১৪.৬.০৮

মুজিব ইরম বিরচিত দীর্ঘ কবিতা :: কবিবংশ


মুজিব ইরম বিরচিত দীর্ঘ কবিতা

কবিবংশ

এ পদ্য তোমার জন্য - যে-তুমি ডেকেছো ভোর-রাতে। এ পদ্য তোমার জন্য যে-তুমি ডাকিবে সন্ধ্যা-রাতে।

যে-বাঁশি বাজিলো ধীরে হিয়ার ভিতর দিনকানা, রাত্রিকানা ভুলে থাকা দায়। কে তুমি বংশীবাদক এই দেহভাণ্ডে থাকো, কী নামে বাঁশির ছিদ্র থমকে থমকে ওঠে ? তুমি বুঝি একি নামে জগতে বিরাজো ? তুমি বুঝি চেনা নামে আরিপরি খোঁজো ? এত যে বাজলো নাম এত এত লয়ে, এত যে ছড়ালো নাম পাশে কিংবা দূরে, কী আর হয়েছে তাতে বলো দেখি বলো ? কেনো তবে দিনেরাতে নামেনামে ডাকো ? এমনি মারিছো বাণ, জানি না রে আজ কোন বা বাঁশের বাঁশি ওষ্ঠে বেঁধে রাখি ! অবেলা হয়েছে বেলা, কিসে ভয়-ডর ? অপথে উঠেছে ধ্বনি, সুরে ভাঙ্গে ঘর।...কেনো যে বুঝোনি সেই, ফেলিয়াছো দিন যেই, অপথের মাঝে। ডেকেছে কতো না ছায়া, এনেছো অচিন মায়া, কাঁটাবিদ্ধ তা যে ! সেই কবে যাত্রাদিনে, রেখে আসা বৃক্ষ-মূলে, ধরে রাখি মন। এত পথ হেঁটে এসে, পক্ষিকুল ভালোবেসে, আগলে রাখি বন। ভুলেও থাকি না আজ, সেই যে দিয়েছো কাজ, দেহভাণ্ড ভরে। যা কিছু গিয়েছে ধীরে, পাশ কেটে চোখ বোজে, কান্না অবসরে। এ-মনে হয়েছে রোগ, তারে তুমি বলো সুখ, মনে শান্তি পায়। তুমি এ-সংসারে দেবী, অধমের মন সেবী, ভরেছো আশায়।...হেঁটে হেঁটে আজ বুঝি ক্লান্তি নামে পথের ধুলায় তবে কি রে মন তুমি শস্যবিদ্যা ভুলেছো হেলায় ?...ডেউয়া ফলের জলে মুছে দেই কতো হস্তলিপি, আরো কতো নিরাকার তৈরি করি বালির সমাধি। কাটাকুটি জলেস্থলে কয়লায় ধুয়েছে দেয়াল, হাওয়ায় ভেসেছে কতো মগ্ন থেকে রাখিনি খেয়াল। থুতু ঘষে নাই হয় কতো কিছু সরলে গরল, পাতাপত্রে আঁকাআঁকি বুঝিনি তা বয়স তরল। আর কতো বেহিসাবী আর কতো ওলট-পালট শস্য কি ভিজেছে রো,ে জেগেছে কি পুবের হালট ? জানা নাই, নাই শোনা, প্রশ্নে প্রশ্নে করি দোনোমনো, বয়স বাড়েনি আজো স্লেটে লিখি হাঁটু ভাঙ্গা তনু।...কী মাত মাতিনু আর ভুলে যাই কথার ধরণ, যতনে লুকানো দাগ স্পষ্ট হয় ব্যথার স্মরণ। মুরব্বি মহান যারা তারা দেখি বলাতে অসীম, জগত-বাখানে তারা তুচ্ছ করে মাতের আফিম। আকারে প্রকারে খুলে মোহ-ভর্তি কথার সিন্দুক, মোহমুগ্ধ সুরে দেখি তুষ্ট করে যতেক নিন্দুক। গোষ্ঠী ও ঘরের শত্র“ গুণমুগ্ধ হয়তো পরের, তুষ্ট হয়ে ফিরে চলে বক্ষভরা কুহক সুরের। এসব কমতি নিয়ে মাঠে কেনো এসেছিলে তুমি ? দিনেদিনে আরো বেশি কথা বন্ধ বোবা-দগ্ধ-ভূমি। খুঁজে খুঁজে নি-মাতের পদ ছুঁয়ে নেই মুরিদানি, বংশের কলঙ্ক-কালি মুছে দিতে আসে কোন জ্ঞানী ?...