মন্দিরাকে বুকে আঁকড়ে ফিরে যাব চাঁদের শহরে, অ্যালসেশনের মতো ড. আকবর লিখুন কালের ইতিহাস
পীর হাবিবুর রহমান: সুনামগঞ্জের দেখার হাওরে আষাঢ়ে পূর্ণিমা রাতে চাঁদের আছড়েপড়া রূপের সঙ্গে জলতরঙ্গের খেলা উপভোগ করতে অনেকেই আগ্রহী। হাওরে জ্যোৎøায় অঙ্গ ভিজিয়ে গল্প করতে দেশ-বিদেশ থেকে অনেকে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আমি ওয়ান-ইলেভেনের কট্টর সমর্থক। পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা আমার বুকে হাওরের ঢেউয়ের মতো আঘাত হানে। আমি তাই বারবার বলি কোথাও আমার হাত-পা বাঁধা নেই। তবু আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল। আমার চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছা করে, ফিরিয়ে দাও আমার সাদা-কালো যুগের রাজনীতি। বন্ধ করো রাজনীতির রঙিন ছবি।
ওয়ান-ইলেভেনের লক্ষ্য অর্জিত না হলে আমার মতো অনেকেই স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ব্যথিত হতাশ হবেন। ওয়ান-ইলেভেন বিজয়ী হলে জনগণ জিতবে। হারলে জনগণ পরাজিত হবে। তাই ওয়ান-ইলেভেনের উদ্যোক্তা, সমর্থকদের বলবো বিবেকের কারফিউ ভেঙে সত্যকে সত্য বলুন। সবাইকে শোনাই নজরুলের কবিতার পঙক্তিÑ ‘দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার/লঙ্ঘিত হবে রাত্রিÑ নিশীতে যাত্রীরা হুশিয়ার/ দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ/ ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ? কে আছে জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ। এ তুফান ভারি দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার’। কোথায় চলেছে স্বদেশ, তা নিয়ে আমার এই কবিতাটি স্মরণ।
বারবার বলেছি ২৭ ও ২৪ বছরের রাজনৈতিক নেতৃত্বে যোগ্যতা প্রমাণে দুই নেত্রী যথেষ্ট সময় পেয়েছেন। বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণতন্ত্রের বদলে তারা প্রতিহিংসার অসুস্থ রাজনীতি দিয়েছেন। তারা অবসর নিলেই আমি আনন্দিত। রাজনীতিতে ফিরে আসবে কি দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবারতন্ত্র? সন্ত্রাসী, গডফাদার ও লুটেরা দুর্নীতিবাজ? খালেদা জিয়া যখন জনগণের কাছে তার পুত্র, হাওয়া ভবন ও সরকারের দুর্নীতির মহোৎসবের গ¬ানি উপেক্ষা করে লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে বলেন তার ছেলেরা অন্যায় করেনি তখন রীতিমতো ভয় হয়। প্রশ্ন জাগে, তবে কি তারা আবার ফিরে আসবে দানবের বেশে?
আমার লেখার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অনেক কিছুই পাই ফোনে ও ই-মেইলে। ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ’ লেখাটি পড়ে মুগ্ধ মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম টেলিফোনে বলেছেন, জাতির মঙ্গল কামনার পথ থেকে হয়তো পথিক সরেছে, তবে তাদের বেরিয়ে যাওয়ার পথ হারায়নি। আমার তখন টিআইবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের কথা কানে বাজে, নেতাদের ‘জি নেত্রী জি নেত্রী’ সব শেষ হয়ে গেল।
আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় দেশে কি আজ একজন নেতাও নেই যারা শেখ মুজিবের অঙ্গুলি হেলন থেকে কোনো যোগ্যতা অর্জন করেননি? কর্মীদের সুরে নেতা কথা বলবেন নাকি নেতার সুরে কর্মী কথা বলবেন? ভাসানীর ‘খামোশ’ শব্দটি থেকে একজন সাহসী নেতার জš§ হয়নি ভাবলে অবাক হই। ঊনসত্তর যে তোফায়েলের হাতে তুলে দিয়েছিল হ্যামিলনের বাঁশি, মাথায় পরিয়েছিল নায়কের খেতাব, তিনি আমার কতটা স্বজন পাখিরাও জেনে গেছে। তার বাড়ির মধুর আড্ডা, ভোলার মিষ্টি, ভাবীর অতিথেয়তা আর তোফায়েলের রোমান্টিক হাসি আমাকে মুগ্ধ করে। একবার তাকে নিয়ে আমাদের সময়ে লিখলে অনেকে বলেছিলেন, আবেগ থামাও। গায়ে মাখিনি, আজ যখন তাকে দেখি মতিয়া চৌধুরীর উদ্ধৃতি দিয়ে বক্তব্য রাখেন তখন মনে হয়, আজ একি শুনি মন্থরার মুখে? সত্তর ও আশির দশকের ছাত্রনেতাদের মনে মনে খুঁজি, কোথায় মাহমুদুর রহমান মান্না, ফজলুর রহমান, আখতারুজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ, জিয়াউদ্দিন বাবলু, বাহালুল মজুনন চুন্নু, আবদুল মান্নান, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, ফজলে হোসেন বাদশা, খ ম জাহাঙ্গীর, মুকুল বোস, মনির উদ্দিন আহমদ, হাসিব খান, শিরিন আখতার, ডা. মোশতাক হোসেন, জিয়ার শার্টের কলার ধরতে যাওয়া হাবিবুর রহমান খান, তোমরা সাহসী হও। প্রতিটি শহরে-গ্রামে তোমাদের কত অনুসারী-ভক্ত। বিবেকের কারফিউ ভেঙে কড়া নাড়ো মানুষের দরজায়।
