
তিনি লিখেছেন, আমার দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা অনেক কিছু নিয়ে বহু বিষয়ে পরিব্যপ্ত। তাই মনে হল, আমার ভাবনা-চিন্তা স্পষ্ট করে তুলতে সবচেয়ে ভালো হয়, যদি কাগজে-কলমে সেগুলো লিখে ফেলি। এই হল বইটির জšে§র ইতিহাস। তিনি বলেন, বই পড়া শেষে পাঠক জিজ্ঞেস করতে পারেন, আপনি কি মনে করেন ভারতের আর কোনো আশাই নেই, মোটেই তা নয়। কিš' ভারতকে যদি বাঁচাতে হয়, শুধু বাঁচতে নয়, তার প্রাপ্য মর্যাদা আবার অর্জন করতে হয় তাহলে আমাদের সবাইকে তার উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের জন্য কাজ করতে হবে। একটি কর্মসূচি, ভবিষ্যতের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা আমি প্রণয়ন করেছি। সেই বাস্তবসম্মত পথে ভারতের পুনর্জš§ ঘটতে পারে।
বইটিকে তিনি চারভাগে ভাগ করেছেন। সেই চারটি ভাগ মোটামুটি জাতির দেহ, মন, আÍা এবং রক্তের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে বলে লেখকের অভিমত। প্রথম ভাগে গণতন্ত্রের চারটি অঙ্গÑ প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, গণপ্রচার মাধ্যম এবং রাজনৈতিক সংগঠনের কথা বলেছেন। একইসঙ্গে গণতান্ত্রিক কাঠামোর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ অর্থাৎ আমলাতন্ত্রও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। দ্বিতীয় ভাগের বিষয় বলতে জাতির ‘মন’ বলে যেটাকে মনে করা যায়, তার বিষয়ব¯' হল অর্থনীতি, মানবসম্পদের ব্যবহার, পরিবেশ, পরিকল্পনা, সুরক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্প এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়ে তাদের ভ্রান্তনীতির কথা। তৃতীয়ভাগে জাতির আÍা, দৃষ্টিপাত করেছে তাদের বিচিত্র এবং সমৃদ্ধ ধর্মীয় উত্তরাধিকার এবং সাংস্কৃতিক সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে সেসব কথা।
একটি প্রশ্ন এসেছে, যাকে লেখক মারাÍক বলে মন্তব্য করেছেন। তা হলো, ভারতীয় বলতে কী বোঝায়? সর্বশেষ ভাগের আলোচনায় এসেছে জাতির প্রাণশক্তির যা আধার তার সেই রক্ত, অর্থাৎ নির্বাচন, নির্বাচন প্রক্রিয়া। তিনি বলেছেন, এ বই লিখতে গিয়ে আমাকে চিন্তা করতে হয়েছে আরো গভীরভাবে, আমাদের জাতির সামনে যেসব সমস্যা এখন এসে দাঁড়িয়েছে তার সম্বন্ধে জাতির অবনতি যিনি রোধ করতে চান, আবার তাকে মহান করতে চান, এমন প্রত্যেকটি পাঠকের চিন্তা-ভাবনায় আমি যদি কিছু সহায়তা করতে পারি তাহলেই এ বই সার্থক।
ইতিহাসের পাতা থেকে তিনি শাসক সম্রাট অশোক ও সম্রাট আকবরের নাম উলে¬খ করে বলেছেন, তারাও গায়ের জোরের চেয়ে ন্যায়-নীতিকে বেশি মর্যাদা দিতেন। রাজা কিংবা রাজ্যশাসকদের এই আদর্শ, যার নৈতিক চরিত্র হবে নিষ্কলুষ। এই সেদিন পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীন হয় তখন পর্যন্ত তা বজায় ছিল খানিকটা মহাÍা গান্ধীর প্রভাবে, খানিকটা নৈতিক সংস্কৃতির ঐতিহ্যের কারণে। তার কারণে সেসময়ে এমন কয়েকজন নেতা ছিলেন, যাদের সম্পর্কে বলা যায়, ‘অকপট, সোজা মানুষ’। যেমন সরদার বল¬ভ ভাই প্যাটেল, পণ্ডিত গোবিন্দ বল¬ব পন্থ এবং জন মাথাই। এ আদর্শ ৬০ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিল। লালবাহাদুর শাস্ত্রী এবং কে কামরাজের মতো লোকেরা দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন। ছেলেবেলায় শাস্ত্রী সাঁতরে নদী পেরিয়ে স্কুলে যেতেন, সে গল্প সবাই জানেন। তাহলে কি হবে, অত উচ্চ পদ ব্যবহার করেও সর্বসাধারণের অর্থের অপব্যবহার তিনি কখনো করেননি।
নেতাদের মধ্যে কারো কারো জš§ই হয়েছিল ঐশ্বর্যের ক্রোড়ে, যেমন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। আর্থিক প্রাচুর্যই বলুন, কিংবা তার ফলে যা কিছু লাভ করা যায় সে কথাই বলুন, সবই তারা অবহেলা করতে পারতেন। কিš' শাস্ত্রীর মতো যাদের জš§ দরিদ্র ঘরে, তাদের পক্ষে দৃঢ় নৈতিক চরিত্রের প্রয়োজন ছিল প্রবল। লেখক বলছেন, নৈতিক চরিত্র কথাটা আমি সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করছি না। নারীদের সম্পর্কে আপনার আচরণ কেমন, আমি চোখ ফেরালেই ফাউন্টেন পেনটি আপনি হাতিয়ে নেবেন কিনা সে কথা বলছি না। একজন নেতার ক্ষেত্রে নৈতিক চরিত্রের প্রশ্ন আরো বড় আকার ধারণ করে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, এই বিশেষ গুণটির কদর এখন অনেক কমে গেছে। দুর্নীতি, সরকারি অর্থের অপব্যবহার, এ তো হবেই। লোকে তাই ধরে নেয়। মন্ত্রী মশাই জনসাধারণের কোটি কোটি টাকা পকেটে পুরবেন এবং ধরা পড়লেও বলবেন ‘গদি ছাড়ব না’। ইঞ্জিনিয়ার এবং ঠিকাদাররা এমন বহুতল বাড়ি বানাবেন, যা কয়েক মাসের মধ্যেই ধসে পড়ে তাদেরই জ্যান্ত কবর দেবে।
লেখকের ভাষায়, ভারত সরকারের একজন সচিবের ব্যক্তিগত সহকারী এক মন্ত্রীকে ৬৮ হাজার টাকা দিয়েছিলেন একটি আবাসন যেন তাকে অ্যালট দেয়া হয়। ওই পরিমাণ অর্থের বিনিময়েই তার চাহিদা পূরণ করা হল। এক্ষেত্রে টাকা যিনি দিলেন তিনি সবচেয়ে নিচুতলার সরকারি কর্মচারীদের একজন। আর টাকাটি পেলেন রাষ্ট্রমন্ত্রী। এই দৃষ্টান্তটির সবচেয়ে মারাÍক দিকটি হল মন্ত্রী মহোদয় তার জীবনচর্চার অঙ্গীভূত করে নিয়েছেন এই ধরনের ব্যাপারকে। দেশের সর্বোচ্চ নেতাদেরও ক্ষমতা নেই তাকে পদচ্যুত করার। এ ধরনের ঘটনা এখন আর ব্যতিক্রম নয়। নিয়মেই দাঁড়িয়েছে। আর পরিণতি কি দেখছি, এই নৈতিক অধঃপতনের রাজনীতি, প্রশাসনে বিচার ব্যবস্থায়, সমাজে অবক্ষয়ের মূলে যার বাসা! পরিণতি সবই দেখতে পাচ্ছি, একমাত্র রিস্টওয়াচ ছাড়া। ‘টাইটান’-এর দেখা আর কোথাও পাওয়ার জো নেই।
পচন কতদূর পৌঁছেছে বুঝতে গিয়ে শেষণ বলেন, ভারতে লোভনীয় যেসব পেশা তার একটি হল সিভিল সার্ভিস। পঞ্চাশের দশকে একজন আমলা ছিলেন এমজি পিমপুটকর। অফিসে নিজের টেলিফোনের পাশে পয়সা ফেলার বাক্স রাখতেন। আর যখনই ব্যক্তিগত কোনো ফোন করতেন কুড়িটি পয়সা সেই বাক্সে ফেলতেন। আর আজকের একজন আইএস অফিসার যদি সরকারি গাড়িতে করে তার স্ত্রী-পুত্র-পরিজনকে সিনেমা দেখতে পাঠান তাহলে কেউ ভ্রƒক্ষেপও করে না। ভারত বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিকতা জাতীয় ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলের এক টেবিলে বসা, একটি অবাধ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাই যথেষ্ট। কার্যকর সংসদে সরকারের জবাবদিহিতা মিলিয়ে বলা হয় সেদেশে মানুষের দেশপ্রেম সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে।
এমনি অবস্থায় ডাকসাইটে ব্যুরোক্রেট আর চিফ নির্বাচন কমিশনার যখন বলেন, নিচুতলার কর্মচারীকে ফ্ল্যাট দিয়ে মন্ত্রী টাকা নেন, তাতেই তিনি বলেছেন পচন ধরেছে। তিনি নির্বাচনকে তামাশায় পরিণত করতে কংগ্রেসকে প্রধান আসামি করলেও দায়ী করেছেন সবাইকে এবং সব সরকারকে। ভোট কেন্দ্র দখল ভোটের বাক্স বোঝাই করার কথা বলেছেন। এমনকি পাটনায় রাজ্যসভার একটি নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী ভোট কেন্দ্র দখল করে সিল মারায় তা বাতিল করে যখন পুনঃনির্বাচন দিলেন তখন আর কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।
শেষণের কথার শুরু থেকেই যখন নেহরু লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে কামরাজদের কথা বলেন, তখন আমার দেশের রাজনীতির ইতিহাসের চাকা পিছনে ঠেলে আমি তৃপ্তি পাই।
৩. এখানেও সৎ দেশপ্রেমের রাজনীতির মডেল হয়েছিলেন হয় প্রাচুর্য থেকে এসে, না হয় মানুষের সাহায্যে রাজনীতি করে। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এমনকি আতাউর রহমান খান, বিত্তসুখে থাকা মুসলিম লীগের ফজলুল কাদের চৌধুরী, সবুর খান, বামপাড়ার কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিংহ, ন্যাপের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, মাহমুদ আলী এসব সাদা-কালো যুগের রাজনীতিবিদরা দেশের জন্য কতই না কল্যাণের রাজনীতি করেছেন। কি করুণ যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে কতটা সংগ্রামের পথ ধরে শেখ মুজিবের কঠোর পরিশ্রম, অধ্যাবসায় সামন্ত শ্রেণীর মুসলিম লীগের ওপর উঠিয়ে নিয়ে এসেছিলেন আওয়ামী লীগকে। রাজনীতিতে টুঙ্গীপাড়া থেকে উঠে খোকা নামের তরুণটি সোহরাওয়ার্দীর গণতন্ত্রের শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়েছিলেন। গভীর দেশপ্রেম, মানুষকে ভালবাসার মতো, সাগরের মতো হƒদয় নিয়ে রাজনীতি করেছিলেন বলে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে উঠেছিলেন।
ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত বিকাশ হয়েছিল মুজিবের হাত ধরে। সাধারণ মানুষের মন জয় করে রাজনৈতিক সচেতন মধ্যবিত্ত, বাঙালি উঠতি উচ্চবিত্তদের ছোট্ট অংশ নিয়েই তার উত্থান! সর্বোপরি তৃণমূল পর্যায়ে সভা করে করে সংগঠন দাঁড় করানোর অসাধারণ কাজটি তিনি করেছিলেন। এই আওয়ামী লীগের দায়িত্বের জন্য তিনি যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা থেকে সরে দাঁড়াতে দ্বিধা করেননি। রাজনীতিতে জনগণকে তারা এতটাই ভালবেসেছিলেন যে, মুজিবের পাইপ, মোনায়েমের চশমা, ভাসানীর টুপি যেন ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে গেল।
’৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে মুজিবকে দমাতে কয়েকশ টাকার দুর্নীতি মামলা দিলেন। আদালতে সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন, ‘মুজিব করাপ্ট হলে দুনিয়া করাপ্ট’। আজ ভাবি, ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক লড়লেও এমন জোর দিয়ে কথা বলতে পারছেন না।
’৫৪ সালে কৃতি ফুটবলার ও ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপু ছিলেন ভাষা মতিনের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্দোলনের অপরাধে তাকে বহিষ্কার করলে তার সৎ সরকারি কর্মকর্তা বাবা বলেছিলেন, বাড়ি ভাড়া করে পড়ানোর সামর্থ্য আমার নেই। রাজশাহী ফিরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হলেন তিনি। তার হাত ধরে রাজশাহী কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন কাজী জাফর আহমদ। তার অতীতও ছিল শ্রমিক রাজনীতি ঘিরে বর্ণাঢ্য।
শেখ মুজিবকে ঘিরে যখন ’৬৯-এর উš§াদনা, গণঅভ্যুত্থান হল তখন তার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু। ’৭০ সালের গণরায় নিয়ে তিনি জাতিকে এক সুতোয় বাঁধলেন, তখন মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, মুজিব অনেক উপরে চলে গেছে। তাকে স্পর্শ করার দিন শেষ। এখন তাকে সমর্থন দেয়ার সময়। ছাত্র রাজনীতিও তখন এতটাই সম্মানের উচ্চাসনে ছিল যে, মানুষ আজকালের রাজনীতিবিদ, মন্ত্রীদের চেয়ে সেদিনের ছাত্রনেতাদের বেশি সম্মান করত। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল, স্বাধীনতা তাই তিনি দিয়েছেন। তার নামে আসা বাংলাদেশকে যদি কেউ গণপ্রজাতন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন আমি মধুর ভুল বলে প্রশ্ন তুলব না।
ভারতের ডাকসাইটে আমলা শেষণ যখন ভারতের অধঃপতনের নমুনা বলেন, তখন আমি বিস্মিত হই। এত বড় গণতান্ত্রিক দেশে ছোট ভুল-ত্র“টি থাকতে পারে। পৃথিবীর সব দেশেই কম-বেশি দুর্বলতা আছে। ভারতে সিভিল প্রশাসনের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের অহমের দ্বন্দ্ব থাকলেও এখানে অবস্থা করুণ। ভারতে চিফ নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা রাখেন। আর আমাদের দেশে একজন একনায়ক, গণতন্ত্র হরণকারী এরশাদকে সরিয়ে যে স্বর্ণযুগের স্বপ্ন দেখেছিলাম তা আর পেলাম কই? মাগুরার উপনির্বাচন থেকে যে শিক্ষা জাতি পেয়েছিল তাতে নির্বাচন কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথ আর সিইসি বিচারপতি আবদুর রউফ মাগুরা ছেড়ে লজ্জা ঢাকতে চেয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হল নির্বাচন নিরপেক্ষ করতে। নির্বাচন নিরপেক্ষ হলেও পরাজিত দল কারচুপির অভিযোগ করেছে বারবার।
শেষণ তার দেশের সিভিল অফিসারদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, যদিও তার বেতন আহামরি কিছু নয়, বিলাসবহুল বাড়িতে থাকেন, যে বাড়ির আসবাবপত্র এবং অন্যসব সাজ-সরঞ্জামের দাম কয়েক কোটি টাকা এবং তার ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে লন্ডনে, ঠিকাদারদের খরচে। শেষণের লেখা পড়লে আমার সাবেক সেনাপ্রধান হাসান মশহুদ চৌধূরীর কথা মনে হয়। তিনি তার স্ত্রীকে বান্ধবীর বাড়ি যেতে অফিসের গাড়ি দেননি বলে শুনেছি। ড. আকবর আলি খানের কাছে বলতে ইচ্ছা করে, আপনার কথা মানুষ শুনছে। আপনি বলুন সঙ্গে লিখুন কালের ইতিহাস।
আমি যখন এরশাদ শাসনামলের সঙ্গে পরের দুই দলের তিন সরকারের তুলনা করি তখন অনেকেই মনে করেন, এরশাদের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা আছে কিনা। আমার তা নেই। এরশাদ ও তার জাপাকে তুনোধুলো করা অসংখ্য রিপোর্ট করেছি অনেকবার। যাক, আমরা বলেছি এরশাদ সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করে এক নায়কতন্ত্র চালিয়েছিলেন। তাকে সরিয়ে কি আমরা সংবিধান অর্পিত অধিকার ফিরে পেয়েছিলাম? সংসদ কি কার্যকর হয়েছিল।
৫ম সংসদে মাঝে মাঝে সংসদ নেত্রী খালেদা জিয়া হাজির হলেও কথা বলতেন না। সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত তো একদিন বলেই ফেললেন, ‘একটা কথা কও গোলাপি, একটা কথা কও’। দেশের তুখোর পার্লামেন্টারিয়ানরা নেই। কেউ মারা গেছেন, সুরঞ্জিত সেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও তোফায়েল আহমেদের উচ্চতায় ক’জন পার্লামেন্টারিয়ান এখন দেশে আছেন? উত্তর হাতে গুনে পাওয়া যায়নি। যাক, জিয়া দলছুটদের নিয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী প¬্যাটফরম করেছিলেন। মুসলিম লীগের শূন্যস্থান পূরণ করেছিলেন। নব্বই দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদল থেকে বেরিয়ে আসা শতাধিক নেতাকর্মী পরে এমপি হয়েছিলেন। এরশাদ পতনের পর কেউই সংবিধানের প্রতি অবনত মস্তকে শ্রদ্ধা জানাননি। দেশকে দুর্নীতি, সন্ত্রাসের নরকে ক্রমশ পরিণত করেন। র‌্যাবের জš§ না হলে সাধারণ মানুষ থেকে ব্যবসায়ী কেউ নিরাপদ বোধ করতেন না।
আমি বারবার বলেছি, এরশাদের সময়ে যে দুর্নীতি হয়েছে, রওশন এরশাদের শাড়ির ভাঁজে যে টাকা পাওয়া গেছেÑ এখন তা হাস্যকর ব্যাপার। অস্ট্রেলিয়া থেকে মিল্টন বলেন, এরশাদ জমানায় মেডিকেল মর্গে লাশ আর লাশ আসত। আর আমি বলেছি, আমরা তো বিজয়ী হয়েছিলাম সেই লাশের মিছিলে। শিল্পী কামরুল হাসান বিশ্ব বেহায়ার ছবি এঁকে সাড়া জাগিয়েছিলেন। মোজাম্মেল বাবুরা তা রাতারাতি ছেপে প্রকাশও করেছিলেন। কিš' পরে আমরা কী দেখলাম, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস, দুর্নীতির আমল শেষে খালেদার শেষ আমলে হাওয়া ভবনের দুর্নীতিতে মন্ত্রী-এমপিদের সুযোগ সৃষ্টি হয়। দেশে নামে অন্ধকার যুগ। তাদের আমলে তাদের মুখে বলা রাজনৈতিক কর্মী হত্যা হয়েছে কয়েক হাজার। দুর্নীতির মহোৎসব চলে। পিএসসি প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পর্যন্ত দলীয়করণ করে ক্ষমতায় ফিরে আসার পথ তৈরি হয়। খালেদার সহকর্মী মোসাদ্দেক আলী ফালু রাতারাতি মিডিয়ামোঘল হয়ে যান। কেউ প্রশ্ন তোলেন না এই অর্থের উৎস কোথায়? এত প্রেম! কোথায় আজ হাওয়া ভবনের প্রশ্রয়-আশ্রয়ে থাকা আশিক মার্কা অনাথরা?
তারেক রহমানকে ঘিরে তরুণ এমপিরা নতুন স্বপ্ন দেখেছিলেন। গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের নাম ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়Ñ ‘যেখানে ব্যবসা-কমিশন সেখানেই তারেক-মামুন’; তবু খালেদার ঘুম ভাঙে না। পটুয়া কামরুল বেঁচে থাকলে লাজ লজ্জাহীন কোন বেহায়ার চিত্র আঁকতেন? ১১ মাস জেল খেটেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা, তখন কোথায় ছিল তার কিচেন কেবিনেট? রাজপথে থাকতে একটি বে¬জার পেয়ে যারা আনন্দে লাফাত ক্ষমতা তাদের বেহুঁশ করেনি?
ড. কামাল হোসেন রুগ্ন রাজনীতি বলে চিৎকার করেছেন এক যুগ। তার আর জাসদের নাজমুল হক প্রধানের কণ্ঠে প্রথম উঠে আসে হাওয়া ভবনের দুর্নীতির পরিচয়। এরশাদ গণতন্ত্র দেননি, উন্নয়ন দিয়েছেন। দুই নেত্রী কোনোটাই দেননি। এরশাদ থাকলে ঢাকা আন্তর্জাতিক মানের রাজধানী শহর হতো। কত রাস্তা, ফ্লাইওভার হতো এ কথা আমি বহুবার বলেছি। গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য আরো বাড়ত। একনায়ক কাকে বলে? যার হাতে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে? তাহলে দুই নেত্রীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে তারা কি একনায়ক হননি? নাকি তারা ছিলেন লৌহমানবী?
সিডনি থেকে আকিদুল ইসলাম যখন পরিশীলিত মার্জিত ভাষায় আমার লেখার সমালোচনা করেন তখন আমি মুগ্ধ হই। এরশাদের বাসায় ব্রেকফাস্ট টেবিলে যাওয়া নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। আকিদুল ইসলাম ভুলে যাচ্ছেন আমার লেখক সত্তার পাশাপাশি রিপোর্টার সত্তাও রয়েছে। একজন রাজনৈতিক রিপোর্টারের রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই থাকুক না কেন তার সোর্স থাকতে হবে সব দলে। আমি গোলাম আজমের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে গিয়ে তার আপ্যায়নের অংশ সৌদি খেজুরও খেয়েছি। গোলাম আজমও আমার সঙ্গে ভদ্র-বিনয়ী আচরণ করেছিলেন। আর এরশাদের ব্রেকফাস্টের টেবিল থেকে উঠে আমি তার পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি চুক্তির সই করা কাবিন-নামাটিও সংগ্রহ করেছিলাম যা যুগান্তরে ছাপা হয়েছিল ‘যেভাবে এরশাদ মহাজোটে গিয়েছিলেন’।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ফজরের নামাজ শেষে সুধা সদনে হাসিনার সঙ্গে এরশাদের এক বৈঠক হয়েছিল। এরশাদ চেয়েছিলেন সমঝোতা, কিš' হাসিনার ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারে আÍবিশ্বাস এতটাই ছিল যে তিনি এরশাদকে আমলই দেননি। বৈঠক ভাঙার আগে এরশাদ হাসিনাকে অনুরোধ করেছিলেন, আপনি অন্তত পীরগঞ্জ আসনের নির্বাচন করবেন না। এতে নূর মোহাম্মদ মন্ডলের কাছে আপনার হেরে যেতে হবে। হাসিনা বলেছিলেন, দেখি জনগণ তো আমাকে চায়। কিš' নির্বাচনে হাসিনা পরাজিত হয়ে প্রেস কনফারেন্সে রসিকতা করে বলেছিলেন, এতদিন ভাত পাইনি এখন ভোটও পাইনি।
এরশাদের সঙ্গে সেই ভোরবেলার বৈঠকটি একমাত্র আমিই যুগান্তরে প্রকাশ করেছিলাম। আর এ সত্য প্রকাশের পর আমার ওপর আস্থা বেড়েছিল আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর। একজন রিপোর্টারকে অনেক ঘটনার সাক্ষীও হতে হয় তার সোর্সদের দেয়া সুযোগের কারণে। ব্যক্তি সম্পর্ক কোথায় কি আছে সেটা বড় কথা নয়। একজন সংবাদকর্মী সম্পর্কের ঊর্ধ্বে উঠে রিপোর্ট লিখতে পারলেন কিনা, একজন লেখক সমালোচনা হবে কিনা জেনেও সত্য লিখতে পারলেন কিনা, সেটাই বড় কথা বলে আমি মনে করি। তারপরেও এরশাদের প্রতি আমার কোনো ব্যক্তি মোহ নেই। দুই নেত্রীর ব্যার্থতায় সাধারণ মানুষ এরশাদের উন্নয়নের কথা স্মরণ করে। স্বাধীনতার ৩৭ বছর পরও প্রবীণেরা আইয়ুবের উন্নয়নের গান গাইতে দেখি। সংস্কার হয়নি বলে ব্রিটিশের আইনের প্রশংসা শুনি। রাজনীতির উর্বর ভূমি থেকে মানুষের হৃদয় হরণকারী একজন নেতার আবির্ভাব হয়নি বলে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকে ৭ মার্চের শেখ মুজিবের ভাষণ। আকিদুল ইসলামসহ সব সমালোচনার প্রশংসা আমি সানন্দে গ্রহণ করি। আমার কোনো দলের প্রতি আনুগত্য নেই। অসাম্প্রদায়িক দুর্নীতিমুক্ত সুন্দর বাংলাদেশ আমার স্বপ্ন।
জনগণের প্রত্যাশায় রক্তপাত বন্ধে ওয়ান ইলেভেন রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে চেষ্টা করেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দিয়েছে। পিএসসি, দুর্নীতি দমন কমিশন দলীয়মুক্ত করেছে। এখনও প্রশাসন দলীয়করণমুক্ত হয়নি। এখনও টিআইবির রিপোর্টে দুর্নীতির চিত্র আসে। ভারতের অ্যালসেশনের মতো ক্ষমতা দাও আমাদের ড. এটিএম শামসুল হুদাকে। অ্যালসেশনের প্রতি বলি, তোমরা অনেক ভালো আছ। অধঃপতনের দেখছ কী? গুলশানে এক তরুণ এয়ারলাইন্স এজেন্ট ব্যবসায়ীর কাছে ছিল বিএমডবি¬উ জীপ, কার, জাগুয়ার, মার্সিডিজ গাড়ি। ঢাকা শহরে দুর্নীতির রাজনীতি কাঁচা টাকায় নামিয়েছিল অসংখ্য হ্যামার, বিএমডবি¬উ। লেক্সাস তো ডাল-ভাত হয়েছিল। প্র্যাডো তো তুচ্ছ ব্যাপার। নেশন, উদ্বিগ্ন তার আমলাদের বাড়ির আসবাবপত্র দেখে। আমরা লজ্জিত নই সোনালী ব্যাংকের কর্মচারী বাকের, টিএন্ডটির ফিরোজের সম্পদ বানানোর ইতিবৃত্ত দেখে।
সাফল্যের স্বর্ণশিখর থেকে অবসর নেন মাহাথির মোহাম্মদ। আমাদের দুই নেত্রী শাসনের ব্যর্থতা কাঁধে নিয়েও অবসরের কথা ভাবেন না। খালেদা জিয়া যখন জনগণের কাছে করজোড়ে ক্ষমা না চেয়ে বলেন, তার দুই ছেলে কোনো অন্যায় করেনি, তখন যারা শুনেও মুখে কুলুপ আঁটেন বুঝতে হবে তারা দলকানা, না হয় বিবেকের মৃত্যু হয়েছে। আর খালেদা হারিছের সব লাজ-লজ্জা। সরকার যখন দুই নেত্রীকে বাইরে পাঠাতে যায়, রাজকীয় সম্মানে তখন উঠতেই পারে অনেক প্রশ্ন। যদি বলি তাহলে যারা কারাগারে, যারা বিদেশে স্বেচ্ছানির্বাসনে, তাদের কী হবে?
৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশ আজ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের খবর নাই দিলাম, তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা বানিয়েছে বহুতল বাড়ি, টাকার পাহাড়। এখানে মূল্যবোধ নেই। এখানে লাজ-লজ্জা নেই। আন্দোলন-নির্বাচনের ধ্বনি ওঠে। সংস্কার শেষ না করে কিসের নির্বাচন?
আমার মাহাথির মোহাম্মদের স্বপ্ন শুনে অনেক পাঠক অনেক কথা বলেছেন। আমি বলি, ১৫ কোটি মানুষের দেশে যদি একজন মাহাথির পাওয়া না যায় তাহলে রুগ্ন, অসুস্থ, অসৎ লুটপাটের রাজনীতির ক্যান্সার থেকে দেশকে কীভাবে ঠিক করবেন? ২৭ ও ২৪ বছর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার পর দুই নেত্রীর কাছ থেকে তাদের রক্তের উত্তরাধিকার গ্রহণের মন যাদের আছে, তারা থাক খোন্দকার দেলোয়ার কিংবা মতিয়া চৌধুরীর পাশে। আর যাদের বিবেক আছে তারা যদি মনে কর এই দুটি বড় দলকে নবায়ন করার সাধ্য কারো নেই, তারা বেরিয়ে এস। নতুন জীবনের গান গাও। মানুষের কাছে যাও। নেপালে রাজতন্ত্রের মৃত্যু ঘটেছে। এখানে রাজতন্ত্রের আবহ তৈরি করে যারা কর্মচারীদের নিয়ে গণতন্ত্র ও সংবিধানের সর্বনাশ ডেকেছেন, রাজনীতি কলুষিত করেছেন, দুর্নীতির মহোৎসব করেছেন তাদের আর ফিরতে দিও না। আগেই বলেছি, মানুষ বাঘের পিঠে উঠেছে, বাঘ কাবু কর। বাঘের কাছে কাবু যেন না হও।
আমি শীতলক্ষ্যা নদীতীরে বেড়ে উঠিনি, পদ্মাও টানে না, যমুনায় দেখা হয়নি রাধার সঙ্গে। দেখা হলে না হয় কৃষ্ণের বাঁশি বাজাতাম। সেদিন আমার লেখা পড়ে আওয়ামী লীগের সৎ, সাহসী এক নেত্রী ফোন করে এমন আন্তরিক কণ্ঠে বললেন, তোমার লেখায় অভিভূত, সাহস হারিয়ো না। মানুষ তোমার পাশে আছে। তবে সতর্ক থাকবে। আমি তোমার জন্য দোয়া করব। সৎ সাহসী মানেই মতিয়া নয়, এই দলে সৎ মানুষের সংখ্যা অনেক। যাক, তার কথা শুনে আমার মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ল। মা’র মৃত্যুর সময় পাশে ছিলাম না। ‘কতদিন দেখি না মায়ের মুখ’ গানটি যখন বন্ধু সেলিম চৌধুরী দরদে গায় তখন মনে হয় আর কখনো দেখা হবে না। ওই আওয়ামী লীগ নেত্রীর কথায় মনে হলো, আমার মা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় যেমন দোয়া করে ফুঁ দিতেন, তেমনি যেন আরেক মাতৃহƒদয় আমার জন্য দোয়া করছেন।
৪. জ্যোৎøার শহরে সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরে যদি এবার আষাঢ়ে পূর্ণিমায় রাষ্ট্রযন্ত্রের কেউ যেতে চান তাহলে বলব, জ্যোৎøার নিচে কৃষকের চোখের জলের চিকচিক বেদনাও দেখতে ভুলবেন না। অকাল বন্যায় হাওরের বাঁধ যখন ভাঙে, তখন মাটি বুক দিয়ে আঁকড়ে রক্ষা করতে যায় হাওরবাসী। হাওরকন্যা দিলারা পা’কে বিয়ে করে চাঁদের শহরের জামাই হয়েছিলেন মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ। পানিসম্পদ মন্ত্রী থাকাকালে তিনি হাওর ভাঙনের হাত থেকে ফসল রক্ষায় প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছিলেন। ৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি ধান উৎপাদন হয় এই হাওর অঞ্চলে। পার্লামেন্টে সুরঞ্জিত বলেছিলেন, ৫শ কোটি দাও, আমি বছরে ১ হাজার কোটি টাকা সরকারকে দেব। সাইফুর রহমান তখন তার নামকরণের ফলক লাগানো নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। আমরা অসহায় হাওরবাসীর কণ্ঠে মরমী গানের সুর শুনে আপ¬ুত হই। কণ্ঠের মাধুর্য স্পর্শ করলেও তাদের উদরের শূন্যতা আমাদের স্পর্শ করে না।
এখানকার মরমী গানের শিল্পীরাও বুনো ফুল ফোটার মতো সুবাস ছড়িয়ে ঝরে যায়। মিডিয়া তার খোঁজ নেয় না। বিলুপ্ত প্রাণীর জন্য খরচ হয় কোটি কোটি ডলার। গ্রামে হাত বাড়ায় বিশ্বব্যাংক। কিš' এদের জন্য যেন কারো তাড়া নেই। তাহিরপুরের লাওরাজ্যের প্রতœতত্ত্বের খোঁজ নিতে কেউ যায় না। মহাকবি সঞ্জয় মহাভারতের প্রথম বাংলা রচয়িতা এই ভাটির মানুষ। ‘যদিও জানি মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশিরাম দাস ভনে শুনে পুণ্যবান’। সঞ্জয়কে নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয়েছে কিš' বাংলা একাডেমীসহ কেউ তার খবর রাখে না।
সৈয়দ শাহনুর শাহকে ফকিরের ফকির বলা হয়। ড. মৃদুল কান্তি চক্রবর্তীর ভাষায়, মরমী কবি হাসন রাজা বলেছিলেন, ‘আমি এ যুগের শাহনুর হয়ে এসেছি।’ কবি মোহাম্মদ সাদিক আমার মাটির মমতা মাখানো এক প্রিয় কবি। তার স্ত্রী জেসমিন একজন বিচারক। এই সৎ যুগল দম্পতির জীবন বড়ই সুখের। যদিও সাদিকের রমণীমোহন চেহারা আর কবিতা কিশোরী বালিকাকেও জাদুর মতো টানে। কবি সাদিককে বলব, নাগরি নিয়ে বিশাল গবেষণা শেষ হল। গ্রামের বাড়িতে তৈরি করেছেন ‘ফকির মেলার নিসর্গ’। এবার সাহিত্যে টেনে আনো সৈয়দ শাহনুরকে। যেভাবে রবীন্দ্রনাথ, নির্মলেন্দু চৌধুরী ও সেলিম চৌধুরী ছড়িয়েছে হাসন রাজার নাম। সেলিম রাধারমনকেও উঠিয়ে নিয়ে এসেছে।
তাই বলি কবি সাদিক, মানুষ শুনুক শাহনুরের গানÑ ‘হরিণ ও জঙ্গলার মাঝে বানাইলাম ঘর/ ভাইও নাই বান্ধবও নাই কে লইব খবর?’ বিশ্বায়ন প্রগতি ও অর্থনীতির কথা বলে, মানুষের হƒদয়ের ক্রন্দনের কথা বলে না। হƒদয়বান মানুষের তপ্ত দীর্ঘশ্বাসে হাওরের বাতাস ভারি হয়ে যায়। শুনেছি সাদিকের সামনের কাব্যগ্রন্থ হবে ‘কে লইব খবর’।
লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক যুগান্তর।
ই-মেইল: peerhabib.rahman@gmail.com