বাছনা বেয়ে জেগে উঠি শিমের নিঃশ্বাস। দোআঁশ মাটির টানে অন্তর অধীন, প্রাণ ঢেলে অপ্রাণের বাড়াও উত্তাপ। আমাকে সজীব করোওগো অগ্নিময়ী, লকলকে প্রাণবায়ু সাকারে আকার, ফোটে পুষ্প-ফনা-মদ মত্ত চুপিসারে, বিষবাষ্পে রংহীন পাতা-পুষ্প-লতা, বাখাল বাঁশের আগা পেঁচিয়ে সঙ্গীন, সবুজে অবুঝ ঋণ আভোগ আফিম। কে ধরে লতানো লতা ঝাঁকে মেশা কুঁড়ি ? এতটা মোহন ডাকে বায়ু বাষ্পানলে, কঞ্চিভরা প্রাণবায়ু তোমার অধীন। এই পত্রে লিখা হোক বাঁচা-মরা-ঋণ, মাচাং ভরিয়া ফোটে তুঁহু রাঙ্গা দিন।...বারমাসে তের ফুল ফুটে থাকে ডালে, নগরে নগরে ঘুরি নিজস্ব অনলে। বারমাসে তের ফল ধরে থাকে ডালে, তবুও কিসের নামে অশান্তি বিরাজে ? নবান্নে আসিও তুমি-তুমি সেই তাপ, তাড়িও দেহের গুণে বিষের প্রলাপ। বারমাসে তের রূপ অগ্নিফোটা রাত, আমাদের ঘর হোক পদ্যপারিজাত।...এ-পদে কি মিশেছে আজ শুরুর সঙ্গীত ? কোথায় পথের শুরু, কোথা সেই গীত ?...বাজিল মুরলী ডাক দূর-দূরবাসে, এ-বাঁশি পদের নামে ঘরহীন করে। অন্তরে সরল বাঁশি গরল উগারে, কুলবান কুলহারা নাশিল পরাণে। মাগি ভিক্ষা দ্বারে দ্বারে যদি বা বিরল, সুরের কদম্ব-তলে মিলায় অতল। নগরে নগরে ঘুরি শব্দসঙ্গ যাচি, তবু কি কালার বাঁশি শুদ্ধ করে আঁখি ? যারা যারা এই পথে ধরেছিলো সুর, তারা কি রে সেই তাপে ধরে আছে ঘোর ? আর কেবা জানে বলো, আর কেবা জানে-গোবিন্দ দাসের মন জানে বুঝি মানে ? ইরমে কান্দিয়া কয়-ওগো অগ্নিময়ী, উঠেছি তোমার নায়ে ধরো আশাবরী।...কে করিবে দূতিয়ালি হায়, কুলাচার্য ইরমের বাণী ! গোষ্ঠিকথা লিখিয়াছি যতো কুলজি-গ্রন্থের অভিধানে-এই সেই কারিকা পুরাণ, রচিবারে মহাবংশাবলী, আমাকে কি কুলপতি দলে, কবিবংশ নাম ধরিবারে, তুলে নিবে তুমি কবিশ্বরী ?...বাতাসে উড়িছো তুমি শিমুলের তুলা, নিশ্চয় রহিলো বন্ধু নিতি আত্মভোলা। বাতাসে উড়িছো তুমি আমনের নাড়া, আসে না আসে না বন্ধু-কেনে এত তাড়া ? বাতাসে উড়িছো তুমি ঝরে-পড়া ফুল, কেনো এত তার নামে ওঠে হুলুস্থুল ? এক নামে ডাকো তারে এক নামে ডাকো, আসিবে আসিবে করি বুকে আশা বাঁধো। নতুন নামের গুণে যদি দয়া হয়, এ-ঘরে চান্দের আলো হয়িবো উদয়। কেনো এত ভাবো তুমি কেনো এত ভাবো, তোমার সোদর ভাই আইনুদ্দীনে কয়-বন্ধুয়া আসিবে করি মোর মনে লয়।...ভিজেছে পাহাড়, পাতাবৃক্ষফুল, এমনি বারিষা মনে কতো দূরে তুমি থাকো ওহে জলেশ্বরী ? নগরে নগরে বুঝি আর-জন্মে যোগি হয়ে ঘুরি ? কবে থেকে তার শুরু-বলো তবে বলো ওগো গেরুয়া ধারিণী, ও আমার যুগল যুগিনী !...