বঙ্গবন্ধু মানুষের দরজায় কড়া নেড়ে সামন্তবাদী মুসলিম লীগ আর পাকিস্তানি শাসকদের একসঙ্গে পদ্মা-যমুনায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। জনতার শক্তির চেয়ে বড় কোনো শক্তি আজো পৃথিবীতে আসেনি। জনতার অন্ধ আবেগে কড়া নাড়ো, তাদের চোখ খুলে দেয়ার দায়িত্ব নাও। যদি সংস্কার ও রাজনীতি এবং প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়া বিষ ঝেড়ে না ফেলে নির্বাচন হয় তাহলে তা দেশকে ওয়ান-ইলেভেনের পূর্বে নিয়ে যাবে। এখনই বলাবলি হচ্ছে রাজনীতি ওয়ান-ইলেভেনের আগের জায়গায় যেতে ধীর লয়ে পিছু হটছে।
যদি এমন হয়, বলি, ‘জাগো বাহে কোণ্ঠে সবাই’। যদি এমন হয় তাহলে আমি চলে যাব আমার শহরে। মার মন্দিরাকে বুকে আঁকড়ে ধরে টিনের ঘরে মুষলধারে নেমে আসা বৃষ্টির শব্দ শুনব। হাওর দেখব জ্যোৎøা রাতের বজরায়। বারান্দায় মুখোমুখি বসে নির্মলেন্দু গুণের কবিতা শোনাবÑ ‘শুধু একবার তোমাকে ছোঁব/ ঐ আনন্দে কেটে যাবে সহস্র জীবন/ শুধু একবার তোমাকে ছোঁব/ অহংকারে মুছে যাবে সকল দীনতা/ শুধু একবার তোমাকে ছোঁব/ শুধু একবার পেতে চাই অমৃত আস্বাদ/ শুধু একবার তোমাকে ছোঁব/ অমরত্ব বন্দি হবে হাতের মুঠোয়/ শুধু একবার তোমাকে ছোঁব/ তারপর হব ইতিহাস। যদি এটা ভালো লাগে তাহলে বলবÑ ‘হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে/ মন বাড়িয়ে ছুঁই/ দুই কে আমি এক করি না/ এককে করি দুই/ হেমের মাঝে শুই না যবে/ প্রেমের মাঝে শুই/ তুই কেমন করে যাবি? পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া/ আমাকে তুই পাবি। তবুও আমি আর ওই লুটপাট রক্তপাত, দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি দেখতে এই ঢাকা ছেড়ে চলে যাব আমার আঁতুড়ঘরে। তোমরা যারা রাজমহলের কৃতদাসদের সঙ্গসুখ নিয়ে রাজনীতি করার মানসিকতা রাখো, তারা দেশ শোষণ করো। ১৫ কোটি মানুষের দেশ থেকে যদি নৈতিক মনোবল, দৃঢ় সাহসী ও সৎ একজন নেতা দেশের শূন্য নেতৃত্ব পূরণে বেরিয়ে আসতে না পারে, পুনর্বহাল হয় দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবারতন্ত্র তাহলে আমি গ্রামের ছেলে. কবিয়াল লড়াই বাউলের আসরে ডুবে যাব।
২. তিরুনেল¬াই নারায়ণাইয়ার শেষণ (টিএন শেষণ) ১৯৯০ সালে ভারতের মুখ্য নির্বাচন আধিকারিকের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তার আগে ’৫৪ সালে আইএএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে সরকারি প্রশাসনে যুক্ত হন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা সচিব, প্রতিরক্ষা সচিব ও কেবিনেট সচিবের দায়িত্বও পালন করেন। নয়টি ভাষায় কথা বলতে পারেন। ভালবাসেন কর্তব্যনিষ্ঠ জীবন ও নীরব কর্মপ্রবাহের পরিবেশ শব্দ সন্ধান করতে। ব¬্যাক টি পানে আসক্ত শেষণ কর্ণাটকি সঙ্গীতের একজন মুগ্ধ শ্রোতা। নিজেকে রহস্য করে শেষণ বলেন, ‘অ্যালসেশন’। কেন বলেন তা খোলাসা করেননি। তার লেখা ‘ভারতের অধঃপতন’ বইটি পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি। ভূমিকায় তিনি বলেছেন, বইটি লিখতে গিয়ে তিনি বহু বিনিদ্র রজনী ভেবেছেন, তার দেশের চারিত্রিক অবনতির কথা ভেবে, যেন তাদের চরিত্রশক্তি আবার পুনরুজ্জীবন হয় এবং এর জন্য তিনি কি করতে পারেন।
তিনি লিখেছেন, আমার দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা অনেক কিছু নিয়ে বহু বিষয়ে পরিব্যপ্ত। তাই মনে হল, আমার ভাবনা-চিন্তা স্পষ্ট করে তুলতে সবচেয়ে ভালো হয়, যদি কাগজে-কলমে সেগুলো লিখে ফেলি। এই হল বইটির জšে§র ইতিহাস। তিনি বলেন, বই পড়া শেষে পাঠক জিজ্ঞেস করতে পারেন, আপনি কি মনে করেন ভারতের আর কোনো আশাই নেই, মোটেই তা নয়। কিš' ভারতকে যদি বাঁচাতে হয়, শুধু বাঁচতে নয়, তার প্রাপ্য মর্যাদা আবার অর্জন করতে হয় তাহলে আমাদের সবাইকে তার উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের জন্য কাজ করতে হবে। একটি কর্মসূচি, ভবিষ্যতের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা আমি প্রণয়ন করেছি। সেই বাস্তবসম্মত পথে ভারতের পুনর্জš§ ঘটতে পারে।
বইটিকে তিনি চারভাগে ভাগ করেছেন। সেই চারটি ভাগ মোটামুটি জাতির দেহ, মন, আÍা এবং রক্তের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে বলে লেখকের অভিমত। প্রথম ভাগে গণতন্ত্রের চারটি অঙ্গÑ প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, গণপ্রচার মাধ্যম এবং রাজনৈতিক সংগঠনের কথা বলেছেন। একইসঙ্গে গণতান্ত্রিক কাঠামোর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ অর্থাৎ আমলাতন্ত্রও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। দ্বিতীয় ভাগের বিষয় বলতে জাতির ‘মন’ বলে যেটাকে মনে করা যায়, তার বিষয়ব¯' হল অর্থনীতি, মানবসম্পদের ব্যবহার, পরিবেশ, পরিকল্পনা, সুরক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্প এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়ে তাদের ভ্রান্তনীতির কথা। তৃতীয়ভাগে জাতির আÍা, দৃষ্টিপাত করেছে তাদের বিচিত্র এবং সমৃদ্ধ ধর্মীয় উত্তরাধিকার এবং সাংস্কৃতিক সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে সেসব কথা।