২৯.৬.০৮

তিন মাসেও সৌদি থেকে গাফফাররে লাশিট এল না

হিন্দু প্রশাসনের হাতে বুদ্ধগয়া মহাবোধি তীর্থভূমি :: সোনা কান্তি বড়ুয়া

হিন্দু প্রশাসনের হাতে বুদ্ধগয়া মহাবোধি তীর্থভূমি
সোনা কান্তি বড়ুয়া

সম্প্রতি ভারতের “দৈনিক পাটনা” পত্রিকার সংবাদ ছিল মানুষের সকল মৌলিক অধিকার পরিপন্থী, মানবতা বিরোধী এক কালো আইনের নাম “বুদ্ধগয়া মহাবোধি ম্যানেজম্যান্ট কমিটির সদস্যগণের নীতিমালা” (ভারত, দৈনিক পাটনা, ২৪ মে, ২০০৮)। ভারতে পলিটিক্যাল হিন্দুধর্ম নাম যশের জন্যে বৌদ্ধধর্মের গলা টিপে দিয়ে বৌদ্ধদের অবলোকিতশ্বর বোধিসত্বকে হিন্দুদের শিব বানিয়ে বৌদ্ধ ঐতিহ্য সমূহ সহ বুদ্ধগয়া মহাবোধি মন্দির তীর্থভূমি দখল করে নিয়েছে। বৌদ্ধদের তারা দেবীকে হিন্দু মহিষাসুর মর্দিনী দূর্গা বানিয়েছে। বৌদ্ধধর্মের শ্মশানের উপর হিন্দুস্থানে অশোকচক্র খচিত জাতীয় পতাকা বিরাজমান। সত্য কথা বলার উপায় নেই। ‘বৌদ্ধধর্ম তো হিন্দুধর্মের শাখা নয়’ বলতে না বলতে মৌলবাদী হিন্দুরা তেড়ে আসে। বৌদ্ধধর্মের শত্র“ রাজা পুষ্যমিত্র (খৃ: পূ: ১৫০) থেকে রাজা শশাংক ( ৬৫০ খৃষ্ঠাব্দ) বুদ্ধগয়া মহাবোধি মন্দিরকে দখল করে হিন্দু মন্দিরে রুপান্তরিত করার হীন ষড়যন্ত্র করে। বৌদ্ধধর্মের অন্যতম শত্র“ ও যুদ্ধাপরাধী শংকরাচার্য (৮ম শতাব্দী) দিনের পর দিন অমানবিক বৌদ্ধহত্যা যজ্ঞ (১০ বছরের জেনোসাইড) চালিয়ে বৌদ্ধধর্মকে ধ্বংস করে। মনুষ্যত্ব বিরোধী বর্বর এই হত্যাযজ্ঞ ও জেনোসাইডমূলক আইনের মারপাঁচে ভারতের বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের মধ্যে চিরস্থায়ী ক্ষতের জন্ম দিয়েছে। তার ভয়ঙ্কর ফল বিশ্ববৌদ্ধদের শ্রেষ্ঠতম তীর্থস্থান “বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দির” (যেই পবিত্র বোধিবৃক্ষের তলে বসে রাজকুমার সিদ্ধার্থ কঠোর সাধনার মাধ্যমে সম্যক সম্বুদ্ধ বা বুদ্ধত্ব লাভ করেন) হিন্দু রাজনীতি দখলে রাখবে।
অহিংসার জন্মস্থানে এটা হিন্দু বনাম বৌদ্ধদের সমস্যা নয়। ভারতে একমাত্র বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দিরে হিন্দু নেতাগণের ষড়যন্ত্রে ম্যানেজম্যান্ট কমিটির এ আইন মনুষ্য সৃষ্ঠ অথচ মনুষ্যত্ব বিরোধী। ভারতের বিহার সরকার ক্ষতিগ্রস্থ নির্যাতীত বৌদ্ধদেরকে তাঁদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া রাষ্ঠ্রের দায়িত্ব এই সহজ কথাটি পর্যন্ত ভুলে গেছে। পলিটিক্যাল হিন্দুধর্ম ভারতীয় বৌদ্ধগণের মানবাধিকার হরণ করেছে। জাতিভেদ প্রথা ভিত্তিক হিন্দুধর্মে বৌদ্ধদের বিন্দুমাত্র ও অস্তিত্ব নেই। বাংলাদেশের বৌদ্ধগণ ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্মের পথের কাঁটা। রাজা বল্লালসেনের মহামন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্র আরবের শেখকে তোয়াজ করে “শেখ শুভোদয়া” রচনা করে। তারপর বখতিয়ার খিলজি বাংলাদেশ আক্রমন করে তার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে বাংলার বৌদ্ধগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। ভারতবর্ষে স্বাধীন বৌদ্ধ জাতির অস্তিত্ব ধ্বংস করে পলিটিক্যাল হিন্দুধর্মের জয়গান, “সারা জাঁহা সে আচ্ছা হে হিন্দুস্থান তোমারা।”
রাজনৈতিকভাবে ভারতে আজকের বৌদ্ধগণ কি পলিটিক্যাল হিন্দুধর্মের গোলাম? বেহায়া হিন্দুরা বুদ্ধগয়ায় মহাবোধি মন্দির দখল করতে দিনের পর দিন মহাবোধি মন্দিরের ভেতরে শিবলিঙ্গ সহ হিন্দুদের দেবদেবী স্থাপন করেছে। বৈদিক হিন্দু রাজা ইন্দ্র মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার প্রাগৈতিহাসিক বৌদ্ধধর্ম (গৌতমবুদ্ধের পূর্বে আর ও ২৭ জন বৌদ্ধ ছিলেন) ধ্বংস করে বৈদিক সভ্যতা স্থাপন করেন। পলিটিক্যাল হিন্দুধর্মে বৌদ্ধসভ্যতা বিরোধি এক কালো আইন বা প্রথার নাম ‘অবতার বাদ।’ রামায়ণের অযোধ্যা অধ্যায়ে ৩২ নম্বর শ্লোকে বুদ্ধকে গালাগাল দেবার পর রাজনৈতিক হিন্দুধর্ম আজ আবার বুদ্ধকে হিন্দুদের নবম অবতার বানিয়ে ভারতীয় বৌদ্ধগণের অস্তিত্ব সমূলে ধ্বংস করেছে। আজ ও ভগবান মহাবীর ও গুরু নানক হিন্দুদের অবতার হয় নি। তবে ষড়যন্ত্র হরদম চলেছে। পলিটিক্যাল হিন্দুধর্ম অবতার বানিয়ে বিশ্বের সকল ধর্মকে গিলে ফেলবে কি? তবে বলিউডে সাধক কবিরকে রাম বা কৃষ্ণের অবতার বানিয়ে ধর্মের বাজার দখল করে ফেলেছে।
অধ্যাপক মনীন্দ্রমোহন বসু যর্থাথই লিখেছেন, ‘অবশেষে এই তান্ত্রিক বৌদ্ধমত তিব্বত, নেপাল প্রভৃতি দেশে যাইয়া আশ্রয় লাভ করিয়াছে। বৌদ্ধ ধর্মের এই পরাজয় এত সম্পূর্ণ হইয়াছিল যে, ধর্মের সঙ্গে ধর্মগ্রন্থ সমূহ ও ভারতবর্ষ হইতে বিতাড়িত হইয়াছে। থেরবাদ সম্প্রদায়ের গ্রন্থগুলি সিংহল ও ব্রহ্মদেশ হইতে আবিস্কৃত হইয়াছে, আর মহাযান মতের শাস্ত্র সমূহ পাওয়া গিয়াছে প্রধানতঃ চীন জাপান প্রভৃতি দেশে। চর্যাপদের পুঁথি নেপালে আবিস্কার হইয়াছিল। আর ইহার অনুবাদের সন্ধান পাওয়া গিয়োছে তিব্বতি ভাষায়। এখন ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের সমাধির স্মৃতি চিহ্ন মাত্রই দৃষ্ট হইয়া থাকে।” সুসভ্য চীন জাপান সহ পৃথিবীর অনেক দেশের কোটি কোটি জনতা বুদ্ধের ধর্ম গ্রহন করে বৌদ্ধ হলেন।
গৌতমবুদ্ধের মহাপরিনির্বানের (মৃত্যুর) প্রায় দেড় হাজার বছর পর কতিপয় মৌলবাদী ব্রাহ্মণ পন্ডিতের দল বুদ্ধকে রাতারাতি হিন্দুর নবম অবতার করে সর্বগ্রাসী হিন্দু ধর্মের ফায়দা লুটে নিতে বাংলাদেশের ইতিহাস বদলে দিয়ে সেন রাজত্ব স্থাপনের পর বৌদ্ধ নিধন যজ্ঞ শুরু হ’ল ।
ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান দন্ডিত রাজাকারদের ক্ষমা করার পরের ঘটনা সমূহ আমরা সবাই জানি। ইতিহাসের আলোকে ঠিক তেমনি বিজয় সেন সুদূর কর্ণাটক থেকে এসে বাংলা দখল করে নিল এবং বহিরাগত সেন রাজারা যে চারশ বছরের পাল সাম্রাজ্যের সমদর্শী সংস্কৃতি ও প্রচলিত বৌদ্ধধর্মের বিলোপ ঘটিয়েছে। বাঙালীর মুখ থেকে বাংলা ভাষা কেড়ে নিয়ে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি তন্ত্র চাপিয়ে দিল। বলতে গেলে সমাজ জীবনের ও ব্যক্তি জীবনের সর্বত্র তখন ব্রাহ্মণ আধিপত্য। নিপীড়িত মানবাত্মার জয়গানে মুখরিত এই চর্যাগুলো। বাঙালী সমাজের এই করুণ ছবি দেখতে পাই ৩৩ নং চর্যায়। ”টালত মোর ঘর নাঁহি পড়বেসী। হাড়ীতে ভাত নাঁহি নিতি আবেশী। এর মানে, নিজ টিলার উপর আমার ঘর। প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে ভাত নাই, অথচ নিত্য ক্ষুধিত।” সেন রাজত্ব মানে কর্ণাটকের ব্রাহ্মণ্যদের অধীনে বাংলা, নিজ বাসভূমেই পরবাসী করে দিয়েছে বাঙালীকে। ইতিহাসের এই অন্ধকার যুগে তবু বাঙালী দুহাতে অনন্ত সমস্যার পাথর সরিয়ে জীবনের যাত্রা পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছিল অন্যতর আলোর লক্ষ্যে।
ব্রাহ্মণ্যবাদের মাফিয়াচক্রে জাতিভেদ প্রথায় সনাতন ধর্মের মস্তক বিক্রয় করে গণতান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মকে বৈদিক ব্রাহ্মণগণ ধ্বংস করে। অধ্যাপক হরলাল রায় তাঁর লেখা ‘চর্যাগীতি’ গ্রন্থের দশম পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘ধর্মকোলাহলেই বাংলা সাহিত্যের পুষ্টি ও বিকাশ। ভারতেই আমরা দেখতে পাই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতায় পালি সাহিত্যের উৎপত্তি। হিন্দুধর্মের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলেই বৌদ্ধ ধর্ম ভারত হতে বিতারিত হয়েছিল। আশ্চর্য্যরে বিষয়, বৌদ্ধ ধর্ম তাঁর জন্মভূমি হতে প্রায় বিলুপ্ত হয়েছিল। মুসলমান আক্রমণের বহু পূর্বেই আমরা সারা ভারতে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পূনরুত্থান দেখতে পাই। সংস্কৃত ভাষা ও চর্চা চলেছে তখন পুরোদমে। তাঁরাই বিধান দিলেনঃ অষ্টাদশ পূরণানি রামস্যচরিতানি চ। ভাষায়াং মানবঃ শ্রত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ। এভাবে যাঁরা সংস্কৃতকে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন, তাদের পক্ষে যে অন্য ভাষা সহ্য করা অসম্ভব ছিল তা মনে করা যুক্তিযুক্ত। সর্বগ্রাসী হিন্দুধর্ম শক্তিশালী অনার্য সভ্যতাকে আয়ত্ত করে নিজের কুক্ষিগত করেছিলেন। বিশেষতঃ কুমারিল ভট্ট, শংকরাচার্য প্রমুখের নেতৃত্বে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পূনরুত্থান আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল। এ সময়ে বৌদ্ধ সমাজের বুদ্ধিজীবিগণ নিস্তেজ হয়ে পড়েন এবং রিক্ত সর্বশান্ত হয়ে তাঁরা ধীরে ধীরে ভারতবর্ষ হতে তিব্বত ও আসামের দিকে সরে পড়েছেন।
ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক শেখড়ের সন্ধানে ইহা ও এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, আমরা ‘বৌদ্ধ চর্যাপদের’ সন্ধান পেলাম আজ থেকে শতবর্ষ আগে। ১৯০৭ খৃষ্টাব্দে নেপালের রাজদরবারের পুঁথিশালায় প্রাচীন পান্ডুলিপির সন্ধান (১৯০৭ - ২০০৭) করতে গিয়ে মহামহোপধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহোদয় উক্ত বৌদ্ধ চর্যাপদের মরমী সংগীতগুলো আবিস্কার করেন এবং ভাষা আন্দোলনের আলোকে চর্যাপদ সন্ধানের ( ১৯০৭- ২০০৭) শতবার্ষিকী । বৌদ্ধ পাল রাজত্বের পতনের যুগে এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পূনরুত্থান কালে অস্থির ঘটনা চাঞ্চল্যের দ্বারা চঞ্চল সেন বর্মন রাষ্ট্রের প্রবল আধিপত্যের প্রেক্ষাপটে চর্যাপদের জন্ম আধুনিক গণতান্ত্রিক অধিকারের মেনিফিষ্টো হিসেবে। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে বাঙালীর সর্বপ্রথম গনতন্ত্রের বীজ ‘বাক স্বাধীনতার অধিকার’। বাংলা ভাষার প্রথম ‘বিপ্লবী মিনার’। বৌদ্ধ কবি ও সাধকগন বিপুল প্রজ্ঞা ও ক্ষুরধার বৌদ্ধদর্শন প্রয়োগ করে মনুষ্যত্বের উন্মেষ বিকাশে চর্যাপদের (৮ম - ১২শ শতাব্দী) এক একটি কবিতা রচনা করতেন। মানুষের দেশ মানুষের মনেরই সৃষ্টি।
একাদশ এবং দ্বাদশ শতাব্দী থেকে শুরু হলো সাধক চর্যাকারগনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। যার দূর্ণিবার জীবন্ত স্রোত হাজার বছরের সংকোচের জগদ্দল পাথর ভেঙ্গে এলো আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারীর উনিশশো বায়ান্ন সাল থেকে আজকের বাঙালী ঐতিহ্যমন্ডিত আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙালী জাতি আবার নতুন সহস্রাব্দের আলোকে আবিস্কার করবে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন বৌদ্ধ চর্যাপদের প্রতিটি শব্দ ও তার গভীর মর্মার্থকে। কারণ দেশ ও ভাষা বাঙালীর কাছে নিরেট বাস্তব, অতিশয় অপরিহার্য। বৌদ্ধ চর্যাপদ পাঠ এবং গবেষণার সময় মনে হবে বাংলা কেবল একটি দেশ নয়, সে একটি সভ্যতা, একটি সংস্কৃতি, একটি অপাপবিদ্ধ জীবনাদর্শ বা জীবন দর্শণের প্রতীক, যার মর্মবাণী হল বিশ্ব মানবতাবাদ। পরকে আপন করে দেখা।
বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, চর্যাপদগুলো নিয়ে যখন আমরা আলোচনায় বসি তখন সাধারণতঃ একটা প্রশ্ন জাগে যে, বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন এ চর্যাপদগুলো নেপালে ও ভূটানে পাওয়া গেল কেন? চর্যাকারদের জীবনী গ্রন্থগুলোই বা তিব্বতি ভাষায় লেখা কেন? এ সমস্ত সমস্যামূলক প্রশ্নের উত্তরদানে একটু আলোচনা দরকার। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, অনেক ভারতীয় লেখক ও পন্ডিত মনে করেন যে ভারতে বৌদ্ধ রাজাদের অহিংসা ও সন্ন্যাস নীতির কারণে ভারতীয় সামরিক শক্তির অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যের তুর্কি সৈন্যদল ভারত ও বাংলা জয় করে নিল। যাঁরা ইতিহাস চর্চার সঙ্গে যুক্ত তাঁদের জিজ্ঞাস্যঃ পাঠান ও তুর্কি সৈন্যগণ কি শুধু বৌদ্ধ বিহার, বিশ্ববিদ্যালয় ও মন্দির ধ্বংস করল? তাহলে পুরীর বৌদ্ধবিহারকে কারা হিন্দুর জগন্নাথ মন্দিরে দীক্ষা দিল? বাবরি মসজিদ যারা ভেঙ্গেছে তাদের পূর্ববংশেরা অনেক বৌদ্ধবিহার দখল করে নিয়েছে। আমরা বৌদ্ধধর্মের স্বাধীনতা সহ বুদ্ধগয়ায় মহাবোধি মন্দিরের মুক্তি কামনা করি। বৌদ্ধমন্দিরকে হিন্দু মৌলবাদীনেতাগণ দখল করে আছে কেন?