কিন ব্রীজ পাড়ি দিয়ে যে-দিন নগরে তুমি অজু সেরেছিলে, লিখিয়েছিলে মুরারি চাঁদে নাম, তোমার অপেক্ষা করে আলী আমজদ-এর ঘড়ির কাঁটায় সময় আটকে ছিলো বহুদিন-সেই থেকে তুমি বুঝি পাখিডানা পেলে ? এত এত পাখি পুষে কাটালে প্রহর-তোমার নিজস্ব পাখি বংশ ভুলে কেনো তবে অ-রূপ ধরেছে ? তুমি তো বৈতল নও জালালী নগরে-এ-পাখি তোমারে চিনে-নামের দোহাই, কেনো তবে উড়ে আসো, ভুলে থাকো মনু ও খোয়াই ?...যেখানে যাওয়ার জন্য একদিন নেমে আসি পথে, যাত্রা কি ফুরালো মন, যাত্রা কি ফুরায় কোনোদিন ? এত পথ এসে দেখি যাত্রা আজও ফুরালো না, হায় ! কোথাও আচমকা শুধু তোমার স্মরণ রেখা এঁকে, ভুলে থাকি কথাগুচ্ছ, দিনে দিনে ক্লান্তি শুধু বাড়ে। শিখিনি কিছুই বুঝি ? বৃথা বুঝি নামাবলি জপা ? কে বলে এমন কথা-বাড়েনি কি চক্রহারে দেনা ? যে-চারা রুয়েছি সেই ফেলে আসা বিষের নগর-তা-ও কি ফলেছে বৃথা, ধরে থাকি বিম্ব-কাক-ফল ? নতুন নগরে লগি গাড়া হলো বেশদিন শেষে, সেখানেও বৃক্ষ আজি নিজনামে পুষ্পধ্বনি ফোটে-তুমি কি বাজাও বলো নগরে নগরে এই নাম ? গড়ে তুলি তিলে তিলে দেহচর্বি জ্বেলে কবিবংশ, হয়েছি অনেক শেষে কাদাসিক্ত শুভ্র রাজহংস।...এ-বংশে জন্মেছে যারা, ভুলে যাই তারা কারা, আর যতো পন্থহারা নাম-তাদের চরণ-মাঝে বাঁশুরি-বাদ্য কি বাজে, সেই নামে সিদ্ধ সাজে ধাম ?...একদা বংশের বাতি জ্ঞানদাস জ্বালে, বিদ্যাপতি-বংশগীত রাধা রাধা বলে। চণ্ডিদাস জ্ঞাতি হয় এই যমুনায়, পদে পদে ওঠে সুর কৃষ্ণ নাম গায়। আমি কি বংশের বাতি এই তরিকায়, ক্ষমা কি করিবে আদি গুরু কাহ্নপায় ? এমন জাতের কথা কভু নাহি শুনি, নিজবংশ ছেড়েছুড়ে পরবংশ ধরি। এমন বাঁশির কথা কেনো তুমি তোলো, কদম্ব তরুর তল নগরে বিচারো ? আড়বাঁশি ছিদ্র-কানা কবি কবি বলে, এই শব্দ ঘর-কানা যমুনার জলে। এই দেহ রাধা সাজে এই দেহ গীত, এই মন কানু বিনা বুঝে কি সঙ্গীত ? এমন লজ্জার ভার কার কাছে রাখি, বেনামে নামের ধ্বনি পরনিন্দা মাখি। সকলে শুনিলো ডাক ভুলে গেলো সবি, পশিলো হিয়ার মাঝে শব্দ-বাক্য-ছবি। নিরানন্দ থাকি শুধু নিরানন্দ থাকি-ভুলে যদি সাদাপাতা পড়ে থাকে খালি ? এই ভয় ওঠে মনে এই ভয় ওঠে, না-জানি গীতের ঢেউ পদে নাহি জুটে ! শ্রী ইরম ঘর হারা বৈতল স্বভাবে-কে এসে গাইবে গীত এমন অভাবে ?...এ-দেহ রাধিকা রূপ-ছিদ্রবাঁশি-এ-দেহ কানাই, শব্দ-ব্রহ্ম-সখা তুমি-আড়বাঁশি-নিয়ত বাজাই। এ-বংশে হাছন কাঁদে-চরণ ধরিতে তার সাধ, এ-বংশে করিম কাঁদে-ওরে, পাইমু নি তার লাগ ! শাহনূর দগ্ধ হলে চাইর প্রহর রাত্রি ফানা হয়, বানেশ্রী ছাড়িলে কাঁদে মনোপাখি বন্ধু সমুদয়। যমুনা যমুনা সুর-বাঁশি তবে কার নাম জপে, ধামাইল উঠেছে কি দূরে রাধারমণের নামে ? এ-বংশে আমি কি আছি-আমি কি ছিলাম কোনো কালে ? আমি কি থাকিবো রোজ-সহি দিলে-চরণে নূপুর-ধ্বনি হয়ে ? শা’নূর আমার ভাই বানেশ্রী বিচারে-ত্যাগিলে কদমহাটা নালিহুরী কাঁদে।...