একটি প্রশ্ন এসেছে, যাকে লেখক মারাÍক বলে মন্তব্য করেছেন। তা হলো, ভারতীয় বলতে কী বোঝায়? সর্বশেষ ভাগের আলোচনায় এসেছে জাতির প্রাণশক্তির যা আধার তার সেই রক্ত, অর্থাৎ নির্বাচন, নির্বাচন প্রক্রিয়া। তিনি বলেছেন, এ বই লিখতে গিয়ে আমাকে চিন্তা করতে হয়েছে আরো গভীরভাবে, আমাদের জাতির সামনে যেসব সমস্যা এখন এসে দাঁড়িয়েছে তার সম্বন্ধে জাতির অবনতি যিনি রোধ করতে চান, আবার তাকে মহান করতে চান, এমন প্রত্যেকটি পাঠকের চিন্তা-ভাবনায় আমি যদি কিছু সহায়তা করতে পারি তাহলেই এ বই সার্থক।
ইতিহাসের পাতা থেকে তিনি শাসক সম্রাট অশোক ও সম্রাট আকবরের নাম উলে¬খ করে বলেছেন, তারাও গায়ের জোরের চেয়ে ন্যায়-নীতিকে বেশি মর্যাদা দিতেন। রাজা কিংবা রাজ্যশাসকদের এই আদর্শ, যার নৈতিক চরিত্র হবে নিষ্কলুষ। এই সেদিন পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীন হয় তখন পর্যন্ত তা বজায় ছিল খানিকটা মহাÍা গান্ধীর প্রভাবে, খানিকটা নৈতিক সংস্কৃতির ঐতিহ্যের কারণে। তার কারণে সেসময়ে এমন কয়েকজন নেতা ছিলেন, যাদের সম্পর্কে বলা যায়, ‘অকপট, সোজা মানুষ’। যেমন সরদার বল¬ভ ভাই প্যাটেল, পণ্ডিত গোবিন্দ বল¬ব পন্থ এবং জন মাথাই। এ আদর্শ ৬০ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিল। লালবাহাদুর শাস্ত্রী এবং কে কামরাজের মতো লোকেরা দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন। ছেলেবেলায় শাস্ত্রী সাঁতরে নদী পেরিয়ে স্কুলে যেতেন, সে গল্প সবাই জানেন। তাহলে কি হবে, অত উচ্চ পদ ব্যবহার করেও সর্বসাধারণের অর্থের অপব্যবহার তিনি কখনো করেননি।
নেতাদের মধ্যে কারো কারো জš§ই হয়েছিল ঐশ্বর্যের ক্রোড়ে, যেমন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। আর্থিক প্রাচুর্যই বলুন, কিংবা তার ফলে যা কিছু লাভ করা যায় সে কথাই বলুন, সবই তারা অবহেলা করতে পারতেন। কিš' শাস্ত্রীর মতো যাদের জš§ দরিদ্র ঘরে, তাদের পক্ষে দৃঢ় নৈতিক চরিত্রের প্রয়োজন ছিল প্রবল। লেখক বলছেন, নৈতিক চরিত্র কথাটা আমি সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করছি না। নারীদের সম্পর্কে আপনার আচরণ কেমন, আমি চোখ ফেরালেই ফাউন্টেন পেনটি আপনি হাতিয়ে নেবেন কিনা সে কথা বলছি না। একজন নেতার ক্ষেত্রে নৈতিক চরিত্রের প্রশ্ন আরো বড় আকার ধারণ করে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, এই বিশেষ গুণটির কদর এখন অনেক কমে গেছে। দুর্নীতি, সরকারি অর্থের অপব্যবহার, এ তো হবেই। লোকে তাই ধরে নেয়। মন্ত্রী মশাই জনসাধারণের কোটি কোটি টাকা পকেটে পুরবেন এবং ধরা পড়লেও বলবেন ‘গদি ছাড়ব না’। ইঞ্জিনিয়ার এবং ঠিকাদাররা এমন বহুতল বাড়ি বানাবেন, যা কয়েক মাসের মধ্যেই ধসে পড়ে তাদেরই জ্যান্ত কবর দেবে।
লেখকের ভাষায়, ভারত সরকারের একজন সচিবের ব্যক্তিগত সহকারী এক মন্ত্রীকে ৬৮ হাজার টাকা দিয়েছিলেন একটি আবাসন যেন তাকে অ্যালট দেয়া হয়। ওই পরিমাণ অর্থের বিনিময়েই তার চাহিদা পূরণ করা হল। এক্ষেত্রে টাকা যিনি দিলেন তিনি সবচেয়ে নিচুতলার সরকারি কর্মচারীদের একজন। আর টাকাটি পেলেন রাষ্ট্রমন্ত্রী। এই দৃষ্টান্তটির সবচেয়ে মারাÍক দিকটি হল মন্ত্রী মহোদয় তার জীবনচর্চার অঙ্গীভূত করে নিয়েছেন এই ধরনের ব্যাপারকে। দেশের সর্বোচ্চ নেতাদেরও ক্ষমতা নেই তাকে পদচ্যুত করার। এ ধরনের ঘটনা এখন আর ব্যতিক্রম নয়। নিয়মেই দাঁড়িয়েছে। আর পরিণতি কি দেখছি, এই নৈতিক অধঃপতনের রাজনীতি, প্রশাসনে বিচার ব্যবস্থায়, সমাজে অবক্ষয়ের মূলে যার বাসা! পরিণতি সবই দেখতে পাচ্ছি, একমাত্র রিস্টওয়াচ ছাড়া। ‘টাইটান’-এর দেখা আর কোথাও পাওয়ার জো নেই।
পচন কতদূর পৌঁছেছে বুঝতে গিয়ে শেষণ বলেন, ভারতে লোভনীয় যেসব পেশা তার একটি হল সিভিল সার্ভিস। পঞ্চাশের দশকে একজন আমলা ছিলেন এমজি পিমপুটকর। অফিসে নিজের টেলিফোনের পাশে পয়সা ফেলার বাক্স রাখতেন। আর যখনই ব্যক্তিগত কোনো ফোন করতেন কুড়িটি পয়সা সেই বাক্সে ফেলতেন। আর আজকের একজন আইএস অফিসার যদি সরকারি গাড়িতে করে তার স্ত্রী-পুত্র-পরিজনকে সিনেমা দেখতে পাঠান তাহলে কেউ ভ্রƒক্ষেপও করে না। ভারত বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিকতা জাতীয় ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলের এক টেবিলে বসা, একটি অবাধ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাই যথেষ্ট। কার্যকর সংসদে সরকারের জবাবদিহিতা মিলিয়ে বলা হয় সেদেশে মানুষের দেশপ্রেম সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে।