লেখক এস বড়ুয়া খ্যাতিমান ঐতিহাসিক, কথাশিল্পী, বিবিধগ্রন্থ প্রনেতা এবং প্রবাসী কলামিষ্ঠ ।
barua_s@hotmail.com

২৮.৬.০৮

লজ্জাবতী লতা :: যুথিকা বড়ুয়া

লজ্জাবতী লতা
যুথিকা বড়ুয়া

লজ্জাবতীর মুখখানি ঘোমটায় ঢাকা
সেজেছে কনের সাজ, লাগছে ভারি ন্যাকা।
লজ্জায় হলো গাল লাল টুকটুক্
উরু উরু মন তার দুরু দুরু বুক।
ছাদনা তলায় যাবে আজি হবে পতীর মিলন
প্রেমের কুঁড়ি ফুটবে যখন কাঁপিবে হৃদয়স্পন্দন।
লজ্জাবতী লতা যাবে শ্বশুড়বাড়ী
কেমনে সে কইবে কথা এই চিন্তায় মরি।
হাসাহাসি কানাকানি করছে যে সবাই
লজ্জাবতীর লতার কেমন হলো জামাই।
শ্বশুড়বাড়ি গেল চলে লজ্জাবতী লতা
মায়ের চিন্তা দূর হলেও লাগছে ভীষণ ব্যথা।
লজ্জাবতী আসবে ফিরে বরের হাতটি ধরে
অবাক চোখে দেখবে সবাই রাখবে তারে ফিরে।
লজ্জাবতীর আসল নাম বেবী টুনটুনি
বছর ঘুরতেই হলো সে, একটি ছোট্ট শিশুর জননী।

যুথিকা বড়ুয়া : কানাডা প্রবাসী লেখক ও সঙ্গীত শিল্পী।
guddi_2003@hotmail.com

নীলিম করকা :আইয়ুব আহমেদ দুলাল

প্রথম পর্ব

আইয়ুব আহমেদ দুলাল

নীলিম করকা

(১)
পুরানো ঢাকার রাস্তায় এতো জ্যাম সিহাব রিক্সায় বসে থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে গেছে। কিছুক্ষন পর পর রিক্সা একটু এগিয়ে যায় আবার দাঁড়িয়ে থাকে অনেক সময় ধরে। পাশেই একটি ঘোড়ার গাড়ী। পুরানো ঢাকার ঐতিহ্য ঐ ঘোড়ার গাড়ী। তবে বর্তমানে রাস্তায় গুটিকয়েক দেখা যায়। ঘোড়াগুলোও পুরানো। জরাজীর্ন, রোগাক্রান্ত। সিহাব দেখল ঘোড়ার গাড়ীতে চলমান দুইটি ঘোড়ার মধ্যে একটি হাড্ডিসার, আরেকটি মোটামুটি নাদুস-নুদুস ও পরিচ্ছন্ন। পিছনে এক গুচ্ছ লেজ, বেশ ভালই দেখাচ্ছিল।
‘ বাহ্, ঘোড়াটার লেজতো বেশ সুন্দর ! - সিহাব বলল।
‘ হ ভাই, এমন সুন্দর ঘোড়া পুরান ঢাহায় অহন আর নজরে পড়ে না। যেইগুলো আছে হেইগুলো দ্যাখ্লে মনে অয় সোমালিয়াত্তন আইছে। - রিক্সাচালক বলল।
সিহাবের খুব হাসি পেল।
‘ তুমি আবার সোমালিয়া চেনো নাকি ?
‘ চিনুম না ক্যান ? ঐ দ্যাশে অহন দুর্ভিক্ষ ছলতিছে, টিভিতে দেহিছি। অভাবী মানুষগুলাইন কত কষ্টে আছে! দেখ্লে মনে অয় হ্যারা পিথিবীর বাইরে অন্য কোনহানে বাস করে।
‘ কেন, তোমার এমন মনে হয় কেন ?
‘ হুনেন ভাই, পিথিবীতে থাকলে তো কেউ না কেউ তাগরে দেখ্তো।
‘ অবশ্যই দেখে, কেউ না কেউ তো দ্যাখে।
‘ দ্যাহে না ভাই, দ্যাহে না, বুঝাই যায়। এই দুন্যেত কেউ কারোরে দেহে না। সবাই যার যার ধান্দায় থাহে।
‘ কে বলল তোমাকে ? মানুষইতো মানুষের জন্যে।
‘ ভাই, ঐ কথাগুলাইন আম্নেগ বইয়ের ভিত্তে রাহেন। মানুষ যদি মাইনষের লাইগাই অইতো তাইলে বুশ খান্কির পোলায় সাদ্দামের গোয়ায় বাঁশ না দিয়া ঐ অভাবী মানুষগুলার মাথার উপর বাঁশের মাছা’তো বানাইয়া দিবার পারে। পারে না কন্ ?
‘ হ্যা পারে। কিন্তু মাঁচায় থাকলে হবে, খাওয়া লাগবে না ? খাবার দেবে কে ?
‘ ক্যা, ব্লেয়ার ছোদানীর পোলায় কী করবো ? হ্যায় দিতে পারবো না ?
রিক্সাচালকের কথা শুনে অবাক হল সিহাব। একজন খেটে খাওয়া লোক। রিক্সাচালনা যার পেশা। সারাদিন সে ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে সংসারের ব্যয়ভাব যোগান দেয়। তার চিন্তাধারা রিক্সা আর সংসার এই দুইয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকার কথা। তারওতো সংসারে অভাব কম নয়। অথচ তার চিন্তাশক্তি ছড়িয়ে গেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। একেই বলে মনুষ্যত্ব। প্রকৃত অর্থে যাদের থাকা উচিত তাদের নেই কেন? এটা সকলেরই প্রশ্ন। রিক্সাওলার অকপট প্রকাশ ভঙ্গিতে সিহাব তখনো মিটিমিটি হাসছিল।
জ্যাম একটু হাল্কা হওয়া মাত্র আইল্যান্ড থেকে একসারি সরে গিয়ে দুই তিনটা রিক্সা ওভারটেক করে এগিয়ে গেল ঐ ঘোড়ার পাড়ীটি। ফলে সিহাব ঐ গাড়ী থেকে আরো দুইতিনটা রিক্সার পিছনে পড়ে গেল।
এক পর্যায়ে যানজটের মধ্যে রিক্সার ফাঁক দিয়ে ঐ পরিচ্ছন্ন ঘোড়াটির লেজ তার নজরে পড়ল। তার কাছে বেশ ভালই লাগছিল। যানযট পুনরায় কিছুটা হাল্কা হলে রিক্সাচালক সুযোগ বুঝে ফাঁকফোকড় পেরিয়ে চার-পাঁটটা রিক্সা পিছনে ফেলে সামনে চলে গেল। সিহাব ব্যাপারটা বেশ এন্জয় করল। পিকুলিয়র টাইপের রিক্সাচালক। ভালমন্দ নানান কথা তার মুখে শোভা পাচ্ছিল। হঠাৎ সে পিছন ফিরে সিহাবের দিকে তাকিয়ে বলল- ‘ভাই, এই দ্যাহেন ঘোড়ার লেজ।
সিহাব ফিরে তাকাল। লক্ষ্য করল ঐ ঘোড়ার লেজের দিকে। কিন্তু হায়! তাকিয়ে দেখে ওটা ঘোড়া নয়, একজন রূপসী রমনী। তার চুলগুলো ঐ ঘোড়ার লেজের মতই। পার্থক্য করা কঠিন। খুব আপসোস হল। মনে প্রশ্ন জাগলো- কেন মেয়েরা নিজেদের চুলগুলোকে রাঙিয়ে ঘোড়ার লেজের মত করে ফেলে। কেমন দেখায়! রাঙানো ঐ চুলগুলোকে কী রঙে প্রকাশ করা যায়! বাংলায় বললে বাদামী আর ইংরেজীতে ব্রাউন, মেহেদী কালারও বলা যায়, তবে গোবরে কালার বললে পারফেক্ট হয়। যেভাবেই বলা হোক না কেন, আসলে কেমন দেখায় ? মেহেদী লাগিয়ে চুলের প্রকৃত রংটাকে পরিবর্তন করে ফেলে। সে ক্ষেত্রে সাদা চুলটাকে ভাল মানায়, বিশেষ করে বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের পাকা চুল।
মুসলমানদের জন্যে মেহেদী ব্যবহার করা একটা উত্তম কাজ। তবে শরীরের বিশেষ কয়েকটি স্থানে, যেখানে ব্যবহার করলে আদব কায়দা ও পবিত্রতা ঠিক থাকবে। হয়ত কোথাও লেখা নেই, তবুও সুন্নত বললে বোধহয় ভুল হবে না এবং ওয়াজে হুজুরদের মুখে সুন্নত হিসাবেই বলতে শুনেছি। কারণ নবী করিম (সঃ) দাঁড়িতে ও চুলে মেহেদী ব্যবহার করেছিলেন। সেই হিসাবে আমরাও ব্যবহার করতে পারি। তবে কালো চুলে বা কালো দাঁড়িতে ব্যবহার করলে তেমন একটা বুঝা যায় না। সাদা হলেই ভাল দেখায়। কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান যুগের মেয়েরা পবিত্রতা রক্ষা করে মেহেদী ব্যবহার করেনা। তারা ব্যবহার করে ওয়েষ্টার্ন ষ্টাইল হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করার জন্যে। অর্থাৎ আধুনিক হওয়ার অপচেষ্টা মাত্র। তাই তারা চুলে, হাতে, এমনকি পায়েও মেহেদী ব্যবহার করে থাকে। মুলতঃ পায়ে মেহেদী ব্যবহার করা মোটেই উচিত নয়। এটা কমনসেন্সের বিষয়। যা নবী করিম (সঃ) এর দাঁড়িতে শোভা পেয়েছিল, তা কীভাবে মুসলিম উম্মার পায়ে স্থান পায় বোধগম্য নয়।
শোনা যায়, প্রকৃতির অবদান কালো চুলে যদি মেহেদীর রঙটা ফুটে না ওঠে তাহলে বিউটি পারলারে ব্যবহৃত হয় ¯িপরিট জাতীয় এক ধরনের কেমিক্যাল। যা চুলে লাগানো মাত্রই ধোঁয়া উঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে ওয়াশ করে ফেলে। অর্থাৎ চুলের প্রকৃত কালারটাকে পুঁড়িয়ে ফেলা হয়। তারপর ব্যবহার করে এক ধরনের রঙ। সেই রঙ দিয়েই সাজে বিভিন্ন স্টাইলে। পরনের পোশাক যদি হয় লাল তাহলে মেচিং করে চুলের রঙটা করা হয় লালসে। যদি নীল হয় তাহলে চুলের রঙ নীলসে করা হয়। ব্রাউন কালার সব পোশাকের সঙ্গেই চালিয়ে নিতে হয়, কিছুই করার থাকে না। কারণ ওটা ফিক্সড কালার। সেক্ষেত্রে প্রকৃত রঙ কালো আর থাকে না।
পশ্চিমা দেশের মেয়েদের চুল বাদামী, চেহারা সাদা। মানে- ত্বক লালসে কিংবা দুধে আলতা অথবা সাদাও বলা যায়। প্রকৃতিগতভাবেই এর উৎপত্তি। তাদের পোশাক-আশাক কৃষ্টি-কালসার সেই রকম। বাদামী চুল ও খোলামেলা পোশাক তাদেরই মানায়। বাঙালী মেয়েরা যদি কৃত্রিম ভাবে ঐ বেস ধারন করে তাহলে কতটুকু মানানসই হয়, একটু বিবেক খরচা করলেই বোঝা যায়। তাছাড়া ফর্সা মেয়েরা যদি চুল লালসে বানাতে পাটা-পুতার সহায়তা নিয়ে সাজুগুজু করে তাহলে মোটামুটি ভালই দেখায়। কিন্তু পাইকারী হারে যদি সবাই ঐ বেস গ্রহন করে বা অফর্সা ত্বকের মেয়েরাও যদি ঐ বেস নেয় তাহলে কেমন দেখায় ? মূলতঃ অনিজিনালের কোন বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে নিগ্রোরাই নিশ্চিন্ত।
বড় বিচিত্র আমাদের দেশের নারীরা। তারা স্বাধীনতা চায়। পশ্চিমা দেশের পোশাকে সুন্দরী প্রতিযোগীতায় অংশ নেয়। এ কেমন সুন্দরী ? যে যত খোলামেলা ও স্বল্প পোশাক পরিধান করে উম্মুক্ত মঞ্চে নিজের দেহকে প্রদর্শন করবে সেইই নাকি সুন্দরী। সব অবিচার মেনে নিচ্ছি আমরা। অথচ এই নারীদের মর্যাদা অনেক। সব ধর্মই নারীকে মর্যাদার আসন দিয়েছে। একজন নারীই হচ্ছেন মা, বোন, প্রেমিকা, স্ত্রী অথবা মেয়ে। মেয়েরা হচ্ছে পুরুষের অঙ্গ থেকে তৈরী। তাদের স্থান পুরুষের হৃদয়ে, হৃদপিন্ড জুড়ে। হৃদয়ের ঐ সিংহাসনটা একজন নারীর জন্যে নির্মিত। নারী হচ্ছে পুরুষের প্রেরণা। একজন পুরুষের জীবনে কোন বিশেষ নারীর আবির্ভাব না ঘটলেও একজন মায়ের আবির্ভাবতো ঘটেই। কারণ তিনিও একজন নারী। মায়ের প্রেরনাই প্রথম। সুতরাং নারী ছাড়া পুরুষ অচল। তাইতো যুগে যুগে এই পৃথিবী জুড়ে কবি, সাহিত্যিকরা যতটুকুই অবদান রেখে গেছেন তার সবটুকুই ঐ নারী বা মেয়েদের নিয়ে। অথচ ক’জন নারী আছেন যারা পুরুষদের নিয়ে কাব্য বা সাহিত্যচর্চা করেছেন ? হ্যা করেছেন, তবে সেটা পুরুষ প্রজাতি থেকে মুক্তি চেয়ে, স্বাধীনতা চেয়ে। অথচ তারা একটুও অনুভব করেন না যে, একজন পুরুষের যেমন নারী প্রয়োজন তেমনি নারীর জন্যও পুরুষ প্রয়োজন। একজন পুরুষ ব্যতিত কোন নারী নারীই নয়। পুরুষ আছে বলেই নারীদের এতো মূল্যায়ন। পুরুষ আছে বলেই নারীরা তাকে ভালবাসার লোভ দেখিয়ে ভেড়া বানিয়ে মজা নেওয়ার সুযোগ পায়। যেন কিচ্ছু বোঝে না।
ঘুরে ফিরে সিহাবের ঐ একই আপসোস। মেয়েদের চুল কেন ঘোড়ার লেজের মতো ? কালোর মাঝে খারাবী কোথায় ? এক সময় এই চুলকেই কালো করার জন্যে মেয়েরা সাধনা করতো। চুলের যতেœ বিভোর থাকতো। লম্বা ঘন কালো চুলের জন্য বান্ধবীদের মাঝে প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যেতো। লম্বা চুলো বান্ধবীকে দেখলে অন্য বান্ধবীরা হিংসা করতো। ঘন কালো কেশের নিমিত্তে প্রচার মাধ্যমগুলোতে বেশী বেশী বিজ্ঞাপন প্রচার হত। বিভিন্ন ধরনের প্রসেস ও তেলের বিজ্ঞাপন দেওয়া হত। সেসব বিজ্ঞাপনে মেয়েদের জন্যে লোভনীয় বিষয় ছিল ‘ঘন কালো কেশ’। সেই কেশ নিয়েই শিল্পীরা গেয়েছেন বিভিন্ন গান- মেঘ কালো আঁধার কালো, আর যে কলঙ্ক কালো------ তার চেয়ে কালো কন্যা তোমার মাথার চুল--- / তোমার কাজল কেশ ছড়ালে বলে এই রাত এতো মধুর --- / কবি লিখেছেন- চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা --- ইত্যাদি। কিন্তু বর্তমানে মেয়েদের মান্কি কালার চুল নিয়ে কী লিখবেন বা কী গাইবেন বিশেষজ্ঞ শিল্পী, কবি, সাহিত্যিকরাই ভাল জানেন। তবে নুতন করে কালো কেশ নিয়ে যদি কাব্য করা হয় তাহলে বর্তমানের সাথে তার তেমন মিল খুঁজে পাওয়া যাবেনা। ফলে বিষয়টা হাস্যকর হয়ে যাবে। তবে বাঙালী মেয়েরা যতই মডার্ন হতে চাক্ না কেন- তা সবসময়ই বেমানান দেখাবে। কারণ বাঙালী নারীরা চিরকালই বার’হাত কাপড় আর ঘন কালো কেশেই মানানসই।
(২)
অফিস থেকে বেরিয়ে রিক্সার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিল সিহাব। একটি রিক্সাও যেতে রাজী হয়নি। বাবুবাজার থেকে ইসলামপুরের রাস্তাটি পুরোপুরি জ্যাম। ফাঁকফোকড় দিয়ে একটি মানবদেহ এগিয়ে যাবে সেই অবস্থাও নেই। রাস্তার পাশে শ্রমিকেরা কাপড়ের গাইট যত্রতত্রভাবে রেখেছে। রিক্সা-ভ্যান অথবা পিক-আপ ভ্যানে উঠানামা করছে। মাটির সাথে লাগোয়া ঠেলাগাড়ী তো আছেই। যাও একটু আধটু ফাঁকফোকড় রয়েছে তাতে রিক্সা ডুকিয়ে বানিয়ে রেখেছে ফাকাক্কা বাঁধ। কোন রকমে জ্যাম অতিক্রম করে সিহাব পাটুয়াটুলী হয়ে সদরঘাট মোড়ে গিয়ে দাঁড়াল। সেখানে গিয়েও গন্তব্যে পৌছার মত কোন যানবাহন পায়নি। গাড়ীর আওয়াজ আর রিক্সার টুংটাং শব্দে রীতিমত অতিষ্ট। ধুলোবালিতো আছেই। সিহাব নাকে রুমাল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষন পর পর টেম্পো আসলেও জায়গামত পৌঁছার আগেই ফুল হয়ে যায়। হঠাৎ সিহাবের লক্ষ্য স্থির হয়ে গেল। চেনা চেনা মনে হল মহিলাকে।
‘ খালাম্মা স্লামালিকুম, কেমন আছেন ?
‘ ভাল। কিন্তু ----
‘ চিনতে পারেন নি ! আমি সিহাব, গোপীবাগ আপনাদের বাসার কাছে--।
‘ ও হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। কেমন আছ বাবা ?
‘ জ্বি ভাল। এটা কে, স্বর্না নাহ্ ?
‘ হ্যাঁ।
‘ ওয়াও, বড় হয়ে গেছো ! কেমন আছ ?
‘ জ্বি ভাইয়া, ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন ?
ওরা খিলগাঁও যাবে। সিহাবের গন্তব্য গোপীবাগ। কিন্তু যাওয়ার মত কোন বাহন ছিলনা। স্বর্নাদের বাসা আগে গোপীবাগেই ছিল। ঠিক সিহাবদের পাশের ফ্ল্যাটে। প্রয়োজনের তাগিদে তারা বাসা পরিবর্তন করে চলে গেল খিলগাঁও তালতলা। অনেকদিন পর দেখা হল।
এবার সিহাব পড়ল আরেক ঝামেলায়। এতসময় ধরে একটা রিক্সাই পায়নি। এখন খুঁজছে দুইটা।
‘ খালাম্মা, কোথা থেকে এলেন ?
‘ বুলবুল ললিতকলা একাডেমী থেকে।
‘ ও, স্বর্না এখনো গান শিখছে ? ভাল, খুব ভাল। ধরে রাখতে পারলে একদিন কাজে লাগবে। এতো ধৈর্য্যইবা কয়জনের আছে। চালিয়ে যাও। ছেড়ো না, একদিন ইন্শাল্লাহ সফল হবে।
‘ তুমি কোন ক্লাসে পড় ?
‘ নাইনে।
‘ ভেরী গুড।