পঞ্চবটী বনে বুঝি পাখি ডেকে ওঠে, কবির ঘুমন্ত গ্রামে মগ্নছায়া জোটে। লতায়-পাতায় জ্ঞাতি আদি কবি নাম, কুলজি রচিতে বসি তাহাকে প্রণাম। আরেক প্রণাম আমি তোমাকে জানাই, যে-তুমি হালতী হলে নিরলে জাগাই। পদে পদে ওঠে নাম পদে দেখা পাই, কোন সুরে বন্ধু ভজি তুমি বলো চাই ? কী করে অধরা ধরো পন্থধারা পাও, কী করে বন্ধুরে খোঁজো আমারে বাতাও। ঘরের বাগিচা-পাশে ভ্রমর-বাখান, তোমার কণ্ঠে জাগায় দেহাতি আজান। ডাকিলো ভজিলো দিলে ধরে দমে-দম, তোমারে খুঁজিলো এত কেনো যে ইরম ! তুমি কি দিয়েছো ভর, তুমি কি অভয় ? তবে তো কপালে কিছু ঘটিবে নিশ্চয়।...এ-দেহ ভুলে থাকি, এ-দেহ পুষে রাখি, অন্তর অধীনতায়, লুপ্তনাম ভোরে হাঁকি, যা কিছু রোদে মাখি-বলো, তা কি রক্ষা পায় ?...পিরাকী-ফকিরী ধরে এ-বংশে লিখেছো যে-নাম, ভালোবেসে এই রাতে বলে রাখি তোমাকে প্রণাম।...তোমাকে রাখিয়া দূরে বাঁশি আর বাজে না গো রাই ! সোয়া ও চন্দন ঘষে দূরদেশে রাত্রি ঘন হয়, দেখে এ-নন্দন, উঠে যে কান্দন, গীতের মহিমা মনে হয়। যাতি-যূথি-চম্পাবতী, ভোর নামে জংলী নদী মনু ও দলাই, এত যে প্রণাম, শুনিয়া সুনাম-আমারে কি প্রাণ বন্ধুয়ার মনে নাই ?...নিমায়া-নিঠুর অতি কেনো থাকি দূরে ? যাতি-যূথি-পুষ্প গাঁথি মালতি মালায়, বিনিসুতা আড়ি দিয়ে ভূতলে গড়ায়। সোয়া ও চন্দনে ঘষি দেহ ফর্সা করে-তুমি নি বলিবে মন কারে বিচারিলে ? পথে পথে কোন ধন হাছিল করিলে ? প্রশ্ন কেনো করো তুমি ওহে মূঢ় মন, তোমার কপালে তীর বিঁধেছে কখন ? যথাতথা যাও তুমি নিজের গরজে, কাজা করো ভোর-সন্ধ্যা-নিশুতি-ফরজে।...এ-আয়াত রচিয়াছি তুমিহারা দিনে, এদিলে জিকির ওঠে সিনাভরা ওমে। এই হাত ধরো তুমি এই হাত ধরো, অপথে জীবন গেলে সোজা পন্থ ধরো। কে দেবে পথের দিশা, সে যে আজ দূরে-মনেতে বিষের ঝড় নেমেছে অঘোরে।...তারে তুমি দেখে রেখো ও আমার নিমের বাতাস। দখিনা বাতাস আসে, কে করে নিষেধ তারে-পাখি, পাখিরে আমার, উঁচা ডালে বসে তুমি কেনো ডাকো দুপুরবেলায় ? কতো মন পুড়ে গেলো-কোকিল-স্বভাবে কেনো, রাত্রি তুমি ডেকে আনো ? কান্নাসুরে দুপুর এলায় তার চুল, ঘনকালো-শিমুল তুলায়। বাউলের পাখি তুমি, বিরহে তোমারে নমি, সে যেনো শোনে না এই আদিম শিলায়, কী করে ধরেছে ক্ষয়, জলে ভিজে, রোদে পোড়ে, ভুলে থাকা বৃষ্টি-জলোচ্ছ্বাস। কে আজ আনবে তুলে, হাহাকার দূর করে-এমন আলোয় ?...