এমনি অবস্থায় ডাকসাইটে ব্যুরোক্রেট আর চিফ নির্বাচন কমিশনার যখন বলেন, নিচুতলার কর্মচারীকে ফ্ল্যাট দিয়ে মন্ত্রী টাকা নেন, তাতেই তিনি বলেছেন পচন ধরেছে। তিনি নির্বাচনকে তামাশায় পরিণত করতে কংগ্রেসকে প্রধান আসামি করলেও দায়ী করেছেন সবাইকে এবং সব সরকারকে। ভোট কেন্দ্র দখল ভোটের বাক্স বোঝাই করার কথা বলেছেন। এমনকি পাটনায় রাজ্যসভার একটি নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী ভোট কেন্দ্র দখল করে সিল মারায় তা বাতিল করে যখন পুনঃনির্বাচন দিলেন তখন আর কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।
শেষণের কথার শুরু থেকেই যখন নেহরু লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে কামরাজদের কথা বলেন, তখন আমার দেশের রাজনীতির ইতিহাসের চাকা পিছনে ঠেলে আমি তৃপ্তি পাই।
৩. এখানেও সৎ দেশপ্রেমের রাজনীতির মডেল হয়েছিলেন হয় প্রাচুর্য থেকে এসে, না হয় মানুষের সাহায্যে রাজনীতি করে। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এমনকি আতাউর রহমান খান, বিত্তসুখে থাকা মুসলিম লীগের ফজলুল কাদের চৌধুরী, সবুর খান, বামপাড়ার কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিংহ, ন্যাপের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, মাহমুদ আলী এসব সাদা-কালো যুগের রাজনীতিবিদরা দেশের জন্য কতই না কল্যাণের রাজনীতি করেছেন। কি করুণ যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে কতটা সংগ্রামের পথ ধরে শেখ মুজিবের কঠোর পরিশ্রম, অধ্যাবসায় সামন্ত শ্রেণীর মুসলিম লীগের ওপর উঠিয়ে নিয়ে এসেছিলেন আওয়ামী লীগকে। রাজনীতিতে টুঙ্গীপাড়া থেকে উঠে খোকা নামের তরুণটি সোহরাওয়ার্দীর গণতন্ত্রের শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়েছিলেন। গভীর দেশপ্রেম, মানুষকে ভালবাসার মতো, সাগরের মতো হƒদয় নিয়ে রাজনীতি করেছিলেন বলে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে উঠেছিলেন।
ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত বিকাশ হয়েছিল মুজিবের হাত ধরে। সাধারণ মানুষের মন জয় করে রাজনৈতিক সচেতন মধ্যবিত্ত, বাঙালি উঠতি উচ্চবিত্তদের ছোট্ট অংশ নিয়েই তার উত্থান! সর্বোপরি তৃণমূল পর্যায়ে সভা করে করে সংগঠন দাঁড় করানোর অসাধারণ কাজটি তিনি করেছিলেন। এই আওয়ামী লীগের দায়িত্বের জন্য তিনি যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা থেকে সরে দাঁড়াতে দ্বিধা করেননি। রাজনীতিতে জনগণকে তারা এতটাই ভালবেসেছিলেন যে, মুজিবের পাইপ, মোনায়েমের চশমা, ভাসানীর টুপি যেন ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে গেল।
’৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে মুজিবকে দমাতে কয়েকশ টাকার দুর্নীতি মামলা দিলেন। আদালতে সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন, ‘মুজিব করাপ্ট হলে দুনিয়া করাপ্ট’। আজ ভাবি, ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক লড়লেও এমন জোর দিয়ে কথা বলতে পারছেন না।
’৫৪ সালে কৃতি ফুটবলার ও ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপু ছিলেন ভাষা মতিনের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্দোলনের অপরাধে তাকে বহিষ্কার করলে তার সৎ সরকারি কর্মকর্তা বাবা বলেছিলেন, বাড়ি ভাড়া করে পড়ানোর সামর্থ্য আমার নেই। রাজশাহী ফিরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হলেন তিনি। তার হাত ধরে রাজশাহী কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন কাজী জাফর আহমদ। তার অতীতও ছিল শ্রমিক রাজনীতি ঘিরে বর্ণাঢ্য।
শেখ মুজিবকে ঘিরে যখন ’৬৯-এর উš§াদনা, গণঅভ্যুত্থান হল তখন তার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু। ’৭০ সালের গণরায় নিয়ে তিনি জাতিকে এক সুতোয় বাঁধলেন, তখন মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, মুজিব অনেক উপরে চলে গেছে। তাকে স্পর্শ করার দিন শেষ। এখন তাকে সমর্থন দেয়ার সময়। ছাত্র রাজনীতিও তখন এতটাই সম্মানের উচ্চাসনে ছিল যে, মানুষ আজকালের রাজনীতিবিদ, মন্ত্রীদের চেয়ে সেদিনের ছাত্রনেতাদের বেশি সম্মান করত। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল, স্বাধীনতা তাই তিনি দিয়েছেন। তার নামে আসা বাংলাদেশকে যদি কেউ গণপ্রজাতন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন আমি মধুর ভুল বলে প্রশ্ন তুলব না।