স্বর্না সিহাবের অনেক জুনিয়র। চোখের সামনেই বড় হয়েছে। কিন্তু বয়ঃসন্ধি ও বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে ওর চেহারা, চাহনী, গড়ন সব কিছুর মাঝে একটা পরিবর্তন এসেছে। যা খুবই আকর্ষনীয় এবং নজর কাড়ার মত। কিন্তু সেই একই অবস্থা। চুলগুলো রাঙা। একদম গোবরে কালার।
হঠাৎ গুলিস্থানের দিক থেকে একটা ট্যাম্পো এলো। একদম খালি। সিহাব বুঝে উঠার আগেই স্বর্না ও তার মা লাফিয়ে উঠে গেল। সিহাবকে একটু যুদ্ধ করেই উঠতে হয়েছে, কারণ ততক্ষনে যাত্রীদের গুতাগুতি শুরু হয়ে গেছে। ট্যাম্পো প্রায় ঘন্টাখানিক লাগিয়ে গুলিস্থান এসে পৌছাল। তারপর ওরা একটি রিক্সায় করে খিলগাঁও চলে গেল। যাওয়ার সময় সিহাবকে বাসার লোকেশন দিয়ে গেল।
সিহাব নিজেও গান গাইতো। তার টিচার ছিলেন ওস্তাদ আকতার সাদমানী। কিন্তু সেকথা তাদের বলেনি। সিহাব রিক্সায় চড়ে গোপীবাগের দিকে যেতে লাগল। হঠাৎ স্বর্নার ডাগর ডাগর চোখ এবং গালে টোল পড়া হাসি নজরে ভেসে উঠল। তার মনে পড়ল সেই গানটি যা সে গেয়েছিল তারই বান্ধবী, অর্থাৎ সিহাবের ছোট বোনের জম্মদিনে। তখন সে পড়তো ক্লাস সিক্সে- ‘আমার গানের মালা আমি করবো কারে দান’। স্বর্না যখন গান গাইছিল তখন সিহাব মাথাটা এগিয়ে দিল। সবাই হেসে উঠল। পরে হাসির জন্যে স্বর্না আর গাইতেই পারেনি।

ছুটির ফাঁদে :: যুথিকা বড়ুয়া

সঞ্জয় আর মালবিকা, ওরা নিঃসন্তান। দুজনেই অর্থ উপার্জন করে। স্ত্রী ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে ছোট্ট ছিমছাম নির্ঝঞ্ঝাট সুখী পরিবার সঞ্জয়ের। পেশায় একজন মেডিক্যাল ডাক্তার! চাইল্ড্ স্পেশালিষ্ট! আর স্ত্রী মালবিকা, হাইস্কুলের শিক্ষয়িত্রী। শহরের নিড়িবিলি রেসিডেন্সি এলাকায় অট্টালিকার মতো শ্বেতপাথরের মোজাইক করা বিশাল বাড়ি তাদের! বাড়ির সদর দরজার ওপরে নেইম প্লেটে বড় বড় অক্ষরে খোদাই করে লেখা, “শান্তি কুটির।”
কর্মজীবনে মানব সেবাতেই দিন আর রাত পোহায় সঞ্জয়ের! দিনের শেষে ক্লান্ত সূর্য্যমিামা কখন যে অস্তাচলে ঢলে পড়ে, সন্ধ্যে পেরিয়ে বাইরের পৃথিবীটা অন্ধকারে ছেয়ে যায়, মালুমই হয়না! অবিরাম রুগীর সেবা-শুশ্রূষা করতে করতে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের আনন্দ-উচ্ছাসে একেবারে ভাটাই পড়ে গিয়েছিল সঞ্জয়ের!
সেবার সামার ভেকেশনে মনস্থির করে, রুটিনমাফিক কর্মজীবন থেকে কিছুদিনের জন্য বিরতি নিয়ে সমুদ্র-সৈকতে যাবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয়, তার বৃদ্ধা মাকে নিয়ে! তিনি বাতের ব্যথায় নড়তেই পারেন না কোথাও! সকাল সন্ধ্যে দুইবেলা পালা করে লোক আসে ওনাকে মাসাজ করতে। সারাদিন বেশীর ভাগ সময়ই তিনি শুয়ে বসে কাটান! তার দেখভালের জন্যও একজন বিশ্বস্থ কাউকে দরকার! কিন্তু স্বেচ্ছায় সঞ্জয়ের এতবড় একটা দায়িত্ব নেবে কে! তা’হলে!
শুনে সঞ্জয়ের বাল্যবন্ধু ভাস্কর বলল, -‘আরে এয়ার, ডোন্ট ওরি! ম্যায় হুঁ না!’
প্রভুভক্তের মতো আনুগত্য হয়ে মাথাটা সামনে ঝুঁকিয়ে দিয়ে বলে, -‘বান্দা হাজির দোস্ত! বিপদের সময়ই বন্ধুর পরীক্ষা হয়! মাসিমাকে নিয়েই যতো ভাবনা তো, নিশ্চিন্তে থাক্! ওনার দেখাশোনা আমিই করবো! তুই শুধু বাড়ির চাবিটা আমায় সঁপে দিয়ে যা ব্যস, কেল্লাফতে!’
অপ্রত্যাশিত বন্ধুর আশ্বাস পেয়ে সানন্দে খানিকটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল সঞ্জয়। চোখের তারাদু’টি চক্ চক্্ করে উঠল ওর। দীর্ঘদিন পর ঠোঁটের কোণে মালবিকার মুচকি হাসির ঝিলিকটাও আরো উদ্ধত করে করলো ওকে। স্বহাস্যে ভাস্করের পিঠে আলতোভাবে একটা চড় মেরে বলে,-‘ইয়ে হুই না বাত! সত্যি মাইরি, আমায় বাঁচালি তুই!’
পঁঞ্চাশের উর্দ্ধেঃ বয়স সঞ্জয়ের। মুশকিল আসান হতেই শুরু হয় অবকাশ যাপনের প্রস্তুতিপর্ব। ঘুম ভাঙ্গতেই চোখ মেলে দ্যাখে, ঊষার প্রথম সূর্য্যরে নির্মল হাস্যেৎজ্জ্বল একটি আনন্দময় সকাল। যেন সমস্ত মানুষগুলিকে অকুন্ঠভাবে আহ্বান করছে, স্বতঃস্ফূর্ত মনে উল্কার মতো দ্রুত কক্ষচ্যুত হয়ে আনন্দময় কোনো এক প্রান্তরে চলে আসার জন্য।
সবুর সয়না সঞ্জয়ের। সেদিন সকালেই উৎসাহে-উদ্দীপণায় দায়িত্বের বোঝা ভাস্করকে প্রগাঢ় বিশ্বাসে সঁপে দিয়ে বেরিয়ে আসে বাইরের পৃথিবীতে! সাময়িক অবসর নিয়েই স্বস্ত্রীক রওনা হয়ে গেল সমুদ্র-সৈকতে! কিন্তু মঞ্জুর হলো না বিধাতার! মাঝপথে গিয়ে তাদের বিশাল যাত্রীবাহী টুরিষ্ট বাসটা হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছিকটে পড়ে একটি নোংরা কর্দমাক্ত খাঁদের গভীরে! আর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় আত্মচিৎকার। কাঁন্নার রোল। প্রাণ হারায় অনেকে! কেউ গুরুতরোভাবে ঘায়েল হয়ে অর্ধমৃত অবস্থা! আর কেউ প্রাণে বেঁচে গেলেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বিকলাঙ্গ অবস্থায় প্রায় নমাস চিকিৎসাধিনে পড়েছিল, স্থানীয় হাসপাতালে! সেখানেই এ্যাড্মিটেড ছিল মিষ্টার এ্যান্ড মিসেস সঞ্জয় রায় চৌধুরী! তাদের সঙ্গে কোনপ্রকার আইডেন্টিটি কার্ড কিংবা বাড়ির ঠিকানা ছিলনা যে, এতবড় একটা মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদটা তাদের আত্মীয়-পরিজনের কাছে গিয়ে পৌঁছাবে।

একেই বলে নিয়তির নিমর্ম পরিহাস! ওদের সুখের সংসারে কার যে নজর পড়েছিল, একদিন সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে ফিরে এসে নিজের বাড়িই আর খুঁজে পায়না সঞ্জয়! সারাপাড়া পরিক্রমা করে ও’ বারবার একই জায়গায় এসে দাঁড়ায়! আর মনে মনে ভাবে, এ কি, আমাদের ‘শান্তি কুটির’ গেল কোথায়! এ তো দেখছি, ‘ভবানী ভবন’ লেখা! কি আশ্চর্য্য, বাড়ির নক্সাটাও সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে যে! কিন্তু তাই বা সম্ভব হয় কি করে!
ইতিপূর্বে এক বয়স্ক ভদ্রলোক ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, -‘কাকে চাই?’
অপ্রত্যাশিত হঠাৎ অচেনা লোকের মুখদর্শণে হকচকিয়ে যায় সঞ্জয়। ভবানী ভবনের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বলে, -‘আপনি, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না! আপনি কে হে মশাই!’
ঠোঁট চিবিয়ে চিবিয়ে ভবানিচরণ বললেন,-‘আজ্ঞে আমি হইলাম ভবানীচরণ দাস। এ বাড়ির মালিক। নুতন কিনছি!’
আঁতকে ওঠে সঞ্জয়। -‘বলেন কি মশাই, আপনি এ বাড়ির মালিক! এ চত্তরে আগে তো কোনদিন দেখিনি! মশাই আপনার মস্তিস্ক, শরীরের তাপমাত্রা সব ঠিক আছে তো!’
শুনে রেগে লাল ভবানীচরণ। চোখমুখ রাঙিয়ে একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন। তোতলাতে শুরু করেন। সঞ্জয়ও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। থানা পুলিশের হুমকি দিতেই লেগে যায় তুমুল ঝগড়া। অথচ তখনও কল্পনাই করতে পারেনি, যে নিজের ভাইয়ের চেয়েও বেশী, সেই ছোট্ট বয়স থেকে একসাথে বেড়ে ওঠা বাল্যবন্ধু ভাস্কর মিত্র, যার উপর বাড়ির সমস্ত দায়-দায়িত্ব সঁপে দিয়ে গিয়েছিল, সে-ই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে! ভাবতে পারেনি, জীবনের সাঁঝবেলায় এসে ওরই বিশ্বস্থ বন্ধু ভাস্কর, নিষ্ঠুরের মতো এতবড় কঠিন আঘাত হেনে প্রৌঢ়ত্বে নিঃশ্ব করে দিয়ে ওকে একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে!
দুই দুটো জলজ্যান্ত প্রাণী হঠাৎ নিখোঁজ হবার পর সারা পাড়ায় যখন হৈচৈ পড়ে গেল, আত্মীয়-স্বজনরাও যখন অনুসন্ধানে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে, ঠিক তখনি সঞ্জয়ের হৃদয়-প্রাণ ‘শান্তি কুটির’ সবার অলক্ষ্যে বেনামে বেচে দিয়ে, সঞ্জয়কে বেঘর, নিরাশ্রয় করে দিয়ে, পলাতক দাগী আসামীর মতো রাতারাতি শহর ছেড়ে অন্যত্রে গিয়ে আত্মগোপন করে তারই বিশ্বস্থ বন্ধু ভাস্কর মিত্র! যা ঘূণাক্ষরেও পাড়ার কেউ টের পায়নি!
ততদিনে সঞ্জয়ের গর্ভধারিনী বৃদ্ধা মায়ের বুঝতে আর বাকি থাকেনা। তার একমাত্র পুত্র সন্তানকে হারানোর শোকে কাতরতায় তিনি মুহ্যমান হয়ে পড়েন। তার শূন্য বুক দুইহাতে চাপড়াতে চাপড়াতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় যে চলে যায়, আর ফিরে আসেনি। হয়তো পথেঘাটে কোথাও মৃত্যুবরণ করেছে, কে জানে!
বিকৃতি চেহারা আর বিকলাঙ্গ শরীর নিয়ে উচ্ছাসহীন, আবেগহীন মালবিকা নিথর নির্জীব প্রাণীর মতো অন্যমনস্ক হয়ে উইলচেয়ারে বসেছিল। একেই আচমকা জীবনে অনাকাঙ্খিত বিপদের সম্মুখীন হয়ে পঙ্গুত্বের গ্লানিতে মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে! তন্মধ্যে দুঃস্বপ্নের মতো অবিশ্বাস্য এবং সর্বস্বান্ত নিঃশ্ব হয়ে যাওয়ার দুঃসংবাদ শুনে মাথায় যেন বজ্রাঘাত পড়ে। এ কি সর্বণাশ হলো তাদের! আনন্দমুখরিত চঞ্চল প্রবাহিত জীবনটা ওদের হঠাৎ কেন বিনা নোটিশে থেমে গেল!

অবসন্ন ব্যাথাতুর দেহটা বহন করবার মতোও শক্তি নেই মালবিকার। বুকের ভিতরের সমস্ত ব্যাথা, কষ্টগুলি বুক ফেটে দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় ঝড়তে থাকে! পারেনি সম্বরণ করতে! ক্ষোভে দুঃখে শোকে বিহ্বলে হঠাৎ সঞ্জয়কে জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজে হু হু কেঁদে ওঠে!
বেদনাহত বিমূঢ়-ম্লান সঞ্জয়, পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে! স্ত্রীকে শান্তনা দেবার মতো একটা শব্দও উচ্চারিত হলোনা ওর! কি বলে শান্তনা দেবে! কখনো কি ভেবেছিল, জীবন জোয়ারে সুখের তরীতে ভাসতে ভাসতে একদিন আচমকা অতল তলে তলিয়ে যাবে! যেখানে কূল নেই! কিনারা নেই! বেঁচে থাকারও কোনো অবলম্বণ নেই! জীবন নদীর খেয়া পুনরায় বাইতে শুরু করলেও উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো প্রাণবন্ত মালবিকার চোখের তারাদু’টিতে কখনো আর খুশীর ঝিলিক দেখা যাবেনা। কিছুই আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না। ফিরেও আসবে না কোনদিন! শুধু নীরব নির্বিকারে বুকের মাঝে জমে থাকবে না বলা কিছু কথা। কথার আলাপন। আর অহরহ কানে বাজবে, খুশীর বন্যায় প্লাবিত করে ভ্রমরের মতো ভেসে বেড়ানো মালবিকার গুনগুন গুঞ্জরণে অপূর্ব সুরের মূছর্ণা।
স্ত্রীর অলক্ষ্যে পলকমাত্র দৃষ্টিপাতে সঞ্জয় দেখল, বিষন্নতায় ছেয়ে গিয়েছে মালবিকার শরীর ও মন! ক’মাসেই অনেক বুড়িয়ে গিয়েছে। চোখমুখও শুকিয়ে মলিন হয়ে পুতুলের মতো দেখাচ্ছে ওকে! কি যেন ভাবছে মালবিকা!
সঞ্জয় তক্ষুণি বিড় বিড় করে ওঠে মনে মনে,-‘কিচ্ছু ভেবো না মালবিকা, আমি অঙ্গীকার বদ্ধ! আমার অকুণ্ঠ হৃদয়ের উজার করা নীরব ভালোবাসায় প্রিয়তমার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের দৃঢ় অঙ্গীকারে আমার বুকের সমস্ত কষ্টগুলি লুকিয়ে থাকবে, ক্ষণিকের একফালি অনিন্দ্য সুন্দর হাসির আড়ালে।’
হঠাৎ মালবিকার গভীর সংবেদনশীল দৃষ্টি বিনিময় হতেই বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল সঞ্জয়ের। ওর ভারাক্রন্ত হৃদয়ে ক্ষণপূর্বের সেই যন্ত্রণাদায়ক গহীন বেদানুভূতির তীব্র দংশণে মস্তিস্কের সমস্তস্নায়ূকোষগুলিকে যেন কুরে কুরে খেতে লাগল! অত্যন্ত পীড়া দিলো মুমূর্ষ্য হৃদয়কে! হতাশায় বিশুস্ক বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠল। অনুতাপ আর অনুশোচনার অন্ত নেই। হারিয়ে ফেলেছে মনের সমস্ত শক্তি! বুকের পাঁজরখানাও ভেঙ্গে গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে ওর! মালবিকার মুখপানে চোখ তুলেও আর তাকাতে পারেনা! ওর প্রিয়তমা ওর প্রিয়তমা পত্নী, অর্ধাঙ্গিনী মালবিকাই ছিল, চির অম্লান, চির সজীব, স্নিগ্ধ শান্ত কোমনীয় এক উদ্বিগ্ন যৌবনা অনন্যা! প্রেমের মহিমায় দ্বীপ্ত মমতাময়ী বিদূষী রমণী। ওর হৃদয়হরিনী। সঞ্জয়ের নিবেদিত প্রাণ, শক্তির উত্স! ওর প্রেরণা, ভাই-বন্ধু-প্রেয়সী, সব!

কইতে নারি সই :: তানবীরা তালুকদার

তানবীরা তালুকদার

কইতে নারি সই


ঘুমের মধ্যে বার বার মাথাটা এপাশ ওপাশ করছে বালিশে , একটা কিসের যেনো ছটফটানী ঘেমে যাচ্ছে সুমনা। তৃষনায় বুকটা শুকিয়ে জিহবা পর্যন্ত আড়ষ্ট হয়ে আছে। কি যেনো একটা স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে যা নিজেও ঠিক বুঝতে পারছে না কিন্তু ঘুমের মধ্যেই মনে মনে ওর একটা অনুভূতি হচ্ছে যে সুখকর কোন স্বপ্ন এটা নয়। সারা শরীর শক্ত হয়ে আছে নড়তে চড়তে পারছে না। অস্বস্তিতে ধড়ফড় করতে করতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো সুমনার। মুখের মধ্যে একটা ভীষন তেতো স্বাদ, গা টা গুলিয়ে গুলিয়ে উঠছে। এমনিতেই যখন ওর পীযুষের সাথে দেখা করার কথা থাকে টেনশনে কদিন আগে থেকেই ও ঘুমাতে পারে না, খেতে পারে না। অতিরিক্ত আনন্দ থেকে কেমন যেনো ঘোরের মধ্যে চলে যায়, অচেনা একটা ভয় লাগতে থাকে। সারাক্ষন মনে হয় এই বুঝি সবার কাছে ধরা পড়ে গেলো, সবাই যেনো ওকে সন্দেহের চোখে দেখছে। বুঝে ফেলছে কেনো সুমনা এতো চঞ্চল, গোপন খুশীটি এবার ধরা পড়ে যাবে। যদিও সুমনা আনন্দ লুকিয়ে সবার সাথে প্রচন্ড স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে, যেমন রোজ কলেজে যায় তেমন কলেজেই যাচ্ছে আজ ভাবটা ধরে রাখে, আজ কোন বিশেষ দিন নয়, বিশেষ কেউ আসার কথা নয় তার কাছে সেই মুখোভাবটা প্রচন্ড ভাবেই ফুটিয়ে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু আজকের অনুভূতিটা সেরকম সুখ মাখানো কষ্টানুভুতি নয়। মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রনা যেনো মাথার শিরা সব এখুনি ফেটে রক্ত পড়বে। মাথা তুলে বসতে পারছে না এতো ভার লাগছে উপড়ের অংশটাকে। কাতর গলায় আর না পেরে মাকে ডাকল, মা ও মা শুনে যাও, শুনছো?