শিখেছি তোমার কাছে পাল তোলা নাওয়ের স্বভাব। সুর, তা-ও তুমি দিলে বেসুরের মাঝে। লইবো না কেনো তবে মুরিদী শপথ ? তা-ও যদি তুমি দাও-না-হয় আমাকে আজ গীতেই ভাসাও।...আর কী এমন দাবি কহিবার আছে ! মিসকিনেরে দিয়েছো লিল্লা ছায়াঘন রাতের সৌরভ। এইবার-ছদকা করো দেবী চক্ষুভরা ঘুম, এই এতিম ফকির দাঁড়িয়েছি তোমার দরজায়। খতমে সেফার গুণে মনে যদি বরিষন নামে-ছদকায়ে জারিয়া ভেবে দান করো মনের জৌলুস। দানে জানি কমতি নাই-কবে তুমি কাঙ্গালেরে খয়রাত করেছিলে দেহভরা ঘুমের গৌরব ?...গোষ্ঠীভরা এত এত মৌলানা-হাফেজ, এত এত বুজুর্গ-আলেম, বিজ্ঞ মুহাদ্দিস-সকলেই পেয়েছে কি তোমার রহম ? সেফা করো ওগো দেবী-ভিক্ষা মাগে অন্ধ কবিয়াল, জগত ভ্রমিয়া শেষে আর কেবা হয়েছে মাকাল !...তোমার বাড়িতে এই চৈত্রমাসে ফুটে আছি অস্থির মুকুল। নিমগাছে ধরেছে কি নয়াপাতা ছায়াছিদ্র ফুল ? আমলকি গাছে বুঝি রাঙ্গাপাতা হয়েছে ব্যাকুল ? তার পাশে ছিলো সে যে লিচু আর পড়শী বকুল-গোলাপজামের ফুল শুভ্র রূপে বেঁধেছে কি চুল ? বন আলো জাগলা হলে গৃহকাজে শান্ত হয় মন-আমের বউলে বুঝি ডেকে আনে ভ্রমর-গুঞ্জন ? তোমার বাড়িতে আজ নিম হয়ে ফুটে আছি বনাজী কুসুম-তবু তুমি ভয়ে কেনো নিজেই হয়েছো এত অস্থির অঘুম ?...উদ্ধত ভঙ্গিমা নিয়ে জেগে ওঠে দুধমরিচের ডাল-চৈত্রমাসি রোদে। এমন গর্বিত গ্রীবা-কম্পন বিধুর মন মজে থাকে শুভ্র ইশারায়। রুয়েছো মনের টান-তুঁতফল ডেকে আনে পক্ষিকুল, নামেতে ইরম। উঠানে উঠানে থাকি নীল মরিচের গাছ, বারোমাসি বেগুনের ঝোপ। একবার শুশ্রƒষায় জলছিটা দাও-এ-জীবন ধূলিশূন্য হোক, অপেক্ষা ঝরুক।...তুমি এসে বসে থাকো আজ-সময় সামান্য অতি হায়, আজ চন্দ্র অস্ত যাবে ঠিক-তোমার মহিমা-রাঙ্গা পায়।...দীর্ঘ-দীঘির সমান নীরব ক্রন্দন-তুমি কি দেখোনি প্রাণ, উচাটন নিশিভর পতিত বাথানে ? কিসের রাখালি তবে-ঘাসে ঘাসে কিসের বন্ধন ? দূরে দিন উঠিয়াছে বিষণœ-বিপুল-মন তুমি ভিজে থাকো-এ-দেহে বিঁধেছে আজ রোদের ত্রিশূল। বিস্তৃত বিরাণ-মাঠে কার নামে জয়ধ্বনি ওঠে ? দূরের কুটুম ডাকে, এই নামে পুষ্পধ্বনি ফোটে।...তোমার নিমের ডালে ধরে আছে নামহীন কুঁড়ি, তারপাশে ফোটা-ফুল আর কিছু পাতা-পুষ্প-ডাল, তারা কি দুপুর-বেলা রোদে ভিজে হয়েছে বেহাল ? চৈত্রের এমন রূপ গাছে গাছে আকাল সুন্দরী। আহারে গর্জনশীল ভয় নিয়ে আসো কেনো তুমি ? দূরবাসে পড়ে থাকি, একা থাকে আমার ঘরণী। দূরত্ব প্রগাঢ় হলে কেঁপে ওঠে বিরহ ধমনী-কেনো তবে এই বেলা কাঁপে পাতা কাঁপে বৃক্ষ-ভূমি ? বন্ধ করো ওহে মেঘ অচিরা- তোমার নর্তন, করেছে আদেশ এই মধ্যরাতে পদগ্রস্থ কবিতুলে আনো শান্ত ঢেউ, হোক তবে সুরের মন্থন, আঁকা হবে মৃদু-মন্দ হাওয়া-রাঙ্গা সুখরাত্রি ছবি। আমার রমণী দূরে আঁকে দিলে ঘর-প্রতিচ্ছবি, তার তরে মধ্যরাতে তুলে রাখি দেহের চন্দন। এই ঘরে আছো তুমি, এই ঘর তোমার স্মারক, তোমার চরণ-জলে দূর হোক মারি ও মরক।...