ভারতের ডাকসাইটে আমলা শেষণ যখন ভারতের অধঃপতনের নমুনা বলেন, তখন আমি বিস্মিত হই। এত বড় গণতান্ত্রিক দেশে ছোট ভুল-ত্র“টি থাকতে পারে। পৃথিবীর সব দেশেই কম-বেশি দুর্বলতা আছে। ভারতে সিভিল প্রশাসনের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের অহমের দ্বন্দ্ব থাকলেও এখানে অবস্থা করুণ। ভারতে চিফ নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা রাখেন। আর আমাদের দেশে একজন একনায়ক, গণতন্ত্র হরণকারী এরশাদকে সরিয়ে যে স্বর্ণযুগের স্বপ্ন দেখেছিলাম তা আর পেলাম কই? মাগুরার উপনির্বাচন থেকে যে শিক্ষা জাতি পেয়েছিল তাতে নির্বাচন কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথ আর সিইসি বিচারপতি আবদুর রউফ মাগুরা ছেড়ে লজ্জা ঢাকতে চেয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হল নির্বাচন নিরপেক্ষ করতে। নির্বাচন নিরপেক্ষ হলেও পরাজিত দল কারচুপির অভিযোগ করেছে বারবার।
শেষণ তার দেশের সিভিল অফিসারদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, যদিও তার বেতন আহামরি কিছু নয়, বিলাসবহুল বাড়িতে থাকেন, যে বাড়ির আসবাবপত্র এবং অন্যসব সাজ-সরঞ্জামের দাম কয়েক কোটি টাকা এবং তার ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে লন্ডনে, ঠিকাদারদের খরচে। শেষণের লেখা পড়লে আমার সাবেক সেনাপ্রধান হাসান মশহুদ চৌধূরীর কথা মনে হয়। তিনি তার স্ত্রীকে বান্ধবীর বাড়ি যেতে অফিসের গাড়ি দেননি বলে শুনেছি। ড. আকবর আলি খানের কাছে বলতে ইচ্ছা করে, আপনার কথা মানুষ শুনছে। আপনি বলুন সঙ্গে লিখুন কালের ইতিহাস।
আমি যখন এরশাদ শাসনামলের সঙ্গে পরের দুই দলের তিন সরকারের তুলনা করি তখন অনেকেই মনে করেন, এরশাদের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা আছে কিনা। আমার তা নেই। এরশাদ ও তার জাপাকে তুনোধুলো করা অসংখ্য রিপোর্ট করেছি অনেকবার। যাক, আমরা বলেছি এরশাদ সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করে এক নায়কতন্ত্র চালিয়েছিলেন। তাকে সরিয়ে কি আমরা সংবিধান অর্পিত অধিকার ফিরে পেয়েছিলাম? সংসদ কি কার্যকর হয়েছিল।
৫ম সংসদে মাঝে মাঝে সংসদ নেত্রী খালেদা জিয়া হাজির হলেও কথা বলতেন না। সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত তো একদিন বলেই ফেললেন, ‘একটা কথা কও গোলাপি, একটা কথা কও’। দেশের তুখোর পার্লামেন্টারিয়ানরা নেই। কেউ মারা গেছেন, সুরঞ্জিত সেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও তোফায়েল আহমেদের উচ্চতায় ক’জন পার্লামেন্টারিয়ান এখন দেশে আছেন? উত্তর হাতে গুনে পাওয়া যায়নি। যাক, জিয়া দলছুটদের নিয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী প¬্যাটফরম করেছিলেন। মুসলিম লীগের শূন্যস্থান পূরণ করেছিলেন। নব্বই দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদল থেকে বেরিয়ে আসা শতাধিক নেতাকর্মী পরে এমপি হয়েছিলেন। এরশাদ পতনের পর কেউই সংবিধানের প্রতি অবনত মস্তকে শ্রদ্ধা জানাননি। দেশকে দুর্নীতি, সন্ত্রাসের নরকে ক্রমশ পরিণত করেন। র্যাবের জš§ না হলে সাধারণ মানুষ থেকে ব্যবসায়ী কেউ নিরাপদ বোধ করতেন না।
আমি বারবার বলেছি, এরশাদের সময়ে যে দুর্নীতি হয়েছে, রওশন এরশাদের শাড়ির ভাঁজে যে টাকা পাওয়া গেছেÑ এখন তা হাস্যকর ব্যাপার। অস্ট্রেলিয়া থেকে মিল্টন বলেন, এরশাদ জমানায় মেডিকেল মর্গে লাশ আর লাশ আসত। আর আমি বলেছি, আমরা তো বিজয়ী হয়েছিলাম সেই লাশের মিছিলে। শিল্পী কামরুল হাসান বিশ্ব বেহায়ার ছবি এঁকে সাড়া জাগিয়েছিলেন। মোজাম্মেল বাবুরা তা রাতারাতি ছেপে প্রকাশও করেছিলেন। কিš' পরে আমরা কী দেখলাম, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস, দুর্নীতির আমল শেষে খালেদার শেষ আমলে হাওয়া ভবনের দুর্নীতিতে মন্ত্রী-এমপিদের সুযোগ সৃষ্টি হয়। দেশে নামে অন্ধকার যুগ। তাদের আমলে তাদের মুখে বলা রাজনৈতিক কর্মী হত্যা হয়েছে কয়েক হাজার। দুর্নীতির মহোৎসব চলে। পিএসসি প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পর্যন্ত দলীয়করণ করে ক্ষমতায় ফিরে আসার পথ তৈরি হয়। খালেদার সহকর্মী মোসাদ্দেক আলী ফালু রাতারাতি মিডিয়ামোঘল হয়ে যান। কেউ প্রশ্ন তোলেন না এই অর্থের উৎস কোথায়? এত প্রেম! কোথায় আজ হাওয়া ভবনের প্রশ্রয়-আশ্রয়ে থাকা আশিক মার্কা অনাথরা?