মা তখন সবে ঘুম থেকে উঠে স্নিগ্ধ ভোরের আমেজ গায়ে মেখে রোজকার সকালের প্রাত্যহিক কাজের তদারকী করছেন। কারো ঘুমের যাতে অসুবিধে না হয় সেজন্য মা প্রায় নিঃশব্দ পায়ে চলাফেলা করলেও তার চলাফেরার একটা মৃদ্যু মিষ্টি আওয়াজ সুমনা ঘুম থেকে রোজই টের পায়। ভোরের দিকে তখন ঘুমটা হালকা হয়ে আসে, সামান্য সে যতো সামান্যই হোক, নড়াচড়া অনুভব করা যায়। কিন্তু ভোরের আলসেমী গায়ে মেখে সুমনা বেশীরভাগ সময়ই শুয়ে থাকে, উঠে না বেলা না চড়লে। এতো ভোরে সুমনার গলা পেয়ে অবাক হয়ে মা সুমনার কাছে এলেন। এসেই আতকে উঠে বললেন কি হয়েছেরে তোর? এমন চোখ - মুখ লাল কেনো? সুমনা বলল, বুঝতে পারছি না তো মা। মা এসে কপালে হাত রাখলেন। প্রায় অস্ফুট স্বরে চিৎকার করে উঠলেন, একি গাতো দেখি জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কি করে হলো? ক্লান্ত গলায় সুমনা বলল, জানি না। একগ্লাস পানি দাও না, মা বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। মা পানি এনে সুমনাকে খাইয়ে আদর করে কপালে হাত বুলিয়ে শুইয়ে দিতে যেয়ে আবার চিৎকার করলেন একিরে কপালে এটা কি? সুমনারও কি রকম একটা অস্বস্তি মতো লাগছিল ব্যাথা ব্যাথা কপালে, কিন্তু এতো আলসেমী লাগছিল যে হাত দিয়ে সেটা ধরে দেখার ইচ্ছেও করছিল না। মা বুঝে গেলেন সুমনার পক্স হয়েছে। বললেন, নাস্তা বানিয়ে দিচ্ছি, খেয়ে শুয়ে থাকো, কোথাও যেতে হবে না কদিন, পড়া, কোচিং সব বন্ধ। বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ শোনা মাত্র সুমনার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় সজাগ হয়ে উঠল। আজ তাকে যেকোরেই হোক বেরোতেই হবে, তারপর তিন মাস না বেরোলেও চলবে। কিন্তু সে কথাতো আর মাকে বলা যায় না। তাই সে সমানে মাকে বলে যাচ্ছে, এমনিতেই একটু গা টা গরম হয়েছে, জ্বর টর কিছু নয়তো। সে দিব্যি ভালো আছে। মা বেশী ভাবছে ওকে নিয়ে, আজ কোচিং এ স্যার জরুরী কিছু
পড়াবেন, কিছুতেই তা মিস করা যাবে না। কিন্তু মা অভিজ্ঞ চোখে দেখে বললেন, তোর জামাটা ওপরেতোলতো দেখি পেটটা একটু। জামা উপড়ে তুলতেই দেখা গেলো পেটের মধ্যে তিনটে , চারটে




পানিওয়ালা বড় বল হাসি মুখে সুমনার দিকে তাকিয়ে আছে। মা নিশ্চিত করে দিয়ে গেলেন যে পক্সই হয়েছে, নট নড়ন - চড়ন, এই অবস্থায়।

পাড়ার কোচিং এ পড়তে যেয়ে পীযুষের সাথে আলাপ সুমনার। যদিও কথা বলতে তেমন কিছুই হয়নি কখনও তার সাথে, শুধু দূরে থেকেই দুজন দুজনকে দেখেছে। চোখে চোখ রাখার বাইরে আলাপ বেশী দূর এগোয়নি তখনও। কিন্তু একদিন সুমনা অবাক হয়ে লক্ষ্য করল পী্যুষ না আসলে পড়ায় মন বসছে না সুমনার। বার বার দরজার দিকে চোখ চলে যায় এই বুঝি এলো, এই বুঝি এলো। পরে আর থাকতে না পেরে বন্ধুদের জিজ্ঞেসই করে ফেলতো পীযুষ এলো না আজ? পীযুষেরও প্রায় সেরকমই অবস্থা। দু পক্ষের ইচ্ছায় মন দেয়া নেয়া হয়ে গেলো অতি দ্রুত। আস্তে আস্তে পড়া শেষ করে খুব ভালো রেজাল্ট করে পী্যুষ বড় শহরে পড়তে চলে গেলো। আর রক্ষনশীল পরিবারের মেয়ে হওয়ায় ভালো রেজাল্ট সত্বেও সুমনার বাইরে যাওয়া হয়নি পড়তে, এখানেই নিজের শহরে সুমনা রয়ে গেলো। যোগাযোগ বলতে চিঠি আর মাঝে মধ্যে লুকিয়ে ফোন। আগে যেখানে রোজ দেখা হতো সেটা এখন কখন সখনোতে পৌছে গেছে। অথচ সারাদিন সুমনা তার ভাবনাতেই ব্যাকুল থাকে। দিন যায় রাত যায় তার পী্যুষের কথা ভেবে ভেবেই। এমনিতে সময়গুলোকে কি অসহ্য লম্বা লাগতে থাকে সারাবেলা সারাক্ষন, কিন্তু যে একবেলা পীযুষের সাথে সুমনার দেখা হয় সেই সময়টা যেনো হাওয়ার ভর দিয়ে পংঙ্খীরাজ ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে থাকে। চোখের পলক ফেলার আগে, পীযুষের বুকে মাথা গুজে দুদন্ড নিঃশ্বাস নেয়ার আগেই শেষ ঘন্টি বেজে উঠে। সুমনা কতো কি ভেবে রাখে পীযুষ এলে কি বলবে, কোন গল্পটা এখনও ওকে করা হয়নি কিন্তু পীযুষ সামনে এলে ও সব ভুলে যায়। আনন্দে সুমনার মাথাটাই এলোমেলো হয়ে যায়, স্বাভাবিক বুদ্ধিটাও কাজ করে না তখন যেনো।

সেই ভীষন প্রতীক্ষিত সময়ে পক্সের কথা শুনে সুমনা ব্যাকুল হয়ে কাদতে লাগল। সুমনার কান্না দেখে বাড়ির সবাই অবাক। সবাই ভাবছে সুমনা বুঝি পক্সের জন্য কেদে আকুল হচ্ছে। সুমনা গড়পড়তা বাংগালী মেয়েদের তুলনায় বেশ সুন্দরী। সাধারন বাংগালী মেয়েদের থেকে বেশ লম্বা, ছিপছিপে একহারা গড়নের, গোলগাল মিষ্টি পান পাতা মুখের ফর্সা সুমনার সুন্দরী হিসেবে পাড়াময় খ্যাতি আছে। বাড়ির লোকেরা ভাবছে, পক্স হয়েছে, মুখে দাগ পড়বে, সৌন্দর্য নষ্ট হবে সেই দুঃখে বুঝি সুমনা কেদে যাচ্ছে, কিন্তু সুমনা কাউকে কি করে বলে আজ পাক্কা তিনটি মাস পর পীযুষ বাড়ি আসছে, সুমনার সাথে দেখা করতে। সবাই জানে পীযুষ ওর বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে বাড়ী আসছে কিন্তু সুমনাতো জানে কার জন্য পীযূষ এতো ঝক্কি নিয়ে বাড়ী আসছে ,তিন তিনটি মাস দেখা হয়নি দুজনার। আবার চলে যেতে হবে তাকে আজ রাতের ট্রেনেই। আজ চলে গেলে আবার কতোদিন দেখা হবে না দুজনার। সবাই স্বান্ত্বনা দিচ্ছে কাদিস না, পক্সের দাগ থাকে না, নখ দিয়ে না খুটলেই চলে যাবে দেখিস কদিনের মধ্যেই। আবার ওকে নিশচিত করার জন্য অব্যর্থ উপকারী সব ওষুধের নাম করছে, ডাবের পানি দিয়ে খুব ধুলেই পক্সের দাগ থাকে না কিংবা বেসন এর উপকারিতা অনেক ইত্যাদি ইত্যাদি। সুমনা না পারছে কইতে , না পারছে সইতে। কাউকে বলতে না পেরে আরো জোরে জোরে কাদতে লাগল, ওদিকে পীযুষযে তার অপেক্ষায় তাদের সেই প্রিয় বড় বড় জারুল গাছের ছায়া দিয়ে ঢাকা জায়গাটাতে , নদীর পাশটাতে উচাটন মন নিয়ে বসে আছে গো ..................।।


তানবীরা তালুকদার
২৬.০৬.০৮

২৬.৬.০৮

সৃষ্টিতত্ত্বের গালগপ্প বনাম বিবর্তনের শিক্ষা-২ :: তানবীরা তালুকদার

সৃষ্টিতত্ত্বের গালগপ্প বনাম বিবর্তনের শিক্ষা-২
মেহুল কামদার
অনুবাদক: তানবীরা তালুকদার

পূর্ববর্তী পর্বের পর ...
সারা বিশ্ব জুড়ে আমাদের পূর্ব পুরুষদের করা আপ্রান চেষ্টা থেকে এটা স্পষ্টতঃই বোঝা যায় যে, জীবনের সৃষ্টি কিংবা এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি কি করে হলো সেটা বুঝতে এবং জানতে তারাও খুবই আগ্রহী ছিলেন এবং এ নিয়ে তারা বিস্তর চিন্তা ভাবনাও করেছেন। আদিম যুগের মানুষেরা বিজ্ঞান কিংবা শিক্ষার জ্ঞান ছাড়া বাধাহীন কল্পনা শক্তির দ্বারা উদ্ধুদ্ধ হয়ে আশে পাশের পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে যা তাদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হতো তারা সেভাবেই তার একটা ব্যাখা দাড় করাতো। যখন তারা মাটির ঘরে বসবাস করতো, পশু দিয়ে টানা বাহন ব্যবহার করতো, সেই সময়ের মানুষদের পক্ষে আজকে আমাদের কাছে যা খুবই নৈমিত্তিক বা সহজ কাজ তা তাদের কল্পনায়ও অসাধ্য ঘটনা ছিল। পাখির মত উড়ে বেড়ানো নিয়ে মানুষেরা কল্পণাপ্রবন ছিল প্রথম থেকেই- আদিম মানুষদের কল্পনায় প্রথমে উড়ন্ত দেবতা তৈরী হতো তারপর তাদের উপকথায় প্রবশ করত তাকে উড়ানোর কৌশলগত রঙ বেরঙ-এর গল্প । বর্বর যুগে নানা জরা ব্যাধি এবং যুদ্ধ বিগ্রহের কারনে মানুষের জীবন স্বল্পস্থায়ী হতো, প্রতি দিনের জীবন যুদ্ধের যন্ত্রনাগুলো ভুলে থাকার উপায় ছিল পরকালের সু্খ শান্তির গল্প শোনা। এবং যখন এই প্রশ্নটি আসতো কিভাবে মানুষের এবং অন্যান্য প্রানীর সৃষ্টি হলো তখন মানুষের একজন স্বর্গীয় সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি করতে হতো যিনি এই বিদ্যমান সমস্ত কিছুই সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টিকর্তার স্বরূপ কিরকম হবে এতো দূর মানুষ কল্পনা করতে পারেনি তাই সে তার নিজের পছন্দের সৃষ্টিকর্তার অবয়ব তৈরী করে নিয়েছে। আরবীয় ধর্মগুলোতে পরিস্কারভাবে সৃষ্টিকর্তার অবয়বের ইঙ্গিত আছে, যেখানে হিন্দু ধর্ম, প্রাচীন মিশরীয় ধর্ম, গ্রীস এবং রোমের ধর্মগুলো এতো প্রাঞ্জলভাবে এনিয়ে কিছু বলেনি, কিন্তু আছে তাদের পরিপূর্ন নিজস্ব আদলে যুদ্ধরত রাজার মতো দেবতা, আদালতের গল্পসহ পৌরনিক কাহিনী, উপপত্নী, ক্রীতদাস, বিদূষক এবং তাদের সময়ে মানুষকে শোষন করার অন্যান্য সকল ফাকিবাজী গল্প।
এইসব পৌরনিক গল্পগুলোতে পরিবর্তন আসতে অনেক সময় লেগেছে, ঐশীগ্রন্থ গুলো পরিবর্তন হতে পারেনি কারন তাদের ধর্মে পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই। তাদেরকে পরিপূর্ন বলে ধরে নেয়া হয় সেখানে কোন প্রশ্ন করার এমনকি কিছু কিছু জায়গায় ভাষার ব্যাখা নিয়েও কথা বলার সুযোগ নেই, আগের শতাব্দীগুলো থেকে এ ধরনের বেশ কয়েকটি উৎপথগামী ঘটনার কথা জানা যায়। আর এখন, মানুষের জ্ঞানের উৎকর্ষতা সীমাহীন। বিজ্ঞানী জেমস হাটনের ভূতাত্ত্বিক গবেষনা এবং চার্লস ডারউইনের বিবর্তনের উপর গবেষনা শীঘ্রই সবাইকে যথাযথ বিবরনের সাথে জানাবে, কিভাবে প্রথমে জীবনের উদ্ভব হলো এবং তাদের নিখূত গবেষনার সেই পদ্ধতি যার দ্বারা বিজ্ঞানীরা সমস্ত ঘটনাগুলোকে এক সাথে যৌক্তিকভাবে সারিবদ্ধ করে সবার সামনে আনেন, যদিও তারা ধর্মের লোকজনের কারনে আতংকিত থাকেন, বিশেষ করে গীর্জার অনুসারীদের দ্বারা। ইশ্বর তার কল্পনা থেকে মানুষের সৃষ্টি করেননি, বরং মানুষ পৃথিবীতে এসেছে বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় - এ ধরনের সত্য কথায় চার্চের গুরুত্ব কমে যায়। যারা ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্রীতদাস বানিয়ে রেখে শোসন করে চলেছে যুগ যুগ ধরে আর জোর করে পয়সা কড়ি হাটিয়ে নিচ্ছে - মানুষের কাছে তাদের আসল রুপও প্রকাশ পেয়ে যায়। মোটামুটি পরিস্কার করেই, এরা জনগনকে বোঝায় যে ধর্ম বইতে যা লেখা আছে, তাই সত্য। পৃথিবীর বেশীরভাগ লোকই আগে ক্রিশ্চিয়ান বাইবেলের অনুসারী ছিলেন, তারা একটি বাস্তব দৃষ্টিকোন থেকে সকলেই ভুল ছিলেন। অনেক আগে ক্রিশ্চিয়ান সমাজ বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে তার সৌরজগত সম্পর্কে দেয়া মতামত প্রত্যাহার করার জন্য জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু পরে ইংল্যান্ড রোম, স্পেনকে এ নিয়ে প্রকাশ্যে বিতর্কের আহ্ববান জানিয়েছে এবং পরে ফ্রান্সকে বাধ্য করেছে নতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে সমাধান হিসেবে নিতে, তখন কোন চার্চের সাহস হয়নি এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করতে। তবে এক্কেবারে প্রথম দিকে, ইংল্যান্ডের সরকারী প্রটেষ্টান্ট চার্চ এর তরফ থেকে বাধা দেয়ার জন্য প্রচন্ড চেষ্টা করা হয়েছিল, বিশপ্ স্যাম উইলবিফোর্স চেষ্টা করেছিল ডারউইনের এবং তার অনুসারী বিজ্ঞানীদেরকে টমাস হাক্সলি’র মুখোমুখী করতে , যেখানে হাক্সলিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সে কি উত্তরাধিকার সুত্রে তার মায়ের বংশের নাকি বাবার বংশের বানরকুল থেকে জন্মগ্রহন করেছে। হাক্সলের জবাব ছিল খুবই নেতিবাচক, তিনি বললেন, আমি এমন একজন শিক্ষিত ব্যক্তি যিনি তার প্রাকৃতিক শক্তি, বাগপটুতাকে, পক্ষপাতদুষ্ট, মিথ্যাকথন এর কাজে ব্যবহার করে তার ঔরসথেকে জন্ম নেয়ার পরিবর্তে বরং একটি শিম্পাঞ্জী থেকে জন্মগ্রহন করতে পছন্দ করব। সেই সময়ের সংবাদপত্রগুলো এ নিয়ে বিশাল বিশাল কার্টুন ছাপে সে সময় এই বলে যে, হাক্সলি বলেছেন, তিনি বিশপ হয়ে জন্ম নেয়ার পরিবর্তে একটি শিম্পাঞ্জী হয়ে জন্মগ্রহন করতে চেয়েছিলেন। এরপর আর কোন চার্চ বিবর্তনবাদীদের বিরক্ত করার কোন স্পর্ধা দেখায়নি। তারা বরং বিবর্তনবাদকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য অনেক ধরনের প্যাচানো ঘোরালো পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। প্রথমে তারা, মৃত্যুশয্যায় ডারউইনের ক্রিশ্চিয়ান হয়ে যাওয়ার মিথ্যে গুজব রটিয়েছেন, তারপর তারা বিবর্তনবাদ পড়ানোর উপরে বিভিন্নভাবে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের চেষ্টা চালিয়েছেন, এবং অবশেষে তারা পরিপূর্ন প্রতারনামূলক ধর্ম তত্ব “ইন্টিলেজেন্স ডিজাইন” নিয়ে এসেছেন, এবং আবারো চেষ্টা চালাচ্ছেন এ্যামেরিকার উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে বিবর্তনবাদের পরিবর্তে এটিকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে পড়ানোর জন্য। এবং কিছু কিছু আরব দেশ সহ বিভিন্ন জায়গায় বিবর্তনবাদ পড়ানো বন্ধ করার ব্যাপারে চার্চগুলো সফলও হয়েছে বিশেষ করে আরবের উপসাগরের পরামর্শ দাতা দেশগুলো তাদের দেশের স্কুলগুলোতে বিবর্তনবাদ পড়ানো নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন।
যদিও শেষ পোপ দ্বিতীয় জন পল স্বীকার করেছেন যে, বিবর্তনবাদ ছিল বিজ্ঞানের সঠিক তত্ব, এবং তার উত্তরসূরী বেনডিক্ট তার সাথে একমত, তারপরো দুজনে মিলে সৃষ্টি তত্বের গল্পের “নৈতিকতা” প্রচার করে বিরাট হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন চারধারে। যেনো লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর হওয়া অত্যাচারের ইতিহাস, অতীতে চলা গীর্জার স্বৈরতন্ত্র বাইবেলের ব্যখ্যা যার পর নাই 'নৈতিক', আর অন্যদিকে জীববিজ্ঞানীদের সতর্ক এবং শ্রমসাধ্য বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, যারা ডারউইনের বিবর্তনের তত্বকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আরো গবেষনা করে চলছেন এবং মুল উৎসের দিকে ক্রমস ধাবিত হয়ে অন্তিম রহস্যের সমাধানের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন - তাদের সবকিছুই কোন না কোনভাবে অনৈতিক। যেনো বিজ্ঞানের বাস্তব শিক্ষা, কিংবা বিবর্তনবাদ সত্য হলেও বাইবেল ছাড়া কোন না কোনভাবে “অনৈতিক”। এই হলো পরোক্ষ ভাবে বিবর্তনবাদকে গ্রহন করার সেই নমুনা যেখানে তারা সারাক্ষন বোঝাতে চাইছেন বিবর্তনবাদকে ধর্মের সাথে মিশিয়ে পড়াতে হবে, রাজনৈতিকভাবে এদেরকে দুমুখো সাপ বলা ই বোধ হয় সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত হবে।
ধর্মের যুক্তিনুসারে এদের কথাগুলো প্রশ্নের অতীত, এর বিরুদ্ধে যেকোন ধরনের সমালোচনা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বেশীরভাগ ঐশী গ্রন্থগুলোতেই যারা এর বিরুদ্ধাচারণ করবে তাদেরকে ভয়ানক হুশিয়ারী দেয়া আছে, প্রায়শই দেখা যায় ধার্মিকগন এসব কল্পকাহিনীতে এতোটাই জড়িয়ে যান যে যারা তাদের এই মৌলবাদী মতের সাথে একমত পোষন করে না, তাদেরকে খুন, অত্যাচার এমনকি পঙ্গু করে দিতেও দ্বিধা বোধ করেন না। যেসব পরিস্থিতিতে তারা এধরনের কিছু করতে অপারগ হয়, যেমন এ্যামেরিকার কিছু উচ্চ শিক্ষিত ভদ্র এলাকায় সেখানে তারা আইনের আশ্রয় নিয়ে আইনের মুগুর দিয়ে বিজ্ঞানকে থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সত্যি হলো বিজ্ঞানের গবেষনা কোন স্থির হয়ে থাকা জড় বিষয় নয়, আর বিজ্ঞানীদেরকে তাদের গবেষনার পক্ষে যুক্তি প্রমান দাড় করাতে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়, যেখান থেকে নতুন সম্ভাবনার উদয় হবে। বিজ্ঞানীদের শিক্ষা, গবেষনা ও তথ্যের প্রতি যে উদ্দীপনা দেখা যায় ঠিক সেই রকম উদ্দীপনা মৌলবাদীদের মধ্যেও দেখা যায় লোককে বিশৃংখল, বিভ্রান্ত ও মিথ্যের দিকে নিয়ে যেতে। আমরা একটা চলমান এলোপাতাড়ি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীতে এসেছি এই তথ্যটি জানার পর পৃথিবীর প্রতি আমাদের দ্বায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। দীর্ঘ জৈব-রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়ার ফলে এক সময় প্রানের সৃষ্টি হয়েছে। যে কোন ধরনের অবিমৃশ্যকারীতা আবার এটাকে শেষও করে দিতে পারে। বিবর্তনের এই জ্ঞানই আমাদেরকে পৃথিবী, পরিবেশ কিংবা জীবনকে সম্মান করতে শিখায়। বিজ্ঞানীদের কিংবা মানবতাবাদীদের পরকালের নরকের ভয়ে কিংবা স্বর্গলাভের আশায় “নৈতিক” জীবন যাপনের দরকার নেই। যেহেতু কোন সৃষ্টিকর্তাই নেই, তাই সাধারন মানুষের নৈতিক জীবন যাপনের ভার তার নিজের উপর। স্বর্গ বলতে যেহেতু কিছু নেই, তাই জীবনের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আনন্দ উচ্ছাসে জীবন ভরিয়ে তোলার খুবই দরকার আছে, এবং যখন আমরা জানব কিভাবে আমরা এই সুন্দর জীবন পেয়েছি সেটাকে আরো বেশী করে উপভোগ করব। ডারউইন দিবস সেই জন্যই সমস্ত পৃথিবী জুড়ে উৎসব করার মতো একটি সেক্যুলার দিবস কারন এই দিনের মাধ্যমেই সমস্ত কুসংস্কার, বর্বরতা এবং মাথার উপর জোর করে চেপে থাকা অজ্ঞতার অবসান জানানো হয়েছে।