তুমি যে ডেকেছো কাছে অচিন প্রলাপে, তুমি যে ঘিরেছো ধীরে বিভূর বিলাপে-কী করে ধরেছি বক্ষে জলে-ঢাকা রাত, প্রলাপে-বিলাপে তুমি এনেছো প্রভাত। আঙ্গিনা ভরেছে ধীরে রাত্রি-ফোটা ফুলে-আর কি কাটাবো পাশ স্পর্শ-মায়া ভুলে ? তুমিই ধরেছো সখি এই দুই হাত, এ-জীবনে বেঁধে রাখি সুরের রাকাত। একদিন ভুল করে জেগে দেখি রোদ, পড়ছে অচিন রাগে অধরা দরুদ। সেই থেকে মনে ধরি দিলে থাকি বাঁধা, তোমার হাসির নামে শুধু সুর সাধা। তুমি যে থাকিবে পাশে মোহমুগ্ধ দিনে, আমাকে বাঁধিও তবে জন্মমৃত্যু-ঋণে।...যা কিছু একদা ছিলো সমান বয়সী, সেও বলে নির্দ্বিধায় গম্ভীর হয়েছি। তুমিও পরেছো শাড়ি স্বর্ণলতা নাম, কেনো যে আড়াল করো বিদগ্ধ প্রণাম। সন্ধ্যা হতে বাকি নাই, কে আজ হাঁকায় ? ধরে আছো এই হাত শান্ত যমুনায়। ভুল সুরে ভুল পথে হয়েছি চাতক, আসন্ন শিশুর নামে রচিও জাতক। যদি চায় ক্লান্ত পাখি ছায়ার আশ্রয়, পাতার মহিমা ধরো-ডালের অভয়। কতো নাম মুছে গেলো কতো নাম ভাসে, এই বার্তা গীত হোক খড়ে আর ঘাসে। এই বংশ গীত হোক-কবিবংশ গীত, তুমিও ধরিও হাত-বাজুক সঙ্গীত।...এ-এক বংশের গান, যে-সুরে ধরেছে মান, মিয়া মালহার রাগে। ভুলে গেছি দিনকাল, যতনে বিরাগে প্রাণ, শুধু বিরজনে জাগে। কেনো যে ভুলেছি আজ নিজস্ব-জগত-এ-পথে কি ধূলি ওড়ে শস্যের শপথ ? কেনো তবে এসেছি এ গন্তব্য সীমায়-বলো তুমি ধূলিপত্র শস্য কোথা হায় !...চৈত্রের তাণ্ডব শেষে তপ্তদিনে নিমেষে নেমেছে-বোশেখের সদ্যজলে স্বচ্ছতোয়া ঘাসের প্রপাত। উজান স্রোতের প্রেমে যুদ্ধে কাঁপে দেহজীর্ণ মিন-এমন কাতর দেহে সইবে কি তোড়ের আঘাত ? ছিলো তার নিস্তরঙ্গ কোনো এক জলার বসত, ডেকেছে তর্পণ দিনে জলসিক্ত উজানি সাকিন। পাথরে পাথরে ওঠে যাত্রাধ্বনি নিথর নিক্কণ, কে তবে দেহাতি ডাক গেয়ে ওঠে-আশা বড়ো ক্ষীণ ? পরে আছি রাঙ্গাবাস দূরান্নয়ী মিন যথা দশা, যাত্রী সহচরে যারা ক্লান্তি ধারি উজান সঙ্গীন। শুনিয়া দেওয়ার ডাক মর্মে গাঁথি নব্য জলাভূমি, একাকী উজান গামি থাকি রোজ মেঘের অধীন। আছো কি তুমিও পাশে, যে তোমার করি আরাধানা ? উজাইয়ের মাছ জানি স্থলস্রোতে করিও ভজনা।...