তারেক রহমানকে ঘিরে তরুণ এমপিরা নতুন স্বপ্ন দেখেছিলেন। গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের নাম ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়Ñ ‘যেখানে ব্যবসা-কমিশন সেখানেই তারেক-মামুন’; তবু খালেদার ঘুম ভাঙে না। পটুয়া কামরুল বেঁচে থাকলে লাজ লজ্জাহীন কোন বেহায়ার চিত্র আঁকতেন? ১১ মাস জেল খেটেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা, তখন কোথায় ছিল তার কিচেন কেবিনেট? রাজপথে থাকতে একটি বে¬জার পেয়ে যারা আনন্দে লাফাত ক্ষমতা তাদের বেহুঁশ করেনি?
ড. কামাল হোসেন রুগ্ন রাজনীতি বলে চিৎকার করেছেন এক যুগ। তার আর জাসদের নাজমুল হক প্রধানের কণ্ঠে প্রথম উঠে আসে হাওয়া ভবনের দুর্নীতির পরিচয়। এরশাদ গণতন্ত্র দেননি, উন্নয়ন দিয়েছেন। দুই নেত্রী কোনোটাই দেননি। এরশাদ থাকলে ঢাকা আন্তর্জাতিক মানের রাজধানী শহর হতো। কত রাস্তা, ফ্লাইওভার হতো এ কথা আমি বহুবার বলেছি। গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য আরো বাড়ত। একনায়ক কাকে বলে? যার হাতে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে? তাহলে দুই নেত্রীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে তারা কি একনায়ক হননি? নাকি তারা ছিলেন লৌহমানবী?
সিডনি থেকে আকিদুল ইসলাম যখন পরিশীলিত মার্জিত ভাষায় আমার লেখার সমালোচনা করেন তখন আমি মুগ্ধ হই। এরশাদের বাসায় ব্রেকফাস্ট টেবিলে যাওয়া নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। আকিদুল ইসলাম ভুলে যাচ্ছেন আমার লেখক সত্তার পাশাপাশি রিপোর্টার সত্তাও রয়েছে। একজন রাজনৈতিক রিপোর্টারের রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই থাকুক না কেন তার সোর্স থাকতে হবে সব দলে। আমি গোলাম আজমের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে গিয়ে তার আপ্যায়নের অংশ সৌদি খেজুরও খেয়েছি। গোলাম আজমও আমার সঙ্গে ভদ্র-বিনয়ী আচরণ করেছিলেন। আর এরশাদের ব্রেকফাস্টের টেবিল থেকে উঠে আমি তার পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি চুক্তির সই করা কাবিন-নামাটিও সংগ্রহ করেছিলাম যা যুগান্তরে ছাপা হয়েছিল ‘যেভাবে এরশাদ মহাজোটে গিয়েছিলেন’।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ফজরের নামাজ শেষে সুধা সদনে হাসিনার সঙ্গে এরশাদের এক বৈঠক হয়েছিল। এরশাদ চেয়েছিলেন সমঝোতা, কিš' হাসিনার ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারে আÍবিশ্বাস এতটাই ছিল যে তিনি এরশাদকে আমলই দেননি। বৈঠক ভাঙার আগে এরশাদ হাসিনাকে অনুরোধ করেছিলেন, আপনি অন্তত পীরগঞ্জ আসনের নির্বাচন করবেন না। এতে নূর মোহাম্মদ মন্ডলের কাছে আপনার হেরে যেতে হবে। হাসিনা বলেছিলেন, দেখি জনগণ তো আমাকে চায়। কিš' নির্বাচনে হাসিনা পরাজিত হয়ে প্রেস কনফারেন্সে রসিকতা করে বলেছিলেন, এতদিন ভাত পাইনি এখন ভোটও পাইনি।