তানবীরা তালুকদার
০৩.০৬.০৮

সৃষ্টিতত্ত্বের গালগপ্প বনাম বিবর্তনের শিক্ষা

সৃষ্টিতত্ত্বের গালগপ্প বনাম বিবর্তনের শিক্ষা
মেহুল কামদার
অনুবাদক: তানবীরা তালুকদার
অনেক অনেক বছর আগে ভারতে আমার ছোট্টবেলার এক ঘটনা। আমি তখন আমার দাদাবাড়িতে। খুব কষ্ট করে আমার দাদা বাড়ি তথা তার চশমার শোরুম-এর ছাদে উঠেছিলাম। এমনি এমনি ছাদে উঠিনি, মনে ধান্দা ছিলো একটা। ভাবছিলাম, সেদিনের ইতিহাস ক্লাশে পড়ানো আর্কিমিডিসের একটা পরীক্ষা হাতে নাতে করা যায় কিনা। আসলে স্কুলের স্যার সেদিন আমাদেরকে আর্কিমিডিস কিভাবে সূর্যরশ্মির সাহায্যে “পার্শিয়ান নৌযান পুড়িয়ে” দিয়েছিলেন সে সম্বন্ধে পড়িয়েছিলেন। আর বলেছিলেন আমরা নিজেরাই চশমার কাচ ব্যবহার করে একই পদ্ধতিতে ছোট কাগজ পোড়াতে পারব। আমি দোকানে রাখা বিশাল বাক্স থেকে খুজে পেতে দশ ডাইঅপ্টারের একটি কাচ বের করে নিলাম এবং সেটা নিয়ে মাদ্রাজের তীব্র রোদ উপেক্ষা করে বাইরে চলে এলাম হাতে একটা শক্ত কাগজ নিয়ে। তখনও আমি স্কুলের পোষাক পাল্টায়নি, আমি প্রচন্ড মনোযোগ দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম কাচের ভেতর দিয়ে সূর্যরশ্মিকে কাঁচের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীভূত করে কাগজটাকে পুড়িয়ে দিতে। কিছুটা সময় অপেক্ষার পর আমি দেখতে পেলাম, কাগজের মাথায় যেখানে আলো পড়েছিল সেখানটায় একটা কালো দাগ পড়েছে, এবং একটা মৃদু ধোঁয়ার কুন্ডলী উঠছে। আলোক রশ্মির দ্বারা কাগজটা পুড়েছে। এটা আমার জন্য একটি দম বন্ধ করা মুহুর্ত - আমি কাচের ভেতরের রশ্মির সাহায্যে আস্তে আস্তে বোর্ডের উপড় আমার নাম লেখার চেষ্টা করছিলাম, প্রথম তিনটা অক্ষর লেখা হতেই আমি আনন্দে আমার হাতের কাপুনি এবং আমার উত্তেজনা টের পেতে লাগলাম। ঠিক সেসময় আমার মা আমাকে ছাদের লাগোয়া রান্নাঘর থেকে ডাক পাড়লেন, “মেহুল, তুমি এই রোদের মধ্যে ছাদে বসে কি করছ”? আমি মায়ের দিকে না তাকিয়েই সানন্দে চিৎকার উত্তর দিলাম, “আমি কাচ দিয়ে সূর্যের আলো দিয়ে কাগজে আমার নাম লিখছি”। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই মা দৌড়ে এসে খপ করে আমার হাত থেকে সব কেড়ে নিলেন। আমি হতভম্ব চোখে তাকিয়ে মাত্র জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম আমি কি কিছু ভুল করেছি, ঠিক তখনই আমার গালে কষে একটা চড় পড়ল। চড়ের সাথে বলা মায়ের কথাগুলোও এখনও আমার মনে আছে, যদিও গুজরাটি থেকে অনুবাদ করলে ভাষাটা অনেকটাই তার মাধুর্য্য হারাবে। তিনি আমাকে বললেন, “সূর্য দেবতা রেগে যাবেন”, আম সজল নেত্রে মাকে বল্লাম, সূর্য রশ্মি ব্যবহার করলে সূর্যদেব যদি রেগেই যেতেন তাহলে তিনি পার্শিদের বিরুদ্ধে গ্রীকদের যুদ্ধে তাদেরকে জেতার জন্য রশ্মি দিয়ে সাহায্য করতেন না। প্রায় সাথে সাথেই আর একটি চড় অবধারিত ভাবে গালে নেমে এলো। আমি বুঝতে পারলাম ধর্মীয় অতিকথা নিয়ে প্রশ্ন করা বিপদজনক - যা আমি সেই কিশোর বয়সে বুঝেছি অনেকেই তা হয়ত তাদের জীবন দিয়ে শিখেছেন।
তারপরও ধর্মকথা আমাকে প্রবল ভাবে আকর্ষন করে। মায়ের কাছে প্রত্যকে বার চড় খাওয়া মানেই ভারতের সংস্কৃতিতে দাদীর কাছে প্রত্যেকবার আদর পাওয়া। আমাদের দাদী যখন আমরা ছোট ছিলাম তখন আমাদেরকে গান গেয়ে ভোলাতেন আর যখন বড় হলাম তখন গল্প বলে ভোলাতেন। দাদীর বিশাল গল্পের ভান্ডারে আমাদের প্রত্যেকেরই পছন্দের আলাদা গল্প ছিল, এবং দাদী খুব খুশি মনেই সে সব গল্প আমাদেরকে বারবার শুনিয়ে যেতেন। দাদীর গল্প আমাকে এতোটাই মুগ্ধ করেছিল যে অনেক অনেক বছর পড়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়তে আগ্রহী হই। যাক সেটা অন্য আর একটি গল্প। কিন্তু যখন মুক্তমনাতে ডারউইন ডে’র উপর লেখা দেয়ার জন্য সবাইকে আমন্ত্রন জানানো হলো, আমি অতি সহজেই সেটিকে এড়িয়ে যেতে পারতাম এই ভেবে যে এই বিষয়ের উপরতো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমি পড়িনি। যে এ্যামেরিকায় বাস করে অতীতে ইহুদী-খ্রীষ্টানদের মধ্যে ধর্মের রূপকথাকে কেন্দ্র করে (যাদের অধুনা অবতার হলো “Intelligent Design” বা 'সৃষ্টির বুদ্ধিদীপ্ত অনুকল্প') স্মরন রাখার মতো যুদ্ধের কথা জেনেছি, এবং তাদের সে যুদ্ধ এখনো নানাভাবে দেখছি, বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির আলোকে এই সৃষ্টিতত্ত্বের উপকথাগুলো নিয়ে আলোচনা করাটা আমার জন্য বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
বিভিন্ন দেশের শত শত উপকথার নানা রকম তথ্য দিয়ে শত শত ওয়েব সাইট তৈরী হয়েছে। যেমন আশা করা যায় কেউ কেউ আছেন ধর্মের গল্প গুলো শুধু শুনেছেন এবং সেই শোনা গল্পগুলোই মানব জাতীর জন্য লিখে ফেলেছেন, আবার কারো কারো কাছে হয়তো এই গল্পগুলো শুধুই উপভোগ্য কল্পিত গল্প মাত্র, বিভিন্ন যুগের গল্প গুলোকে এক সাথে জোড়া দিলে মানুষের চিন্তা ভাবনার বিকাশের স্তরগুলো পাওয়া যায়। তাদের কথানুযায়ী ধর্মের উপকথা থেকে মূল বক্তব্য নেয়া প্রয়োজনীয় বলে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এমন কোন আজগুবী ওয়েব সাইট থেকে গল্প নেবো যারা এই গল্পগুলোকে সত্যি বলে প্রমান করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। কোন নিরশ্বরবাদী কিংবা স্বাধীন চিন্তা ভাবনার ওয়েব সাইট থেকে যদি তথ্য সংগ্রহ করি তাহলে হয়তো তাদের তথ্যে লেখায় আমার নিজস্ব চিন্তা ভাবনার ছাপ পড়ে যেতে পারে। আর যে ওয়েব সাইট গুলো বিশ্বাস করে যে এই গল্প গুলো ভবিষ্যতের কোন একটি বিরাট ইঙ্গিত বহন করছে তারা অনেক রঙ চঙ দিয়ে সেই গুলোকে বিস্তারিত ভাবে পরিবেশন করেছে।
ইহুদী-খ্রীষ্টানদের মিথ দিয়েই শুরু করি। বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন যাকে এই সংখ্যাটি উৎসর্গ করা হবে তার মতবাদের সাথে প্রথমেই যাদের মতবাদের সরাসরি দ্বন্দ্ব - তারা হলেন মূসা- খ্রীষ্টের অনুসারীরা। বাইবেলের সৃষ্টি তত্বের জেনেসিস অধ্যায়টি মনোযোগ দিয়ে পড়লে এটি খুব সহজেই বোঝা যায় -
শুরুতেই স্রষ্টা প্রথমে স্বর্গ তৈরী করেছেন আর পৃথিবী। পৃথিবী তখন ছিল আকারহীন এবং অকার্যকর একটা জায়গা। এর মুখায়ব ছিল অন্ধকারে ঢাকা। স্রষ্টার চিন্তা তখন পানির দিকে ঘুরল। স্রষ্টা তখন বললেন, আলো হোক, জগত আলোয় ভরে উঠল। স্রষ্টা আলো দেখে মুগ্ধ হলেন, তিনি অতঃপর আলোকে অন্ধকার থেকে আলাদা করলেন। আলোকে স্রষ্টা নাম দিলেন দিবা আর অন্ধকারকে নাম দিলেন রাত্রি। আর সন্ধ্যা এবং সকাল হলো দিনের প্রথম সূচনা। তারপর তিনি বললেন সমুদ্রের ঠিক মাঝখানে একটি মহাকাশ তৈরী হোক, এবং এরপর পানি পানি থেকে পৃথক হোক। এরপর তিনি মহাকাশ তৈরী করেন, তারপর তিনি মহাকাশের উপরের পানি থেকে নীচের পানি আলাদা করেন। এবং এভাবেই এই জগতের সৃষ্টি হয়েছে।
অ্যাপাচি রূপকথার সাথে এই রূপকথার গল্পের পার্থক্য কতো :
শুরুতে কিছুই ছিল না, না পৃথিবী, না আকাশ, না চাদ, না সূর্য, শুধুই অন্ধকার ছিল চারিধারে। হঠাৎ করে অন্ধকার থেকে একটি হালকা গোলাকার সমতল একটা চাকতি বেরিয়ে আসল, যার এক পাশ হলুদ আর অন্যপাশ সাদা, মধ্যকাশে ঝুলন্ত অবস্থায় এটিকে দেখা গেলো। সেই পাতলা গোলাকার চাকতির মধ্যে একজন শুভ্র সফেত পোষাক পড়া দাড়িওয়ালা স্রষ্টা বসে আছেন । যেনো এইমাত্র তিনি লম্বা ঘুম থেকে দুইহাতে চোখ মুখ কচলে উঠে বসলেন।
যখন তিনি অসীম অন্ধকারের দিকে তাকালেন, উপড়ে আলো জ্বলে উঠল। তিনি নীচের দিকে তাকালেন সেখানেও আলোর সমুদ্র তৈরী হলো। পূর্ব দিকে তিনি অত্যন্ত দ্রুত উজ্জল হলুদাভ প্রত্যুষ তৈরী করলেন। পশ্চিম দিকের চারপাশ জুড়ে ছড়িয়ে দিলেন অনেক রঙের আনাগোনা। নানা রঙের মেঘও ছিল অবশ্য।
আর কারা এসব রুপকথায় বিশ্বাস করে বলে আপনি ভাবছেন :
লক্ষ্য লক্ষ্য অগনিত বছর ধরে যে অন্ধকার ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, যখন স্বর্গ - মত্য কিছুই ছিল না, শুধু ছিল সীমাহীন স্বর্গীয় বিধি বিধান। তখন দিন আর রাত ছিল না, সূর্য বা চাদ ছিল না। যেনো স্রষ্টা সীমাহীন এক অতল নিদ্রায় তলিয়ে ছিলেন। সৃষ্টির কোন সংজ্ঞা ছিল না, কোন বানী ছিল না, আলো - বাতাস কিছুই ছিল না। জন্ম, মৃত্যু বা পরকালের জীবনের কোন অস্তিত্ব ছিল না। কোন মহাদেশ, কোন অঞ্চল, কোন বহতা নদী বা সাত সমুদ্রের সীমারেখা ছিল না। ইহকাল - পরকাল, স্বর্গ - মর্ত্য, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সময়ের কোন কিছুরই কোন অস্তিত্ব ছিল না। জন্ম - মৃত্যু তখন আসেওনি, ফিরেও যায় নি।
(এটা শিখ সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে নেওয়া হয়েছে)

(চলবে)
তানবীরা তালুকদার
৩০. ০৫. ০৮

১৪.৬.০৮

মুজিব ইরম বিরচিত দীর্ঘ কবিতা :: কবিবংশ


মুজিব ইরম বিরচিত দীর্ঘ কবিতা

কবিবংশ

এ পদ্য তোমার জন্য - যে-তুমি ডেকেছো ভোর-রাতে। এ পদ্য তোমার জন্য যে-তুমি ডাকিবে সন্ধ্যা-রাতে।