তোমাকে রেখেছি, অজানা ডেকেছি, এসেছি এত যে দূর। ভুলে-ভালে দিন, হয়েছে বিলীন-তবু কি ভাঙ্গিলো ঘোর ? গুহাগাত্রে নামাবলি, এঁকেছিলে তুমি বুঝি, জন্মে-জন্মে এই পথে, তারে দেখি তারে খুঁজি। ভুলে-যাওয়া নাম ধরে, যে ডাকিতো ঘরে ঘরে, ফুটে ফুল পন্থহারা যতো-তুমি না ভজেছো তারে, কেনো তবে দোলাচলে, নিজ-ছায়া ভেবেছো আহত? দূরের অতিথি হয়ে যেই গাই নিজগুণগান, এখানেও বংশ-মাঝে ফুটে দেখি অবুদ্ধ বাগান।...বন্দনা করেছি দিন-যে-দিন হয়েছে ভুলে কেবলি আহত, যা কিছু হয়েছে ঋণ-তুলে রাখি মধ্যদিনে শিরদাঁড়া নত। এ-বংশে দিয়েছি বাতি, খুঁজে আনি আঁতিপাতি, মূলসুদ্ধ আধা-অন্ধকার। তুমি এসে বসো পাশে, তোমাকেই নৌকা ভেবে, করি আজ শব্দ পারাপার।...পারাপারে দিন যায় পারাপারে রাত-তুমি কি বেভুলে তারে পরাও প্রভাত ? জেগে জেগে রাত যায় ঘুমে ঘুমে দিন-চক্রবৃদ্ধি হারে বুঝি বাড়ে শুধু ঋণ !...আলো-বিদ্ধ রাত্রি নামে কাছে। ডানা নাড়ে িসগ্ধ সুরে, কী যে রাত কী যে ভোরে, জন্মদাগ ঋণ পড়ে আছে। যদি থাকে মনঃস্তাপ, না করিও ভুলে মাফ, বংশ রক্ষা কুল রক্ষা রেখেছি অধীন। ভেলকিবাজি দেখে-টেখে, অযথা গন্তব্য রেখে, ঘুমঘোরে পড়ে থাকি, বেহুদা যেদিন। এ-দেহ ভুলে থাকি, এ-দেহ পুষে রাখি, অন্তর অধীনতায়। লুপ্তনাম ভোলে হাঁকি, যা কিছু রোদ মাখি, তা কি রক্ষা পায় ? মধ্যঘোরে তুমি উঠে, ডাক দিলে নিদ্রা টুটে, এ-নিদ্রা লখাইর বাসর। কী করে ভাঙ্গিবে ঘোর, এ-কর্ণে বিঁধেছে সুর, এ-চক্র নিজস্ব আছর।...পথে পথে হলো দেখা, তুমিই দিয়েছো ব্যথা, আবার নিয়েছো বুকে তুলে। ডেকে ডেকে নাম ধরে, এ-নামের শান্তি ঝরে, একদা জাগিও সন্ধ্যা হলে। তোমাকে ডেকেছি ভোরে, অনেক পৃথিবী ঘুরে, তুমিই দিয়েছো যতো তৃষ্ণা-নিবারণ। কেনো তবে এই নামে, তৃষ্ণা জাগে বারেবারে, তোমার নামের সুরে কণ্ঠ আহরণ।...লিখি রোজ পদ যতো তোমার নামের, যদি কিছু হয় ভুল, ছিন্ন করি জাতিকুল, ক্ষমা করে দিও তুমি বিক্ষিপ্ত দিলের।...আজ দিন ভালো লাগে, আজ দিন চেনা লাগে, তুমি বড়ো হাসি-হাসি তাই। কাল দিন ভালো রবে, কাল দিন নয়া হবে, তোমার চোখেতে টের পাই।...পুষি অন্ধ আঁখি, ভোরে জাগা পাখি, বাঁধি সুরের রাকাত। তুমি কি ধরিবে, এ-হাত বাঁধিবে, যদি মিলায় সাক্ষাৎ ? সেই সব কথা, ছিলো যথাতথা, বলে কাটাবো প্রহর। তুমিও শুনিবে, এ-সুর ধ্বনিবে, গাবে কীর্তন-আখর। তুমিও জ্বালিও, বংশের চেরাগ, এই মায়ামগ্ন-ঘরে। তুমিও পুষিও, বসন্ত বেহাগ, যতো বৃষ্টি-ঝঞ্ঝা-ঝড়ে।...ধরে আছি বংশবিদ্যা, আমাকে বাতাও তুমি এমন তরিকা-ম্লান করে পৃথিবীর তাব- কুলীন, হয় যেনো সিলসিলা স্বরূপে হাজির। একদিন গীত হবে এ-বংশের বাতুনি জিকির।...