এরশাদের সঙ্গে সেই ভোরবেলার বৈঠকটি একমাত্র আমিই যুগান্তরে প্রকাশ করেছিলাম। আর এ সত্য প্রকাশের পর আমার ওপর আস্থা বেড়েছিল আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর। একজন রিপোর্টারকে অনেক ঘটনার সাক্ষীও হতে হয় তার সোর্সদের দেয়া সুযোগের কারণে। ব্যক্তি সম্পর্ক কোথায় কি আছে সেটা বড় কথা নয়। একজন সংবাদকর্মী সম্পর্কের ঊর্ধ্বে উঠে রিপোর্ট লিখতে পারলেন কিনা, একজন লেখক সমালোচনা হবে কিনা জেনেও সত্য লিখতে পারলেন কিনা, সেটাই বড় কথা বলে আমি মনে করি। তারপরেও এরশাদের প্রতি আমার কোনো ব্যক্তি মোহ নেই। দুই নেত্রীর ব্যার্থতায় সাধারণ মানুষ এরশাদের উন্নয়নের কথা স্মরণ করে। স্বাধীনতার ৩৭ বছর পরও প্রবীণেরা আইয়ুবের উন্নয়নের গান গাইতে দেখি। সংস্কার হয়নি বলে ব্রিটিশের আইনের প্রশংসা শুনি। রাজনীতির উর্বর ভূমি থেকে মানুষের হৃদয় হরণকারী একজন নেতার আবির্ভাব হয়নি বলে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকে ৭ মার্চের শেখ মুজিবের ভাষণ। আকিদুল ইসলামসহ সব সমালোচনার প্রশংসা আমি সানন্দে গ্রহণ করি। আমার কোনো দলের প্রতি আনুগত্য নেই। অসাম্প্রদায়িক দুর্নীতিমুক্ত সুন্দর বাংলাদেশ আমার স্বপ্ন।
জনগণের প্রত্যাশায় রক্তপাত বন্ধে ওয়ান ইলেভেন রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে চেষ্টা করেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দিয়েছে। পিএসসি, দুর্নীতি দমন কমিশন দলীয়মুক্ত করেছে। এখনও প্রশাসন দলীয়করণমুক্ত হয়নি। এখনও টিআইবির রিপোর্টে দুর্নীতির চিত্র আসে। ভারতের অ্যালসেশনের মতো ক্ষমতা দাও আমাদের ড. এটিএম শামসুল হুদাকে। অ্যালসেশনের প্রতি বলি, তোমরা অনেক ভালো আছ। অধঃপতনের দেখছ কী? গুলশানে এক তরুণ এয়ারলাইন্স এজেন্ট ব্যবসায়ীর কাছে ছিল বিএমডবি¬উ জীপ, কার, জাগুয়ার, মার্সিডিজ গাড়ি। ঢাকা শহরে দুর্নীতির রাজনীতি কাঁচা টাকায় নামিয়েছিল অসংখ্য হ্যামার, বিএমডবি¬উ। লেক্সাস তো ডাল-ভাত হয়েছিল। প্র্যাডো তো তুচ্ছ ব্যাপার। নেশন, উদ্বিগ্ন তার আমলাদের বাড়ির আসবাবপত্র দেখে। আমরা লজ্জিত নই সোনালী ব্যাংকের কর্মচারী বাকের, টিএন্ডটির ফিরোজের সম্পদ বানানোর ইতিবৃত্ত দেখে।
সাফল্যের স্বর্ণশিখর থেকে অবসর নেন মাহাথির মোহাম্মদ। আমাদের দুই নেত্রী শাসনের ব্যর্থতা কাঁধে নিয়েও অবসরের কথা ভাবেন না। খালেদা জিয়া যখন জনগণের কাছে করজোড়ে ক্ষমা না চেয়ে বলেন, তার দুই ছেলে কোনো অন্যায় করেনি, তখন যারা শুনেও মুখে কুলুপ আঁটেন বুঝতে হবে তারা দলকানা, না হয় বিবেকের মৃত্যু হয়েছে। আর খালেদা হারিছের সব লাজ-লজ্জা। সরকার যখন দুই নেত্রীকে বাইরে পাঠাতে যায়, রাজকীয় সম্মানে তখন উঠতেই পারে অনেক প্রশ্ন। যদি বলি তাহলে যারা কারাগারে, যারা বিদেশে স্বেচ্ছানির্বাসনে, তাদের কী হবে?
৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশ আজ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের খবর নাই দিলাম, তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা বানিয়েছে বহুতল বাড়ি, টাকার পাহাড়। এখানে মূল্যবোধ নেই। এখানে লাজ-লজ্জা নেই। আন্দোলন-নির্বাচনের ধ্বনি ওঠে। সংস্কার শেষ না করে কিসের নির্বাচন?