যে-বাঁশি বাজিলো ধীরে হিয়ার ভিতর দিনকানা, রাত্রিকানা ভুলে থাকা দায়। কে তুমি বংশীবাদক এই দেহভাণ্ডে থাকো, কী নামে বাঁশির ছিদ্র থমকে থমকে ওঠে ? তুমি বুঝি একি নামে জগতে বিরাজো ? তুমি বুঝি চেনা নামে আরিপরি খোঁজো ? এত যে বাজলো নাম এত এত লয়ে, এত যে ছড়ালো নাম পাশে কিংবা দূরে, কী আর হয়েছে তাতে বলো দেখি বলো ? কেনো তবে দিনেরাতে নামেনামে ডাকো ? এমনি মারিছো বাণ, জানি না রে আজ কোন বা বাঁশের বাঁশি ওষ্ঠে বেঁধে রাখি ! অবেলা হয়েছে বেলা, কিসে ভয়-ডর ? অপথে উঠেছে ধ্বনি, সুরে ভাঙ্গে ঘর।...কেনো যে বুঝোনি সেই, ফেলিয়াছো দিন যেই, অপথের মাঝে। ডেকেছে কতো না ছায়া, এনেছো অচিন মায়া, কাঁটাবিদ্ধ তা যে ! সেই কবে যাত্রাদিনে, রেখে আসা বৃক্ষ-মূলে, ধরে রাখি মন। এত পথ হেঁটে এসে, পক্ষিকুল ভালোবেসে, আগলে রাখি বন। ভুলেও থাকি না আজ, সেই যে দিয়েছো কাজ, দেহভাণ্ড ভরে। যা কিছু গিয়েছে ধীরে, পাশ কেটে চোখ বোজে, কান্না অবসরে। এ-মনে হয়েছে রোগ, তারে তুমি বলো সুখ, মনে শান্তি পায়। তুমি এ-সংসারে দেবী, অধমের মন সেবী, ভরেছো আশায়।...হেঁটে হেঁটে আজ বুঝি ক্লান্তি নামে পথের ধুলায় তবে কি রে মন তুমি শস্যবিদ্যা ভুলেছো হেলায় ?...ডেউয়া ফলের জলে মুছে দেই কতো হস্তলিপি, আরো কতো নিরাকার তৈরি করি বালির সমাধি। কাটাকুটি জলেস্থলে কয়লায় ধুয়েছে দেয়াল, হাওয়ায় ভেসেছে কতো মগ্ন থেকে রাখিনি খেয়াল। থুতু ঘষে নাই হয় কতো কিছু সরলে গরল, পাতাপত্রে আঁকাআঁকি বুঝিনি তা বয়স তরল। আর কতো বেহিসাবী আর কতো ওলট-পালট শস্য কি ভিজেছে রো,ে জেগেছে কি পুবের হালট ? জানা নাই, নাই শোনা, প্রশ্নে প্রশ্নে করি দোনোমনো, বয়স বাড়েনি আজো স্লেটে লিখি হাঁটু ভাঙ্গা তনু।...কী মাত মাতিনু আর ভুলে যাই কথার ধরণ, যতনে লুকানো দাগ স্পষ্ট হয় ব্যথার স্মরণ। মুরব্বি মহান যারা তারা দেখি বলাতে অসীম, জগত-বাখানে তারা তুচ্ছ করে মাতের আফিম। আকারে প্রকারে খুলে মোহ-ভর্তি কথার সিন্দুক, মোহমুগ্ধ সুরে দেখি তুষ্ট করে যতেক নিন্দুক। গোষ্ঠী ও ঘরের শত্র“ গুণমুগ্ধ হয়তো পরের, তুষ্ট হয়ে ফিরে চলে বক্ষভরা কুহক সুরের। এসব কমতি নিয়ে মাঠে কেনো এসেছিলে তুমি ? দিনেদিনে আরো বেশি কথা বন্ধ বোবা-দগ্ধ-ভূমি। খুঁজে খুঁজে নি-মাতের পদ ছুঁয়ে নেই মুরিদানি, বংশের কলঙ্ক-কালি মুছে দিতে আসে কোন জ্ঞানী ?...বাছনা বেয়ে জেগে উঠি শিমের নিঃশ্বাস। দোআঁশ মাটির টানে অন্তর অধীন, প্রাণ ঢেলে অপ্রাণের বাড়াও উত্তাপ। আমাকে সজীব করোওগো অগ্নিময়ী, লকলকে প্রাণবায়ু সাকারে আকার, ফোটে পুষ্প-ফনা-মদ মত্ত চুপিসারে, বিষবাষ্পে রংহীন পাতা-পুষ্প-লতা, বাখাল বাঁশের আগা পেঁচিয়ে সঙ্গীন, সবুজে অবুঝ ঋণ আভোগ আফিম। কে ধরে লতানো লতা ঝাঁকে মেশা কুঁড়ি ? এতটা মোহন ডাকে বায়ু বাষ্পানলে, কঞ্চিভরা প্রাণবায়ু তোমার অধীন। এই পত্রে লিখা হোক বাঁচা-মরা-ঋণ, মাচাং ভরিয়া ফোটে তুঁহু রাঙ্গা দিন।...বারমাসে তের ফুল ফুটে থাকে ডালে, নগরে নগরে ঘুরি নিজস্ব অনলে। বারমাসে তের ফল ধরে থাকে ডালে, তবুও কিসের নামে অশান্তি বিরাজে ? নবান্নে আসিও তুমি-তুমি সেই তাপ, তাড়িও দেহের গুণে বিষের প্রলাপ। বারমাসে তের রূপ অগ্নিফোটা রাত, আমাদের ঘর হোক পদ্যপারিজাত।...এ-পদে কি মিশেছে আজ শুরুর সঙ্গীত ? কোথায় পথের শুরু, কোথা সেই গীত ?...বাজিল মুরলী ডাক দূর-দূরবাসে, এ-বাঁশি পদের নামে ঘরহীন করে। অন্তরে সরল বাঁশি গরল উগারে, কুলবান কুলহারা নাশিল পরাণে। মাগি ভিক্ষা দ্বারে দ্বারে যদি বা বিরল, সুরের কদম্ব-তলে মিলায় অতল। নগরে নগরে ঘুরি শব্দসঙ্গ যাচি, তবু কি কালার বাঁশি শুদ্ধ করে আঁখি ? যারা যারা এই পথে ধরেছিলো সুর, তারা কি রে সেই তাপে ধরে আছে ঘোর ? আর কেবা জানে বলো, আর কেবা জানে-গোবিন্দ দাসের মন জানে বুঝি মানে ? ইরমে কান্দিয়া কয়-ওগো অগ্নিময়ী, উঠেছি তোমার নায়ে ধরো আশাবরী।...কে করিবে দূতিয়ালি হায়, কুলাচার্য ইরমের বাণী ! গোষ্ঠিকথা লিখিয়াছি যতো কুলজি-গ্রন্থের অভিধানে-এই সেই কারিকা পুরাণ, রচিবারে মহাবংশাবলী, আমাকে কি কুলপতি দলে, কবিবংশ নাম ধরিবারে, তুলে নিবে তুমি কবিশ্বরী ?...বাতাসে উড়িছো তুমি শিমুলের তুলা, নিশ্চয় রহিলো বন্ধু নিতি আত্মভোলা। বাতাসে উড়িছো তুমি আমনের নাড়া, আসে না আসে না বন্ধু-কেনে এত তাড়া ? বাতাসে উড়িছো তুমি ঝরে-পড়া ফুল, কেনো এত তার নামে ওঠে হুলুস্থুল ? এক নামে ডাকো তারে এক নামে ডাকো, আসিবে আসিবে করি বুকে আশা বাঁধো। নতুন নামের গুণে যদি দয়া হয়, এ-ঘরে চান্দের আলো হয়িবো উদয়। কেনো এত ভাবো তুমি কেনো এত ভাবো, তোমার সোদর ভাই আইনুদ্দীনে কয়-বন্ধুয়া আসিবে করি মোর মনে লয়।...ভিজেছে পাহাড়, পাতাবৃক্ষফুল, এমনি বারিষা মনে কতো দূরে তুমি থাকো ওহে জলেশ্বরী ? নগরে নগরে বুঝি আর-জন্মে যোগি হয়ে ঘুরি ? কবে থেকে তার শুরু-বলো তবে বলো ওগো গেরুয়া ধারিণী, ও আমার যুগল যুগিনী !...কিন ব্রীজ পাড়ি দিয়ে যে-দিন নগরে তুমি অজু সেরেছিলে, লিখিয়েছিলে মুরারি চাঁদে নাম, তোমার অপেক্ষা করে আলী আমজদ-এর ঘড়ির কাঁটায় সময় আটকে ছিলো বহুদিন-সেই থেকে তুমি বুঝি পাখিডানা পেলে ? এত এত পাখি পুষে কাটালে প্রহর-তোমার নিজস্ব পাখি বংশ ভুলে কেনো তবে অ-রূপ ধরেছে ? তুমি তো বৈতল নও জালালী নগরে-এ-পাখি তোমারে চিনে-নামের দোহাই, কেনো তবে উড়ে আসো, ভুলে থাকো মনু ও খোয়াই ?...যেখানে যাওয়ার জন্য একদিন নেমে আসি পথে, যাত্রা কি ফুরালো মন, যাত্রা কি ফুরায় কোনোদিন ? এত পথ এসে দেখি যাত্রা আজও ফুরালো না, হায় ! কোথাও আচমকা শুধু তোমার স্মরণ রেখা এঁকে, ভুলে থাকি কথাগুচ্ছ, দিনে দিনে ক্লান্তি শুধু বাড়ে। শিখিনি কিছুই বুঝি ? বৃথা বুঝি নামাবলি জপা ? কে বলে এমন কথা-বাড়েনি কি চক্রহারে দেনা ? যে-চারা রুয়েছি সেই ফেলে আসা বিষের নগর-তা-ও কি ফলেছে বৃথা, ধরে থাকি বিম্ব-কাক-ফল ? নতুন নগরে লগি গাড়া হলো বেশদিন শেষে, সেখানেও বৃক্ষ আজি নিজনামে পুষ্পধ্বনি ফোটে-তুমি কি বাজাও বলো নগরে নগরে এই নাম ? গড়ে তুলি তিলে তিলে দেহচর্বি জ্বেলে কবিবংশ, হয়েছি অনেক শেষে কাদাসিক্ত শুভ্র রাজহংস।...এ-বংশে জন্মেছে যারা, ভুলে যাই তারা কারা, আর যতো পন্থহারা নাম-তাদের চরণ-মাঝে বাঁশুরি-বাদ্য কি বাজে, সেই নামে সিদ্ধ সাজে ধাম ?...একদা বংশের বাতি জ্ঞানদাস জ্বালে, বিদ্যাপতি-বংশগীত রাধা রাধা বলে। চণ্ডিদাস জ্ঞাতি হয় এই যমুনায়, পদে পদে ওঠে সুর কৃষ্ণ নাম গায়। আমি কি বংশের বাতি এই তরিকায়, ক্ষমা কি করিবে আদি গুরু কাহ্নপায় ? এমন জাতের কথা কভু নাহি শুনি, নিজবংশ ছেড়েছুড়ে পরবংশ ধরি। এমন বাঁশির কথা কেনো তুমি তোলো, কদম্ব তরুর তল নগরে বিচারো ? আড়বাঁশি ছিদ্র-কানা কবি কবি বলে, এই শব্দ ঘর-কানা যমুনার জলে। এই দেহ রাধা সাজে এই দেহ গীত, এই মন কানু বিনা বুঝে কি সঙ্গীত ? এমন লজ্জার ভার কার কাছে রাখি, বেনামে নামের ধ্বনি পরনিন্দা মাখি। সকলে শুনিলো ডাক ভুলে গেলো সবি, পশিলো হিয়ার মাঝে শব্দ-বাক্য-ছবি। নিরানন্দ থাকি শুধু নিরানন্দ থাকি-ভুলে যদি সাদাপাতা পড়ে থাকে খালি ? এই ভয় ওঠে মনে এই ভয় ওঠে, না-জানি গীতের ঢেউ পদে নাহি জুটে ! শ্রী ইরম ঘর হারা বৈতল স্বভাবে-কে এসে গাইবে গীত এমন অভাবে ?...এ-দেহ রাধিকা রূপ-ছিদ্রবাঁশি-এ-দেহ কানাই, শব্দ-ব্রহ্ম-সখা তুমি-আড়বাঁশি-নিয়ত বাজাই। এ-বংশে হাছন কাঁদে-চরণ ধরিতে তার সাধ, এ-বংশে করিম কাঁদে-ওরে, পাইমু নি তার লাগ ! শাহনূর দগ্ধ হলে চাইর প্রহর রাত্রি ফানা হয়, বানেশ্রী ছাড়িলে কাঁদে মনোপাখি বন্ধু সমুদয়। যমুনা যমুনা সুর-বাঁশি তবে কার নাম জপে, ধামাইল উঠেছে কি দূরে রাধারমণের নামে ? এ-বংশে আমি কি আছি-আমি কি ছিলাম কোনো কালে ? আমি কি থাকিবো রোজ-সহি দিলে-চরণে নূপুর-ধ্বনি হয়ে ? শা’নূর আমার ভাই বানেশ্রী বিচারে-ত্যাগিলে কদমহাটা নালিহুরী কাঁদে।...পঞ্চবটী বনে বুঝি পাখি ডেকে ওঠে, কবির ঘুমন্ত গ্রামে মগ্নছায়া জোটে। লতায়-পাতায় জ্ঞাতি আদি কবি নাম, কুলজি রচিতে বসি তাহাকে প্রণাম। আরেক প্রণাম আমি তোমাকে জানাই, যে-তুমি হালতী হলে নিরলে জাগাই। পদে পদে ওঠে নাম পদে দেখা পাই, কোন সুরে বন্ধু ভজি তুমি বলো চাই ? কী করে অধরা ধরো পন্থধারা পাও, কী করে বন্ধুরে খোঁজো আমারে বাতাও। ঘরের বাগিচা-পাশে ভ্রমর-বাখান, তোমার কণ্ঠে জাগায় দেহাতি আজান। ডাকিলো ভজিলো দিলে ধরে দমে-দম, তোমারে খুঁজিলো এত কেনো যে ইরম ! তুমি কি দিয়েছো ভর, তুমি কি অভয় ? তবে তো কপালে কিছু ঘটিবে নিশ্চয়।...এ-দেহ ভুলে থাকি, এ-দেহ পুষে রাখি, অন্তর অধীনতায়, লুপ্তনাম ভোরে হাঁকি, যা কিছু রোদে মাখি-বলো, তা কি রক্ষা পায় ?...পিরাকী-ফকিরী ধরে এ-বংশে লিখেছো যে-নাম, ভালোবেসে এই রাতে বলে রাখি তোমাকে প্রণাম।...তোমাকে রাখিয়া দূরে বাঁশি আর বাজে না গো রাই ! সোয়া ও চন্দন ঘষে দূরদেশে রাত্রি ঘন হয়, দেখে এ-নন্দন, উঠে যে কান্দন, গীতের মহিমা মনে হয়। যাতি-যূথি-চম্পাবতী, ভোর নামে জংলী নদী মনু ও দলাই, এত যে প্রণাম, শুনিয়া সুনাম-আমারে কি প্রাণ বন্ধুয়ার মনে নাই ?...নিমায়া-নিঠুর অতি কেনো থাকি দূরে ? যাতি-যূথি-পুষ্প গাঁথি মালতি মালায়, বিনিসুতা আড়ি দিয়ে ভূতলে গড়ায়। সোয়া ও চন্দনে ঘষি দেহ ফর্সা করে-তুমি নি বলিবে মন কারে বিচারিলে ? পথে পথে কোন ধন হাছিল করিলে ? প্রশ্ন কেনো করো তুমি ওহে মূঢ় মন, তোমার কপালে তীর বিঁধেছে কখন ? যথাতথা যাও তুমি নিজের গরজে, কাজা করো ভোর-সন্ধ্যা-নিশুতি-ফরজে।...এ-আয়াত রচিয়াছি তুমিহারা দিনে, এদিলে জিকির ওঠে সিনাভরা ওমে। এই হাত ধরো তুমি এই হাত ধরো, অপথে জীবন গেলে সোজা পন্থ ধরো। কে দেবে পথের দিশা, সে যে আজ দূরে-মনেতে বিষের ঝড় নেমেছে অঘোরে।...তারে তুমি দেখে রেখো ও আমার নিমের বাতাস। দখিনা বাতাস আসে, কে করে নিষেধ তারে-পাখি, পাখিরে আমার, উঁচা ডালে বসে তুমি কেনো ডাকো দুপুরবেলায় ? কতো মন পুড়ে গেলো-কোকিল-স্বভাবে কেনো, রাত্রি তুমি ডেকে আনো ? কান্নাসুরে দুপুর এলায় তার চুল, ঘনকালো-শিমুল তুলায়। বাউলের পাখি তুমি, বিরহে তোমারে নমি, সে যেনো শোনে না এই আদিম শিলায়, কী করে ধরেছে ক্ষয়, জলে ভিজে, রোদে পোড়ে, ভুলে থাকা বৃষ্টি-জলোচ্ছ্বাস। কে আজ আনবে তুলে, হাহাকার দূর করে-এমন আলোয় ?...শিখেছি তোমার কাছে পাল তোলা নাওয়ের স্বভাব। সুর, তা-ও তুমি দিলে বেসুরের মাঝে। লইবো না কেনো তবে মুরিদী শপথ ? তা-ও যদি তুমি দাও-না-হয় আমাকে আজ গীতেই ভাসাও।...আর কী এমন দাবি কহিবার আছে ! মিসকিনেরে দিয়েছো লিল্লা ছায়াঘন রাতের সৌরভ। এইবার-ছদকা করো দেবী চক্ষুভরা ঘুম, এই এতিম ফকির দাঁড়িয়েছি তোমার দরজায়। খতমে সেফার গুণে মনে যদি বরিষন নামে-ছদকায়ে জারিয়া ভেবে দান করো মনের জৌলুস। দানে জানি কমতি নাই-কবে তুমি কাঙ্গালেরে খয়রাত করেছিলে দেহভরা ঘুমের গৌরব ?...গোষ্ঠীভরা এত এত মৌলানা-হাফেজ, এত এত বুজুর্গ-আলেম, বিজ্ঞ মুহাদ্দিস-সকলেই পেয়েছে কি তোমার রহম ? সেফা করো ওগো দেবী-ভিক্ষা মাগে অন্ধ কবিয়াল, জগত ভ্রমিয়া শেষে আর কেবা হয়েছে মাকাল !...তোমার বাড়িতে এই চৈত্রমাসে ফুটে আছি অস্থির মুকুল। নিমগাছে ধরেছে কি নয়াপাতা ছায়াছিদ্র ফুল ? আমলকি গাছে বুঝি রাঙ্গাপাতা হয়েছে ব্যাকুল ? তার পাশে ছিলো সে যে লিচু আর পড়শী বকুল-গোলাপজামের ফুল শুভ্র রূপে বেঁধেছে কি চুল ? বন আলো জাগলা হলে গৃহকাজে শান্ত হয় মন-আমের বউলে বুঝি ডেকে আনে ভ্রমর-গুঞ্জন ? তোমার বাড়িতে আজ নিম হয়ে ফুটে আছি বনাজী কুসুম-তবু তুমি ভয়ে কেনো নিজেই হয়েছো এত অস্থির অঘুম ?...উদ্ধত ভঙ্গিমা নিয়ে জেগে ওঠে দুধমরিচের ডাল-চৈত্রমাসি রোদে। এমন গর্বিত গ্রীবা-কম্পন বিধুর মন মজে থাকে শুভ্র ইশারায়। রুয়েছো মনের টান-তুঁতফল ডেকে আনে পক্ষিকুল, নামেতে ইরম। উঠানে উঠানে থাকি নীল মরিচের গাছ, বারোমাসি বেগুনের ঝোপ। একবার শুশ্রƒষায় জলছিটা দাও-এ-জীবন ধূলিশূন্য হোক, অপেক্ষা ঝরুক।...তুমি এসে বসে থাকো আজ-সময় সামান্য অতি হায়, আজ চন্দ্র অস্ত যাবে ঠিক-তোমার মহিমা-রাঙ্গা পায়।...দীর্ঘ-দীঘির সমান নীরব ক্রন্দন-তুমি কি দেখোনি প্রাণ, উচাটন নিশিভর পতিত বাথানে ? কিসের রাখালি তবে-ঘাসে ঘাসে কিসের বন্ধন ? দূরে দিন উঠিয়াছে বিষণœ-বিপুল-মন তুমি ভিজে থাকো-এ-দেহে বিঁধেছে আজ রোদের ত্রিশূল। বিস্তৃত বিরাণ-মাঠে কার নামে জয়ধ্বনি ওঠে ? দূরের কুটুম ডাকে, এই নামে পুষ্পধ্বনি ফোটে।...তোমার নিমের ডালে ধরে আছে নামহীন কুঁড়ি, তারপাশে ফোটা-ফুল আর কিছু পাতা-পুষ্প-ডাল, তারা কি দুপুর-বেলা রোদে ভিজে হয়েছে বেহাল ? চৈত্রের এমন রূপ গাছে গাছে আকাল সুন্দরী। আহারে গর্জনশীল ভয় নিয়ে আসো কেনো তুমি ? দূরবাসে পড়ে থাকি, একা থাকে আমার ঘরণী। দূরত্ব প্রগাঢ় হলে কেঁপে ওঠে বিরহ ধমনী-কেনো তবে এই বেলা কাঁপে পাতা কাঁপে বৃক্ষ-ভূমি ? বন্ধ করো ওহে মেঘ অচিরা- তোমার নর্তন, করেছে আদেশ এই মধ্যরাতে পদগ্রস্থ কবিতুলে আনো শান্ত ঢেউ, হোক তবে সুরের মন্থন, আঁকা হবে মৃদু-মন্দ হাওয়া-রাঙ্গা সুখরাত্রি ছবি। আমার রমণী দূরে আঁকে দিলে ঘর-প্রতিচ্ছবি, তার তরে মধ্যরাতে তুলে রাখি দেহের চন্দন। এই ঘরে আছো তুমি, এই ঘর তোমার স্মারক, তোমার চরণ-জলে দূর হোক মারি ও মরক।...তুমি যে ডেকেছো কাছে অচিন প্রলাপে, তুমি যে ঘিরেছো ধীরে বিভূর বিলাপে-কী করে ধরেছি বক্ষে জলে-ঢাকা রাত, প্রলাপে-বিলাপে তুমি এনেছো প্রভাত। আঙ্গিনা ভরেছে ধীরে রাত্রি-ফোটা ফুলে-আর কি কাটাবো পাশ স্পর্শ-মায়া ভুলে ? তুমিই ধরেছো সখি এই দুই হাত, এ-জীবনে বেঁধে রাখি সুরের রাকাত। একদিন ভুল করে জেগে দেখি রোদ, পড়ছে অচিন রাগে অধরা দরুদ। সেই থেকে মনে ধরি দিলে থাকি বাঁধা, তোমার হাসির নামে শুধু সুর সাধা। তুমি যে থাকিবে পাশে মোহমুগ্ধ দিনে, আমাকে বাঁধিও তবে জন্মমৃত্যু-ঋণে।...যা কিছু একদা ছিলো সমান বয়সী, সেও বলে নির্দ্বিধায় গম্ভীর হয়েছি। তুমিও পরেছো শাড়ি স্বর্ণলতা নাম, কেনো যে আড়াল করো বিদগ্ধ প্রণাম। সন্ধ্যা হতে বাকি নাই, কে আজ হাঁকায় ? ধরে আছো এই হাত শান্ত যমুনায়। ভুল সুরে ভুল পথে হয়েছি চাতক, আসন্ন শিশুর নামে রচিও জাতক। যদি চায় ক্লান্ত পাখি ছায়ার আশ্রয়, পাতার মহিমা ধরো-ডালের অভয়। কতো নাম মুছে গেলো কতো নাম ভাসে, এই বার্তা গীত হোক খড়ে আর ঘাসে। এই বংশ গীত হোক-কবিবংশ গীত, তুমিও ধরিও হাত-বাজুক সঙ্গীত।...এ-এক বংশের গান, যে-সুরে ধরেছে মান, মিয়া মালহার রাগে। ভুলে গেছি দিনকাল, যতনে বিরাগে প্রাণ, শুধু বিরজনে জাগে। কেনো যে ভুলেছি আজ নিজস্ব-জগত-এ-পথে কি ধূলি ওড়ে শস্যের শপথ ? কেনো তবে এসেছি এ গন্তব্য সীমায়-বলো তুমি ধূলিপত্র শস্য কোথা হায় !...চৈত্রের তাণ্ডব শেষে তপ্তদিনে নিমেষে নেমেছে-বোশেখের সদ্যজলে স্বচ্ছতোয়া ঘাসের প্রপাত। উজান স্রোতের প্রেমে যুদ্ধে কাঁপে দেহজীর্ণ মিন-এমন কাতর দেহে সইবে কি তোড়ের আঘাত ? ছিলো তার নিস্তরঙ্গ কোনো এক জলার বসত, ডেকেছে তর্পণ দিনে জলসিক্ত উজানি সাকিন। পাথরে পাথরে ওঠে যাত্রাধ্বনি নিথর নিক্কণ, কে তবে দেহাতি ডাক গেয়ে ওঠে-আশা বড়ো ক্ষীণ ? পরে আছি রাঙ্গাবাস দূরান্নয়ী মিন যথা দশা, যাত্রী সহচরে যারা ক্লান্তি ধারি উজান সঙ্গীন। শুনিয়া দেওয়ার ডাক মর্মে গাঁথি নব্য জলাভূমি, একাকী উজান গামি থাকি রোজ মেঘের অধীন। আছো কি তুমিও পাশে, যে তোমার করি আরাধানা ? উজাইয়ের মাছ জানি স্থলস্রোতে করিও ভজনা।...তোমাকে রেখেছি, অজানা ডেকেছি, এসেছি এত যে দূর। ভুলে-ভালে দিন, হয়েছে বিলীন-তবু কি ভাঙ্গিলো ঘোর ? গুহাগাত্রে নামাবলি, এঁকেছিলে তুমি বুঝি, জন্মে-জন্মে এই পথে, তারে দেখি তারে খুঁজি। ভুলে-যাওয়া নাম ধরে, যে ডাকিতো ঘরে ঘরে, ফুটে ফুল পন্থহারা যতো-তুমি না ভজেছো তারে, কেনো তবে দোলাচলে, নিজ-ছায়া ভেবেছো আহত? দূরের অতিথি হয়ে যেই গাই নিজগুণগান, এখানেও বংশ-মাঝে ফুটে দেখি অবুদ্ধ বাগান।...বন্দনা করেছি দিন-যে-দিন হয়েছে ভুলে কেবলি আহত, যা কিছু হয়েছে ঋণ-তুলে রাখি মধ্যদিনে শিরদাঁড়া নত। এ-বংশে দিয়েছি বাতি, খুঁজে আনি আঁতিপাতি, মূলসুদ্ধ আধা-অন্ধকার। তুমি এসে বসো পাশে, তোমাকেই নৌকা ভেবে, করি আজ শব্দ পারাপার।...পারাপারে দিন যায় পারাপারে রাত-তুমি কি বেভুলে তারে পরাও প্রভাত ? জেগে জেগে রাত যায় ঘুমে ঘুমে দিন-চক্রবৃদ্ধি হারে বুঝি বাড়ে শুধু ঋণ !...আলো-বিদ্ধ রাত্রি নামে কাছে। ডানা নাড়ে িসগ্ধ সুরে, কী যে রাত কী যে ভোরে, জন্মদাগ ঋণ পড়ে আছে। যদি থাকে মনঃস্তাপ, না করিও ভুলে মাফ, বংশ রক্ষা কুল রক্ষা রেখেছি অধীন। ভেলকিবাজি দেখে-টেখে, অযথা গন্তব্য রেখে, ঘুমঘোরে পড়ে থাকি, বেহুদা যেদিন। এ-দেহ ভুলে থাকি, এ-দেহ পুষে রাখি, অন্তর অধীনতায়। লুপ্তনাম ভোলে হাঁকি, যা কিছু রোদ মাখি, তা কি রক্ষা পায় ? মধ্যঘোরে তুমি উঠে, ডাক দিলে নিদ্রা টুটে, এ-নিদ্রা লখাইর বাসর। কী করে ভাঙ্গিবে ঘোর, এ-কর্ণে বিঁধেছে সুর, এ-চক্র নিজস্ব আছর।...পথে পথে হলো দেখা, তুমিই দিয়েছো ব্যথা, আবার নিয়েছো বুকে তুলে। ডেকে ডেকে নাম ধরে, এ-নামের শান্তি ঝরে, একদা জাগিও সন্ধ্যা হলে। তোমাকে ডেকেছি ভোরে, অনেক পৃথিবী ঘুরে, তুমিই দিয়েছো যতো তৃষ্ণা-নিবারণ। কেনো তবে এই নামে, তৃষ্ণা জাগে বারেবারে, তোমার নামের সুরে কণ্ঠ আহরণ।...লিখি রোজ পদ যতো তোমার নামের, যদি কিছু হয় ভুল, ছিন্ন করি জাতিকুল, ক্ষমা করে দিও তুমি বিক্ষিপ্ত দিলের।...আজ দিন ভালো লাগে, আজ দিন চেনা লাগে, তুমি বড়ো হাসি-হাসি তাই। কাল দিন ভালো রবে, কাল দিন নয়া হবে, তোমার চোখেতে টের পাই।...পুষি অন্ধ আঁখি, ভোরে জাগা পাখি, বাঁধি সুরের রাকাত। তুমি কি ধরিবে, এ-হাত বাঁধিবে, যদি মিলায় সাক্ষাৎ ? সেই সব কথা, ছিলো যথাতথা, বলে কাটাবো প্রহর। তুমিও শুনিবে, এ-সুর ধ্বনিবে, গাবে কীর্তন-আখর। তুমিও জ্বালিও, বংশের চেরাগ, এই মায়ামগ্ন-ঘরে। তুমিও পুষিও, বসন্ত বেহাগ, যতো বৃষ্টি-ঝঞ্ঝা-ঝড়ে।...ধরে আছি বংশবিদ্যা, আমাকে বাতাও তুমি এমন তরিকা-ম্লান করে পৃথিবীর তাব- কুলীন, হয় যেনো সিলসিলা স্বরূপে হাজির। একদিন গীত হবে এ-বংশের বাতুনি জিকির।...আর কি নিদানি থাকি, আর কি বেদ্বীন, এই কর্ণে পশেছে যেই মীরার ভজন ? সাক্ষী জ্ঞাতি এই দিলে নানক-কবীর, এ-রক্তে মিশেছে কোন হাওয়ার দূষণ ! রচিলে তুলসি দাস বংশবাতি জ্বলে, লালনের ঘর জোড়ে পড়শি বিরাজে। এ-ভিটা কি খালি থাকে, থাকে কি অধীন ? জালাল ধরেছে গীত সন্ধ্যা ফানা করে। জগত মজেছে ঘুমে দীর্ঘ চুপিসারে, চণ্ডিদাস বিপ্রলব্ধা রাধিকা ভজেছে। সেই সুর ওঠে না কি, সেই সে-বিরহ ? দোলে নৌকা নীলাম্বরী আত্মসমাহিত। এ-দিন কাহারে দানি, কে সে তুমি দেবী ? ভারতচন্দ্রে পদে দিয়েছিলে ভর। রোসাঙ্গ রাজের সভা পদ্মাবতী রূপে, আলাওল আনে বুঝি বংশের ঝলক ? আমি এক দীনহীন সভাসদগণে, কী করে কী লিখি আজ রূপের বাহান ! লিখেছে অতীত কবি জ্ঞানদাস নাম, সেই বাণী-তুঁহু বিনে আন নাহি জানি, তাহার পদের নামে জানাই প্রণাম।...এ-নাদ তোমার মাঝে শান্ত-সমাহিত, এ-নাদ তোমার নামে স্তব্ধ অনাহত। ত্রিস্বরে বিবাগী মন সপ্তমে বিলায়, তোমাতে বিলীন নাদ ব্রহ্মরূপ পায়। তুমি দেবী ধরো হাত ক্লান্তি-নামা রাতে, আহত বারিষা নামে গম্ভীর বিহাগে।...তোমাকে নিয়ত জপি চৌত্রিশ প্রকারে, তোমাকে প্রত্যহ গড়ি মন্ময় আকারে। পরমগীতের ধ্বনি এই দেহে বাজে, তুমি কি উছিলা করে এ-হাত ধরিবে ? ওহো দেবী পরমার্থ অধমের ধন, তোমাকে জপিতে দিলে মলিন বদন। নিজের চৌহদ্দি রেখে অচেনা ভূগোল, কে দিলো কপালে তোলে এমন আগল ? ক্ষিদীর্ণ বিনীত ডাক তোমার বচন, জীবন-জীবিকা করে পেয়েছে ক’জন ? কাদা-মাঝে হংস যথা-শিখিয়েচো তুমি, কর্দমাক্ত দেহভাণ্ড যাচে জলাভূমি।...গহন জলান্ধ-জলে হিজল সুরত-রঙ্গের মাতম ওঠে নদীয়ার ঘাটে। আর নি উঠিবে সুর-মদির মন্দিরা কাঁদে-রাই বিরহিনী, কদম্ব তরুর ডাল-হস্তদ্বয় ডুবিয়েছি বাঁশুরির ডাকে। আমারে তরাও তুমি-বিনোদিনী-বৃন্দাবনে আহাজারি নামে ! আঁখি যুগলের মাঠে-শব্দাক্রান্ত জ্বরে-বংশের রাখালি করি রাত্রি ঘন হলে।

মোনাজাত : কহে শ্রী ইরম, কুলহারা মন, পদে কি গছিবে হায় ! যতনে পরাও সুরের মহিমা, ধরেছি গীতের পায়।






মুজিব ইরম : জন্ম ১৯৬৯, নালিহুরী , মৌলভীবাজার।

প্রকাশিত কাব্য-গ্রন্থ : মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান ১৯৯৬, ইরমকথা ১৯৯৯, ইরমকথার পরের কথা ২০০১, ইতা আমি লিখে রাখি ২০০৫, উত্তরবিরহচরিত ২০০৬, সাং নালিহুরী ২০০৭, শ্রী ২০০৮। শিশুসাহিত্য : এক যে ছিলো শীত ও অন্যান্য গপ ১৯৯৯। উপন্যাস/আউটবই : বারকি ২০০৩, মায়াপির ২০০৪, বাগিচাবাজার ২০০৫।

পুরস্কার : মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান-এর জন্য বাংলা একাডেমী তরুণ লেখক প্রকল্প পুরস্কার ১৯৯৬।

বিজ্ঞানের অংগনে যখন ধর্মের প্রবেশ - দুটোর যৌক্তিক পার্থক্য কি এতো সহজ? :: তানবীরা তালুকদার

বিজ্ঞানের অংগনে যখন ধর্মের প্রবেশ
দুটোর যৌক্তিক পার্থক্য কি এতো সহজ?
রির্চাড ডকিন্স
অনুবাদক: তানবীরা তালুকদার

এক ধরনের কাপুরষোচিত বোধশক্তিজনিত মানসিক শিথিলতা কিংবা আপোষকামিতার কথা বাদ দিলে বিচারশক্তিসম্পন্ন যুক্তিবাদী লোকদের সিদ্ধান্তগুলো বরং যুগ যুগ ধরে প্রতিষ্ঠিত ধর্মের বিরুদ্ধেই যায় (এখানে সাম্প্রতিক যুগের Scientology(1) অথবা Moonies(2) -এগুলোর কথা বিচার্য্য নয়)। স্টিফেন জে গুল্ড তার প্রাকৃতিক ইতিহাস কলামে পোপের বিবর্তনবাদ এর প্রতি আচরণ সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা প্রবলভাবে তার আপোষকামী মনোভাবকেই প্রকাশ করে -
“বিজ্ঞান এবং ধর্মের মধ্যে কোন সংঘাত নেই, সঠিক শিক্ষার অভাবে সেসব ক্ষেত্রে সহজেই পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আমি বিশ্বাস করি, আমার সমস্ত অন্তকরন দিয়ে, একটি সম্মানজনক, একটি ভালোবাসাময় চুক্তি (আমি এটাকেই গুরুত্ব দেই ) ...।"
যহোক, কি সেই দুটো সহজ দৃষ্টিতে পার্থক্যময় ক্ষেত্র, যাকে গুল্ড 'অসম্পৃক্ত স্বতন্ত্র বলয়' (Nonoverlapping Magisteria, সংক্ষেপে NOMA) নামে অভিহিত করেছেন - আর ধারনা করেছেন এদুটোকে আমাদের সমান উষ্ণভাবে সম্মান আর ভালোবাসা দিয়ে বুকে ধারণ করে রাখতে হবে? গুল্ড আরো বলেছেন, 'বিজ্ঞানের জ্ঞান শুধু ভৌত বাস্তবতার আলোকে প্রায়োগিক বিশ্বকে ধারণ করে। আর ধর্মের জ্ঞান মানুষের নৈতিক চিন্তা আর মূল্যবোধের ধারনাকে প্রসারিত করে।' কিন্তু সত্যই কি তাই?
নৈতিকতা কারা ধারণ করে ?
আসলে ব্যপারটা কি এতোই সরল? কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি সে আলোচনায় যাবো যেখানে আসলে পোপ বিবর্তনবাদ বলতে কি বুঝিয়েছেন তার ভিত্তি তুলে ধরব এবং এরপর তার চার্চের অন্যসব স্বীকৃতির ব্যাপারেও কিছু কথা বলব। দেখবো আসলেই এগুলো এতো পরিস্কারভাবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যাখা দেয় কি না। প্রথমেই সংক্ষিপ্ত আকারে ধর্মের সেই দাবী নিয়ে আলোচনা কারা যাক- যেখানে বলা হয় ধর্ম বিশেষ দক্ষ ভাবে আমাদের নৈতিকতা সম্বন্ধে শিক্ষা দিতে। এ ধারনাটি অনেক সময় অনেক অবিশ্বাসী লোকও সাদরে গ্রহন করেন, ধারনা করা হয় সভ্যতার সাথে সাথে "মাথা নুয়ে" তোমার প্রতিদ্বন্দ্বীর সর্বোচ্চ যুক্তিকে স্বীকার করে নেয়া - সে যতো দুর্বল যুক্তিই হোক না কেন।
প্রশ্ন হলো, “কোনটি ভুল এবং কোনটি ঠিক?” এটি একটি সত্যিকারের কঠিন প্রশ্ন যেটার উত্তর বিজ্ঞান হয়ত দিতে পারে না। নৈতিকতার অবয়ব দিয়ে কিংবা পূর্ববর্তী নৈতিক বিশ্বাস দিয়ে, গুরুত্বপূর্ন এবং কঠিন সব লৌকিক নৈতিক দর্শনের নিয়মানুবর্তিতা দিয়ে একজনকে হয়তো চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, বিজ্ঞান এবং যৌক্তিক কারনের সাহায্যে এর সাথে জড়ানো সংশ্লিষ্ট গোপন বিশ্বাসকে, অলক্ষ্যনীয় সামঞ্জস্যহীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। কিন্তু চুড়ান্ত নৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তি মানুষের অন্য কোন জায়গা থেকে আসা উচিৎ, অনুমান করা যায় যুক্তি-তর্কের উর্ধ্বের কোন দৃঢ় প্রত্যয় থেকে। বিশ্বাসীদের দাবী অনুযায়ী এটা হয়ত আসে ধর্মের মাধ্যমে- মানে ঈশ্বর, ধর্মগুরু, সনাতন ঐতিহ্য, এবং একটি ঐশী বইয়ের মাধ্যমে এই নৈতিকতার টনিক বিতরন করা হয় - মানবজতির হেদায়েতের উদ্দেশ্যে।
দূর্ভাগ্যজনকভাবে, যে আশাটা ধর্ম দিতে পারে সেটা উষর প্রস্তরখন্ড ছাড়া কিছু নয়, সেখানে থেকে উৎপন্ন হওয়া বালির ভিত্তি সম নৈতিকতাগুলো একেবারেই নিস্ফলা। সত্যি বলতে কি- প্রাত্যহিক জীবনে কোন সভ্য মানুষই ধর্মগ্রন্থকে নৈতিকতার চূড়ান্ত বাহন হিসেবে পালন করে না। বরং আমরা নিজেদের পছন্দনীয় স্লোক বা আয়াত ধর্মগ্রন্থ থেকে বেছে নেই (যেমন, 'ধর্মে কোন জবরদস্তি নেই', 'প্রতিবেশীর প্রতি ভাল ব্যবহার কর' -এধরনের হিতোপদেশ সমূহ), এবং সানন্দে অশোভন অংশটুকু বাদ দিয়ে দেই (যেমন বেগানা নারীকে বেত্রাঘাত, বা তাদের ব্যাভিচারের জন্য পাথর ছুড়ে হত্যা, স্বধর্মত্যাগীদের মুরতাদ আখ্যা দিয়ে হত্যার আইন চালু করা, প্রতিপক্ষের বংশধরদেরকে শাস্তি দেয়া ইত্যাদি)। পুরনো বাইবেলের যে সৃষ্টিকর্তা তিনি নিজেই এক নির্মম, প্রতিহিংসাপরায়ন, নিজের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী, নারী পুরুষের মধ্যে অযৌক্তিক বৈষম্য সৃষ্টিকারী এবং ভয়ংকর রক্তপিপাসু এক চরিত্র, আজকের সমাজে কোন ব্যাক্তি তাকে আর্দশ চরিত্র বলে মেনে নেবে না। হ্যা, অবশ্যই আমাদের আজকের সভ্যতার অর্জনের আলোকে প্রাগৈতিহাসিক যুগের রীতিনীতিকে বিচার করা খুবই অনুচিত । আর সেটাই আমার “আসল” কথা! ষ্পষ্টতই, আমাদের কাছে নৈতিকতার কিছু চূড়ান্ত বিকল্প উৎস আছে, যা আমাদের সুবিধামতো ধর্মগ্রন্থকে পদদলিত করে হলেও সামনে এগিয়ে যায়।
সেই বিকল্প উৎসটিকে মনে হয় খুবই উদার মতের শালীন ধারার এবং প্রাকৃতিক ন্যায় বিচারক যা ইতিহাসের সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়, যখন যেই ধর্ম প্রচারক থাকে তার প্রভাবনুসারে নিয়মিত পরিবর্তন হতে থাকে। সত্যি কথা বলতে কি, তা খুব কঠিন কিছু না। কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনে, এমনকি আমাদের মধ্যে যারা খুব ধার্মিক তারাও এটাকে ধর্মগ্রন্থের চেয়ে বেশী মূল্য দিয়ে থাকি। প্রাত্যহিক জীবনে আমরা সবাই কম বেশী ধর্মগ্রন্থকে অবহেলা করে থাকি, সে সমস্ত বানীগুলোকেই উদ্বৃত্ত করা হয় যেগুলো আমাদের উদার মানসিকতাকে ধারন করে আর যেগুলো করে না সেগুলোকে সযত্নে সজ্ঞানে এড়িয়ে যাওয়া হয়। আর যেখান থেকেই সেই উদারতা আসুক না কেনো, এটা আমাদের সবার জন্যই গ্রহনযোগ্য সে আমরা ধার্মিক হই কিংবা না হই।
অনুরূপভাবে, যীশু খ্রীষ্ট কিংবা গৌতম বুদ্ধের মতো মহান সব ধর্ম শিক্ষকরা, তাদের নিজেদের চারিত্রিক ভালো গুন দ্বারা আমাদেরকে অনুপ্রানিত করেন, তাদের ব্যাক্তিগত চরিত্রের দৃঢ়তা ও নৈতিকতাকে গ্রহন করার জন্য। কিন্তু আমরা আবার সেই ভালো কয়েকজন ধার্মিক নেতার মধ্যে থেকেই বাছাই এবং পছন্দের কাজটা করছি, জিম জোন্স অথবা চার্লস ম্যানসন এর মতো পাজী ধার্মিক নেতাদের বাদ দিয়ে। কিন্তু আমরা আর্দশ হিসবে জওহারলাল নেহরু কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলার মতো নীতিবান নেতাদেরও তো গ্রহন করতে পারি। প্রথাগতভাবে, যেহেতু যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে তাই ভালো কি মন্দ সে বিচার না করে, আমরা আমাদের নৈতিকতা আর শালীনতার বিচার এবং প্রকৃতি থেকে আহরিত জ্ঞান দিয়ে নিজেরা সিদ্ধান্ত নেই কোনটা গ্রহন করব আর কোনটা বর্জন করব।
(চলবে )

তথ্যসূত্র (অনুবাদকের সংযোজন)

1. এল. রন। হার্ভাড Sceintelogy এর প্রবক্তা। ১৯৫০ সাল থেকেই তিনি এ নিয়ে কাজ শুরু করেন যা তিনি ১৯৫২ সালে জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। ১৯৫৩ সালে তার এ মতবাদকে তিনি ধর্মের নাম এবং রূপ দেন। ১৯৬০ সালে তিনি Sceintelogy কে এই বলে সংঙ্গায়িত করেন, এ ধর্মনীতির মূল হলো, বিশ্বাস, আচরন আর ঐতিহাসিক পটভূমি আর ধর্মনীতি শব্দটি নিজেই নিজেকে প্রতিফলিত করে। Sceintelogy চার্চ এর অনুসারীরা এ ধর্ম সর্ম্পকে বলেন, “সত্যের শিক্ষা হলো এ ধর্মের মূল কথা”। মূল শব্দটি নিজেই ল্যাটিন শব্দ scientia এর জোড়া যার মানে হলো “জ্ঞান, দক্ষতা” অর্থ্যাৎ এর মূল ক্রিয়াপদ হলো জানা।
2. সান মুংগ মুন Moonies ধর্মের প্রবক্তা। ইউনিফিকেশন কমিউনিটি চার্চ থেকে ১৯৭০ সালে এ ধর্মের যাত্রা শুরু। এ ধর্মালম্বীরা নিজেদেরকে চাদের সন্তান মনে করেন। ১৯৭৪ সালে মেডিসন স্কয়ার গার্ডেন চার্চের এক সমাবেশের মধ্য দিয়ে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এ ধর্মালম্বীদের সাধনার তিনটি স্তর থাকে, Moonies থেকে সাধনার মাধ্যমে SUNNIES। এবং SUNNIES এর সাধনা থেকে পাওয়া শক্তি ও ভক্তি তাকে KINGIES এর বা সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যাবে, যা সাধনাকে পরিপূর্ন করবে।


*************************************************************************************

আমরা নৈতিকতার মূল্য নিয়ে আলোচনা করতে করতে মূল বিষয় থেকে দূরে সরে এসেছি। এখন আমি আমার মূল আলোচনা বিবর্তনবাদে ফিরে যাবো দেখব পোপ আমাদের প্রত্যাশানুযায়ী বিজ্ঞান-মনস্কতার ঝান্ডা উর্ধ্বে তুলে ধরতে পেরেছেন কিনা। “Pontifical Academy of Sciences” কে তার বিবর্তনবাদের উপর দেয়া বানীটি শুরুই হয়েছে নেতিবাচকভাবে দুমুখো ভাবধারার কথা দিয়ে যার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে দ্বিতীয় জন পলের আগের উক্তির সাথে মিল রাখা। আরো সন্দেহজনক হলো বারোতম পিয়াসের একটি উক্তির অন্তর্ভুক্তি -যিনি অন্যান্যদের তুলনায় বিবর্তনবাদের প্রতি খুবই বিরূপ। এখন পোপ এলেন আরো কঠিন কাজ করতে, বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমানের সাথে “ঐশী প্রত্যাদেশের” মিলন ঘটাতে।

ধর্মগ্রন্থে বলা হয়, মানুষের সৃষ্টি হয়েছিল সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে এবং তার অবয়ব থেকে ... যদি মানুষ পুর্ববর্তী কোন জীবন থেকে তৈরী হয়ে থাকে তাহলে তার ঐশ্বরিক আত্মা সাথে সাথে সৃষ্টিকর্তা তৈরী করে দেন...... তারফলে তারা মনে করে জীবন্ত প্রানীর সব শক্তির আবির্ভাব হয় আত্মা থেকে, আর বিবর্তনবাদ শেখাচ্ছে পুরো উল্টোটা - আত্মা ছাড়াই কিভাবে প্রাণের বিকাশ আর বিবর্তন হতে পারে - নাকি নিছক দৃষ্টি আকর্ষন করার মত ব্যাপার কেবল এটা, মানুষের সৃষ্টির সাথে সম্পূর্ন সামঞ্জস্যহীন ...... এ দ্বিমুখী দন্দ্বে আমরা মানুষেরা নিজেরা অস্তিত্বের প্রশ্নে মনস্তাত্বিক একটা বিভ্রমের মধ্যে পড়ে যাই, যেটাকে অস্ত্বিত্বের বিষয়ে একটা বিরাট ফাকও বলা যেতে পারে।
এ ব্যাপারে পোপকে একটা বাহবা দিতে হয় যে তিনি তখন অনুধাবন করেছেন যে সম্পূর্ন দুই মেরুতে অবস্থিত দুটো বিপরীতধর্মী ব্যাপারকে তিনি জোর করে এক করতে চাইছেন - "যাহোক এ ধরনের অস্ত্বিত্বর বিষয়ে অবস্থান না গ্রহন করাটাই কি বাস্তবে পদার্থ এবং রসায়নের জগতে বিবর্তন এর উপর গবেষনার মূল ধারা নয়?'

ভয়ের কিছু নেই। অস্পষ্টতা আর নানাপদের আগডুম বাগডুম মুক্তির উপায় বাৎলে দিচ্ছে:

'জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যে পদ্ধতি বহু বার ব্যবহার করা হয়েছে তার দ্বারা দুটো ভিন্নধর্মী মতামতকে এক করা সম্ভব হয়, যাদের এক হওয়াকে আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব বলে মনে হয়। বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষন বর্ননা এবং পরিমাপের মাধ্যমে জীবনের বিভিন্ন দিক স্পষ্ট করে ব্যাখা করে এবং সময়ের সাথে সাথে আরো নির্ভুল ভাবে একে জীবনের সাথে যুক্ত করে। আধ্যাত্মিক সাধনার বিশেষ মূহুর্তকে এভাবে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করা যায় না, তথাপি এটা একটা গবেষনামূলক স্তরের আবিস্কার -যা মানব জীবনের সাথে সম্পর্কিত অনেক নিদির্ষ্ট মূল্যবান জিনিসের প্রতি ইঙ্গিত করে।'

সোজা ভাষায় বলতে গেলে, বিবর্তনবাদের নিদির্ষ্ট একটা লক্ষ্যে পৌছার একটা সময় এলো যখন সৃষ্টিকর্তা মানুষের আত্মাকে পূর্ববর্তী প্রানীর বংশের মধ্যে অন্তর্গত এবং সঞ্চারিত করলেন। (কখন? দশ লক্ষ বছর আগে? বিশ লক্ষ বছর আগে? Homo erectus আর জ্ঞান সম্পন্ন Homo sapiens মানুষের মধ্য? নাকি Homo sapiens মানুষ আর H. sapiens sapiens - মানুষের মধ্যে?) হঠাৎ করে আত্মা সঞ্চারনের অবশ্যই দরকার আছে, নইলে তো মানবজাতির জন্য অতি প্রয়োজনীয় ধর্মের ভিত্তিই ধ্বসে পড়ে। তুমি আহারের জন্য প্রানী হত্যা করতে পারো, কিন্তু ভ্রুন হত্যা কিংবা দুরারোগ্য ব্যাধীতে আক্রান্ত মানুষের যন্ত্রনাহীন মৃত্যু তাদের দৃষ্টিতে অযৌক্তিক জীব হত্যা, কারন -এক্ষেত্রে মহামূল্যবান 'মানব জীবনের' প্রশ্ন জড়িত।

ক্যাথলিজমের জাল কেবল নৈতিক বিবেচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ভাবলে ভুল হবে। ক্যাথলিক ধর্মানুসারীরা বিশ্বাস করে আধুনিক সভ্য Homo sapiens মানুষের সাথে অন্য সমস্ত 'ইতর প্রানী জগতের' একটি বিরাট বিভেদ আছে। আর বিজ্ঞানের চোখে এই বিভেদ একেবারেই ভ্রান্ত। বলা নিষ্প্রয়োজন, আজকের যুগে আকস্মিক ভাবে কোন ধরনের অমর আত্মার মাধ্যমে প্রানের বিকাশের কথা বিবর্তনবাদের কাছে বৈজ্ঞানিক ভাবে অগ্রহনযোগ্য।

আরো সাধারনভাবে বলতে গেলে, এটা বলা খুবই অযৌক্তিক, যেমন গুল্ডস এবং অন্যান্যরা বলে থাকেন, যে 'ধর্ম নিজেই বিজ্ঞানের অংগন থেকে দূরে অবস্থান করে, এবং শুধু নৈতিকতা আর মূল্যবোধের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে।' ঈশ্বার নামকএকটি অলৌকিক সত্ত্বা দ্বারা সৃষ্ট এবং তার দ্বারা বিরাজিত মহাবিশ্ব, প্রকৃতগতভাবে এবং গুনগতভাবে ঈশ্বরবিহীন মহাবিশ্ব থেকে আলাদা হওয়ারই কথা। আর সেই বিভেদটিই হলো অপরিহরনীয় বৈজ্ঞানিক পার্থক্য। ধার্মিকেরা যে সত্ত্বার অস্তিত্বের দাবী করে, তা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাদের বৈজ্ঞানিক দাবীকেই উপস্থাপন করতে চায়।

প্রধান প্রধান রোমান ক্যাথলিক চার্চগুলোর বেশীর ভাগই এই ধরনের দাবীর প্রতি আস্থাশীল। বিনা ঔরসে কুমারীর মাতার সন্তান প্রসব, কুমারী মেরীর সশরীরে স্বর্গপ্রবেশ, সমাধি থেকে যীশূর পুনরুত্থান, মৃত্যুর পরে আমাদের আত্মার জবাবদিহিতা, -এগুলো ভুল হোক, ঠিক হোক - যথার্থ বৈজ্ঞানিক দাবী। হয় যীশূর একজন সত্য সত্যই বাবা ছিলেন নতুবা নয়। যথার্থ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার মাধ্যমেই এর জবাব মিলতে পারে। এটা কোন “নৈতিকতা” কিংবা “মূল্যবোধের” প্রশ্ন নয়, এটা হলো বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা তথা সত্যান্বেষী মননের প্রশ্ন। আমাদের কাছে এটার জবাব দেয়ার মতো সাক্ষ্যপ্রমান হয়তো নেই কিন্তু এটি যে একটি বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন -এতে তো কোন সন্দেহ নেই। তবে বিজ্ঞান যদি অদূর ভবিষ্যতে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো কোন প্রমান খুঁজে পায়, আপনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন, ভ্যাটিকান সেটিকে উচ্চারনও করতে দেবে না।

যখন মাতা মেরী মারা যান, হয় তখন তার দেহ বিনষ্ট হয়ে গেছে, নতুবা তার দেহ এই পৃথিবী থেকে স্বসরীরে স্বর্গে তুলে নেয়া হয়েছে। আনুষ্ঠানিক দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত রোমান ক্যাথলিক চার্চ এর অনুমান, সম্প্রতি ১৯৫০ সালে তারা অধ্যাদেশ জারি করেছেন, যেখানে তারা বলেছেন স্বর্গ জিনিসটার সত্যিকারের 'ভৌগলিক অস্তিত্ব' বাস্তবিকই আছে, নইলে একজন রমনীর শরীর কিভাবে সেখানে গেলো? আমি একথা এখানে বলছি না যে, কুমারী মাতাকে নিয়ে অনুমিত এই মতবাদ আসলেই মিথ্যা, (যদিও আমি বিশ্বাস করি এটি অবশ্যই মিথ্যাই হতে হবে)। আমি শুধু এই যুক্তিই খন্ডন করতে চাচ্ছি যে, যারা বলেন এ ধরণের দাবী বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের বাইরে রাখতে হবে। বরং, এই কুমারীর এই গল্পটি সত্য কিনা তা বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে নির্ণয় করা যেতে পারে - এটি তাই পরীক্ষণযোগ্য একটি বৈজ্ঞানিক তত্ব। আমাদের শারীরিক ভাবে মৃত্যু হলে আমাদের আত্মার জবাবদিহি করতে হবে কিনা কিংবা সেই সাথে ফেরেশতাদের দ্বারা বিচারপর্বের গল্প, স্পষ্টতই মাদার মেরীর সাথে যুক্ত হওয়ার অলৌকিক গল্পসমূহ, এবং এধরনের অন্যান্য সব গল্পসমূহ-এর ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।

প্রায়শই খুব অসৎ মতবাদ অবলম্বন করে বলা হয় যে কোন ধর্মীয় দাবীই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের বাইরে। অন্যদিকে এরাই আবার অতি প্রাকৃতিক রং-বেরং-এর গল্প সমূহ, এবং মৃত্যুর পরের জীবনের কথা বলে সাধারন মানুষদেরকে অভিভূত করার চেষ্টা থাকেন, নিজের দল ভারী করে গোপন উপায়ে জেতার চেষ্টা, কিংবা উপসনালয় বৃদ্ধির চেষ্টা থাকেন। এটাই তাদের বৈজ্ঞানিক শক্তি যা তাদেরকে এ সমস্ত গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে উপস্থাপন করার সার্মথ্য দেয়। এবং একই সময়ে সে সব বিষয়ের যৌক্তিক ব্যাখ্যা, বৈজ্ঞানিক গবেষনা কিংবা নুন্যতম সমালোচনাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয় - 'এগুলো ধর্মের বিষয়, বিজ্ঞানের এখান থেকে দূরে থাকা উচিৎ।' কিন্তু তুমি গাছেরটাও খাবে - তলারটাও কুড়োবে - এ তো হতে পারে না। অন্তত ধর্মের তাত্বিক আর আত্মপক্ষ সর্মথনকারী্দের এই দুমুখো নীতিকে আমাদের কখনোই প্রশ্রয় দেওয়া উচিৎ না। দূভার্গ্যবশতঃ তারপরো, আমাদের মধ্যে অনেকেই, এমনকি যারা ধর্মে বিশ্বাস রাখেন না তারাও অম্লান বদনে তাদেরকে একাজ গুলো অহরহই করতে দেই।

আমার মতে, সনাতন কট্টর মৌলবাদীদের বিপক্ষে পোপকে দলে টেনে আত্মপ্রসাদ লাভের একটা প্রচেষ্টা। এতে অবশ্য খুশী হবার মত কারণ আছে - যারা ক্যাথলিক ধর্মের প্রবক্তা যেমন মাইকেল বিহেদের পায়ের তলা থেকে আস্তে আস্তে মাটি সরে যাচ্ছে। তারপরেও যদি আমাকে বলা হয় সত্যিকারের সনাতন ঈশ্বর-বিশ্বাসী, ধর্মগ্রন্থ মেনে চলা সৎ ধার্মিক আর অন্যদিকে কপট, দুমুখোস্বভাবের, গোঁজামিল দেওয়া বক-ধার্মিকদের মাঝ থেকে কাউকে গ্রহণ করতে, আমি জানি আমাকে কোনটা গ্রহন করতে হবে।

তানবীরা তালুকদার
০৫.০৫.২০০৮

morou kobita