আর কি নিদানি থাকি, আর কি বেদ্বীন, এই কর্ণে পশেছে যেই মীরার ভজন ? সাক্ষী জ্ঞাতি এই দিলে নানক-কবীর, এ-রক্তে মিশেছে কোন হাওয়ার দূষণ ! রচিলে তুলসি দাস বংশবাতি জ্বলে, লালনের ঘর জোড়ে পড়শি বিরাজে। এ-ভিটা কি খালি থাকে, থাকে কি অধীন ? জালাল ধরেছে গীত সন্ধ্যা ফানা করে। জগত মজেছে ঘুমে দীর্ঘ চুপিসারে, চণ্ডিদাস বিপ্রলব্ধা রাধিকা ভজেছে। সেই সুর ওঠে না কি, সেই সে-বিরহ ? দোলে নৌকা নীলাম্বরী আত্মসমাহিত। এ-দিন কাহারে দানি, কে সে তুমি দেবী ? ভারতচন্দ্রে পদে দিয়েছিলে ভর। রোসাঙ্গ রাজের সভা পদ্মাবতী রূপে, আলাওল আনে বুঝি বংশের ঝলক ? আমি এক দীনহীন সভাসদগণে, কী করে কী লিখি আজ রূপের বাহান ! লিখেছে অতীত কবি জ্ঞানদাস নাম, সেই বাণী-তুঁহু বিনে আন নাহি জানি, তাহার পদের নামে জানাই প্রণাম।...এ-নাদ তোমার মাঝে শান্ত-সমাহিত, এ-নাদ তোমার নামে স্তব্ধ অনাহত। ত্রিস্বরে বিবাগী মন সপ্তমে বিলায়, তোমাতে বিলীন নাদ ব্রহ্মরূপ পায়। তুমি দেবী ধরো হাত ক্লান্তি-নামা রাতে, আহত বারিষা নামে গম্ভীর বিহাগে।...তোমাকে নিয়ত জপি চৌত্রিশ প্রকারে, তোমাকে প্রত্যহ গড়ি মন্ময় আকারে। পরমগীতের ধ্বনি এই দেহে বাজে, তুমি কি উছিলা করে এ-হাত ধরিবে ? ওহো দেবী পরমার্থ অধমের ধন, তোমাকে জপিতে দিলে মলিন বদন। নিজের চৌহদ্দি রেখে অচেনা ভূগোল, কে দিলো কপালে তোলে এমন আগল ? ক্ষিদীর্ণ বিনীত ডাক তোমার বচন, জীবন-জীবিকা করে পেয়েছে ক’জন ? কাদা-মাঝে হংস যথা-শিখিয়েচো তুমি, কর্দমাক্ত দেহভাণ্ড যাচে জলাভূমি।...গহন জলান্ধ-জলে হিজল সুরত-রঙ্গের মাতম ওঠে নদীয়ার ঘাটে। আর নি উঠিবে সুর-মদির মন্দিরা কাঁদে-রাই বিরহিনী, কদম্ব তরুর ডাল-হস্তদ্বয় ডুবিয়েছি বাঁশুরির ডাকে। আমারে তরাও তুমি-বিনোদিনী-বৃন্দাবনে আহাজারি নামে ! আঁখি যুগলের মাঠে-শব্দাক্রান্ত জ্বরে-বংশের রাখালি করি রাত্রি ঘন হলে।

মোনাজাত : কহে শ্রী ইরম, কুলহারা মন, পদে কি গছিবে হায় ! যতনে পরাও সুরের মহিমা, ধরেছি গীতের পায়।






মুজিব ইরম : জন্ম ১৯৬৯, নালিহুরী , মৌলভীবাজার।

প্রকাশিত কাব্য-গ্রন্থ : মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান ১৯৯৬, ইরমকথা ১৯৯৯, ইরমকথার পরের কথা ২০০১, ইতা আমি লিখে রাখি ২০০৫, উত্তরবিরহচরিত ২০০৬, সাং নালিহুরী ২০০৭, শ্রী ২০০৮। শিশুসাহিত্য : এক যে ছিলো শীত ও অন্যান্য গপ ১৯৯৯। উপন্যাস/আউটবই : বারকি ২০০৩, মায়াপির ২০০৪, বাগিচাবাজার ২০০৫।

পুরস্কার : মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান-এর জন্য বাংলা একাডেমী তরুণ লেখক প্রকল্প পুরস্কার ১৯৯৬।

কোন মন্তব্য নেই:

morou kobita