আমার মাহাথির মোহাম্মদের স্বপ্ন শুনে অনেক পাঠক অনেক কথা বলেছেন। আমি বলি, ১৫ কোটি মানুষের দেশে যদি একজন মাহাথির পাওয়া না যায় তাহলে রুগ্ন, অসুস্থ, অসৎ লুটপাটের রাজনীতির ক্যান্সার থেকে দেশকে কীভাবে ঠিক করবেন? ২৭ ও ২৪ বছর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার পর দুই নেত্রীর কাছ থেকে তাদের রক্তের উত্তরাধিকার গ্রহণের মন যাদের আছে, তারা থাক খোন্দকার দেলোয়ার কিংবা মতিয়া চৌধুরীর পাশে। আর যাদের বিবেক আছে তারা যদি মনে কর এই দুটি বড় দলকে নবায়ন করার সাধ্য কারো নেই, তারা বেরিয়ে এস। নতুন জীবনের গান গাও। মানুষের কাছে যাও। নেপালে রাজতন্ত্রের মৃত্যু ঘটেছে। এখানে রাজতন্ত্রের আবহ তৈরি করে যারা কর্মচারীদের নিয়ে গণতন্ত্র ও সংবিধানের সর্বনাশ ডেকেছেন, রাজনীতি কলুষিত করেছেন, দুর্নীতির মহোৎসব করেছেন তাদের আর ফিরতে দিও না। আগেই বলেছি, মানুষ বাঘের পিঠে উঠেছে, বাঘ কাবু কর। বাঘের কাছে কাবু যেন না হও।
আমি শীতলক্ষ্যা নদীতীরে বেড়ে উঠিনি, পদ্মাও টানে না, যমুনায় দেখা হয়নি রাধার সঙ্গে। দেখা হলে না হয় কৃষ্ণের বাঁশি বাজাতাম। সেদিন আমার লেখা পড়ে আওয়ামী লীগের সৎ, সাহসী এক নেত্রী ফোন করে এমন আন্তরিক কণ্ঠে বললেন, তোমার লেখায় অভিভূত, সাহস হারিয়ো না। মানুষ তোমার পাশে আছে। তবে সতর্ক থাকবে। আমি তোমার জন্য দোয়া করব। সৎ সাহসী মানেই মতিয়া নয়, এই দলে সৎ মানুষের সংখ্যা অনেক। যাক, তার কথা শুনে আমার মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ল। মা’র মৃত্যুর সময় পাশে ছিলাম না। ‘কতদিন দেখি না মায়ের মুখ’ গানটি যখন বন্ধু সেলিম চৌধুরী দরদে গায় তখন মনে হয় আর কখনো দেখা হবে না। ওই আওয়ামী লীগ নেত্রীর কথায় মনে হলো, আমার মা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় যেমন দোয়া করে ফুঁ দিতেন, তেমনি যেন আরেক মাতৃহƒদয় আমার জন্য দোয়া করছেন।
৪. জ্যোৎøার শহরে সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরে যদি এবার আষাঢ়ে পূর্ণিমায় রাষ্ট্রযন্ত্রের কেউ যেতে চান তাহলে বলব, জ্যোৎøার নিচে কৃষকের চোখের জলের চিকচিক বেদনাও দেখতে ভুলবেন না। অকাল বন্যায় হাওরের বাঁধ যখন ভাঙে, তখন মাটি বুক দিয়ে আঁকড়ে রক্ষা করতে যায় হাওরবাসী। হাওরকন্যা দিলারা পা’কে বিয়ে করে চাঁদের শহরের জামাই হয়েছিলেন মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ। পানিসম্পদ মন্ত্রী থাকাকালে তিনি হাওর ভাঙনের হাত থেকে ফসল রক্ষায় প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছিলেন। ৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি ধান উৎপাদন হয় এই হাওর অঞ্চলে। পার্লামেন্টে সুরঞ্জিত বলেছিলেন, ৫শ কোটি দাও, আমি বছরে ১ হাজার কোটি টাকা সরকারকে দেব। সাইফুর রহমান তখন তার নামকরণের ফলক লাগানো নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। আমরা অসহায় হাওরবাসীর কণ্ঠে মরমী গানের সুর শুনে আপ¬ুত হই। কণ্ঠের মাধুর্য স্পর্শ করলেও তাদের উদরের শূন্যতা আমাদের স্পর্শ করে না।
এখানকার মরমী গানের শিল্পীরাও বুনো ফুল ফোটার মতো সুবাস ছড়িয়ে ঝরে যায়। মিডিয়া তার খোঁজ নেয় না। বিলুপ্ত প্রাণীর জন্য খরচ হয় কোটি কোটি ডলার। গ্রামে হাত বাড়ায় বিশ্বব্যাংক। কিš' এদের জন্য যেন কারো তাড়া নেই। তাহিরপুরের লাওরাজ্যের প্রতœতত্ত্বের খোঁজ নিতে কেউ যায় না। মহাকবি সঞ্জয় মহাভারতের প্রথম বাংলা রচয়িতা এই ভাটির মানুষ। ‘যদিও জানি মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশিরাম দাস ভনে শুনে পুণ্যবান’। সঞ্জয়কে নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয়েছে কিš' বাংলা একাডেমীসহ কেউ তার খবর রাখে না।
সৈয়দ শাহনুর শাহকে ফকিরের ফকির বলা হয়। ড. মৃদুল কান্তি চক্রবর্তীর ভাষায়, মরমী কবি হাসন রাজা বলেছিলেন, ‘আমি এ যুগের শাহনুর হয়ে এসেছি।’ কবি মোহাম্মদ সাদিক আমার মাটির মমতা মাখানো এক প্রিয় কবি। তার স্ত্রী জেসমিন একজন বিচারক। এই সৎ যুগল দম্পতির জীবন বড়ই সুখের। যদিও সাদিকের রমণীমোহন চেহারা আর কবিতা কিশোরী বালিকাকেও জাদুর মতো টানে। কবি সাদিককে বলব, নাগরি নিয়ে বিশাল গবেষণা শেষ হল। গ্রামের বাড়িতে তৈরি করেছেন ‘ফকির মেলার নিসর্গ’। এবার সাহিত্যে টেনে আনো সৈয়দ শাহনুরকে। যেভাবে রবীন্দ্রনাথ, নির্মলেন্দু চৌধুরী ও সেলিম চৌধুরী ছড়িয়েছে হাসন রাজার নাম। সেলিম রাধারমনকেও উঠিয়ে নিয়ে এসেছে।
তাই বলি কবি সাদিক, মানুষ শুনুক শাহনুরের গানÑ ‘হরিণ ও জঙ্গলার মাঝে বানাইলাম ঘর/ ভাইও নাই বান্ধবও নাই কে লইব খবর?’ বিশ্বায়ন প্রগতি ও অর্থনীতির কথা বলে, মানুষের হƒদয়ের ক্রন্দনের কথা বলে না। হƒদয়বান মানুষের তপ্ত দীর্ঘশ্বাসে হাওরের বাতাস ভারি হয়ে যায়। শুনেছি সাদিকের সামনের কাব্যগ্রন্থ হবে ‘কে লইব খবর’।
লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক যুগান্তর।
ই-মেইল: peerhabib.rahman@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন