একটি বুলেট
মোঃ সেলিম রেজা
শ্যামল ভূমির নিসর্গ রূপে লোভের বেসাতি
বীভৎস দৃশ্যের অবতারণা; হত্যাযজ্ঞ,
রক্তের হোলিখেলায় মৃত্যুর আর্তনাদ
বাংলার মাটির জন্য
বজ্রমুষ্টি অগ্নি শপথ
পিশাচ দম্ভের তীক্ষè প্রতিরোধ
বিপ্লবীর হাতে জ্বলন্ত মশাল
বাতাসে কামানের গর্জন
চোখে প্রতিশোধের আগুন
অজস্র ঢেউ রক্ত কণিকায়
মাথায় হেলমেট
ক্ষুব্ধ রাইফেল হাতে
মরণজয়ী সৈনিক
শুধু একটি বুলেট
যে বুলেট সাতকোটি জনতার
যার বিপ্লবী নাম
জয়বাংলা।
২১ অক্টোবর ২০০৭
দিগভ্রান্ত পদাবলী
মোঃ সেলিম রেজা
কাছাকাছি ফাঁকা জায়গায়
দুরন্ত হাওয়ায় উড়ে শুকনো পাতা;
অসীম শূন্যতায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা
একরাশ অভিমানে জ্বলে আগুন
দূরে সামুদ্রিক মোহনায়
উত্তাল তরঙে ভিড়ে সময়ের ভেলা
অনপনেয় ভরসায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা
জলের আয়নায় মনোরম নৃত্য
আর তুমি আমি আছি এখনও
শূন্যের মাঝে দাঁড়িয়ে।
চ্যানেল আই
৯ম বর্ষে পদার্পন উপলক্ষে
মোঃ সেলিম রেজা
তোমার জন্মদিনে দাওয়াত করলে আমায়
তোমাকে চমকে দেবার জন্যে
পুষ্পনীড়ে গেলাম
সুন্দর দেখে চোখ ধাঁধানো প্রচ্ছদে
বাঁধা নয়টি গোলাপকলি।
আন্তরিকতায় মোড়ানো উপহার
হৃদয়ে রেখেছি তোমার নাম---
আমি বললাম-হ্যাপী বার্ড ডে টু ইউ
চ্যানেল আই- সাথে অনেকে...
আজ জমেছে হৃদয় আঙিনায় মাঙ্গলিক মোহড়া
চারিদিকে আনন্দ হিল্লোল
সবার ভালবাসায় সুদূর প্রসারী হোক আমার চ্যানেল আই।
১ অক্টোবর ২০০৭
ডিজায়ার ওয়ার্ল্ড
মোঃ সেলিম রেজা
দীর্ঘকাল নির্বাসনের পর দিগন্ত পেরিয়ে
উম্মাদের মতো ছুটে আসা;
কবিতার ভেজা ঠোঁট জোড়ায় আলতো চুমু
বাঁধ ভেঙ্গে নেমে আসে চিবুকের দিকে,
তারপর লোমকুপ বুকে কবিতা রাখে মুখ
ঘসে দেয় নাক;
ইচ্ছে মতো সাঁতার কাটে কাম দিঘীতে,
নিভৃত ছন্দ ঝংকার তুলে ডিজায়ার ওয়ার্ল্ড
দেহরস জোয়ারে
গভীর আলিঙ্গনে যেন নগ্ন রূপালী ইলিশ
রাত জেগে মুঠো ভর্তি রতিসুখ
উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে যেন ছড়ানো চুলের সৌরভ
গভীর আশ্লেষে উবে যাওয়া ঘুমের কুয়াশা
কবিতা শুয়ে আছে স্বপ্ন সাম্পানে
আর আমি দাঁড় টানি স্বর্গীয় সুখে।
২৪ আগস্ট ২০০৭
অভীক সহযাত্রী
বন্ধুবরেষু তরুণ কবি সাব্বির আহমেদ সুবীরকে
মোঃ সেলিম রেজা
ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে বারান্দায়
নানান ভাবনা এসে ভীড় করে
কতদিন কেটে গেল, কত বছর!
এখন ঠিক আগের মতো খোঁজ খবর
নেওয়া হয় না কাক্সিক্ষত ঠিকানায়!
মাঝে মাঝে মধ্যরাতে সপ্তর্ষি নক্ষত্রমালা
নিশ্চুপ নিসর্গে শুনে বিরহের সানাই।
বন্ধু তুমি ছিলে সাহসী নাবিক
অহোরাত্রি কবিতার বন্দরে ফেলেছ নোঙর;
দীর্ঘ এই পথে রঙ বেরঙের আলো-ছায়ায়
দিনের পর দিন তোমার সাহচর্যে
কাটিয়েছি পরজনহীন প্রতিটি মুহূর্ত।
নিত্য সহচর কাটিয়ে দিয়েছি
কবিতার পঙক্তিমালায় সত্য-সুন্দরের সন্ধানে
এখনও নিশ্চিত নিরিবিলি খুঁজে চলি
শব্দগুচ্ছ কবিতা পাঠের জমপেশ আড্ডায়
বন্ধু বরেষু সহযাত্রী তোমায়,
যেখানে থাকো না কেন, জীবনের পাঠশালায়
ভালো থেকো এই কামনায়।
৪ আগষ্ট ২০০৭
মঙ্গল গ্রহ
মোঃ সেলিম রেজা
কেউ কোথায়ও নেই;
একা একাই চলি অসম রাজ্যে
তীরের মতো ছুটে আসা একগাদা প্রশ্ন
কোনওখানে নেই বসত, নেই মানুষজন
তবে কেন? শেষমেশ...........
নির্জন পথে পথিকের পায়ের রক্তছাপ!
শুনেছি পুরনো ছিটমহল ভাগাভাগিতে
রাক্ষস খেয়ে গেছে সরলরেখা
সর্বনাশ, কুজোঁ মাথায় ভয়ের ডিপো
ভূ-ত্বকে ফাটল ধরণীর ওঠে নাভিশ্বাস,
স্বপ্নও ভেঙ্গে পড়ে ঝুরঝরে মাটির মতো
সবুজ শূন্য পৃথিবীতে আর নয় বসবাস
খাঁ খাঁ শূন্যতায় যন্ত্রণার বিষফোঁড়া
তবে কী? মঙ্গলগ্রহই ভবিষ্যৎ স্বপ্ন বিলাস!
২৯ জুলাই ২০০৭
আত্মশুদ্ধি
মোঃ সেলিম রেজা
ইদানিং আমি আমাকেই খুঁজছি
আমার যতসব যাতনা-শোক-আত্মপরিচয়
কারণ-অকারণ রাগ-অভিমান দুঃখ
গুজে রাখি নিরবে মনের গভীরে।
শেষ রক্তবিন্দুয় হাঁটছি ভিনদেশী শহরে
অচেনা পথিকের দীর্ঘ পথ।
উঁচু গলায় কথা বলা যদি বাহাদূরী হয়
তবে আমি নিচুতেই থাকি সকাল-সন্ধ্যা।
ধূর্ত বিড়ালের মতো স্বভাব যাদের
নরম মাটিতেই সক্রিয় তাদের ধারালো নখ
নগন্য আমি ঠাই খুঁজি সামান্য পরিসরে
ঝুটো রতি মহারথী পা চাটারাও আজ
জ্ঞানীর লেবাসে কথা বিশারদ,
ছিটেফোঁটা নগদ প্রাপ্তিতে
একজোড়া ছাগল ছানার লাফালাফি
গুটি কয়েক বেয়াডা কাকের উড়াউড়িতে
বুকের খাঁজে রেখেছি পুরনো ঠিকানা।
আমি তো গাছ-পাথর কিংবা শেওলা নয়
মনুষত্ব আছে বলেই সামাজিক-নির্লোভ
প্রাণবাজী ঘোর অন্ধকারে অবিনশ্বর ভালোবাসায়।
১৭ জুলাই ২০০৭
অনুভবে প্রতিদিন
মোঃ সেলিম রেজা
বাহিরে তাকালেই নির্জন গলির পথ;
নিভু নিভু প্রদীপ রাতের অন্ধকারে
তন্দ্রাহীন নিঃশব্দ চোখ-প্রগাঢ় শূন্যতা
বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব হয়, কমে-বাড়ে
প্রতিদিন মরতে মরতে বেঁচে যাই
তবুও অন্তহীন পথ চলা মরুর বুকে
রোজকার সন্ধ্যায় আড্ডার টেবিলে হাসাহাসি
কানাকানি হৈ-হুল্লোড় আরও কত কী...
কাউকে বুঝতে দিইনা আজকাল বুকে প্রচণ্ড ব্যথা
স্বাভাবিক ভাবেই চলাফেরা-সংলাপ
কুশল বিনিময় ঠিক আগের মতো...
অসম্পূর্ণ দু’চোখের স্বপ্ন-স্বাদ-নতুন জীবন
আজ মায়ের মুখ খুব বেশী মনে পড়ে
দিবসনিশি পরিজনহীন একাকী নির্বাসনে
হাফিয়ে উঠি দীর্ঘ প্রতীক্ষায়;
মাতৃভূমে মায়ের কোলে মাথা রেখে
ঘুমাতে খুব বেশী ইচ্ছে করে...
খু-উ-ব বেশী।
১০ জুলাই ২০০৭
৩১.৭.০৮
কুয়েতে হাজার হাজার বাংলাদেশী শ্রমিকদের ধর্মঘট, ব্যাপক গাড়ি ভাংচুর, পুলিশের ধরপাকড় ও অমানবিক নির্যাতন অব্যাহত
কুয়েতে হাজার হাজার বাংলাদেশী শ্রমিকদের ধর্মঘট, ব্যাপক গাড়ি ভাংচুর, পুলিশের ধরপাকড় ও অমানবিক নির্যাতন অব্যাহত
মোঃ সেলিম রেজা, কুয়েত থেকে
শ্রমিক বিভিন্ন দাবী আদায়ের লক্ষ্যে কুয়েতে নতুন করে ধর্মঘট শুরু হয়েছে যার কারণে ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করছে শ্রমিকদের মাঝে। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকা গুলোতে সাধারণ মানুষের চলাফেরায় বিঘœ ঘটে। কুয়েতে ন্যাশনাল ক্লিনিং কোম্পানি, আল-আবরাজ, আল-তুয়েক, আল-জোহরা, সুইডিশ, আব্দুল হামিদ, কেয়ার সার্ভিস ক্লিনিং কোং কুয়েত, আল-রওয়াদসহ মোট ১০টি কোম্পানিতে কর্মরত নারী-পুরুষ বাংলাদেশী শ্রমিকরা নতুন করে ধর্মঘট শুরু করেছে, তাদের বেতন ভাতা বাড়ানো সহ নানা সুযোগ সুবিধার দাবীতে। এসব কোম্পানির শ্রমিকরা কুয়েতের বিভিন্ন সরকারী, আধা-সরকারী ও মালিকানাধিন কোম্পানি গুলোর সেবা বিভাগে কাজ করত। এ নিয়ে কুয়েতে বাংলাদেশী নিম্ন আয়ের শ্রমিকদের মাঝ টানা উত্তেজনা বিরাজ করছে। এদিকে শ্রমিকরা এক সময় বিক্ষুদ্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। ব্যাপক গাড়ী ভাংচুর চালায়। ঐ সময় পুরো এলাকায় ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পুলিশ শত চেষ্টা করেও শ্রমিকদের নিবৃত্ত করতে পারে নাই। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের ডেকে আনা হয় ঘটনাস্থলে। শ্রমিকরা এসব ভাংচুর চালায় বাংলাদেশী অধ্যুসিত এলাকা হিসেবে পরিচিত জিলিব আল সুয়েখ এর হাসাবিয়া এলাকায়। অন্যদিকে আজ সকাল থেকে শ্রমিকরা আবারো জোটবদ্ধভাবে রাস্তায় নেমে আসে। এ মূহুর্তে পুলিশ এবং সেনা সদস্যরা পুরা এলাকা ঘিরে রাখে। সেখানে দ্রুতবাসের শ্রম সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দকী সহ উর্ধতন কর্মকর্তারা এবং স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন এবং শ্রম অধিদপ্তরের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত রয়েছেন। হ্যান্ড মাইকে শ্রমিকদের আন্দোলনের পথ পরিহার করে ফিরে যাওয়ার আহবান জানাচ্ছে। সেই সাথে তাদের দেওয়া সকল দাবী-দাওয়া মেনে নেয়া হবে বলে আশ্বস্থ করছে। তারপরও শ্রমিকরা ব্যারাকে ফিরে যেতে চাইছে না। ব্যাপক আতঙ্ক বিরাজ করছে গোটা কুয়েতে। পুলিশ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে গত রাত থেকে। এদিকে একটি বিশ্বস্থ সূত্র জানায় কোম্পানির হয়ে বাংলাদেশী যেসব এরিয়া ম্যানেজার ও সুপারভাইজাররা শ্রমিকদের নানাভাবে হয়রানি করত তাদের চিন্নিত করে গতরাতে বেদম প্রহার করেছে বিক্ষুদ্ধ শ্রমিকরা। বর্তমানে ঐসব বাংলাদেশী ম্যানেজার এবং শ্রমিকরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তারমধ্যে অনেকের অবস্থা আশংকাজনক। বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্নস্থানের ব্যারাক গুলোর আশে-পাশে ব্যাপক পুলিশ মোতায়ন রয়েছে, যাতে করে আইন-শৃংখলার অতিরিক্ত অবনতি না ঘটে। ধর্মঘট থেকে শ্রমিকদের নিবৃত্ত করতে দূতাবাসের সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করেছে কুয়েতের শ্রম ও সমাজ কল্যাণ সহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রানালয় এবং মালিকপক্ষ। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী শ্রমিকদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে বৈঠক করেছে। তাদের সমস্যাগুলো চিন্নিত করে রাতেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং মালিকপক্ষের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করে শ্রমিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েক দফা দাবী দাওয়া উত্তাপন করেন। অন্যদিকে কেয়ার সার্ভিস, ন্যাশনাল রিয়েলষ্ট্যাট, আল-আবরাক কোম্পানীর প্রায় সাত হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক নতুন করে ৮টি কোম্পানীর শ্রমিকদের সাথে ধর্মঘটে অংশ গ্রহণ করতে পারে এমন খবরের তথ্য ফাঁস হয়ে যায় কুয়েত প্রশাসনের কাছে। এসব শ্রমিকদের ধর্মঘট থেকে বিরত রাখতে শ্রম অধিদপ্তরের উর্ধতন কর্মকর্তারা দূতাবাসের সহযোগিতা কামনা করে। শ্রমিকরা ঐ সময় তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ৬ দফা দাবীনামা পেশ করে শ্রম সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকীর কাছে। সচিব এই ৬ দফা দাবী নিয়ে দফায়-দফায় বৈঠক করেন সংশ্লিষ্ট কুয়েতী কর্মকর্তা ও মালিকপক্ষের সাথে। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পান দূতাবাস। দূতাবাস তড়িৎ গতিতে শ্রম মন্ত্রানালয় এবং মালিক পক্ষের উপস্থিতিতে এই ৭ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিকদের সাথে ওপেন সভা করে জিলিব আল সুয়েখের একটি খোলা মাঠে। হাজার হাজার শ্রমিকদের সামনে তাদের ১৮ দিনার বেতন থেকে ৪০ দিনার বেতন নির্ধারন, থাকার ব্যবস্থা উন্নতি করন, ব্যাংকের মাধ্যমে তাদের বেতন পরিশোধ, ভিসা নবায়নের জন্য কোন ফি নেওয়া থেকে বিরত থাকা, দুই বছর অন্তর-অন্তর ছুটিতে যাওয়ার জন্য টিকেট এবং ছুটির পূর্ণ হিসাব প্রদান। এবং কোম্পানিতে দূর্নীতিবাজ এরিয়া ম্যানেজার এবং সুপারভাইজারদের শাস্তির ব্যবস্থার দাবীগুলো মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন কর্তৃপক্ষ। সেই সাথে মালিক পক্ষের কাছ থেকে এই ৬ দফা দাবী মেনে নেওয়ার স্বাক্ষর নেওয়া হয়। যার কারণে এইসব শ্রমিকরা নতুন করে আজকের এই ১০টি ধর্মঘটি কোম্পানীর শ্রমিকদের সাথে ধর্মঘটে যাওয়া থেকে বিরত থাকে। বিশেষ করে এইসব কোম্পানীর শ্রমিকরা কুয়েতের বিভিন্ন সরকারী মন্ত্রানালয়ের সেবা বিভাগে কাজ করত। হাজার হাজার শ্রমিকদের উপস্থিতিতে এ ধরনের একটি আলোচনা এক বিরল ঘটনা, এটি আগে কখনো দেখা যায়নি কুয়েতে। এছাড়া দূতাবাসের পাশাপাশি এখানকার মানবাধিকার সংগঠন গুলোর পূর্ণ সমর্থন রয়েছ শ্রমিকদের প্রতি। যার কারণে শ্রমিকরা অতি সহজে আন্দোলনের মাধ্যমে বহু-বছরের দাবীগুলো বিনা বাধায় আদায় করে নিতে পারছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো শ্রমিকদের এই আন্দোলনের অবস্থা দেখে সিকাগো শ্রম আন্দোলনের সাথে তুলনা করেছে। অনেকে মনে করছেন এই আন্দোলনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে কুয়েতের ভাব-মূর্তি বিষণভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে।
মোঃ সেলিম রেজা, কুয়েত থেকে
শ্রমিক বিভিন্ন দাবী আদায়ের লক্ষ্যে কুয়েতে নতুন করে ধর্মঘট শুরু হয়েছে যার কারণে ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করছে শ্রমিকদের মাঝে। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকা গুলোতে সাধারণ মানুষের চলাফেরায় বিঘœ ঘটে। কুয়েতে ন্যাশনাল ক্লিনিং কোম্পানি, আল-আবরাজ, আল-তুয়েক, আল-জোহরা, সুইডিশ, আব্দুল হামিদ, কেয়ার সার্ভিস ক্লিনিং কোং কুয়েত, আল-রওয়াদসহ মোট ১০টি কোম্পানিতে কর্মরত নারী-পুরুষ বাংলাদেশী শ্রমিকরা নতুন করে ধর্মঘট শুরু করেছে, তাদের বেতন ভাতা বাড়ানো সহ নানা সুযোগ সুবিধার দাবীতে। এসব কোম্পানির শ্রমিকরা কুয়েতের বিভিন্ন সরকারী, আধা-সরকারী ও মালিকানাধিন কোম্পানি গুলোর সেবা বিভাগে কাজ করত। এ নিয়ে কুয়েতে বাংলাদেশী নিম্ন আয়ের শ্রমিকদের মাঝ টানা উত্তেজনা বিরাজ করছে। এদিকে শ্রমিকরা এক সময় বিক্ষুদ্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। ব্যাপক গাড়ী ভাংচুর চালায়। ঐ সময় পুরো এলাকায় ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পুলিশ শত চেষ্টা করেও শ্রমিকদের নিবৃত্ত করতে পারে নাই। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের ডেকে আনা হয় ঘটনাস্থলে। শ্রমিকরা এসব ভাংচুর চালায় বাংলাদেশী অধ্যুসিত এলাকা হিসেবে পরিচিত জিলিব আল সুয়েখ এর হাসাবিয়া এলাকায়। অন্যদিকে আজ সকাল থেকে শ্রমিকরা আবারো জোটবদ্ধভাবে রাস্তায় নেমে আসে। এ মূহুর্তে পুলিশ এবং সেনা সদস্যরা পুরা এলাকা ঘিরে রাখে। সেখানে দ্রুতবাসের শ্রম সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দকী সহ উর্ধতন কর্মকর্তারা এবং স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন এবং শ্রম অধিদপ্তরের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত রয়েছেন। হ্যান্ড মাইকে শ্রমিকদের আন্দোলনের পথ পরিহার করে ফিরে যাওয়ার আহবান জানাচ্ছে। সেই সাথে তাদের দেওয়া সকল দাবী-দাওয়া মেনে নেয়া হবে বলে আশ্বস্থ করছে। তারপরও শ্রমিকরা ব্যারাকে ফিরে যেতে চাইছে না। ব্যাপক আতঙ্ক বিরাজ করছে গোটা কুয়েতে। পুলিশ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে গত রাত থেকে। এদিকে একটি বিশ্বস্থ সূত্র জানায় কোম্পানির হয়ে বাংলাদেশী যেসব এরিয়া ম্যানেজার ও সুপারভাইজাররা শ্রমিকদের নানাভাবে হয়রানি করত তাদের চিন্নিত করে গতরাতে বেদম প্রহার করেছে বিক্ষুদ্ধ শ্রমিকরা। বর্তমানে ঐসব বাংলাদেশী ম্যানেজার এবং শ্রমিকরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তারমধ্যে অনেকের অবস্থা আশংকাজনক। বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্নস্থানের ব্যারাক গুলোর আশে-পাশে ব্যাপক পুলিশ মোতায়ন রয়েছে, যাতে করে আইন-শৃংখলার অতিরিক্ত অবনতি না ঘটে। ধর্মঘট থেকে শ্রমিকদের নিবৃত্ত করতে দূতাবাসের সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করেছে কুয়েতের শ্রম ও সমাজ কল্যাণ সহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রানালয় এবং মালিকপক্ষ। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী শ্রমিকদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে বৈঠক করেছে। তাদের সমস্যাগুলো চিন্নিত করে রাতেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং মালিকপক্ষের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করে শ্রমিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েক দফা দাবী দাওয়া উত্তাপন করেন। অন্যদিকে কেয়ার সার্ভিস, ন্যাশনাল রিয়েলষ্ট্যাট, আল-আবরাক কোম্পানীর প্রায় সাত হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক নতুন করে ৮টি কোম্পানীর শ্রমিকদের সাথে ধর্মঘটে অংশ গ্রহণ করতে পারে এমন খবরের তথ্য ফাঁস হয়ে যায় কুয়েত প্রশাসনের কাছে। এসব শ্রমিকদের ধর্মঘট থেকে বিরত রাখতে শ্রম অধিদপ্তরের উর্ধতন কর্মকর্তারা দূতাবাসের সহযোগিতা কামনা করে। শ্রমিকরা ঐ সময় তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ৬ দফা দাবীনামা পেশ করে শ্রম সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকীর কাছে। সচিব এই ৬ দফা দাবী নিয়ে দফায়-দফায় বৈঠক করেন সংশ্লিষ্ট কুয়েতী কর্মকর্তা ও মালিকপক্ষের সাথে। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পান দূতাবাস। দূতাবাস তড়িৎ গতিতে শ্রম মন্ত্রানালয় এবং মালিক পক্ষের উপস্থিতিতে এই ৭ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিকদের সাথে ওপেন সভা করে জিলিব আল সুয়েখের একটি খোলা মাঠে। হাজার হাজার শ্রমিকদের সামনে তাদের ১৮ দিনার বেতন থেকে ৪০ দিনার বেতন নির্ধারন, থাকার ব্যবস্থা উন্নতি করন, ব্যাংকের মাধ্যমে তাদের বেতন পরিশোধ, ভিসা নবায়নের জন্য কোন ফি নেওয়া থেকে বিরত থাকা, দুই বছর অন্তর-অন্তর ছুটিতে যাওয়ার জন্য টিকেট এবং ছুটির পূর্ণ হিসাব প্রদান। এবং কোম্পানিতে দূর্নীতিবাজ এরিয়া ম্যানেজার এবং সুপারভাইজারদের শাস্তির ব্যবস্থার দাবীগুলো মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন কর্তৃপক্ষ। সেই সাথে মালিক পক্ষের কাছ থেকে এই ৬ দফা দাবী মেনে নেওয়ার স্বাক্ষর নেওয়া হয়। যার কারণে এইসব শ্রমিকরা নতুন করে আজকের এই ১০টি ধর্মঘটি কোম্পানীর শ্রমিকদের সাথে ধর্মঘটে যাওয়া থেকে বিরত থাকে। বিশেষ করে এইসব কোম্পানীর শ্রমিকরা কুয়েতের বিভিন্ন সরকারী মন্ত্রানালয়ের সেবা বিভাগে কাজ করত। হাজার হাজার শ্রমিকদের উপস্থিতিতে এ ধরনের একটি আলোচনা এক বিরল ঘটনা, এটি আগে কখনো দেখা যায়নি কুয়েতে। এছাড়া দূতাবাসের পাশাপাশি এখানকার মানবাধিকার সংগঠন গুলোর পূর্ণ সমর্থন রয়েছ শ্রমিকদের প্রতি। যার কারণে শ্রমিকরা অতি সহজে আন্দোলনের মাধ্যমে বহু-বছরের দাবীগুলো বিনা বাধায় আদায় করে নিতে পারছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো শ্রমিকদের এই আন্দোলনের অবস্থা দেখে সিকাগো শ্রম আন্দোলনের সাথে তুলনা করেছে। অনেকে মনে করছেন এই আন্দোলনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে কুয়েতের ভাব-মূর্তি বিষণভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাদম্বরী ------ ঘটনার অন্তরালে (শেষ পর্ব)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাদম্বরী ------ ঘটনার অন্তরালে
শেষ পর্ব
স্ত্রীর এই মৃত্যুকে জ্যোতিরিন্দ্র কিভাবে গ্রহন করেছিলেন, সে কৌতুহল জাগা খুবই স্বাভাবিক। কাদম্বরীর মৃত্যুর এক মাস পরেই তিনি জ্ঞানদানন্দিনী, সুরেন্দ্র, ইন্দিরা ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সরোজিনী জাহাজে চড়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে “তিনি যেমন ছিলেন, তেমনি আছেন।“ কিন্তু না, কাদম্বরীর জীবনাহুতি জ্যোতিরিন্দ্রকে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়েছিল। তা না হলে তিনি জীবনের কাছে এভাবে পরাজিত হতেন না। শুধু ব্যবসাতেই যে তিনি পর্যুদস্ত হয়েছেন তাই নয়, তার মতো নাট্যকার কাদম্বরী চলে যাওয়ার পর মৌলিক রচনা বাদ দিয়ে সারাটা জীবন শুধু অনুবাদ নিয়ে কাটিয়ে দিলেন? জমাটি আড্ডার আসর থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন নির্বাসনে। নিজেকেই ভুলে থাকতে চাইতেন হয়তো তিনি। জ্যোতিরিন্দ্রের চারিত্রিক দুর্বলতার কোন সুনিশ্চিত প্রমান কখনও কেউ দিতে পারেননি। মর্হষি তার ছেলে মেয়েদের নৈতিক চরিত্র গঠনে যথেষ্ট সজাগ ছিলেন। এবং তার সন্তানরাও সে আর্দশ মেনে চলেছিলেন। যদিও সে সময় কোলকাতায় বাবু কালচারে নৈতিকতার চরম অধঃপতনের সময় বিরাজ করছিল, কিন্তু ঠাকুরবাড়ির মানুষরা ছিল তাদের থেকে আলাদা। কাদম্বরী যখন তাকে ছেড়ে চলে যায়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র পয়ত্রিশ বছর। কিন্তু তিনি জীবনে দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। প্রচন্ড অনুশোচনা ছিল তার মধ্যে। কেউ তাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলেই তিনি জবাব দিতেন, “তাকে ভালবাসি।“ স্বেচ্ছা নির্বাসনে রেখে তিলে তিলে শাস্তি দিয়েছেন নিজেকেই। শাস্তি দিয়েছেন কাদম্বরীর প্রতি উদাসীন স্বামী জ্যোতিকে। শোনা যায় কিছুদিনের জন্য তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেছিলেন।
যদিও তার রচনায় কাদম্বরীর কথা আশ্চর্যভাবে অনুপস্থিত। এমনকি তার লেখা “আমার জীবনস্মৃতি” কিংবা শেষ বয়সের ডায়রীতেও তার মনের কোন কথা ধরা নেই। আমার জীবনস্মৃতি” তে দু’একটি জায়গায় রেফারেন্স হিসেবে ছাড়া কোথাও কাদম্বরীর কোন উল্লেখ নেই। অথচ রাচীতে তার নিজ বাড়ি শান্তিধামের যে ঘরটিতে তিনি থাকতেন, তার দেয়ালে একটিমাত্র ছবি টানানো ছিল, তার নিজের হাতে আকা কাদম্বরীর পেন্সিল স্কেচ। যদিও রবীন্দ্র ভাইজি ইন্দিরা লিখেছেন, “নতুন কাকিমার নিজের হাতে আকা একটি পেন্সিলের ছবিই সেই ঘরের একমাত্র সজ্জা ছিল” তাতে স্পষ্ট হয় না ছবিটা কার হাতে আকা ছিল। ঠাকুর বাড়ির অনেক মেয়ে - বউই ছবি আকতে জানতেন, হয়তো কাদম্বরীও জ্যোতির কাছে ছবি আকতে শিখেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্র সেই ছবিটিই ঘরে টানিয়ে রেখেছিলেন। নিরাবরন নিরাভরন গৃহের একমাত্র সজ্জা। এই আপাত ভুলে থাকা হয়তো নয় ভোলা। হয়তো সে কারনেই কবিগুরু লিখেছিলেন, চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয় .........। একা থেকে জ্যোতি হয়তো বারবার সেই অসামান্যা নারীর উপস্থিতি অনুভব করতে চেয়েছিলেন।
কেউ কেউ অবশ্য এটাও ভাবতে পছন্দ করতেন যে, কোন এক না বলা কারন নিয়ে রবি আর জ্যোতির মধ্যের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। এর কারন হিসেবে তারা রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি আর নতুন বৌঠানের আত্মহত্যাকে এক সূতোয় বুনতে চান। কিন্তু দুটি কারনকেই সে সময়ের বাস্তবতা দিয়ে বিচার করলে অসার মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের খ্যাতির প্রতি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ঈর্ষার কোন কারন ছিল না, তিনি তখন জীবন থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছেন, সংসারের মোহ মায়া কাটিয়ে নিয়েছেন। তাদের মধ্যে স্বাভাবিক যোগাযোগ সব সময়ই ছিল। কাদম্বরীর মৃত্যুর পর দুই ভাই এক সাথে সরোজিনী জাহাজে করে বেড়াতে বেরিয়েছেন। সে সময় দুইভাই সত্যেন্দ্রনাথের বাড়িতে পাশাপাশি ঘরে বহুদিন বাস করেছেন। জ্যোতির লেখা শেষ বয়সের ডায়রীতে রবীন্দ্রনাথের প্রসংগ এসেছে ঘুরে ফিরে অনেকবার। রবীর দাড়ি রাখা, বক্তৃতা, গান কিছুই তার চোখ এড়ায়নি। এমনকি তিনি রবীর ছবিও একেছেন, রবীর তেষট্টি বছরের জন্মদিনে পচিশ - ছাব্বিশ জন অতিথির সামনে “বাল্মীকি প্রতিভার” গান গেয়ে শুনিয়ে ছিলেন, শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গেছেন, শান্তিনিকেতন তাকে এতোটাই মুগ্ধ করেছিল যে সেখানে তিনি বাড়ি কেনার কথাও ভেবেছিলেন। কিন্তু সে সময় জ্যোতি আস্তে আস্তে তার স্বাভাবিক জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছিলেন, সে কারনে অনেক কিছুর সাথেই তার যোগাযোগ নষ্ট হচ্ছিল।
অন্যদিকে জ্যোতিদাদাকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলোতেও দেখা যাবে অন্তরংগতার সুরেরই মূর্ছনা। দাদার ছবির এ্যালবাম ছেপে দেয়ার আগ্রহী ও উদ্যোক্তা তিনি। মূল নাটক লেখা ছেড়ে শুধু অনুবাদ নিয়ে পড়ে থাকা দাদাকে তিনি মৃদ্যু তিরস্কারের ভঙ্গীতে লিখেছেন, “আপনিতো সংস্কৃত নাটক প্রায় শেষ করে ফেললেন”। প্রায় সে সময়েই রবীন্দ্রনাথ নোবেল পান, তার নিজস্ব ব্যস্ততা বেড়ে যায়। এছাড়া তার নিজের পারিবারিক জীবনেও নেমে আসে নানা দুর্ভোগ। স্ত্রী - পুত্র কন্যাদের মৃত্যু, শান্তিনিকেতন নিয়ে সমস্যা, অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে বিব্রত কবি তখন নিজের তেমন কোন আত্মীয় স্বজনদের সাথেই যোগাযোগ রাখতে পারছিলেন না। আর সংসারত্যাগী জীবনবিবাগী জ্যোতিতো তখন আরো দূরের মানুষ। তাই কাদম্বরীর মৃত্যু দুই ভাইয়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল, একথাটা বোধ হয় এখানে বেমানান। জ্যোতিরিন্দ্র খুজে ফিরেছেন সারাবেলা বিদেহী কাদম্বরীকে আর রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায়, ছবিতে মিশে ছিলেন তিনি আজীবন।
এই অভিমানীনি নিজের হাতে জীবন প্রদীপটি নিভিয়ে দিয়ে অন্তরালে না চলে গেলে হয়তো ঠাকুরবাড়ীর নারীদের ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হতো। ঠাকুরবাড়ীর অন্তপুরে সে সাহিত্য - সাংস্কৃতির একটি ফল্গুধারা বইছিলো তা অন্তত আরো কিছুদিন এভাবেই বইতো। তার মৃত্যুর পর থেকেই জোড়াসাকোর ঠাকুরবাড়ীর সোনালি দিনগুলো শীতের পাখির মতো বিদায় নিল। সব মিলে কাদম্বরী আজ সবার কাছে বাস্তব আর কল্পনায় মেশা একটি চরিত্র হয়ে আছে। কবিই বলেছেন “অধের্ক মানবী তুমি অধের্ক কল্পনা”। রোমান্টিক স্বপ্ন সঞ্চারিনী নতুন বউঠানের মাঝে মানবী কাদম্বরী হারিয়ে গেছেন। সমসাময়িক ব্যাক্তিদের সাক্ষ্য এবং কবিদের কবিতা থেকে ধরে নেয়া যায়, কাদম্বরীর মৃত্যুর সাথে রবীন্দ্রনাথের বিয়েকে জড়িয়ে যে অনুচিত কল্পনা মানুষের মাঝে দোলা দেয়, আসলে হয়তো তা ভিত্তিহীন।
এই লেখাটির জন্য জোড়াসাকো থেকে পৃথিবীর পথে - বাসব ঠাকুর, ঠাকুরবাড়ির কথা - হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় ও ঠাকুরবাড়ির অন্দর মহল - চিত্রা দেবের বইগুলো ব্যবহার করা হয়েছে।
তানবীরা তালুকদার
০৮.০৭.০৮
শেষ পর্ব
স্ত্রীর এই মৃত্যুকে জ্যোতিরিন্দ্র কিভাবে গ্রহন করেছিলেন, সে কৌতুহল জাগা খুবই স্বাভাবিক। কাদম্বরীর মৃত্যুর এক মাস পরেই তিনি জ্ঞানদানন্দিনী, সুরেন্দ্র, ইন্দিরা ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সরোজিনী জাহাজে চড়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে “তিনি যেমন ছিলেন, তেমনি আছেন।“ কিন্তু না, কাদম্বরীর জীবনাহুতি জ্যোতিরিন্দ্রকে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়েছিল। তা না হলে তিনি জীবনের কাছে এভাবে পরাজিত হতেন না। শুধু ব্যবসাতেই যে তিনি পর্যুদস্ত হয়েছেন তাই নয়, তার মতো নাট্যকার কাদম্বরী চলে যাওয়ার পর মৌলিক রচনা বাদ দিয়ে সারাটা জীবন শুধু অনুবাদ নিয়ে কাটিয়ে দিলেন? জমাটি আড্ডার আসর থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন নির্বাসনে। নিজেকেই ভুলে থাকতে চাইতেন হয়তো তিনি। জ্যোতিরিন্দ্রের চারিত্রিক দুর্বলতার কোন সুনিশ্চিত প্রমান কখনও কেউ দিতে পারেননি। মর্হষি তার ছেলে মেয়েদের নৈতিক চরিত্র গঠনে যথেষ্ট সজাগ ছিলেন। এবং তার সন্তানরাও সে আর্দশ মেনে চলেছিলেন। যদিও সে সময় কোলকাতায় বাবু কালচারে নৈতিকতার চরম অধঃপতনের সময় বিরাজ করছিল, কিন্তু ঠাকুরবাড়ির মানুষরা ছিল তাদের থেকে আলাদা। কাদম্বরী যখন তাকে ছেড়ে চলে যায়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র পয়ত্রিশ বছর। কিন্তু তিনি জীবনে দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। প্রচন্ড অনুশোচনা ছিল তার মধ্যে। কেউ তাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলেই তিনি জবাব দিতেন, “তাকে ভালবাসি।“ স্বেচ্ছা নির্বাসনে রেখে তিলে তিলে শাস্তি দিয়েছেন নিজেকেই। শাস্তি দিয়েছেন কাদম্বরীর প্রতি উদাসীন স্বামী জ্যোতিকে। শোনা যায় কিছুদিনের জন্য তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেছিলেন।
যদিও তার রচনায় কাদম্বরীর কথা আশ্চর্যভাবে অনুপস্থিত। এমনকি তার লেখা “আমার জীবনস্মৃতি” কিংবা শেষ বয়সের ডায়রীতেও তার মনের কোন কথা ধরা নেই। আমার জীবনস্মৃতি” তে দু’একটি জায়গায় রেফারেন্স হিসেবে ছাড়া কোথাও কাদম্বরীর কোন উল্লেখ নেই। অথচ রাচীতে তার নিজ বাড়ি শান্তিধামের যে ঘরটিতে তিনি থাকতেন, তার দেয়ালে একটিমাত্র ছবি টানানো ছিল, তার নিজের হাতে আকা কাদম্বরীর পেন্সিল স্কেচ। যদিও রবীন্দ্র ভাইজি ইন্দিরা লিখেছেন, “নতুন কাকিমার নিজের হাতে আকা একটি পেন্সিলের ছবিই সেই ঘরের একমাত্র সজ্জা ছিল” তাতে স্পষ্ট হয় না ছবিটা কার হাতে আকা ছিল। ঠাকুর বাড়ির অনেক মেয়ে - বউই ছবি আকতে জানতেন, হয়তো কাদম্বরীও জ্যোতির কাছে ছবি আকতে শিখেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্র সেই ছবিটিই ঘরে টানিয়ে রেখেছিলেন। নিরাবরন নিরাভরন গৃহের একমাত্র সজ্জা। এই আপাত ভুলে থাকা হয়তো নয় ভোলা। হয়তো সে কারনেই কবিগুরু লিখেছিলেন, চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয় .........। একা থেকে জ্যোতি হয়তো বারবার সেই অসামান্যা নারীর উপস্থিতি অনুভব করতে চেয়েছিলেন।
কেউ কেউ অবশ্য এটাও ভাবতে পছন্দ করতেন যে, কোন এক না বলা কারন নিয়ে রবি আর জ্যোতির মধ্যের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। এর কারন হিসেবে তারা রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি আর নতুন বৌঠানের আত্মহত্যাকে এক সূতোয় বুনতে চান। কিন্তু দুটি কারনকেই সে সময়ের বাস্তবতা দিয়ে বিচার করলে অসার মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের খ্যাতির প্রতি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ঈর্ষার কোন কারন ছিল না, তিনি তখন জীবন থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছেন, সংসারের মোহ মায়া কাটিয়ে নিয়েছেন। তাদের মধ্যে স্বাভাবিক যোগাযোগ সব সময়ই ছিল। কাদম্বরীর মৃত্যুর পর দুই ভাই এক সাথে সরোজিনী জাহাজে করে বেড়াতে বেরিয়েছেন। সে সময় দুইভাই সত্যেন্দ্রনাথের বাড়িতে পাশাপাশি ঘরে বহুদিন বাস করেছেন। জ্যোতির লেখা শেষ বয়সের ডায়রীতে রবীন্দ্রনাথের প্রসংগ এসেছে ঘুরে ফিরে অনেকবার। রবীর দাড়ি রাখা, বক্তৃতা, গান কিছুই তার চোখ এড়ায়নি। এমনকি তিনি রবীর ছবিও একেছেন, রবীর তেষট্টি বছরের জন্মদিনে পচিশ - ছাব্বিশ জন অতিথির সামনে “বাল্মীকি প্রতিভার” গান গেয়ে শুনিয়ে ছিলেন, শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গেছেন, শান্তিনিকেতন তাকে এতোটাই মুগ্ধ করেছিল যে সেখানে তিনি বাড়ি কেনার কথাও ভেবেছিলেন। কিন্তু সে সময় জ্যোতি আস্তে আস্তে তার স্বাভাবিক জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছিলেন, সে কারনে অনেক কিছুর সাথেই তার যোগাযোগ নষ্ট হচ্ছিল।
অন্যদিকে জ্যোতিদাদাকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলোতেও দেখা যাবে অন্তরংগতার সুরেরই মূর্ছনা। দাদার ছবির এ্যালবাম ছেপে দেয়ার আগ্রহী ও উদ্যোক্তা তিনি। মূল নাটক লেখা ছেড়ে শুধু অনুবাদ নিয়ে পড়ে থাকা দাদাকে তিনি মৃদ্যু তিরস্কারের ভঙ্গীতে লিখেছেন, “আপনিতো সংস্কৃত নাটক প্রায় শেষ করে ফেললেন”। প্রায় সে সময়েই রবীন্দ্রনাথ নোবেল পান, তার নিজস্ব ব্যস্ততা বেড়ে যায়। এছাড়া তার নিজের পারিবারিক জীবনেও নেমে আসে নানা দুর্ভোগ। স্ত্রী - পুত্র কন্যাদের মৃত্যু, শান্তিনিকেতন নিয়ে সমস্যা, অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে বিব্রত কবি তখন নিজের তেমন কোন আত্মীয় স্বজনদের সাথেই যোগাযোগ রাখতে পারছিলেন না। আর সংসারত্যাগী জীবনবিবাগী জ্যোতিতো তখন আরো দূরের মানুষ। তাই কাদম্বরীর মৃত্যু দুই ভাইয়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল, একথাটা বোধ হয় এখানে বেমানান। জ্যোতিরিন্দ্র খুজে ফিরেছেন সারাবেলা বিদেহী কাদম্বরীকে আর রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায়, ছবিতে মিশে ছিলেন তিনি আজীবন।
এই অভিমানীনি নিজের হাতে জীবন প্রদীপটি নিভিয়ে দিয়ে অন্তরালে না চলে গেলে হয়তো ঠাকুরবাড়ীর নারীদের ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হতো। ঠাকুরবাড়ীর অন্তপুরে সে সাহিত্য - সাংস্কৃতির একটি ফল্গুধারা বইছিলো তা অন্তত আরো কিছুদিন এভাবেই বইতো। তার মৃত্যুর পর থেকেই জোড়াসাকোর ঠাকুরবাড়ীর সোনালি দিনগুলো শীতের পাখির মতো বিদায় নিল। সব মিলে কাদম্বরী আজ সবার কাছে বাস্তব আর কল্পনায় মেশা একটি চরিত্র হয়ে আছে। কবিই বলেছেন “অধের্ক মানবী তুমি অধের্ক কল্পনা”। রোমান্টিক স্বপ্ন সঞ্চারিনী নতুন বউঠানের মাঝে মানবী কাদম্বরী হারিয়ে গেছেন। সমসাময়িক ব্যাক্তিদের সাক্ষ্য এবং কবিদের কবিতা থেকে ধরে নেয়া যায়, কাদম্বরীর মৃত্যুর সাথে রবীন্দ্রনাথের বিয়েকে জড়িয়ে যে অনুচিত কল্পনা মানুষের মাঝে দোলা দেয়, আসলে হয়তো তা ভিত্তিহীন।
এই লেখাটির জন্য জোড়াসাকো থেকে পৃথিবীর পথে - বাসব ঠাকুর, ঠাকুরবাড়ির কথা - হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় ও ঠাকুরবাড়ির অন্দর মহল - চিত্রা দেবের বইগুলো ব্যবহার করা হয়েছে।
তানবীরা তালুকদার
০৮.০৭.০৮
কাকলির ১ম সিডি ‘ভয় হতে তব অভয় মাঝে’ প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত

কাকলির ১ম সিডি ‘ভয় হতে তব অভয় মাঝে’ প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত
শিল্পী শিল্পীই, তা তিনি প্রবাসেই থাকুন আর দেশেই থাকুন। সুরের সাধনার কোন দেশভাগ নেই। গত ৭ জুন সেকথাই আবারো প্রমাণ হল শিল্পী নাহিদ কবীর কাকলির প্রথম সিডি ‘ভয় হতে তব অভয় মাঝে’-এর প্রকাশনা উৎসবে। টরন্টোর আলবার্ট ক্যাম্পবেল লাইব্রেরীর অডিটরিয়ামে তিনি তাঁর প্রথম সিডির প্রকাশনা উৎসবে গাইলেন একে একে রবীঠাকুরের ১৮টি গান। নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রভক্তরা আপ্লুত হয়েছেন, আনন্দিত হয়েছেন। শিল্পী নিজেও কম আপ্লুত নন, তবুও তাঁর হৃদয়ে বেদনার মত বাজে শিক্ষাগুরু ওয়াহিদুল হকের কথা। বরেণ্য এই প্রয়াত শিল্পীর অনুপ্রেরণাতে ও সহযোগিতায় আরও আগেই, ২০০৫ সালে সিডিটি প্রকাশ করার কথা ছিল। ওয়াহিদুল হক তাঁকে বার বার বলতেন, ‘সবকিছু ছাড়লেও গান ছাড়িস না কিন্তু- যা দেশেই থাকিস আর প্রবাসেই থাকিস।’ সেকথা কাকলি ভোলেননি। শিল্পীর বক্তব্য অনুযায়ী, ‘এই সিডি আমার নিজের সৃষ্টি। যে কোন সৃজনশীল মানুষের মতোই, যে কোন শিশুর জন্মের মতোই আমি আনন্দিত। শুধু একটাই কষ্ট আমার এই প্রবল আনন্দের দিনে ওয়াহিদুল হক আর বেঁচে নেই।’
জুনের প্রকাশনা উৎসবের উদ্যোক্তা ও আয়োজক ছিলেন কবি দেলোয়ার এলাহী। টরন্টোতে এই প্রথম কোন বাংলাদেশী শিল্পীর একক রবীন্দ্রসঙ্গীতানুষ্ঠানের সেদিনকার আয়োজনে সুধীজনদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন উদীচীর সভাপতি আজিজুল মালিক, সঙ্গীতশিল্পী জিবিনা সঞ্চিতা হক, নুরুল আলম লাল, দীনু বিল্লাহ, বাংলা জার্নালের সম্পাদক ইকবাল হাসনু, কবি ফেরদৌস নাহার, সংস্কৃতিকর্মী মঞ্জুলী কাজী, শিল্পী সৈয়দ ইকবাল, সঙ্গীতবোদ্ধা হাসান মাহমুদ প্রমুখ।
আবৃত্তিকার অনন্ত আহমেদের উপস্থাপনায় শতাধিক রবীন্দ্রভক্তের এই মিলনমেলায় কাকলি গেয়ে চলেন প্রধানত পূজা ও প্রকৃতিকেন্দ্রিক রবীন্দ্রসঙ্গীত- ভয় হতে তব অভয় মাঝে, দাঁড়াও আমার আঁখির আগে, বসন্তে কি শুধু, পথে চলে যেতে যেতে, কোথা হতে বাজে প্রেম বেদনা রে, কোন পুরাতন প্রাণের টানে এবং এগুলোর ধারাবাহিকতায় ১৮তম গান ছিল স্বদেশের প্রতি ফিরে যাবার প্রত্যয় ব্যক্ত করে, ‘ফিরে চল মাটির টানে’। কাকলির গান ছাড়াও সিডি প্রকাশনা উৎসবে কাকলির ‘আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে’ রেকর্ডের সঙ্গে নাচ করেছে শিশুশিল্পী মাহিয়া হাবিব রিংকেল। পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ থেকে আবৃত্তি করেন রোজিনা করিম ও জ্যোৎøা খানম, গান গেয়েছেন কাকলির ছাত্রী জারা চৌধুরী। প্রায় দেড় ঘন্টার এ অনুষ্ঠানটি সরাসরি অনলাইনে প্রচারিত হওয়ায় বিশ্বের নানা দেশ থেকে দেখেছে রবীন্দ্রনাথের ভক্তরা। অনুষ্ঠানে হারমোনিয়াম, তবলা এবং কী-বোর্ডে সাহায্য করেছেন যথাক্রমে হাসান মাহমুদ, তানজির আলম রাজীব এবং মাহবুব। মঞ্চসজ্জা করেছেন চারুকলার সাবেক ছাত্র শহীদ।
কাকলির সিডির ১২টি গানের মধ্যে ২টি আনুষ্ঠানিক, ১ টি স্বদেশ, ৩টি প্রকৃতি ও বাদবাকি ৬টি পূজা বিষয়ক। গানগুলো নির্বাচন করেছেন শিল্পী নিজে এবং পরিচালক নীলোৎপল সাধ্য। সিডির মিউজিক করেছেন কলকাতার শুভায়ু সেন মজুমদার এবং মিউজিক সম্পাদনা করা হয়েছে কলকাতাতেই। আর পরিবেশক ছিল ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটের ‘সুরের মেলা’।
শুধু ওয়াহিদুল হকই নন, শিল্পী মিতা হকও কাকলির গুরু। তারও আগে যখন এক্কেবারে ছোট্টটি ছিলেন তিনি প্রথম হাতে-খড়ি নিয়েছেন বাবা গীটারশিল্পী এনামুল কবীরের কাছে। বাবার পরে গান শিখেছেন অনুপ ভট্টাচার্য, কাদেরী কিবরিয়া প্রমুখের কাছে।
২৩.৭.০৮
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাদম্বরী ------ ঘটনার অন্তরালে ৩ :: তানবীরা তালুকদার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাদম্বরী ------ ঘটনার অন্তরালে ৩
কাদম্বরীর মৃত্যুর পর তার আশেপাশের সমসাময়িক ঘটনার টুকরো গুলো জোড়া দিলে একটা সামগ্রিক ছবি তৈরী করা হয়তো সম্ভব হবে। হয়তো কোন একটি মনোপীড়া থেকে নয়, সম্মিলিত কয়েকটি মানসিক ধাক্কা তার পক্ষে সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তাই মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কষ্টের ঝরনাগুলো হঠাৎ আঘাতে নিজেকে হারিয়ে দুকূল প্লাবিত করে চলে গেলো। জ়্যোতিরিন্দ্র বেশ খাম খেয়ালী মানুষ ছিলেন। কিছুটা সংসার উদাসীনও ছিলেন। নতুন নতুন নাটক, গান লেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, নিজের যা ভালো লাগতো তাকেই প্রাধান্য দিতেন। তারউপর সত্যেন্দ্রনাথ - জ্ঞানদানন্দিনী তখন কোলকাতায় ফিরে এসেছেন। তাদের সাহচর্য, তাদের ছেলেমেয়েদের সাহচর্য তাকে কিছুটা স্ত্রীর কাছ থেকে দূরে সরিয়েও এনেছিল। জ্ঞানদানন্দিনীর উগ্র আধুনিক চলাফেরার প্রতি জ়্যোতিরিন্দ্রের মোহ জন্মেছিল। তিনি অনেকটা সময়ই সেই বাড়িতে পরে থাকতেন। রবীন্দ্রনাথের ভাতিজি ইন্দিরা কাদম্বরীর মৃত্যু সম্পর্কে লিখেছেন, “জ্যোতিকাকামশাই প্রায়ই বাড়ি ফিরতেন না। তার প্রধান আড্ডা ছিল বিজিতলাওয়ে আমাদের বাড়ি। আমার মা জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে ওর খুব ভাব ছিল”। এরই মধ্যে একদিন অভিমানীনি কাকীমা তাকে বলেছিলেন তাড়াতাড়ি ফিরতে। গানে গানে আড্ডায় আড্ডায় সেদিন এত দেরী হয়ে গেলো যে কাকাবাবুর আর বাড়িই ফেরা হলো না। প্রবল অভিমানে কাকীমা ধ্বংসের পথ বেছে নিলেন।
আবার রবীন্দ্রনাথের ছোটবোন বর্নকুমারীকে প্রশ্ন করে অমল হোম শুনেছিলেন, তখনকার দিনের বিখ্যাত অভিনেত্রী মতান্তরে নটী বিনোদিনীর সাথে জ়্যোতিরিন্দ্রের ভীষন অন্তরংগতা জন্মেছিলো। জ়্যোতিরিন্দ্রের কোটের পকেট থেকে কাদম্বরী বিনোদিনীর কয়েকটি চিঠি পান, যেগুলো তাদের মধ্যের অন্তরংগতার স্বাক্ষরই বহন করে। সেই চিঠিগুলো পেয়ে কাদম্বরী সংসারে নিস্পৃহ সময় কাটান বেশ কিছুদিন এবং তার পর পরই আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর আগে তিনি লিখে গিয়েছিলেন, এই চিঠি গুলোই তার মৃত্যুর কারন, মহর্ষির আদেশে সেই চিঠিগুলো ও সাথে কাদম্বরীর লেখা আত্মহত্যার স্বীকারোক্তিটি নষ্ট করে ফেলা হয়। কাজী আবদুল ওদুদ লিখেছেন যে, তিনি ঠাকুরবাড়ির একজন বিশ্বস্ত ব্যাক্তির কাছে শুনেছেন, যে মহিলার সাথে জ়্যোতিরিন্দ্রের অন্তরংগতা জন্মেছিল তিনি অভিনেত্রী নন, কিন্তু তার কারনে আগেও একবার কাদম্বরী আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছিল। তবে তৎকালীন রুচি ও রীতির পরিপ্রেক্ষিতে জ়্যোতিরিন্দ্রের কোন থিয়েটারের অভিনেত্রী কিংবা নটীর সান্নিধ্যে আসাও বিরাট কিছু ব্যাপার নয়।
নিঃসন্তান কাদম্বরীর মধ্যে একটি সন্তানের জন্য তীব্র আকাংঙা ছিল। তিনি শিশুদেরকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। জানকীনাথ ও স্বনর্কুমারীর ছোটমেয়ে ঊর্মিলাকে নিজের কাছে রেখে সন্তান স্নেহে মানুষ করছিলেন তিনি। তার কাছেই ঊর্মিলা বড় হচ্ছিল তার মেয়ে হয়ে। একটু বড় হয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করার দুমাসের মধ্যেই তেতলার সিড়ি থেকে একা নামতে গিয়ে ঊর্মিলা পড়ে যায় এবং মারা যায়। এই ঘটনাটি কাদম্বরীর কোমল মনে যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করেছিল। তারপরেও সংসারের কাজকর্ম, স্বামী সেবা, সংগীত, সাহিত্য চর্চা ইত্যাদি দিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে, ভুলে থাকতে চাইলেও শেষ রক্ষা তিনি করতে পারেন নি। সে সময়ই সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনীর কোলকাতার বাসায় , রবীন্দ্রনাথ ও জ়্যোতিরিন্দ্র তাদের বেশীরভাগ সময় কাটাতেন। এরি মধ্যে আবার রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করাতে কাদম্বরীর নিঃসংগতা প্রচন্ড বৃদ্ধি পায় যা থেকে তিনি কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন ও আত্মহত্যার পথটিকেই বেছে নেন।
বাড়িতে কাপড় নিতে আসত বিশ্বেশ্বরী তাতিনী বা বিশু তাতিনী। সেই বিশুকে দিয়েই লুকিয়ে আফিম এনে, খেয়ে তিনি মনের জ্বালা জুড়ান। কাদম্বরীর মৃত্যু নিয়ে তৃতীয় কোন অনুমানের চেয়ে, পারিপ্বার্শিকতার বিচারে বর্নকুমারী বর্নিত কিংবা ইন্দিরার লেখা ঘটনাগুলোই বড় বেশী বাস্তব। কিশোর রবীন্দ্রনাথ জানতেন তার নতুন বৌঠানের সেই গোপন মনোকষ্টের কথা। তার “তারকার আত্মহত্যা”তে তিনি লিখেছেন,
“যদি কেহ শুধাইত, আমি জানি কী যে সে কহিত
যতদিন বেচে ছিল, আমি জানি কী তারে দহিত”
সমসাময়িক অনেক কবিই কাদম্বরীর অকাল মৃত্যুকে নিয়ে জ়্যোতিরিন্দ্রের উপর যথেষ্ট বিরক্ত ছিলেন। তাদের অনেকেই সে সময় জ়্যোতিরিন্দ্রকে ব্যংগ করে অনেক কবিতা লিখেছিলেন। তাদের কেউ কেউ কোন রাখ ঢাক ছাড়াই স্ত্রীকে অবহেলার জন্য জ়্যোতিরিন্দ্রের সমালোচনা করেছিলেন। কাদম্বরীর কাছ থেকে আসন উপহার পাওয়া কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী জ়্যোতিরিন্দ্রের পরনারী আসক্তি নিয়ে শালীনতার আড়াল না রেখেই লিখেছিলেন,
“পুরুষ কিম্ভুতমতি চেনে না তোমায়, মন প্রান যৌবন
কি দিয়া পাইবে মন, পশুর মতন এরা নিতুই নতুন চায়।“
সেসব কবিতা, রচনা, সমসাময়িক ব্যাক্তিদের সাক্ষ্য, আলোচনা ইত্যাদি থেকে ধারনা করা যায় কাদম্বরীর মৃত্যুর সাথে রবীন্দ্রনাথের বিয়েকে জড়িয়ে যে অনুচিত কল্পনা করা হয় তার আসলে কোন ভিত্তি নেই।
(চলবে)
০৭.০৭.০৮
কাদম্বরীর মৃত্যুর পর তার আশেপাশের সমসাময়িক ঘটনার টুকরো গুলো জোড়া দিলে একটা সামগ্রিক ছবি তৈরী করা হয়তো সম্ভব হবে। হয়তো কোন একটি মনোপীড়া থেকে নয়, সম্মিলিত কয়েকটি মানসিক ধাক্কা তার পক্ষে সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তাই মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কষ্টের ঝরনাগুলো হঠাৎ আঘাতে নিজেকে হারিয়ে দুকূল প্লাবিত করে চলে গেলো। জ়্যোতিরিন্দ্র বেশ খাম খেয়ালী মানুষ ছিলেন। কিছুটা সংসার উদাসীনও ছিলেন। নতুন নতুন নাটক, গান লেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, নিজের যা ভালো লাগতো তাকেই প্রাধান্য দিতেন। তারউপর সত্যেন্দ্রনাথ - জ্ঞানদানন্দিনী তখন কোলকাতায় ফিরে এসেছেন। তাদের সাহচর্য, তাদের ছেলেমেয়েদের সাহচর্য তাকে কিছুটা স্ত্রীর কাছ থেকে দূরে সরিয়েও এনেছিল। জ্ঞানদানন্দিনীর উগ্র আধুনিক চলাফেরার প্রতি জ়্যোতিরিন্দ্রের মোহ জন্মেছিল। তিনি অনেকটা সময়ই সেই বাড়িতে পরে থাকতেন। রবীন্দ্রনাথের ভাতিজি ইন্দিরা কাদম্বরীর মৃত্যু সম্পর্কে লিখেছেন, “জ্যোতিকাকামশাই প্রায়ই বাড়ি ফিরতেন না। তার প্রধান আড্ডা ছিল বিজিতলাওয়ে আমাদের বাড়ি। আমার মা জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে ওর খুব ভাব ছিল”। এরই মধ্যে একদিন অভিমানীনি কাকীমা তাকে বলেছিলেন তাড়াতাড়ি ফিরতে। গানে গানে আড্ডায় আড্ডায় সেদিন এত দেরী হয়ে গেলো যে কাকাবাবুর আর বাড়িই ফেরা হলো না। প্রবল অভিমানে কাকীমা ধ্বংসের পথ বেছে নিলেন।
আবার রবীন্দ্রনাথের ছোটবোন বর্নকুমারীকে প্রশ্ন করে অমল হোম শুনেছিলেন, তখনকার দিনের বিখ্যাত অভিনেত্রী মতান্তরে নটী বিনোদিনীর সাথে জ়্যোতিরিন্দ্রের ভীষন অন্তরংগতা জন্মেছিলো। জ়্যোতিরিন্দ্রের কোটের পকেট থেকে কাদম্বরী বিনোদিনীর কয়েকটি চিঠি পান, যেগুলো তাদের মধ্যের অন্তরংগতার স্বাক্ষরই বহন করে। সেই চিঠিগুলো পেয়ে কাদম্বরী সংসারে নিস্পৃহ সময় কাটান বেশ কিছুদিন এবং তার পর পরই আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর আগে তিনি লিখে গিয়েছিলেন, এই চিঠি গুলোই তার মৃত্যুর কারন, মহর্ষির আদেশে সেই চিঠিগুলো ও সাথে কাদম্বরীর লেখা আত্মহত্যার স্বীকারোক্তিটি নষ্ট করে ফেলা হয়। কাজী আবদুল ওদুদ লিখেছেন যে, তিনি ঠাকুরবাড়ির একজন বিশ্বস্ত ব্যাক্তির কাছে শুনেছেন, যে মহিলার সাথে জ়্যোতিরিন্দ্রের অন্তরংগতা জন্মেছিল তিনি অভিনেত্রী নন, কিন্তু তার কারনে আগেও একবার কাদম্বরী আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছিল। তবে তৎকালীন রুচি ও রীতির পরিপ্রেক্ষিতে জ়্যোতিরিন্দ্রের কোন থিয়েটারের অভিনেত্রী কিংবা নটীর সান্নিধ্যে আসাও বিরাট কিছু ব্যাপার নয়।
নিঃসন্তান কাদম্বরীর মধ্যে একটি সন্তানের জন্য তীব্র আকাংঙা ছিল। তিনি শিশুদেরকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। জানকীনাথ ও স্বনর্কুমারীর ছোটমেয়ে ঊর্মিলাকে নিজের কাছে রেখে সন্তান স্নেহে মানুষ করছিলেন তিনি। তার কাছেই ঊর্মিলা বড় হচ্ছিল তার মেয়ে হয়ে। একটু বড় হয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করার দুমাসের মধ্যেই তেতলার সিড়ি থেকে একা নামতে গিয়ে ঊর্মিলা পড়ে যায় এবং মারা যায়। এই ঘটনাটি কাদম্বরীর কোমল মনে যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করেছিল। তারপরেও সংসারের কাজকর্ম, স্বামী সেবা, সংগীত, সাহিত্য চর্চা ইত্যাদি দিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে, ভুলে থাকতে চাইলেও শেষ রক্ষা তিনি করতে পারেন নি। সে সময়ই সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনীর কোলকাতার বাসায় , রবীন্দ্রনাথ ও জ়্যোতিরিন্দ্র তাদের বেশীরভাগ সময় কাটাতেন। এরি মধ্যে আবার রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করাতে কাদম্বরীর নিঃসংগতা প্রচন্ড বৃদ্ধি পায় যা থেকে তিনি কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন ও আত্মহত্যার পথটিকেই বেছে নেন।
বাড়িতে কাপড় নিতে আসত বিশ্বেশ্বরী তাতিনী বা বিশু তাতিনী। সেই বিশুকে দিয়েই লুকিয়ে আফিম এনে, খেয়ে তিনি মনের জ্বালা জুড়ান। কাদম্বরীর মৃত্যু নিয়ে তৃতীয় কোন অনুমানের চেয়ে, পারিপ্বার্শিকতার বিচারে বর্নকুমারী বর্নিত কিংবা ইন্দিরার লেখা ঘটনাগুলোই বড় বেশী বাস্তব। কিশোর রবীন্দ্রনাথ জানতেন তার নতুন বৌঠানের সেই গোপন মনোকষ্টের কথা। তার “তারকার আত্মহত্যা”তে তিনি লিখেছেন,
“যদি কেহ শুধাইত, আমি জানি কী যে সে কহিত
যতদিন বেচে ছিল, আমি জানি কী তারে দহিত”
সমসাময়িক অনেক কবিই কাদম্বরীর অকাল মৃত্যুকে নিয়ে জ়্যোতিরিন্দ্রের উপর যথেষ্ট বিরক্ত ছিলেন। তাদের অনেকেই সে সময় জ়্যোতিরিন্দ্রকে ব্যংগ করে অনেক কবিতা লিখেছিলেন। তাদের কেউ কেউ কোন রাখ ঢাক ছাড়াই স্ত্রীকে অবহেলার জন্য জ়্যোতিরিন্দ্রের সমালোচনা করেছিলেন। কাদম্বরীর কাছ থেকে আসন উপহার পাওয়া কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী জ়্যোতিরিন্দ্রের পরনারী আসক্তি নিয়ে শালীনতার আড়াল না রেখেই লিখেছিলেন,
“পুরুষ কিম্ভুতমতি চেনে না তোমায়, মন প্রান যৌবন
কি দিয়া পাইবে মন, পশুর মতন এরা নিতুই নতুন চায়।“
সেসব কবিতা, রচনা, সমসাময়িক ব্যাক্তিদের সাক্ষ্য, আলোচনা ইত্যাদি থেকে ধারনা করা যায় কাদম্বরীর মৃত্যুর সাথে রবীন্দ্রনাথের বিয়েকে জড়িয়ে যে অনুচিত কল্পনা করা হয় তার আসলে কোন ভিত্তি নেই।
(চলবে)
০৭.০৭.০৮
১৬.৭.০৮
মোঃ সেলিম রেজা

হারানো বিজ্ঞপ্তি
সুখের খুঁজে কোন হারানো বিজ্ঞপ্তি দেব না;
নিরিবিলি খুঁজে যাবো পথ-ঘাট-মাঠ
প্রান্তর ছেড়ে শহরের প্রতিটি কোনায় কোনায়
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তন্ন তন্ন খুঁজে যাবো
সকাল থেকে মধ্যরাতের প্রহর শেষ অবধি।
ভ্রমরের মতো উড়ে উড়ে খুঁজে নেব চারদিক
কখনো জীবনের খুচরো রোজ নামচার হিসেব মেলাব না;
স্মৃতি আলপনা টাঙিয়ে হেমন্তের নরোম রোদে
ভাবনাগুলো গোছ করে বুক পকেটে রেখে দেবো
সযতেœ রাখা কোমল পরশে চিরকূট
সস্তা দামে নিলাম বাজারে বিকোব না;
কাঙ্খিত ঠিকানায় সুনিশ্চিত ভবিতব্য
দুঃখের আড়াল থেকে বেরিয়ে নিজের আস্তানায়
সুখের ঘরে ঘুমিয়ে গভীর আলিঙ্গনে
স্বপ্নের শাল গায়ে জড়িয়ে।
৯ মে ২০০৭
উড়ক্কু শব্দগুলো
এক টুকরো কাগজে ঝাঁক বেঁধে আসা
পাখিদের মতো উড়– উড়– শব্দগুলো
দিবানিশি খেলা করে কবিতার উঠোনে।
পলকহীন চোখে দাঁড়িয়ে নৈঃশব্দে
সজাগ দৃষ্টির উদাসীন সময়;
স্বাপ্নিক অরণ্যে প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ
উড়োজাহাজের আদলে উড়ে এসে
একে একে জড়ো হয় ভাবনার টেবিলে।
কবি আর কবিতা মুখোমুখি; যেতে হবে বহুদূর
জীবন পাখায় ভর করে স্বপ্নের কাছাকাছি।
দিগন্ত প্রসারী শব্দকল্প সারসের মতো উড়ে;
বাস্তবের সাথে বোঝা পড়ায় আশার কথা বলে।
এমনি একদিন অলস দুপুরে দিশেহারা
কলমের আঁচড়ে সাদাসিধে জীবন প্রান্তর
শত সহস্র শব্দে অঙ্কুরিত এক একটি অনুচ্ছেদ।
৬ এপ্রিল ২০০৭
আমি তোমার মতো
আমি সেই প্রেমিক
দেবদাসের মতো একজন;
স্বপ্নের মালা গেঁথে
দাঁড়িয়ে অনন্ত যাত্রায়।
আমি সেই আত্মভোলা
কবির মতো একজন;
আনন্দের গুনগুন শব্দে
প্রেয়সীর প্রেম প্রহরায়।
আমি সেই ভাললাগা
ভালবাসার মতো একজন;
সংসার জীবনের সুখে
ভবিষ্যৎ পথ চলা।
আমি সেই প্রেমিক
তোমার মতো একজন;
প্রতীক্ষায় রাত জেগে
চুপিসারে কথা বলা।
আমি সেই প্রতিবাদী
যোদ্ধার মতো একজন;
জীবনবাজির খেলায়
যুথবদ্ধ বিজয় আলিঙ্গন।
৩০ ডিসেম্বর ২০০৬
জীবনালেখ্য
পাগলা বাতাসের টানে
শুকনো পাতারাও আজ ফিরে পেয়েছে প্রাণ,
বিস্তীর্ণ আকাশে আলো করা রোদ্দুর
দূরে রঙবাহারী প্রজাপতির মেলা
উড়ছে তো উড়ছে, সুতো কাটা ঘুড়ির মতো
সবুজ ধূসর দিগন্তে একটানা পাখির কল-কাকলী
এ যেন রোমান্টিক প্রাকৃতিক আবেগ
নরম আলোর দোলনায় দুলতে দুলতে
মাধুরী মেশানো ছন্দানন্দ হিল্লোল
মাটি রঙের পাহাড়ী পাদদেশে
দাঁড়িয়ে আছি প্রকৃতি প্রেমিক মৃত্তিকা মানুষ।
পলকহীন চোখের দৃষ্টি দিনমান
নিসর্গের সবুজ কালিতে লেখা জীবনালেখ্য।
বিপ্লব
শির দাঁড় সোজা করে দাঁড়াতে চাই;
ন্যুব্জ সময়ে দুঃসহ দুর্দিন
অসম্ভব মিথ্যুকে গিজ গিজ চারপাশ
পিছুটান দিয়েছে উুঁকিঝুঁকি।
ওত পেতে থাকা সেই পুরোনো শকুন
কুঁজো করে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস
ডুবে যাওয়া খরস্রোতা নদীর বুকে
ধূলিকণায় ভরা প্রতিটি নিঃশ্বাস।
রক্তাক্ত শরীরে একাকার ঠাঁয় দাঁড়িয়ে
পথের এককোণে শিকড় ছড়িয়ে;
ক্ষত-বিক্ষত হৃৎপিন্ড লাফাতে থাকে
দূরে ঘন অন্ধকারে মনে হয়
মাটিতে শায়িত প্রেতের কঙ্কাল;
বিদগ্ধ আবেগে শিরদাঁড় সোজা করে
উঠে দাঁড়াতে চাই সুদৃঢ় চেতনায়।
পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে মুক্তির উল্লাসে।
মুক্তিযোদ্ধা এবং ......
ক.
একাত্তর’র পরাজিত শত্র“দের আস্ফালন
মর্মাহত করে,
বিপ্লবী করে তোলে রাজাকারদের উত্থান
কালো রাত্রিতে ভেঙ্গেছে স্বপ্ন
দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া বিশ্বাস;
আর আমি সারা রাত জেগে বসে ছিলাম
নিখোঁজ মুক্তিযোদ্ধার পোড়া ভিটেয়।
খ.
ঢেকে রাখা সত্যগুলো আজ
হয়েছে প্রতিপক্ষ,
শ্যামলিমার বুকে পাশবিকতায়
উপচে পড়া রক্তের ফোয়ারা
লাল রক্তে ভেসে যাওয়া ক্ষত-বিক্ষত
শরীর যেন মৃত্যুর গর্জনে ককিয়ে ওঠে
আমি মুক্তিযোদ্ধা .... আমি মুক্তিযোদ্ধা।
১৭ জানুয়ারী ২০০৭
খুলে যায় মনের আগল
আন্ধারের বুকে আমি একা
সাথে বেড়ে চলে রাতের প্রহর,
নেই পাখিদের ইলিমিলি মুখরতা,
শামুকের খোলসের মতো খুলে যায় মনের আগল;
অচেনা মুখ বড্ড চেনা লাগে-
আঁতিপাঁতি খুঁজে চলি স্বপ্ন কয়েক;
উঁই পোকা কুচিকুচি কেটে চলে-
উদোম শরীরে কাম-বাসনা,
আকাশ সম তৃষ্ণার দৈর্ঘ্য
মাতাল আমি নেশাতুর কল্কি টেনে,
চারিদিকে মগ্ধ-দগ্ধ;
নিঃসঙ্গ নিঃসীম এ মানসে-
খুঁজে বেড়াই চুপিচুপি অন্ধকারে
লালিত ললিতার মোহময় তন্।
অষ্টাদশী কিশোরী
জমেছিল অন্তঃপুরে বেদনার কিছু মেঘ
দুঃস্বপ্নের ভেতরে হাঁটে অষ্টাদশী এক কিশোরী।
যার তরতাজা যৌবনের বুকে বিঁধেছে শূল
নিতম্বে সজারুর কাঁটার আঘাত,
স্তনের বোঁটা ছিঁড়েছে বেগানা পুরুষ
জঙ্ঘা বেয়ে যোনি পথে রক্তক্ষরণ।
সম্ভোগের নেশায় চলে সম্ভ্রম হরণের পালা
মধ্যযুগীয় বর্বরতাও হার মানে ভুতুড়ে অন্ধকারে,
হো হো হাসিতে কোমর বেঁধে সাঁতার কাটে
অজানা, অচেনা কিশোরীর সুনসান দীঘিতে।
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার ভেসে আসে কানে
রঙ-বেরঙের মেজাজে নাদান, মুখোশধারী জারজ,
কৃমিকীট, জল্লাদী চেহারার লোলুপ দৃষ্টি,
উল্লাসে মদমত্ত বর্বরেরা হেঁটে চলে বীরদর্পে
সভ্য সমাজের মুখে এক দলা থুথু ছুঁড়ে
ধর্ষিতা কিশোরী দহন জ্বালায় ক্লান্ত পায়ে
হেঁটে চলে অন্ধকার গলি ধরে,
পথ হারিয়ে উদ্ভ্রান্ত পথিকের মতো
ঘুমের ঘোরে এখনও শুনতে পায় এ তল্লাটে
যৌবন হারানোর বেদনায় অষ্টাদশী কিশোরীর গোঙানি।
২৩ ডিসেম্বর ২০০৬
কুয়েত সিটি, কুয়েত
জীবন পানসি
জলরঙে তুলির আঁচড় পড়ে এঁকে বেঁকে
ভাবনার সোনালী সুতোয় বাঁধা শিল্পী
নৈসর্গ প্রকৃতির নিবিড়তায় সুন্দর বোঝা পড়া;
একাকী নির্জনে আঁকে নিজের মতো
নদী তীরে কাদামাটি, ফসলের মাঠ
আর সবুজাভ গ্রামের
এক একটি রোমান্টিক ছবি..
যেখানে প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে শাড়ী পরিহিতা
এক আটপৌরে নারী,
দিবানিশি পল্লী কৃষকের জীবন সংগ্রাম।
শিল্পীর ভূদৃশ্যে ফুটে ওঠে শ্যামলের ছবি
নির্জন পথের কোলে কুঁকড়ে ঘুমিয়ে থাকা টোকাই
ডানপিঠেদের এক্কা দোক্কা, লাট্টু কিংবা ডাংগুলি খেলা
তুলির ক্যানভাসে তরুণী বধুর সুনীল মুখচ্ছবি।
নিলাজ কোলাজে শৈল্পিক মন পথের বাঁকে বাঁকে
এ যেন রূপ লাবন্যে সফল
স্বকীয়তার প্রাণবন্ত জীবন পানসি।
০৮/০১/২০০৭ ইং
নিঃশব্দ সঙ্গীত
ইদানিং আমার স্বপ্নের অবস্থান
চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকা; পুরানা পল্টন জুড়ে
স্বপ্নময় আশা, কবিতার ভাষা-
আগোছালো সংলাপ সবই অপেক্ষামান
রংধনু রঙে আকাশ দেখার মতো
সময় ছুটে চলে জ্যাব্রাক্রসিং পার হয়ে
দুঃচিন্তার গর্ভপাতে সাহসের দীর্ঘ বাঁক;
নগরীর কোলাহলে ভাঙে ঘোর-
পুড়ে জীবন আধুনিকতার শ্লোগানে।
শব্দহীন সঙ্গীত আন্দোলিত অস্থিমজ্জায়
বধির সমাজে তবুও চিরায়ত শব্দে
ঝংকার তুলে ধ্বনি নিরবধি।
মৈথুন শিল্প
মৈথুন অবগাহনে ঝড়ের বেগে
ছুটে নদীর সীমানা পেরিয়ে
মুখে নিঃসৃরিত লালাগুলো অমৃত স্বাদে
শরীরে তুলে মাদকতা
ভরা জোয়ারে কোমর বেঁধে সাঁতরিয়ে
কূলে ওঠতে দীর্ঘ সময়;
যদিওবা বন্ধ চিলেকোটার কপাট,
তবে খুলে যায় মনের অলিন্দে কামুক বাসনা
নতুন আঙ্গিকে নদী আলিঙ্গন
চাপা গোঙানিতে নগ্ন নৃত্য;
আধুনিকতার ছোঁয়ায় সঙ্গম
ইদানিং সেক্স সমাচার
পৌরানিক শব্দে প্রকৃতির চিয়ারত মৈথুন শিল্প।
২৮ জুন ২০০৮
বিকেলের স্নিগ্ধরোদ নীল দিগন্তে
বিকেলের স্নিগ্ধরোদ ঘাসের পালকে করে খেলা;
জীবন বাতাসের সুরে হাঁটে আলপথে
ভোরের স্বপ্ন উঁকি দেয় চিলেকোটার উঠোনে
প্রকৃতিপ্রেমী ভাবুক ফিরে সবুজ অরণ্যে
গভীর আশ্লেষে কানপাতা ভবিতব্য-
নিঃশব্দে ঢুকে পড়ে আশাবরী গলিতে
সুখ কোটরের ভাঁজে ভাঁজে জমে আত্মবিশ্বাস
মন্ত্রমুগ্ধের মতো ছুটে চলে
পশমের বুনুনিতে রঙিন পথ
পলল মৃত্তিকা মাড়িয়ে নীল দিগন্তে....।
২৭ জুন ২০০৮
মোঃ সেলিম রেজা
ইদানিং-৩
ইদানিং নীল রঙের পাখির আনাগোনায়
ফুরফুরে মেজাজে আঠারো বছরে টিনএজ;
ডুব সাঁতারে মগ্ন বডি ল্যাঙ্গুয়েজ
হালের মুঠোফোন নগর থেকে কুঁড়ে ঘরে।
ওরা ভাল থাকলেও ভাল নেই অনেকে
নির্বিকার লোক লজ্জা চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে
সারারাত কথা হয়, দেহকাম নিরবে
জলকেলী হরদম অবিরাম সুখ
প্রতিদিন সাঁতার বিলাস চোখে নেই ঘুম।
১ জুলাই ২০০৮
ইদানিং-৩
ইদানিং মানুষের ভিড় জমে
লেকের পাড়ে শান্ত জলের মিলন মেলায়
বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে মুগ্ধ প্রেমিক;
শব্দহীন জলের স্রোতে ভাসে
সন্ধ্যার ওড়নায় নিঃসীম নির্জনতা.....
স্বপ্ন সন্ধানী দু'জোড়া চোখ তৃষ্ণার পেয়ালায়
দেয় মুখ; রাতের আরশিতে
ফেলে ভালোবাসার দিকচিহৃ....
৬ জুলাই ২০০৮
বিদায় হে কবিতার দিকপাল
(প্রয়াত কবিতার রাজপুত্র শামসুর রাহমান-কে নিবেদিত)
সময়ের আর্বতে বদলায় অনেক কিছু!
শুধু বদলাবেনা আদুরে কারুকাজ;
তুমিই তো কবিতার রাজপুত্র
ব্যাপ্তি প্রসারতার উজ্জ্বল নক্ষত্র।
সেদিনও ব্যস্ততার পাহাড় ভাঙ্গি
হঠাৎ ইথারে ভেসে এলো হু হু আর্তনাদ
নিভে গেলো কবির জীবন প্রদীপ
হারানো বেদনায় নিঃসীম শূন্যতা।
কবির মহাপ্রয়াণে অমানিশার কালো মেঘ
বাংলার আকাশ ভারী, অজস্র কান্নার রোল;
স্মৃতিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে-
জীবনমুখী শব্দের গাঁথুনিতে
বুঝা যেত সহজে কবিতার সুখ দুঃখ।
নতজানু আমি ঋণী কাব্য সংসার
শোকাতুর অশ্র“ সিক্ত শেষ বিদায়-
হে কবিতার দিকপাল
তোমার প্রশ্নের জবাবে বলতে হয়;
নিখাঁদ ভালোবাসাই পারে
মানবকে নিয়ে যেতে মহিমার দিকে।
১৮ আগষ্ট ২০০৬
কবি পরিচিতি
মোঃ সেলিম রেজা, পিতা : মোহাম্মদ ইউনুছ, মাতা : মোছাম্মৎ জয়নাব খাতুন, জন্ম : ২ জানুয়ারী ১৯৮১ইংরেজী, জন্মস্থান : দক্ষিণ পতেঙ্গা, নাজির পাড়া, পতেঙ্গা চট্টগ্রাম-৪২২২।
প্রকাশিত গ্রন্থ : (ক) সপ্তর্ষী নক্ষত্রমালা-২০০৫ইং (কাব্যগ্রন্থ) (খ) বৈশাখ ১৪১৪- বাংলাদেশ দূতাবাস, কুয়েত (গ) উত্তরণ- বইমেলা ২০০৬ (যৌথ কবিতা সংকলন) (গ) কাল উত্তরণ- বইমেলা ২০০৭ (যৌথ কবিতা সংকলন)
যৌথ সম্পাদনা : (ক) উজান : ইতিহাস ঐতিহ্যের কাগজ-কুয়েত (খ) ‘দূর পরবাসে কবিতার আকাশে’- বইমেলা ২০০৮ (কাব্য সংকলন)
অর্জন : সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য সাহিত্য পুরস্কার প্রবাসী সাহিত্য পরিষদ, কুয়েত-একুশে সম্মাননা ২০০৬।
লেখালেখি : মূলত কবিতাই কবির মূল বিষয় অনুষঙ্গ। নিয়মিত স্থানীয় ও জাতীয় পত্র-পত্রিকায় ও সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে-হচ্ছে। এছাড়াও সাহিত্য সংস্কৃতি সমৃদ্ধ বিভিন্ন ওয়েব সাইটসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কবিতা সংকলনে কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে।
বর্তমানে সাপ্তাহিক প্রতিচিত্র’র মধ্যপ্রাচ্য ব্যুরো প্রধান-কুয়েত ও মাসিক একুশে পত্রিকা কুয়েত প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বর্তমান অবস্থান : কুয়েত প্রবাসী। প্রজেক্ট ম্যানেজার, কুয়েত ইউনিভার্সিটি, সুয়েখ।
স্মৃতির পটভূমি :: যুথিকা বড়ুয়া
স্মৃতির পটভূমি
যুথিকা বড়ুয়া
এই তো সেই পটভূমিকা
যেখানে বসে মুখোমুখি, মিলায়ে আঁখি
ছিল দুজনায় প্রেমের মোহনায়,
হয়েছিল কত রঙ্গিন স্বপন
দু’চোখে আঁকা।
এই তো সেই পটভূমিকা।
আকাশে বাতাসে ছিল, ফুলের সুগন্ধে ভরা
হৃদয়াকাশে উঠেছিল জ্বলে, কত সুখতারা
হায়, হঠাৎ কখন যে এলো ঝড়
পাইনি তার সাড়া।
যে ঝড়ে ঝোরে গেল, কাক্সিক্ষত মনের সব আসা
কেঁদে মরে নিরবে নিঃভৃতে, গোপন ভালোবাসা
তারে কেমন করে বোঝাই,
এতো শুধু ছল মরীচিকা।
এই তো সেই পটভূমিকা।
চেয়ে থাকে নিথর নির্বিকারে মনের হিয়া
বিরহে কাটায় নিশি অশ্র“সজলে, হারায়ে পিয়া।
পথ ভুলে এসেছে আজ, বেদনার বালুচরে
স্মৃতির সুরভী হায়, শুধু উড়ে বেড়ায় চারিধারে
কখন যে কাতর মন গেয়ে ওঠে হারানো সেই সুরে
যে সুরে নেই কোনো ছন্দ, কোনো রাগ,
তবে কেন মিছে এই আবেগ-অনুরাগ,
এ তো শুধু জেগে জেগে অবুঝ মনের স্বপ্ন দেখা।
এই তো সেই পটভূমিকা।
যুথিকা বড়ুয়া : কানাডা প্রবাসী লেখক ও সঙ্গীত শিল্পী।
যুথিকা বড়ুয়া
এই তো সেই পটভূমিকা
যেখানে বসে মুখোমুখি, মিলায়ে আঁখি
ছিল দুজনায় প্রেমের মোহনায়,
হয়েছিল কত রঙ্গিন স্বপন
দু’চোখে আঁকা।
এই তো সেই পটভূমিকা।
আকাশে বাতাসে ছিল, ফুলের সুগন্ধে ভরা
হৃদয়াকাশে উঠেছিল জ্বলে, কত সুখতারা
হায়, হঠাৎ কখন যে এলো ঝড়
পাইনি তার সাড়া।
যে ঝড়ে ঝোরে গেল, কাক্সিক্ষত মনের সব আসা
কেঁদে মরে নিরবে নিঃভৃতে, গোপন ভালোবাসা
তারে কেমন করে বোঝাই,
এতো শুধু ছল মরীচিকা।
এই তো সেই পটভূমিকা।
চেয়ে থাকে নিথর নির্বিকারে মনের হিয়া
বিরহে কাটায় নিশি অশ্র“সজলে, হারায়ে পিয়া।
পথ ভুলে এসেছে আজ, বেদনার বালুচরে
স্মৃতির সুরভী হায়, শুধু উড়ে বেড়ায় চারিধারে
কখন যে কাতর মন গেয়ে ওঠে হারানো সেই সুরে
যে সুরে নেই কোনো ছন্দ, কোনো রাগ,
তবে কেন মিছে এই আবেগ-অনুরাগ,
এ তো শুধু জেগে জেগে অবুঝ মনের স্বপ্ন দেখা।
এই তো সেই পটভূমিকা।
যুথিকা বড়ুয়া : কানাডা প্রবাসী লেখক ও সঙ্গীত শিল্পী।
নীলিম করকা :: ২য় কিস্তি
নীলিম করকা
আইয়ুব আহমেদ দুলাল
২য় কিস্তি
(৩)
শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। গোপীবাগ থেকে খিলগাঁও বেশী দুরে নয়। সিহাব বিকেলে স্বর্নাদের বাসায় গেল। খুঁজে পেতে তেমন অসুবিধা হয়নি। দোতলায় থাকে ওরা। দরজায় নক করার পর স্বর্না এসে দরজা খুলল।
ঘরে কোন সাজসজ্জা নেই। আগে যেমন ছিল তেমনই সাদামাটা। তিন ভাইবোন নিয়ে বাবা-মায়ের সংসার। বাবাই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। খুব সীমিত বেতনে তিনি একটি বিস্কুট ফ্যাক্টরীতে চাকুরী করেন। সংসারে বেশ টানাটানি অবস্থা। আগে থেকেই তাদের অবস্থা অস্বচ্ছল। স্বর্নার মায়ের একটি সেলাই মেসিন আছে। বাবার সীমিত আয় এবং মায়ের সেলাই কাজ দিয়েই কোন রকম চলে যায়। এদিকে ছেলেমেয়েদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যোগদান করার প্রয়াশ ও প্রেরনা ছিল তার মায়ের। তিনি ছোটবেলা থেকেই ওদেরকে নাচ-গান শেখানোর প্রতি আগ্রহী ছিলেন।
গল্প গুজব হওয়ার পর চা চক্র হল। হঠাৎ কথায় কথায় মনের ভুলে সে তার সাংস্কৃতিক চর্চার কথা বলে ফেলল। অমনি স্বর্না তড়িৎগতিতে তার পুরানো হারমোনিয়ামটা সামনে এনে দিল।
সিহাব একটু ইতস্তত বোধ করল। কারন সে ছিল তখনো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ছাত্র। ওস্তাদের উপদেশ ছিল যতদিন না তিনি অনুমতি দিবেন ততদিন হারমোনিয়াম ব্যবহার করে গান গাওয়া বা স্টেজে উঠা যাবে না। সম্পুর্ন নিষেধ। তবে হারমোনিয়াম ছাড়া ঘরোয়া পরিবেশে খালি গলায় গান গাওয়ার অনুমতি ছিল। ওস্তাদের থিউরী হল- কোন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ছাত্র মানে সারগাম শিক্ষার্থী, কোর্স কমপ্লিট হওয়ার আগে যদি হারমোনিয়াম দিয়ে গান গায় তাহলে তার কণ্ঠের বেজ নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া ষ্টেজে উঠার ব্যাপারে নিষেধ করেছেন। কারন গান গাওয়ার পর যদি একবার হাতেতালি পড়তে শুরু করে তাহলে সারগাম বা সঙ্গীতের প্রয়োজনীয় পাঠ্যসূচী থেকে সে বি”্যুত হবে এবং ঐ হাততালীর দিকেই সে বেশী আকৃষ্ট হবে। ভাল ভাল গান শুনিয়ে দর্শকদের কাছ থেকে বাহবা নেবে এবং একসময় তার কন্ঠের বেজ নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং স্বর্নার অনুরোধে সে গান গাইতে অস্বীকৃতি জানালেও তারা মানতে রাজী হয়নি। বরং অহংকারী, ঢং এবং মুখ ভেংছি দিয়ে স্বর্না উপহাস করতে শুরু করলো। থিউরী দিয়ে কি আর সঙ্গীত প্রেমীদের দমানো যায় ? কাজেই ছাড় না পেয়ে পরিশেষে সিহাব সা পা চেপে ধরে একটি আধুনিক গান গাইল।
গান শুনে পাশের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন এক ভদ্রমহিলা ও একটি মেয়ে। গান চলাকালীন সময়ে তারা এসে চেয়ারে বসলেন। গান শেষ হওয়া মাত্রই চডরপডর হাতেতালি শুরু হয়ে গেল। স্বর্নাকেও গাইতে বলল। স্বর্নাও হারমোনিয়াম বাজাতে অস্বীকৃতি জানাল। কারণ সে ভাল বাজাতে পারতো না। অর্থাৎ গান তোলা শেখেনি। সেও সারগাম শিখছিল। তবে সিহাবের মত উপদেশ ওস্তাদের কাছ থেকে পায়নি। অর্থাৎ একাডেমীতে যাচ্ছে- ছাত্রছাত্রীদের একত্রে বসানো হচ্ছে। সুরে সুরে সবাই মিলে একত্রে গান গাচ্ছে। শুনতেও ভাল লাগছে। গান গেয়ে মনটা একদম প্রফুল্ল হয়ে যায়। পরিশেষে ডায়েরীতে লিখে বাসায় চলে আসে। ব্যশ।
গান শেষে স্বর্না ভদ্র মহিলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তারা দুইজনই স্বর্নার খালাত বোন। সিহাব সালাম দিল। কিন্তু ভদ্রমহিলা হাসতে হাসতে কুটিকুটি। হাসির মাঝে কেমন যেন একটা রহস্য ছিল। তবে রহস্য উম্মোচনে সিহাব অতটা আগ্রহী ছিল না।
ভদ্রমহিলার নাম শিলা এবং সাথে তার ছোটবোন মিলা। সিহাব যখন শিলার কাছে তার হাজবেন্ডের কথা জানতে চাইল তখন সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠল। সিহাব পড়ে গেল এক বিভ্রতকর পরিস্থিতিতে।
‘ আপনারা হাসছেন কেন ?
‘ আরে ব্যাটা, ওর এখনো বিয়ে হয়নি। ও তোরচে বয়সে অনেক ছোট হবে। মাত্র ডিগ্রীতে পড়ে। গায়ে গতরে বেড়ে গেছে, এই যা। - স্বর্নার মা বললেন।
‘ ও আচ্ছা। দেখেতো মনে হয়না। তাছাড়া নাকে নাকফুল।
অট্টহাসির মত ধ্বনি হল আবার। সিহাব নিজেকে কোনমতে সংবরণ করে নিল। লাল হয়ে গেল তার মুখমন্ডল। শিলার স্বাস্থ্য ও তার বেশবুসায় অবিবাহিত মনেই হয়না। তাকে দেখে সিহাব যেভাবে ভুল করেছে, অনেকেই অমন ভুল করে বলে জানিয়েছে স্বর্নার মা। প্রকৃত সত্য হল- শিলার বয়স আসলেই কম। তবে সে অসুস্থ। দীর্ঘদিন ধরে বাতজ্বরে ভুগছে। সেইজন্য তাকে নিয়মিত ঔষধ সেবন করতে হয় এবং প্রতিমাসে একটি করে ইন্জেকশন নিতে হয়। তারই প্রতিক্রিয়ায় শরীরটা ফুলে গেছে। এমনকি ছয় বছর তাকে ঐভাবে চিকিৎসা নিতে হবে।
মিলা খুব চুপচাপ। চুপচাপ থাকতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। সে ইন্টারের ছাত্রী। লাজুকও বটে। সে একটু বেশী ভদ্র; শিলা বলল।
সিহাব যখন তাদের বাসা থেকে বিদায় নিতে প্রস্তুত হল তখন শিলা এসে অনুরোধ করল কাল পরশু যেন একবার আসে। কোন এক বিশেষ প্রয়োজন আছে। সেই বিশেষ প্রয়োজনের কথা তখন আর বলেনি।
দুই তিনদিন পর সিহাব তাদের বাসায় গেল। গেটের সামনে গিয়ে কলিংবেল বাজাল। স্বর্নার ছোটবোন প্রীতি দরজা খুলে দিল। ঘর ফাঁকা ফাঁকা দেখে সিহাব তার খালাত বোনসহ অন্যান্যদের কথা জানতে চাইল। প্রীতি বলল তারা নাকি মার্কেটে গেছে। তাহলে শুধু শুধু এসে কী লাভ হল! সিহাব চলে যাওয়ার স্টেপ নিল।
‘ ভাইয়া, বসেন। আমরা আছি নাহ !
‘ তোমরা মানে ?
‘ মানে আমি আর মিলা আপু আছি। আমাদের সাথে গল্প করেন।
‘ কী গল্প করবো তোমার সাথে ! তুমি তো হাট্টিমাটিম টিম।
‘ কেন আমি ছোট বলে আমাকে পছন্দ হয়না ?
‘ হবে না কেন ? তুমি ছোট কোথায় ? তুমি তো অ-নে-ক বড়।
‘ মজা করেন নাহ ?
‘ আরে পাক্নী মজা করবো কেন ? তুমি কোন্ ক্লাসে নাহ ?
‘ ক্লাস থ্রি। পরীক্ষায় তিন বিষয়ে ফেল করেছি -হা।
‘ হা হা হা --। ফেল করে আবার বাহাদুরী দেখাও।
‘ এটা কয় জনে পারে বলেন ?
‘ থাক্ তোমাকে আর পাকামো করতে হবে না। এখন বল তোমার আম্মুসহ কখন আসবে ?
‘ দেরী হবে। কিছুক্ষন আগেই তো গেল- মিলা বলল।
এতক্ষন পর মিলার মুখে খই ফুটল। প্রথম থেকেই সে কথা বলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ভেতর থেকে বের হয়নি। তার ভাব দেখেই বুঝা গেছে। এইটুকু কথা বলতে গিয়েও লাল হয়ে গেল।
‘ তোমরা যাওনি কেন ?
‘ আপনি আসবেন, তাই আমরা রয়ে গেছি।
‘ কী করে জানো আমি আসবো ?
মিলা কোন উত্তর করেনি। সিহাব মিলার জড়তা দেখে তার সাথে আরেকটু ইজি হওয়ার চেষ্টা করলো।
‘ তুমি কিসে পড় ?
‘ ইন্টারমিডিয়েট ফার্ষ্ট ইয়ার।
‘ কোন গ্র“পে।
‘ আর্স।
‘ তোমার পার্টস আছে ?
মৃদু হাসল মিলা। - কেন, একথা বললেন কেন ?
‘ না এমনিই। শুনেছি আর্সে যারা পড়ে তাদের নাকি পার্টস থাকে না। তাই জানতে চাইলাম সত্য না মিথ্যা।
মিলা তবুও ইজি হতে পারেনি। তার এ্যাটিটিউড দেখে বুঝা গেল সে আড্ডা মারা বা গল্প করায় অভ্যস্ত নয়। তাছাড়া ইন্টার প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা মুলত গল্পবাজ বা আড্ডাটাকে বেশী মাত্রায় প্রাধান্য দেয়। নবজীবন, নব উদ্দীপনা, নব পরিবেশ, নব ইমেজ বিরাজ করে তাদের মাঝে। কিন্তু মিলার মাঝে তেমন কিছু দেখা যায়নি বরং সংকোচের মাত্রা ছিল বেশী। তবে সামনে থেকে সরেও যায়নি। সে সিহাব ও প্রীতির ট্যাসটেসে কথাগুলো উপভোগ করছিল। মিটিমিটি হাসছিল।
মিলা চা করে নিয়ে এলো। চায়ে চিনি একটু বেশী পড়েছে। সিহাব সেটাকে শরবত বলায় মিলা মুখটা মলিন করে সরে গেল। আড়ালে গিয়ে প্রীতিকে ডাক দিল। প্রীতি ভেতর থেকে এসে সিহাবকে ধমকের সুরে বলল- ভাইয়া, মিলা আপু চা বানিয়েছে। আপনি এটাকে শরবত বলবেন না। আপুর খুব জিদ, হ্যাঁ।
‘ ওরে বাবা, ভয় পেয়েছি। জিদ হলে কী করে ?
‘ খুব রাগ হয়।
‘ কিছু ছুড়ে টুড়ে মারে নাকি ?
‘ হ্যাঁ, তাও মারে।
‘ ও ভাই গো, তাহলে আমি পালাই।
সিহাব উঠে যেতে চাইল।
‘ ধুরো ভাইয়া, কী যে বলেন। বসেন না। একটা গান শুনান।
‘ তোমাদের বাসায় কেউ নেই এখন গান হবে না। আমি বরং যাই। পরে আসব।
সিহাব চলে গেল। চার পাঁচ দিন পর আবার এলো। সেদিন ছুটির দিন। বাসায় সবাই ছিল। বিকেল চারটার মতো বাজে। সবাই খোশগল্পে মেতে ছিল। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। স্বর্না দরজা খুলে দিয়ে একটি ব্যাগ বহন করে কিচেনের দিকে নিয়ে গেল। তার বাবা বাজার করে বাসায় ফিরলেন। সিহাবকে দেখে অবাক হলেন। বিশ্বাসই করতে পারেননি। তারপর কুশলাদী বিনিময় করে তিনি প্রেস হওয়ার জন্যে বাথরুমে চলে গেলেন।
শিলা বলল- আপনি আম্মার সাথে কথা বলেন আমরা কিচেনে যাই।
খালাম্মাকে ওরা আম্মা বলে। আর নিজের মাকে আম্মু বলে। যাইহোক শিলা ও মিলা স্বর্নাকে সাহায্য করতে কিচেনে চলে গেল। তাদের হন্তদন্ত অবস্থা দেখে সিহাব ভদ্রতার খাতিরে নিষেধ করল যেন কোন কিছুর আয়োজন না করে। স্বর্নার মা তখন খিক্ খিক্ করে হেসে উঠলেন।
‘ তোমার জন্যে আয়োজন না করলেও আমাদের জন্যে করতে হবে।
‘ মানে ?
‘ মানে আমরা এখনো খাইনি। এই মাত্র বাজার এলো।
স্বর্নার মার ঠোঁট পাতলা। নির্ধিদ্বায় সব কথা বলে ফেলেন। নিজের সংসারে অভাব, না খেয়ে ঘুমিয়ে থাকা, আধাপেট খেয়ে থাকা তাদের স্বাভাবিক রুটিন। তিনিই এসব বলেন। সিহাব খুব লজ্জ্বায় পড়ে গেল। আড়চোখে একবাব রুমটা দেখে নিল। টানাটানির সংসার, ঠিকমত খাবার জোটে না, পরতে পারে না, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ ঠিকমত বহন করতে পারেনা অথচ তিনি সন্তানদের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেন। অবশ্য সব বাবা মা’ই ছেলেমেয়েদের উজ্জল ভবিষ্যৎ কামনার্থে আত্মত্যাগী হয়ে থাকেন। তারাও তাই করছেন। তবে এ লাইনে প্রচুর খরচ এবং অনেক সাধনার ব্যাপার। বড় মেয়ে গান শেখে, ছোট মেয়ে নাচ শেখে আর ছেলেটাকে শেখানো হচ্ছে মার্শাল আর্ট। আসলে ইট, বালি, সিমেন্টের জোড়াতালি দিয়েই তৈরী হয় ইমারত। অভাবের মাঝে থেকে যদি তাদের কেউ একজন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তবেই কষ্ট সার্থক। তাছাড়া শ্রম কখনো বিফলে যায় না, এটাই হয়ত তাদের পথপ্রদর্শক।
অতি অল্প সময়ের মধ্যে রাঁধুনীরা সংক্ষেপে খিচুড়ী বানিয়ে নিয়ে এলো। সিহাব চলে যেতে চেয়েও পারেনি। অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে হল। লজ্জা ও সংকোচ নিয়ে সিহাবকে তাদের সাথে খেতে হল। কারণ তাদের না খেয়ে থাকার বিষয়টা জানার পর সিহাব না পারছিল উঠে আসতে, না পারছিল কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই গল্প করতে বসে পড়ল। সবারই চোখমুখ সজীব হয়ে উঠল। অতৃপ্তির কোন ছোঁয়া তাদের মাঝে ছিল না। ক্ষুধা পেটে কি আর গল্প জমে! ক্ষুধা নিবারণ করে তাই নিশ্চিন্তে আরাম করে বসল। শিলা যেন কৃত্রিম শক্তি সঞ্চয় করল। শিলাদের পারিবারিক অবস্থা অবশ্য স্বর্নাদের মত নয়। তারা বেশ স্বচ্ছল। তাদের পোশাক আশাকেও বিলাসিতার ছোঁয়া রয়েছে।
‘ সেদিন চলে গেলেন কেন ? শিলা বলল।
‘ ফাঁকা বাসায় কী করবো ? আসতে বলে তো আপনারা হাওয়া হয়ে গেলেন।
‘ একটি বিশেষ প্রয়োজনে মার্কেটে গেলাম। আপনাকে প্রয়োজন ছিল মিলার। সে গান বাজনা খুব পছন্দ করে। আপনার একটি গান শুনেই সে মুগ্ধ। তাই আমাকে বলল আপনাকে বলতে যেন আর একদিন এসে গান শুনিয়ে যান।
‘ কই মিলা তো কিছুই বলেনি। আমি এলাম আর সে ঐ চেয়ারে চুপচাপ বসে ছিল। প্রীতিও তো কিছু বলেনি। সেতো বানরের মত শুধু লাফালাফি করছিল। চুপচাপ বসে থাকতে ভাল লাগছিল না, তাই চলে গেলাম। ভালই তো হত যদি মিলা আমাকে গান গাইতে বলতো। তাহলে নির্জনে নিবৃত্তে গান গাইতাম। আর তাছাড়া আমি মনে করেছি আপনিই বোধহয় গান শুনতে চেয়েছেন। আমাকে আসতে বলার পেছনে এছাড়া আর কোন কারণ দেখিনি। মিলার কথা মনেই আসেনি। মিলা তো কথাই বলে না, খুব লজ্জা পায়।
‘ ও এমনই। চুপচাপ থাকে সারাক্ষন। কোন ঝুট-ঝামেলার মাঝে নেই। ঠিক আছে আজ একটা শুনিয়ে দিন।
‘ মুড নেই, আরেকদিন।
(৪)
চাকুরীর সুবাধে স্বর্নার বাবা পুনরায় বাসা পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি চাকুরী করেন মুগ্দা পাড়ায়। তাই যাতায়াতের সুবিধা বিবেচনা করে বাসা নিলেন মানিকনগর শেষ প্রান্তে। ভাড়া তেমন বেশী নয়, সাবলেট বাসা। গোপীবাগ থেকে সিহাব মাঝে মধ্যে সেখানে যেত। স্বর্নার সাথে এক সঙ্গে মাঝে মাঝে গান বাজনা করতো। স্বর্না শুধু গান গাইতে পারত। যদিও সারগাম সম্পর্কে তেমন আইডিয়া ছিলনা। সিহাব মাঝে মাঝে তাকে সারগাম সম্পর্কে তালিম দিতো। সেই সুত্র থেকেই শিলা ও মিলার সাথে তার দেখা হত। মিলার সাথে তেমন একটা কথা হত না। কারণ ঐ একটাই, সে বড়দের কাছ থেকে সবসময় নিজেকে আড়াল করে রাখে। শিলা ওসবের ধারধারি না। সে এতো চঞ্চল যে, কথা বলতো ঠাস ঠাস, আর হাসতো ফ্রি ষ্টাইলে দাঁত কেলিয়ে। একদিন কথায় কথায় সিহাব লক্ষ্য করলো যে, শিলা তার সাথে কেমন জানি অনীহা নিয়ে কথা বলছে। তার আচরনে কিছুটা তুচ্ছ তাচ্ছিল্যতা রয়েছে। সিহাব এ বিষয়টা লক্ষ্য করে তার সাথে আরো বেশী বেশী মেশার চেষ্টা করলো। এক পর্যায়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলো- সে কি সবার সাথেই এভাবে কথা বলেন ?
‘ কীভাবে বলি ?
‘ এইযে কথার মাঝে একটা তুচ্ছ তুচ্ছ ভাব।
‘ না।
‘ তাহলে ?
‘ ছেলেদের আমি পছন্দ করিনা। সেজন্যই আমার ভিতর থেকে আপনা আপনি অনীহা ভাবটা বেরিয়ে আসে।
‘ হ্যাঁ, আপনার সংকোচহীন এপ্রোজ দেখে তাইই মনে হয়। সত্যতা স্বীকারের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু কারণটা কি জানতে পারি ?
‘ কী জানতে চান ?
‘ ছেলেদের আপনি পছন্দ করেন না, নাকি সহ্য করতে পারেন না।
‘ দুটোই।
‘ মানে ?
‘ পছন্দ করিনা, কারণ ছেলেরা স্বার্থপর। আর সহ্য করতে পারিনা, তার কারণ ওরা প্রতারক।
‘ ছেলেরা কী ক্ষতি করেছে, আপনার ?
‘ অপূরনীয় ক্ষতি।
‘ জানতে পারি ?
‘ কেন বলবো আপনাকে ? আপনিও তো সেই প্রজাতির।
‘ সে জন্যেই জানতে চাই। ছেলেরা স্বার্থপর, প্রতারক অথচ আমার সাথে প্রায় ঘন্টা দু’য়েক হতে চলল গল্প করছেন।
‘ আপনি এখন আমাদের মেহমান। ভদ্রতার খাতিরে কথা বলছি।
‘ সেই কথার মাঝে যদি অনীহা প্রকাশ পায় তাহলে কী সেটাকে ভদ্রতা বলা যায়? নাকি সেটা হবে শিষ্টাচারের পরিবর্তে নিষ্টাচার অথবা ভ্রষ্টাচার।
সিহাবের কথা শুনে চুপসে গেল শিলা। লাল হয়ে গেল তার মুখমন্ডল। সরি, আপনি কিছু মনে করবেন না, আসলে আমি বিষয়টা ওভাবে বলিনি- শিলা বলল।
‘ যাইহোক সেটা আপনার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার।
ক্রমাম্বয়ে শিলার আচরনে অনীহা ভাব কিছুটা কেটে গেল। সে বেশ শালীনতাবোধ বজায় রেখে কথা বলার চেষ্টা করলো। এক পর্যায়ে সিহাব তাকে আর অবজ্ঞা করার সুযোগ না দিয়ে সেদিনের মত চলে গেল।
প্রায় দশ-বারদিন পর এমনি এক ছুটির দিনে শিহাবকে স্বর্নার মা সংবাদ দিয়ে পাঠালেন। সকাল বেলা। সিহাব তখনো বিছানা ছাড়েনি। সুজন গিয়ে ডেকে তুলল।
‘ ভাইয়া, আম্মা আপনাকে এক্ষুনি যেতে বলেছেন, খুব জরুরী।
সুজন সংবাদটা দিয়েই চলে গেল। জরুরী ভিত্তিতে তলব করা হলেও সিহাব অতটা পাত্তা দেয়নি। বাথরুম সেরে গোসল করে ধীরে সুস্থ্যে মহল্লার গলি বেয়ে হেটে গেল তাদের বাসায়। গিয়ে দেখে সবাই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি, যার জন্যে জরুরী তলব করতে পারে !
‘ কী হয়েছে খালাম্মা ?
স্বর্না ও তার মা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ইশারায় কী যেন বলতে চাইল। বলতে গিয়ে একটু ইতস্তত বোধ করলো। এপর্যায়ে স্বর্নার মা বললেন- সিহাব, তোমার কাছে চারশ টাকা হবে ?
শুনে সিহাবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বলল- টাকার প্রয়োজন ছিল, সুজনের কাছে বললেই পারতেন, তাহলে আর আমাকে আসতে হত না।
‘ কেন, তুমি কী আমার বাসায় আসবে না ?
‘ আসব না কেন ? তার জন্যে একটা মানষিক প্রস্তুতি প্রয়োজন, তাই নাহ ?
‘ তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজন ছিল তাই ----।
সিহাব চারশ টাকা বের করে দিল। তবে টাকাটা ফেরৎ পাওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিল না, এটা সে ভাল করেই জানত। এ লাইনে যারা থাকে তাদের হাতে টাকা পয়সা গেলে ফেরৎ আসে না, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। সবাইতো আর সমান নয়। এ ব্যাপারে সিহাবের যথেষ্ট আইডিয়া ছিল। সে একদম পরিপূর্ন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। সে সাংস্কৃতিক জগতে নিজেকে স্থান দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পূর্নতা পায়নি। কারণ ছিল পিছুটান। নাটক বা গান বাজনা এসব সবাইকে দিয়ে হয়না। উত্তোরাধিকার সুত্রে অভিনেতা বা গায়ক নায়ক হওয়া সহজ। ভিন্ন পরিবেশ থেকে এসে স্থান পাওয়া খুবই দুরুহ। এ ধরনের ছেলেদের কাছ থেকে তাই সংশ্লিষ্ট সংগঠনের কর্তারা তাদের সরলতার সুযোগ কাজে লাগিযে হাতিয়ে নেয় টাকা পয়সা। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে লোন নিয়ে আর ফেরৎ দেয়না। চাওয়াও যায় না। বাদ হয়ে যাওয়ার হুমকি থাকে। তাই শখ পূরণের আশায় সেটা জলাঞ্জলি দিতে হয়। সংগঠনের সহকর্মীরাও সিহাবের সাথে এমন করেছে। অর্থাৎ সিহাবকে দিয়ে তাদের ক্ষতিটা পুষিয়ে নিয়েছে। সিহাব সহজ সরল ছেলে, তাই প্যাঁচ বুঝতে সময় লেগেছে। নাটক, থিয়েটার, ফ্যাশনশো সবই ঘেঁটেঘুঁটে পরিশেষে গানের ওস্তাদ ধরেছে। কাজেই টাকাটা দেওয়ার সময় সে মনে মনে ফি-সাবিলিল্লাহ বলেই দিয়েছে।
দুইদিন পর সুজন আবার সিহাবের বাসায় এলো। বলল স্বর্না যেতে বলেছে।
‘ পরে গেলে হবে না ?
‘ না এক্ষুনি যেতে হবে। আমাদের বাসা হয়েই অফিসে যাবেন।
সিহাব ওদের বাসায় গেল। স্বর্না সিহাবকে দেখে মিটিমিটি হাসছিল।
‘ ভাইয়া, আপনার জন্য একটা গুড নিউজ আছে।
‘ কী, জলদি বল।
‘ এটা জলদি করার বিষয় নয়।
শালিকা যেমন দুলাভাইয়ের সঙ্গে গাল, নাক, মুখ, চোখ নৃত্য করে কথা বলে স্বর্নাও সেইভাবে বলছিল।
‘ এই জন্যই কি ডেকেছ ?
‘ হ্যাঁ। তবে বুঝতে পারছি আপনি এখন ব্যস্ত। অফিসে যাওয়ার পথে আছেন। এই নিন একশ টাকা। বাকী টাকা পরে দেবো। আর দুই নম্বর বিষয়টা পরে বলবো। যদি সম্ভব হয় সন্ধ্যায় আসবেন। বিষয়টা অত্যন্ত কন্ফিডেন্সিয়াল এবং গুরুত্বপুর্ন।
সিহাব সেদিন আর যায়নি। পরেরদিন সন্ধ্যায় গেল। টিভিতে প্রচার হবে এমন একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের নাম বলে রেকর্ডিং অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্যে একটা টিকিট দিলেন স্বর্নার মা। স্বর্না তার মায়ের পাশে অন্য একটা চেয়ারে বসে তখনো মিটিমিটি হাসছিল। শিলা নেই। সে তার কোন এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গেছে। মিলা চলে গেল গ্রামের বাড়ীতে। তার কলেজ খোলা, পরীক্ষা নাকি সন্নিকটে।
‘ স্বর্না, কী বলবে বল।
‘ বলবো ভাইয়া, বলবো।
সেদিনও স্বর্না বলেনি। এ নিয়ে সিহাবের তেমন কোন আগ্রহ ছিলনা। কারণ যেই বয়সে ভাবাবেগ থাকে, কৌতুহল থাকে, সেই সময় বা পরিস্থিতি সিহাব বেশ আগেই অতিক্রম করে গেছে। প্রেম করেছে, ছ্যাক খেয়েছে, ছ্যাক দিয়েছে, বাকী নেই কিছুই।
সুজনের জম্মদিন। জম্মদিনের দাওয়াত দিয়ে গেল স্বর্না ও শিলা। শিলাকে দেখেতো সিহাব বলেই ফেলল- আপনি এখনো আছেন ? সে কিছু না বলে স্মীত হাস্যে মাথা নাড়াল। সেখানে তেমন আর গলাবাজী করেনি শিলা। কারণ সিহাব ব্যাচেলর থাকে। আশেপাশে রুমমেটরা ছিল। তাদের সামনে চঞ্চলতা বেমানান।
সিহাব সুজনের জম্মদিনের নেমন্ত্রনে গেল। গিয়ে দেখে তেমন কোন মেহমান নেই। দুই একটা অপরিচিত মুখ, শিলা, মিলা আর ওরা নিজেরাই। ছোটখাট একটি কেক এনে জম্মদিন পালন করলো। খাঁচা ভর্তি একটা ফুলের তোড়া ছাড়া উল্লেখ করার মত তেমন কোন উপহার সিহাব নেয়নি। তাই দেখেই ওরা মহাখুশী। হৈ চৈ করে নেচে উঠলো এবং স্বর্নার ক্যাছক্যাছানী শুরু হয়ে গেল।
‘ ভাইয়া, আরো আগে আসলেন না কেন ? আমরা ছবি তুলতাম !
‘ তোল, মানা করছে কে ?
‘ এখনতো কেক কাটা হয়ে গেছে।
‘ সবার প্লেট থেকে কেক তুলে নিয়ে জোড়া লাগিয়ে আবার কাটো।
‘ (হি হি হি ---) ধুর মিয়া, আপনি একটা কিপ্টা। অন্য কেউ হলে এক্ষুনি গিয়ে আরেকটা কেক নিয়ে আসতো।
‘ হ্যাঁ, যদি সে পাগল হয়।
সমস্বরে হেসে উঠলো সবাই। জানো আপু, ভাইয়াকে কথায় হারানো কঠিন। স্বর্না শিলাকে বলা মাত্রই শিলা একটা ধমক দিয়ে বলল- তোকে আর হারাতে হবে না, উনাকে বসতে দে!
অনুষ্টান শেষে উল্টাপাল্টা আসর। গল্পগুজব, হাসাহাসি, উচ্চকন্ঠ, চড়-থাপ্পড় সব কিছুই চলছিল। স্বর্না, শিলা ও মিলা ধাঁধার আসর বসিয়েছিল। একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করছিল আর পিঠের উপর থাপ্পড় মারছিল। দন্ত প্রদর্শনতো আছেই। সিহাবকেও দু’একটা ধাঁধা ধরল। সে একটিও পারেনি। সিহাবও তাদেরকে একটা অংকের খেলা দিয়েছিল। স্বর্না ও শিলা অপারগতা প্রকাশ করল এবং সেটি মিলিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল মিলার উপর। কারণ মিলা ভাল ছাত্রী এবং তাদের বিশ্বাস সে অংকটা মেলাতে পারবে। মিলা চেষ্টা করে অংকটা পেরেছিল ঠিকই কিন্তু তার ফলাফলে সে লজ্জা পেল। সেই ধাঁধাঁর সুত্র ধরেই মিলা বেশ ইজি হয়ে গেল। জড়তা অনেকটাই হ্রাস পেল। ধাঁধাঁটির উত্তর ছিল একটি প্রেমাত্বক বাক্য। যা দেখে মিলার চোখ মুখ বিবর্ন হয়ে গিয়েছিল। স্বর্না সবাইকে পড়ে শোনাল।
ধাঁধাঁর আসরকে এড়িয়ে সিহাব এক পর্যায়ে শিলার সাথে গল্পে লিপ্ত হল। কারন ওর সাথেই সিহাবের ভাল জমতো। অর্থাৎ ওদের দুজনে যখন কথা বলতো তখন কথার মারপ্যাঁচে কেউ কাউকে হারাতে পারতো না সহজে। সিহাব এই বিষয়গুলো ভালই পারতো এবং এন্জয় করতো।
সিহাবের মনে যে প্রশ্নটি বেশী ঘুরপাক খাচ্ছিল সেটা শিলার কাছে পুনরায় জানতে চাইল। কেন সে ছেলেদের পছন্দ করে না? জবাবে শিলা তার এক বান্ধবীর কথা উল্লেখ করে একটি নাতিদীর্ঘ কাহিনী বর্ননা করল। অর্থাৎ জেমি’র জীবনে ঘটে যাওয়া একটি প্রেম কাহিনী।
জেমি ছিল শিলার প্রিয় বান্ধবী। সে রোকনের সাথে প্রেম করতো। রোকন দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম ছিল এবং কাজে কর্মে আচার ব্যবহারে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করা যেত বা তার উপর নির্ভর হওয়া যেত। জেমি তাকে খুব ভালবাসত। বন্ধুমহলের কেউ কখনো ওদের বিচ্ছেদ কামনা করেনি বা ভাবতে পারেনি। রোকনও তাকে ভালবাসত প্রচন্ড রকমের। ওদের মাঝে কোন বিরোধ ছিলনা। কোন রকমের ভুল বোঝাবুঝিও ছিলনা। হঠাৎ একদিন সংবাদ এলো রোকন বিয়ে করে জাপান চলে গেছে। ঘটনাটা ঘটেছিল এক সপ্তাহের মধ্যে। বুঝে উঠতে পারেনি কেউ। আকাশ ভেঙ্গে পড়ল জেমি’র মাথায়। সে একা অসহায় হয়ে গেল। সান্তনা পাওয়ার ভাষা ছিলনা। পারিবারিক কোন প্রতিবন্ধকতাও ছিলনা। অথচ রোকন এমন বেঈমানী করলো! এই ঘটনার পর থেকে জেমি দুঃশ্চিন্তায় অনেকটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ল। তার দুঃসময়ে একমাত্র শিলাই বন্ধু বা বান্ধবী হিসাবে তার পাশে দাঁড়াল। খুব কাছ থেকেই শিলা তার কষ্ট দেখেছে, তার আনন্দে হেসেছে, তার দুঃখে কেঁদেছে। আর সেই কারণেই শিলা ছেলেদের অপছন্দ করে বলে জানিয়েছে।
তবে কোন্ পরিস্থিতিতে রোকন বিয়ে করলো বা কেনইবা এমন ঘটনা ঘটাল, এর পিছনে রোকনের কোন বাধ্যবাদকতা ছিল কিনা- এসব বিষয়ে খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি কেউ। বরং সিহাবের এহেন প্রশ্নের জবাবে শিলা খুবই বিরক্তি বোধ করলো। ক্ষেপে গেল। মুহুর্তেই রক্তবর্ন হয়ে গেল তার চোখ। চীট, বাটপার, ইতর, অসভ্য, ছোটলোক ইত্যাদি বলে রোকনকে গালমন্দ করলো। সিহাব বাস্তবতার আলোকে বিভিন্ন লজিক দিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু সে মোটেই পাত্তা দেয়নি। মনে হল যেন জেমি নয় শিলাই রোকন কর্তৃক প্রতারিত হয়েছে।
‘ আচ্ছা, আপনি কি ছেলেদের সত্যিই ঘৃনা করেন? আপনি কি কখনো বিয়ে করবেন না ?
‘ নিজ ইচ্ছায় করবো না। তবে ফ্যামিলির চাপ সামলাতে না পারলে হয়ত কোন অপদার্থ পুরুষকে বিয়ে করতে হবে।
‘ তখন সেই পুরুষটিকে আপনি কিভাবে মেনে নেবেন ?
‘ লোক দেখানোভাবে মেনে নেব হয়ত। কিন্তু নিজের স্বাধীনতা আগেই কেড়ে নেব।
‘ দিবা স্বপ্নে বিভোর আপনি। জীবনটাকে যেভাবে ভাবছেন এত সহজ বা কন্টকমুক্ত নয়। বরং এর চেয়েও নব্বই ভাগ বেশী কণ্টকাকীর্ণ। সুতরাং এভাবে বলা উচিত নয়।
‘ জি-হাঁ, এমনই করবো।
‘ পারবেন না। ভাগ্যের মারপ্যাঁচে আপনি হেরে যাবেন। ঠিক আছে, বাদ দিন সেসব কথা। রোকন যাক অরন্যরোদনে। আচ্ছা, আপনি কি কখনো প্রেম করেছেন ? -শিহাব বলল।
‘ না। কখনো করিনি, করবোও না।
‘ মানুষ কখন কোন পরিস্থিতিতে প্রেমে পড়ে যায়, সেটা কি জানেন ?
‘ প্রয়োজন নেই।
‘ হঠাৎ যদি আপনি কারো প্রেমে পড়ে যান, তখন কি আপনি আপনার ঘৃনাটা পুরুষ প্রজাতির বিরুদ্ধে প্রকাশ করতে পারবেন ?
‘ যা আমি ঘৃনা করি। যার প্রতি রয়েছে আমার অনীহা এবং অবজ্ঞা, তার সাথে প্রেম(?), প্রশ্নই উঠেনা।
‘ তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন যে, প্রেম ইচ্ছে করেই হয়। মুখ দিয়ে ভালবাসি বললেই ভালবাসা হয়, কিংবা কাউকে পছন্দ হলেই বা নজর পড়লেই কি ভালবাসা হয়ে যায় ?
‘ তা নয়তো কী ?
‘ আসলে এ বিষয়ে আপনি একদম অজানা বলতে হবে। কারণ মানুষ কে কখন কোন পরিস্থিতিতে কার প্রেমে পড়ে যায় কেউ বলতে পারেনা। এটা অনুভূতির ব্যাপার। এর কোন এ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগে না, এটা হয়ে যায়।
‘ অসম্ভব, তবুও পুরুষের উপর কখনোই আমার ভালবাসা জম্মাবে না।
‘ অবিশ্বাস্য। এটা আপনার ওষ্টকথা। মেয়েরা জোর গলায় এসব বলে এক ধরনের ভালমী দেখায়, যেন তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়। অথবা এটা হবে কারো সাথে প্রেম করার পূর্বাভাস।
‘ ইসসস্। কইছে আপনেরে।
‘ কওয়া লাগে না। এমনিতেই বোঝা যায়। মেয়েরা মুখে বলে এক, অন্তরে থাকে আরেক। আমি জানি আপনি সারাক্ষন বিয়ের কথা ভাবছেন। সব মেয়েরাই ভাবে। এটা মেয়েদের দৈনন্দিন কমন ভাবনা। আপনিও ভাবছেন। সুখের স্বপ্ন দেখছেন। সংসার, ছেলে-মেয়ে, দেবর-ননদ, শশুর-শাশুড়ী এসব নিয়েই ভাবছেন।
সিহাব অযথা আর কথা বাড়ায়নি। সে শুধু একবার শিলার আপাদমস্তক দেখে নিল। এরপর থেকে ঘন ঘন স্বর্নাদের বাসায় যেতে লাগল। বিভিন্ন বিষয়ে একটু একটু করে কথা বলতে লাগল এবং ধীরে ধীরে শিলার চোখে মুখের ঘোলা ভাবটাও সরে যেতে লাগল। তাই সুযোগ পেলেই সিহাব সময় দিতো। আধাঘন্টা একঘন্টা গল্প করেও যেন শিলার মন ভরতো না। এক সময় সিহাব হয়ে গেল তার শুকপাখি।
শিলা শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিল বিধায় সিহাব মাঝে মাঝে ঔষধ এনে দিত। স্বর্নাদের বাসায় যাওয়ার সময় এটা ওটা নিয়ে যেতো। ওদের সাথে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে যেত। বাহিরে বেড়াতে যেতো। শিলা তখন মোটেই সিহাবের সঙ্গচ্যুত হত না। একদম ছায়ায় ছায়ায় লেগে থাকত।
এরই মাঝে মিলা স্বর্নার মাধ্যমে সিহাবকে পছন্দ করার কথা জানাল। স্বর্নার সেই রহস্যময় হাসির অর্থ ছিল এটাই। মিলা তখন গ্রামের বাড়ীতে। স্বর্না বিষয়টি তার মাকেও জানিয়ে দিয়েছিল। তিনি হাসিমুখে গ্রহন করেছিলেন। ইতিমধ্যে শিলাও জেনে গেছে। সেও আপত্তি করেনি। কিন্তু সিহাব তাতে রাজী ছিল কিনা কেউ জানতে চায়নি। সিহাব বারবার স্বর্নাকে বলেছিল মিলাকে বাড়ী থেকে নিয়ে আসতে। কিন্তু মিলার লেখাপড়ার ক্ষতি হবে ভেবে সে আসেনি। কাজেই সিহাব বলেছিল- দুর থেকে প্রেম হয় না।
একদিন শিলা, সিহাবসহ ওরা সবাই বিকেলে ছাদে উঠল। সেখানে গিয়ে সুজন ও প্রীতি ছুটোছুটি শুরু করে দিল। স্বর্না অন্য ছাদে দাঁড়ানো একটি ছেলের সাথে ফিল্ডিং মারছিল। এ সুযোগে শিলা ও সিহাব সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে পুডুর পুডুর গল্প জুড়ে দিল।
‘ আচ্ছা, মিলা কবে আসবে ? - সিহাব শিলাকে জিজ্ঞাসা করল।
‘ জানিনা, আগামী সপ্তাহে আসতে পারে।
‘ ধুর, এভাবে কি প্রেম হয় ? মিলা আমাকে পছন্দ করে, হয়ত ভালও বাসে। কিন্তু সেই ভাললাগাকে পরিপক্ক করার জন্যেতো সাক্ষাতের প্রয়োজন। প্রস্তাব পাওয়ার আগে দেখেছি একরকম, আর প্রস্তাব পাওয়ার পরে তাকে দেখতে কেমন দেখায় অনুভব করতে ইচ্ছে করে। আসলে মিলা একটু চুপচাপ থাকেতো, মনে হয় ওর সাথে ভাল জমবে না। আপনি হলে অবশ্য ভালই জমতো।
একথা শোনার পর শিলার চেহারায় যেন প্রদীপ জ্বলে উঠল। তার কঠোর হিংসাত্মক বা ঘৃনাত্বক মনোভাব ম্লান হয়ে গেল। এমনকি ঐ কথার পরিপ্রেক্ষিতে সে আগের মত কোন প্রতিবাদ বা দ্বিমত পোষন করেনি। বরং আরো ঘনিষ্ঠভাবে আড্ডা দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলো। পর পর দ’ুতিন দিন দেখা না হলে খোঁজ নিত। সিহাবের ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয়ে খুটে খুটে প্রশংসা করতে লাগল। সারাক্ষন শুধু সিহাব। সিহাব ছাড়া যেন আর কোন কথা নেই।
সিহাবের যতœ নিতে শুরু করলো রীতিমত। আসামাত্র বসতে দিত, চা করে দিত, না খাইয়ে যেতে দিত না। অনেকটা জামাই আদর। স্বর্নার মা মিলার কথা ভেবেই সাড়া দিতেন। একদিন শুক্রবার প্রীতির নাচের ক্লাস ছিল। সেদিন তাদের সাথে সিহাবকেও যেতে হয়েছিল। প্রীতির সাপ্তাহিক নাচের ক্লাস হত ঢাকা জর্জকোটের পাশে জেলা পরিষদ ভবনে। নিচতলায় ক্লাস হত। ঐদিন প্রীতিকে নিয়ে যেতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল। তাই টিচার তাকে শাস্তিস্বরুপ কিছুক্ষন বসিয়ে রেখেছিলেন। পাশেই চেয়ার ও বেঞ্চে অভিভাবকগন বসে ছিলেন। স্বর্নার মা ও স্বর্না সেখানে বসা ছিল। ছোট ছোট বাচ্চারা তবলার তালে তালে একযোগে নাচছে- ধা গে তে টে না গে ধিন্ না। তালের সাথে যদি কারো মিল না হয় তাহলে টিচার সামনে গিয়ে নিজে নেচে দেখিয়ে দেন এবং বুঝিয়ে দেন। তারপর নির্দেশ মোতাবেক তারা আবার শুরু করে। শিলা তখন সিহাবকে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। বসার মতো উপযুক্ত জায়গা ছিল না। হয়তো সিঁড়ির উপর বসতে পারতো। কিন্তু তার ইচ্ছে হয়নি। খুব বোর ফিল করছিল।
‘ চলেন, জগন্নাথ থেকে ঘুরে আসি। আমাদের ক্যাম্পাস।
শিলা যেতে রাজী হল। তারপর স্বর্নাকে ডেকে নিয়ে সিহাবের পিছে পিছে গেল। সিহাব যেতে যেতে আড়চোখে তাকিয়ে দেখছিল শিলার হাস্যোজ্জল চেহারা। বেশ উৎফুল্ল সে। সিহাব বুঝতে পেরেছে যে, শিলার মনের জানালা খুলে গেছে। ফাইনালের পূর্ব প্রস্তুতি চলছে। তাই সে নিজের সাথে কমপেয়ার করেছে শিলাকে। কিসের মধ্যে কী ? সে শিলার পাশে একদম বেমানান। কোথায় পঞ্চান্ন কেজি ওজনের লিক্লিকে সিহাব আর কোথায় পঁচাশি কেজি ওজনের কঠিন শিলা। সিহাব মনে প্রাণে গ্রহন করতে পারেনি। তবে বুঝতে পেরেছিল যে, শিলা তার প্রেমে পড়েছে। এটা ছিল তার জন্যে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। শিলার জন্যে খুব আপসোস হল।
জেলা পরিষদের গেট পার হয়ে সোজা হেঁটে গেল পশ্চিম দিকে। ন্যাশনাল হস্পিটালের গেটের সামনে কয়েকটি রিক্সা দাঁড়ান ছিল। তারা সেই রিক্সা যট পার হয়নি। বরং রাস্তা পার হয়ে বিপরীত দিকে ফুটপাতে গিয়ে উঠল। সেখান থেকে বরাবর হেঁটে চলে গেল।
কলেজ গেটের পাশে এবং ভিতরে লম্বা বেঞ্চের উপর পুলিশ সদস্যরা বসে ছিল। অন্য দিনের তুলনায় সংখ্যায় একটু বেশীই মনে হল। গেটের একসাইড বন্ধ, আরেক সাইড খোলা। আসা যাওয়ায় কোন বাধা নেই।
সিহাবের পরনে ছিল পাঞ্জাবী। সিল্কি চুল কাঁধ পর্যন্ত লম্বা ছিল। ক্যাম্পাসে প্রবেশের পর বাতাসে তার পাঞ্জাবী ও চুল এলোমেলোভাবে উড়তে লাগল। এসব বিষয়ে ছেলেদের তোয়াক্কা না করলেও চলে। কিন্তু মেয়েদের তোয়াক্কা করতে হয়, কারণ ঐ বাতাসই ছেলেদেরকে মেয়েদের দিকে তাকানোর আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। যদিও সেদিন কাম্পাসে কোন সাধারণ ছাত্রছাত্রী ছিলনা। তবে ছাত্রনেতাদের আনাগোনাসহ হাতে গোনা কয়েকটি জুটি দেখা গিয়েছিল।
হঠাৎ সিহাব হাঁটুর উপর থেকে পাঞ্জাবী টেনে নিয়ে মুখে কিছু একটা মুছতেছিল। অমনি শিলা ধমক দিল। সিহাব অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে তার খবরদারীর মুভমেন্ট লক্ষ্য করল। দেখল, মোটামুটি সাইজে এসে গেছে। সিহাব মনে মনে আনন্দিত। এমতাবস্থায় সিহাবের এক ক্লাসমেট আদনান এসে সামনে দাঁড়াল।
‘ তুই এখানে, এখন এসেছিস কেন ?
‘ এমনি এসেছি।
‘ চলে যা। জলদি।
‘ কেন ?
‘ সকালে পেপার পড়িসনি ?
‘ না তো ।
‘ ঐ দ্যাখ। কর্ণারে তাকা।
আদনান সিহাবকে বিল্ডিংএর পিছনের দিকে ছিপায় তাকাতে বলল। সিহাব চম্কে উঠল। বুকটা কেঁপে উঠল। আড়ালে কয়েকজনকে দেখা গেল। সবাই সজ্জিত। গতরাতে ক্যাম্পাস দখলের লড়াই হয়েছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মাঝে। সকালে জাতীয় দৈনিকগুলোতে সংবাদ বেরিয়েছে। সিহাব সেদিন সকালে পত্রিকা পড়েনি। তাই তার জানা ছিল না। তড়িগড়ি তারা ফিরে গেল জেলা পরিষদের দিকে।
স্বর্নাকে তার মায়ের কাছে রুমের ভিতরে পাঠিয়ে দিয়ে শিলা সিহাবকে নিয়ে পুনরায় বারান্দায় বসে খোশগল্পে মেতে উঠল। তার কথা বলার স্বরে একটা কাঁপুনী কাঁপুনী ভাব ছিল। ঘামছিল শিলা। হ্যান্ড-ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে অনবরত মুছতেছিল। এতে তার মুখের মেকাপ সব উঠে গিয়ে সিদ্ধ আলুর মত দেখাচ্ছিল। লিপস্টিক লাগানো ঠোঁটে টিস্যু ঘর্ষনের ফলে রঙটা ফেটে গিয়ে মরা গাছে ঝুলে থাকা শষার বাকলের মতো মনে হল। অথচ তার কিছুক্ষন আগেও ছিল টাটকা কমলালেবুর কোষের মতো। আবেগময় মুহুর্ত না হলে হয়ত কমলালেবুর ঐ কোষ দুটো তরতাজাই থাকত। কিন্তু তার কপালের ঐ নীল টিপ তখনো নীল ছিল। একটুও পরিবর্তন হয়নি। সিহাব তখন মুগ্ধ হয়ে ঐ টিপের দিকেই তাকিয়ে ছিল। শিলার তখন লাল টকটকে চেহারা।
‘ ভাবছি জেমিকে কী জবাব দেব ?
‘ কেন কী হয়েছে ?
‘ বুঝ না কী হয়েছে ? ওর সাথে আমার ওয়াদা ভঙ্গ হয়েছে।
‘ কী রকম ওয়াদা।
সিহাব না বোঝার ভান করল। শিলার মুখ থেকে শোনার জন্যে সে ইনিয়ে বিনিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল। মিটিমিটি হাসছিল সিহাব। পারেনা উচ্চস্বরে অট্রহাসি দিয়ে দেওয়াল ফাটিয়ে দেয়। শিলার দিকে তাকিয়ে দেখল তার প্রফুল্লতা। চোখ মুখ তরঙ্গায়িত। দেহের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেন আনন্দে নাচছিল। মনে মনে সিহাব বলল- ছেলেদের পছন্দ করো না (?) করবা করবা ভালমত করবা, প্রেমও করবা, ভালও লাগবে, একেবারে কচি ডাবের পানির মত মনে হবে।
‘ প্রেম করতে খুব মজা। তাই নাহ্ ?
‘ কী জানি !
‘ আচ্ছা মিলাকে কীভাবে সামাল দেবে? সে তো আমাকে অফার করেছিল তোমার আগে। ছোট বোনের পছন্দের জিনিষ বড় বোন নিয়ে যাবে, ব্যাপারটা কেমন হবে ?
এই প্রশ্নের বিপরীতে শিলা কোন জবাব দেয়নি। তবে ছোটবোনের জিনিষটা হাতিয়ে নেওয়ার কথা শুনে একটু বিচলিত বোধ করল।
‘ এটা কোন সমস্যা নয়। আমরা বোনেরা সবাই ফ্রি মাইন্ডেড। মিলাকে সামাল দিতে অসুবিধা হবে না। ওকে মেনেজ করা খুব সহজ।
‘ মিলাকে সহজ সরল পেয়ে ওর পছন্দের জিনিষ পর্যন্ত কেড়ে নেবে- এটা কী ঠিক হবে ?
‘ এটা কোন ব্যাপার না। ও আমার কথার উপর কিছু বলবে না ?
‘ বড় বোন হিসাবে সে তোমাকে শ্রদ্ধা করে। সেজন্য হয়ত তোমার জন্যে সে তার ভাললাগাকে বিসর্জন দেবে। আর সেই সুযোগ তুমি কাজে লাগাবে ? তোমাকে সমীহ করা মানে এই নয় যে, সে দুর্বল। দুর্বলতা মনে করে তুমি তাকে কাজে লাগাতে পারো না। তাকে ঠকানো তোমার উচিত হবে না।
‘ কী বলতে চাও তুমি ? তুমি কী তাহলে ---
‘ না, ঠিক তা নয়। আমি বলতে চাচ্ছি যে, মিলা হয়ত তোমার সিদ্ধান্তে বাধা দেবে না। তাই বলে তোমার কিন্তু বোঝা উচিত যে, তারও একটা মন আছে। সে যেমন তোমার জন্যে সেক্রিফাইজ করতে প্রস্তুত আছে বলে মনে কর, তেমনি তোমারও উচিত তার জন্যে সেক্রিফাইজ করা। বরং তার উপর তোমার দায়িত্ব আরো বেশী। তা না করে যদি তার শিকারটা নিজের স্বার্থে কাজে লাগাও তাহলে তো রীতিমত স্বার্থপরতা হয়ে গেল। নিজের ছোটবোনের সাথে দিনে দুপুরে এমন প্রতারণা ?
শিলাকে একটু চিন্তিত মনে হল। তারপর হেসে উঠে ঐ একই কথা বলল- এটা কোন ব্যাপার না। মিলা খুব ভাল মেয়ে। ওর কোন অসুবিধা হবে না। আমি ঠিক মেনেজ করে নেব। শুনে শিহাবের চোখ দুটো ছোট হয়ে গেল। সে শিলার দিকে তাকিয়ে দেখে তার মাধুরী মেশানো সজীবতা। মিলা কষ্ট পাবে তাতে তার কোন অনুশোচনা নেই। বরং মনে হল যে, সে বুঝি নায়ককে নিয়ে এক্ষুনি গান গাওয়া শুরু করে দেবে- “আমার স্বপ্ন যে সত্যি হল আজ-- ”। প্রেম কী তাহলে স্বার্থপর হয় ? নাকি প্রেমিক প্রেমিকা স্বার্থপর হয় ? এই প্রশ্নের জবাব হয়ত স্বার্থপর প্রেমিক প্রেমিকারাই দিতে পারে। তবে এক্ষেত্রে প্রেমের যে অপব্যবহার হল তাতে কোন সন্দেহ নেই। মূলতঃ প্রেম সবার জন্যই সমান। কেউ সঠিক প্রয়োগ করে, আর কেউ অপপ্রয়োগ করে। কেউ এর মর্যাদা বোঝে, কেউ বোঝে না। যারা বোঝে না তারা একে নিয়ে ভলিবল খেলে, আর যারা বুঝে তারা বুক পকেটে এঁটে রাখে।
সিহাব ভলিবল খেলার দলে নয়। তবে এটা ছেলেদের প্রতি শিলার বিদ্বেষী মনোভাবের প্রতিবাদমাত্র। তারই প্রতিশোধ হিসাবে প্রেমের পাঠ শেখানোর জন্যে বলা যায় ভলিবল খেলোয়াড় হিসাবেই সিহাবের মাঠে নামা। তবে শিলা নবপ্রেমে বিভোর ছিল। তাই সে সিহাবকে বুঝতে পারেনি।
সিহাবের এমএ পরীক্ষা সন্নিকটে। জগন্নাথ থেকে নৈশ শাখায় মাষ্টার্স পরীক্ষার্থী সে। তাই দৈনন্দিন কর্তব্য কর্ম-রুটিনের পাশাপাশি লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত ছিল। এদিকে শিলা প্রতিদিনই তার পথ চেয়ে বসে থাকে। দুই দিন দেখা না হলেই শিলা অস্থির হয়ে পড়ে। সংবাদ পাঠায়। কিন্তু সিহাব অতটা গুরুত্ব দেয়না। তার তেমন আগ্রহও ছিল না, থাকার কথাও নয়। শিলাতো একদম প্রেমের জলে হাবুডুবু খেতে খেতে বাড়ীর কথা ভুলেই গেছে। বিভিন্ন অযুহাতে সে ঢাকায় তার খালার বাসায় অবস্থান করছিল। ওদের বিষয়টা একসময় স্বর্না জেনে গেল। সে তার মাকে জানাল। তিনি প্রথমে একটু বিচলিত ও রাগাম্বিত হলেও পরক্ষনে মেনে নিয়েছেন। কারন বোনদের মাঝে মিলার পজিশন ছিল দ্বিতীয়। সুতরাং শিলার সিরিয়াল আগে। তবুও স্বর্না বাঁধা দিয়েছিল। সে মোটেও সমর্থন দেয়নি, মানতে চায়নি। কারণ মিলার পক্ষে সে। মিলাই তাকে ব্যবহার করেছে। স্বর্না হল মিলার মেন্টাল পার্টনার। কাজেই স্বর্না প্রতিবাদ করলেও তার মা প্রকৃতপক্ষে মিলার প্রতি অবিচারই করেছেন। একবারও তার মানষিক অবস্থা নিয়ে ভাবেননি। তিনি বুঝতেও চাননি।
স্বর্নাকে দিয়েই মিলা শুরু করেছিল তার প্রথম ভালবাসা। সেই স্বর্নার কাছ থেকেই শুনেছে তার ভালবাসা ছিনতাইয়ের সংবাদ। ছিনতাই করলো তারই বড় বোন। শুনে খুবই কষ্ট পেল সে। নীরবে নিবৃত্যে রাতভর শুধু কেঁদেছে। কিন্তু তার সেই কান্নাজল কাউকে শীতল করতে পারেনি। শিলাকেও টলাতে পারেনি। খালা ছিল কঠিন পাহাড়। এক্ষেত্রে তার বাবা-মায়ের তেমন কোন ভুমিকা ছিল না। কারণ শিলা ছিল বিবাহযোগ্যা এবং তার খালা হলেন সবার বড়। সেই হিসাবে তিনি তাদের পরিবারে একটি বিশেষ সম্মান বহন করতেন। যেই সম্মানের কাছে মিলা ছিল অসহায়। কাজেই বুকের উপর পাথর চাপা দেওয়া ছাড়া তার কোন গত্যান্তর ছিল না। কেঁদে কেঁদে শুধু একটা কথাই বলেছিল- অভিভাবকরা বুঝি এমন হয় ?
সিহাবের পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর পরই সারাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিল। রুটিন অনুযায়ী প্রথম বিষয় পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঠিক পনের দিন পর দ্বিতীয় বিষয় পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। অফিস থেকেও ছুটি নিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিষয় পরীক্ষা হওয়ার চার-পাঁচ দিন আগে থেকেই বন্যার পানি বিপদসীমা ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঐরকম পরিস্থিতিতে পরীক্ষা এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিল। কারন বেশীর ভাগ পরীক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থাৎ ঢাকার বাহির থেকে এসে পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতো। তাছাড়া মানবতার উপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সকলেরই সহানুভুতি দেখানো একান্ত কর্তব্য।
যাইহোক সেই সপ্তাহে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হল। ক্রমান্বয়ে আরো বিপজ্জনক হয়ে পড়ল। রাস্তাঘাট তলিয়ে ঢাকার সাথে সারাদেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। পরীক্ষার তারিখ আরো এক সপ্তাহ পিছিয়ে গেল। তাতেও কিছু হলনা। পরিশেষে কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্যে পরীক্ষা পিছিয়ে দিল। হঠাৎ সংবাদ এলো সিহাবের ভিসা এসে গেছে। যেতে হবে মধ্যপ্রাচ্যে। বিশ্বখ্যাত একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানীতে তার চাকুরী হয়ে গেছে। শুনে পরিবারের সবাই খুশী। কিন্তু সিহাব খুশী হতে পারেনি বরং বিমূঢ় হয়ে গেল। যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল। কারণ তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মাষ্টার্স কমপ্লিট করা। এটা তার সারাজীবনের সাধনা, জীবনের সর্বশেষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। সেশনযট মিলে পাঁচ পাঁচটি বৎসর এর পিছনে শ্রম দিয়েছে, সময় দিয়েছে, অর্থ ব্যয় করেছে অথচ শেষ পর্যায়ে একদম তীরে এসে তরীডুবি। কিছুতেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারেনি। সে বিদেশযাত্রা প্রত্যাখ্যান করল। কিন্তু তার ফ্যামিলির কর্তাব্যক্তিগন তার সেই প্রত্যাখ্যান নাকচ করে দিল। সে উপেক্ষা করতে পারেনি। চেষ্টা করেও বেঁকে বসতে পারেনি। কারণ পরিবারের বড় ছেলেরা হয়ত দায়িত্ব উপেক্ষা করতে পারেনা।
আইয়ুব আহমেদ দুলাল
২য় কিস্তি
(৩)
শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। গোপীবাগ থেকে খিলগাঁও বেশী দুরে নয়। সিহাব বিকেলে স্বর্নাদের বাসায় গেল। খুঁজে পেতে তেমন অসুবিধা হয়নি। দোতলায় থাকে ওরা। দরজায় নক করার পর স্বর্না এসে দরজা খুলল।
ঘরে কোন সাজসজ্জা নেই। আগে যেমন ছিল তেমনই সাদামাটা। তিন ভাইবোন নিয়ে বাবা-মায়ের সংসার। বাবাই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। খুব সীমিত বেতনে তিনি একটি বিস্কুট ফ্যাক্টরীতে চাকুরী করেন। সংসারে বেশ টানাটানি অবস্থা। আগে থেকেই তাদের অবস্থা অস্বচ্ছল। স্বর্নার মায়ের একটি সেলাই মেসিন আছে। বাবার সীমিত আয় এবং মায়ের সেলাই কাজ দিয়েই কোন রকম চলে যায়। এদিকে ছেলেমেয়েদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যোগদান করার প্রয়াশ ও প্রেরনা ছিল তার মায়ের। তিনি ছোটবেলা থেকেই ওদেরকে নাচ-গান শেখানোর প্রতি আগ্রহী ছিলেন।
গল্প গুজব হওয়ার পর চা চক্র হল। হঠাৎ কথায় কথায় মনের ভুলে সে তার সাংস্কৃতিক চর্চার কথা বলে ফেলল। অমনি স্বর্না তড়িৎগতিতে তার পুরানো হারমোনিয়ামটা সামনে এনে দিল।
সিহাব একটু ইতস্তত বোধ করল। কারন সে ছিল তখনো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ছাত্র। ওস্তাদের উপদেশ ছিল যতদিন না তিনি অনুমতি দিবেন ততদিন হারমোনিয়াম ব্যবহার করে গান গাওয়া বা স্টেজে উঠা যাবে না। সম্পুর্ন নিষেধ। তবে হারমোনিয়াম ছাড়া ঘরোয়া পরিবেশে খালি গলায় গান গাওয়ার অনুমতি ছিল। ওস্তাদের থিউরী হল- কোন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ছাত্র মানে সারগাম শিক্ষার্থী, কোর্স কমপ্লিট হওয়ার আগে যদি হারমোনিয়াম দিয়ে গান গায় তাহলে তার কণ্ঠের বেজ নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া ষ্টেজে উঠার ব্যাপারে নিষেধ করেছেন। কারন গান গাওয়ার পর যদি একবার হাতেতালি পড়তে শুরু করে তাহলে সারগাম বা সঙ্গীতের প্রয়োজনীয় পাঠ্যসূচী থেকে সে বি”্যুত হবে এবং ঐ হাততালীর দিকেই সে বেশী আকৃষ্ট হবে। ভাল ভাল গান শুনিয়ে দর্শকদের কাছ থেকে বাহবা নেবে এবং একসময় তার কন্ঠের বেজ নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং স্বর্নার অনুরোধে সে গান গাইতে অস্বীকৃতি জানালেও তারা মানতে রাজী হয়নি। বরং অহংকারী, ঢং এবং মুখ ভেংছি দিয়ে স্বর্না উপহাস করতে শুরু করলো। থিউরী দিয়ে কি আর সঙ্গীত প্রেমীদের দমানো যায় ? কাজেই ছাড় না পেয়ে পরিশেষে সিহাব সা পা চেপে ধরে একটি আধুনিক গান গাইল।
গান শুনে পাশের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন এক ভদ্রমহিলা ও একটি মেয়ে। গান চলাকালীন সময়ে তারা এসে চেয়ারে বসলেন। গান শেষ হওয়া মাত্রই চডরপডর হাতেতালি শুরু হয়ে গেল। স্বর্নাকেও গাইতে বলল। স্বর্নাও হারমোনিয়াম বাজাতে অস্বীকৃতি জানাল। কারণ সে ভাল বাজাতে পারতো না। অর্থাৎ গান তোলা শেখেনি। সেও সারগাম শিখছিল। তবে সিহাবের মত উপদেশ ওস্তাদের কাছ থেকে পায়নি। অর্থাৎ একাডেমীতে যাচ্ছে- ছাত্রছাত্রীদের একত্রে বসানো হচ্ছে। সুরে সুরে সবাই মিলে একত্রে গান গাচ্ছে। শুনতেও ভাল লাগছে। গান গেয়ে মনটা একদম প্রফুল্ল হয়ে যায়। পরিশেষে ডায়েরীতে লিখে বাসায় চলে আসে। ব্যশ।
গান শেষে স্বর্না ভদ্র মহিলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তারা দুইজনই স্বর্নার খালাত বোন। সিহাব সালাম দিল। কিন্তু ভদ্রমহিলা হাসতে হাসতে কুটিকুটি। হাসির মাঝে কেমন যেন একটা রহস্য ছিল। তবে রহস্য উম্মোচনে সিহাব অতটা আগ্রহী ছিল না।
ভদ্রমহিলার নাম শিলা এবং সাথে তার ছোটবোন মিলা। সিহাব যখন শিলার কাছে তার হাজবেন্ডের কথা জানতে চাইল তখন সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠল। সিহাব পড়ে গেল এক বিভ্রতকর পরিস্থিতিতে।
‘ আপনারা হাসছেন কেন ?
‘ আরে ব্যাটা, ওর এখনো বিয়ে হয়নি। ও তোরচে বয়সে অনেক ছোট হবে। মাত্র ডিগ্রীতে পড়ে। গায়ে গতরে বেড়ে গেছে, এই যা। - স্বর্নার মা বললেন।
‘ ও আচ্ছা। দেখেতো মনে হয়না। তাছাড়া নাকে নাকফুল।
অট্টহাসির মত ধ্বনি হল আবার। সিহাব নিজেকে কোনমতে সংবরণ করে নিল। লাল হয়ে গেল তার মুখমন্ডল। শিলার স্বাস্থ্য ও তার বেশবুসায় অবিবাহিত মনেই হয়না। তাকে দেখে সিহাব যেভাবে ভুল করেছে, অনেকেই অমন ভুল করে বলে জানিয়েছে স্বর্নার মা। প্রকৃত সত্য হল- শিলার বয়স আসলেই কম। তবে সে অসুস্থ। দীর্ঘদিন ধরে বাতজ্বরে ভুগছে। সেইজন্য তাকে নিয়মিত ঔষধ সেবন করতে হয় এবং প্রতিমাসে একটি করে ইন্জেকশন নিতে হয়। তারই প্রতিক্রিয়ায় শরীরটা ফুলে গেছে। এমনকি ছয় বছর তাকে ঐভাবে চিকিৎসা নিতে হবে।
মিলা খুব চুপচাপ। চুপচাপ থাকতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। সে ইন্টারের ছাত্রী। লাজুকও বটে। সে একটু বেশী ভদ্র; শিলা বলল।
সিহাব যখন তাদের বাসা থেকে বিদায় নিতে প্রস্তুত হল তখন শিলা এসে অনুরোধ করল কাল পরশু যেন একবার আসে। কোন এক বিশেষ প্রয়োজন আছে। সেই বিশেষ প্রয়োজনের কথা তখন আর বলেনি।
দুই তিনদিন পর সিহাব তাদের বাসায় গেল। গেটের সামনে গিয়ে কলিংবেল বাজাল। স্বর্নার ছোটবোন প্রীতি দরজা খুলে দিল। ঘর ফাঁকা ফাঁকা দেখে সিহাব তার খালাত বোনসহ অন্যান্যদের কথা জানতে চাইল। প্রীতি বলল তারা নাকি মার্কেটে গেছে। তাহলে শুধু শুধু এসে কী লাভ হল! সিহাব চলে যাওয়ার স্টেপ নিল।
‘ ভাইয়া, বসেন। আমরা আছি নাহ !
‘ তোমরা মানে ?
‘ মানে আমি আর মিলা আপু আছি। আমাদের সাথে গল্প করেন।
‘ কী গল্প করবো তোমার সাথে ! তুমি তো হাট্টিমাটিম টিম।
‘ কেন আমি ছোট বলে আমাকে পছন্দ হয়না ?
‘ হবে না কেন ? তুমি ছোট কোথায় ? তুমি তো অ-নে-ক বড়।
‘ মজা করেন নাহ ?
‘ আরে পাক্নী মজা করবো কেন ? তুমি কোন্ ক্লাসে নাহ ?
‘ ক্লাস থ্রি। পরীক্ষায় তিন বিষয়ে ফেল করেছি -হা।
‘ হা হা হা --। ফেল করে আবার বাহাদুরী দেখাও।
‘ এটা কয় জনে পারে বলেন ?
‘ থাক্ তোমাকে আর পাকামো করতে হবে না। এখন বল তোমার আম্মুসহ কখন আসবে ?
‘ দেরী হবে। কিছুক্ষন আগেই তো গেল- মিলা বলল।
এতক্ষন পর মিলার মুখে খই ফুটল। প্রথম থেকেই সে কথা বলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ভেতর থেকে বের হয়নি। তার ভাব দেখেই বুঝা গেছে। এইটুকু কথা বলতে গিয়েও লাল হয়ে গেল।
‘ তোমরা যাওনি কেন ?
‘ আপনি আসবেন, তাই আমরা রয়ে গেছি।
‘ কী করে জানো আমি আসবো ?
মিলা কোন উত্তর করেনি। সিহাব মিলার জড়তা দেখে তার সাথে আরেকটু ইজি হওয়ার চেষ্টা করলো।
‘ তুমি কিসে পড় ?
‘ ইন্টারমিডিয়েট ফার্ষ্ট ইয়ার।
‘ কোন গ্র“পে।
‘ আর্স।
‘ তোমার পার্টস আছে ?
মৃদু হাসল মিলা। - কেন, একথা বললেন কেন ?
‘ না এমনিই। শুনেছি আর্সে যারা পড়ে তাদের নাকি পার্টস থাকে না। তাই জানতে চাইলাম সত্য না মিথ্যা।
মিলা তবুও ইজি হতে পারেনি। তার এ্যাটিটিউড দেখে বুঝা গেল সে আড্ডা মারা বা গল্প করায় অভ্যস্ত নয়। তাছাড়া ইন্টার প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা মুলত গল্পবাজ বা আড্ডাটাকে বেশী মাত্রায় প্রাধান্য দেয়। নবজীবন, নব উদ্দীপনা, নব পরিবেশ, নব ইমেজ বিরাজ করে তাদের মাঝে। কিন্তু মিলার মাঝে তেমন কিছু দেখা যায়নি বরং সংকোচের মাত্রা ছিল বেশী। তবে সামনে থেকে সরেও যায়নি। সে সিহাব ও প্রীতির ট্যাসটেসে কথাগুলো উপভোগ করছিল। মিটিমিটি হাসছিল।
মিলা চা করে নিয়ে এলো। চায়ে চিনি একটু বেশী পড়েছে। সিহাব সেটাকে শরবত বলায় মিলা মুখটা মলিন করে সরে গেল। আড়ালে গিয়ে প্রীতিকে ডাক দিল। প্রীতি ভেতর থেকে এসে সিহাবকে ধমকের সুরে বলল- ভাইয়া, মিলা আপু চা বানিয়েছে। আপনি এটাকে শরবত বলবেন না। আপুর খুব জিদ, হ্যাঁ।
‘ ওরে বাবা, ভয় পেয়েছি। জিদ হলে কী করে ?
‘ খুব রাগ হয়।
‘ কিছু ছুড়ে টুড়ে মারে নাকি ?
‘ হ্যাঁ, তাও মারে।
‘ ও ভাই গো, তাহলে আমি পালাই।
সিহাব উঠে যেতে চাইল।
‘ ধুরো ভাইয়া, কী যে বলেন। বসেন না। একটা গান শুনান।
‘ তোমাদের বাসায় কেউ নেই এখন গান হবে না। আমি বরং যাই। পরে আসব।
সিহাব চলে গেল। চার পাঁচ দিন পর আবার এলো। সেদিন ছুটির দিন। বাসায় সবাই ছিল। বিকেল চারটার মতো বাজে। সবাই খোশগল্পে মেতে ছিল। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। স্বর্না দরজা খুলে দিয়ে একটি ব্যাগ বহন করে কিচেনের দিকে নিয়ে গেল। তার বাবা বাজার করে বাসায় ফিরলেন। সিহাবকে দেখে অবাক হলেন। বিশ্বাসই করতে পারেননি। তারপর কুশলাদী বিনিময় করে তিনি প্রেস হওয়ার জন্যে বাথরুমে চলে গেলেন।
শিলা বলল- আপনি আম্মার সাথে কথা বলেন আমরা কিচেনে যাই।
খালাম্মাকে ওরা আম্মা বলে। আর নিজের মাকে আম্মু বলে। যাইহোক শিলা ও মিলা স্বর্নাকে সাহায্য করতে কিচেনে চলে গেল। তাদের হন্তদন্ত অবস্থা দেখে সিহাব ভদ্রতার খাতিরে নিষেধ করল যেন কোন কিছুর আয়োজন না করে। স্বর্নার মা তখন খিক্ খিক্ করে হেসে উঠলেন।
‘ তোমার জন্যে আয়োজন না করলেও আমাদের জন্যে করতে হবে।
‘ মানে ?
‘ মানে আমরা এখনো খাইনি। এই মাত্র বাজার এলো।
স্বর্নার মার ঠোঁট পাতলা। নির্ধিদ্বায় সব কথা বলে ফেলেন। নিজের সংসারে অভাব, না খেয়ে ঘুমিয়ে থাকা, আধাপেট খেয়ে থাকা তাদের স্বাভাবিক রুটিন। তিনিই এসব বলেন। সিহাব খুব লজ্জ্বায় পড়ে গেল। আড়চোখে একবাব রুমটা দেখে নিল। টানাটানির সংসার, ঠিকমত খাবার জোটে না, পরতে পারে না, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ ঠিকমত বহন করতে পারেনা অথচ তিনি সন্তানদের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেন। অবশ্য সব বাবা মা’ই ছেলেমেয়েদের উজ্জল ভবিষ্যৎ কামনার্থে আত্মত্যাগী হয়ে থাকেন। তারাও তাই করছেন। তবে এ লাইনে প্রচুর খরচ এবং অনেক সাধনার ব্যাপার। বড় মেয়ে গান শেখে, ছোট মেয়ে নাচ শেখে আর ছেলেটাকে শেখানো হচ্ছে মার্শাল আর্ট। আসলে ইট, বালি, সিমেন্টের জোড়াতালি দিয়েই তৈরী হয় ইমারত। অভাবের মাঝে থেকে যদি তাদের কেউ একজন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তবেই কষ্ট সার্থক। তাছাড়া শ্রম কখনো বিফলে যায় না, এটাই হয়ত তাদের পথপ্রদর্শক।
অতি অল্প সময়ের মধ্যে রাঁধুনীরা সংক্ষেপে খিচুড়ী বানিয়ে নিয়ে এলো। সিহাব চলে যেতে চেয়েও পারেনি। অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে হল। লজ্জা ও সংকোচ নিয়ে সিহাবকে তাদের সাথে খেতে হল। কারণ তাদের না খেয়ে থাকার বিষয়টা জানার পর সিহাব না পারছিল উঠে আসতে, না পারছিল কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই গল্প করতে বসে পড়ল। সবারই চোখমুখ সজীব হয়ে উঠল। অতৃপ্তির কোন ছোঁয়া তাদের মাঝে ছিল না। ক্ষুধা পেটে কি আর গল্প জমে! ক্ষুধা নিবারণ করে তাই নিশ্চিন্তে আরাম করে বসল। শিলা যেন কৃত্রিম শক্তি সঞ্চয় করল। শিলাদের পারিবারিক অবস্থা অবশ্য স্বর্নাদের মত নয়। তারা বেশ স্বচ্ছল। তাদের পোশাক আশাকেও বিলাসিতার ছোঁয়া রয়েছে।
‘ সেদিন চলে গেলেন কেন ? শিলা বলল।
‘ ফাঁকা বাসায় কী করবো ? আসতে বলে তো আপনারা হাওয়া হয়ে গেলেন।
‘ একটি বিশেষ প্রয়োজনে মার্কেটে গেলাম। আপনাকে প্রয়োজন ছিল মিলার। সে গান বাজনা খুব পছন্দ করে। আপনার একটি গান শুনেই সে মুগ্ধ। তাই আমাকে বলল আপনাকে বলতে যেন আর একদিন এসে গান শুনিয়ে যান।
‘ কই মিলা তো কিছুই বলেনি। আমি এলাম আর সে ঐ চেয়ারে চুপচাপ বসে ছিল। প্রীতিও তো কিছু বলেনি। সেতো বানরের মত শুধু লাফালাফি করছিল। চুপচাপ বসে থাকতে ভাল লাগছিল না, তাই চলে গেলাম। ভালই তো হত যদি মিলা আমাকে গান গাইতে বলতো। তাহলে নির্জনে নিবৃত্তে গান গাইতাম। আর তাছাড়া আমি মনে করেছি আপনিই বোধহয় গান শুনতে চেয়েছেন। আমাকে আসতে বলার পেছনে এছাড়া আর কোন কারণ দেখিনি। মিলার কথা মনেই আসেনি। মিলা তো কথাই বলে না, খুব লজ্জা পায়।
‘ ও এমনই। চুপচাপ থাকে সারাক্ষন। কোন ঝুট-ঝামেলার মাঝে নেই। ঠিক আছে আজ একটা শুনিয়ে দিন।
‘ মুড নেই, আরেকদিন।
(৪)
চাকুরীর সুবাধে স্বর্নার বাবা পুনরায় বাসা পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি চাকুরী করেন মুগ্দা পাড়ায়। তাই যাতায়াতের সুবিধা বিবেচনা করে বাসা নিলেন মানিকনগর শেষ প্রান্তে। ভাড়া তেমন বেশী নয়, সাবলেট বাসা। গোপীবাগ থেকে সিহাব মাঝে মধ্যে সেখানে যেত। স্বর্নার সাথে এক সঙ্গে মাঝে মাঝে গান বাজনা করতো। স্বর্না শুধু গান গাইতে পারত। যদিও সারগাম সম্পর্কে তেমন আইডিয়া ছিলনা। সিহাব মাঝে মাঝে তাকে সারগাম সম্পর্কে তালিম দিতো। সেই সুত্র থেকেই শিলা ও মিলার সাথে তার দেখা হত। মিলার সাথে তেমন একটা কথা হত না। কারণ ঐ একটাই, সে বড়দের কাছ থেকে সবসময় নিজেকে আড়াল করে রাখে। শিলা ওসবের ধারধারি না। সে এতো চঞ্চল যে, কথা বলতো ঠাস ঠাস, আর হাসতো ফ্রি ষ্টাইলে দাঁত কেলিয়ে। একদিন কথায় কথায় সিহাব লক্ষ্য করলো যে, শিলা তার সাথে কেমন জানি অনীহা নিয়ে কথা বলছে। তার আচরনে কিছুটা তুচ্ছ তাচ্ছিল্যতা রয়েছে। সিহাব এ বিষয়টা লক্ষ্য করে তার সাথে আরো বেশী বেশী মেশার চেষ্টা করলো। এক পর্যায়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলো- সে কি সবার সাথেই এভাবে কথা বলেন ?
‘ কীভাবে বলি ?
‘ এইযে কথার মাঝে একটা তুচ্ছ তুচ্ছ ভাব।
‘ না।
‘ তাহলে ?
‘ ছেলেদের আমি পছন্দ করিনা। সেজন্যই আমার ভিতর থেকে আপনা আপনি অনীহা ভাবটা বেরিয়ে আসে।
‘ হ্যাঁ, আপনার সংকোচহীন এপ্রোজ দেখে তাইই মনে হয়। সত্যতা স্বীকারের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু কারণটা কি জানতে পারি ?
‘ কী জানতে চান ?
‘ ছেলেদের আপনি পছন্দ করেন না, নাকি সহ্য করতে পারেন না।
‘ দুটোই।
‘ মানে ?
‘ পছন্দ করিনা, কারণ ছেলেরা স্বার্থপর। আর সহ্য করতে পারিনা, তার কারণ ওরা প্রতারক।
‘ ছেলেরা কী ক্ষতি করেছে, আপনার ?
‘ অপূরনীয় ক্ষতি।
‘ জানতে পারি ?
‘ কেন বলবো আপনাকে ? আপনিও তো সেই প্রজাতির।
‘ সে জন্যেই জানতে চাই। ছেলেরা স্বার্থপর, প্রতারক অথচ আমার সাথে প্রায় ঘন্টা দু’য়েক হতে চলল গল্প করছেন।
‘ আপনি এখন আমাদের মেহমান। ভদ্রতার খাতিরে কথা বলছি।
‘ সেই কথার মাঝে যদি অনীহা প্রকাশ পায় তাহলে কী সেটাকে ভদ্রতা বলা যায়? নাকি সেটা হবে শিষ্টাচারের পরিবর্তে নিষ্টাচার অথবা ভ্রষ্টাচার।
সিহাবের কথা শুনে চুপসে গেল শিলা। লাল হয়ে গেল তার মুখমন্ডল। সরি, আপনি কিছু মনে করবেন না, আসলে আমি বিষয়টা ওভাবে বলিনি- শিলা বলল।
‘ যাইহোক সেটা আপনার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার।
ক্রমাম্বয়ে শিলার আচরনে অনীহা ভাব কিছুটা কেটে গেল। সে বেশ শালীনতাবোধ বজায় রেখে কথা বলার চেষ্টা করলো। এক পর্যায়ে সিহাব তাকে আর অবজ্ঞা করার সুযোগ না দিয়ে সেদিনের মত চলে গেল।
প্রায় দশ-বারদিন পর এমনি এক ছুটির দিনে শিহাবকে স্বর্নার মা সংবাদ দিয়ে পাঠালেন। সকাল বেলা। সিহাব তখনো বিছানা ছাড়েনি। সুজন গিয়ে ডেকে তুলল।
‘ ভাইয়া, আম্মা আপনাকে এক্ষুনি যেতে বলেছেন, খুব জরুরী।
সুজন সংবাদটা দিয়েই চলে গেল। জরুরী ভিত্তিতে তলব করা হলেও সিহাব অতটা পাত্তা দেয়নি। বাথরুম সেরে গোসল করে ধীরে সুস্থ্যে মহল্লার গলি বেয়ে হেটে গেল তাদের বাসায়। গিয়ে দেখে সবাই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি, যার জন্যে জরুরী তলব করতে পারে !
‘ কী হয়েছে খালাম্মা ?
স্বর্না ও তার মা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ইশারায় কী যেন বলতে চাইল। বলতে গিয়ে একটু ইতস্তত বোধ করলো। এপর্যায়ে স্বর্নার মা বললেন- সিহাব, তোমার কাছে চারশ টাকা হবে ?
শুনে সিহাবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বলল- টাকার প্রয়োজন ছিল, সুজনের কাছে বললেই পারতেন, তাহলে আর আমাকে আসতে হত না।
‘ কেন, তুমি কী আমার বাসায় আসবে না ?
‘ আসব না কেন ? তার জন্যে একটা মানষিক প্রস্তুতি প্রয়োজন, তাই নাহ ?
‘ তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজন ছিল তাই ----।
সিহাব চারশ টাকা বের করে দিল। তবে টাকাটা ফেরৎ পাওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিল না, এটা সে ভাল করেই জানত। এ লাইনে যারা থাকে তাদের হাতে টাকা পয়সা গেলে ফেরৎ আসে না, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। সবাইতো আর সমান নয়। এ ব্যাপারে সিহাবের যথেষ্ট আইডিয়া ছিল। সে একদম পরিপূর্ন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। সে সাংস্কৃতিক জগতে নিজেকে স্থান দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পূর্নতা পায়নি। কারণ ছিল পিছুটান। নাটক বা গান বাজনা এসব সবাইকে দিয়ে হয়না। উত্তোরাধিকার সুত্রে অভিনেতা বা গায়ক নায়ক হওয়া সহজ। ভিন্ন পরিবেশ থেকে এসে স্থান পাওয়া খুবই দুরুহ। এ ধরনের ছেলেদের কাছ থেকে তাই সংশ্লিষ্ট সংগঠনের কর্তারা তাদের সরলতার সুযোগ কাজে লাগিযে হাতিয়ে নেয় টাকা পয়সা। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে লোন নিয়ে আর ফেরৎ দেয়না। চাওয়াও যায় না। বাদ হয়ে যাওয়ার হুমকি থাকে। তাই শখ পূরণের আশায় সেটা জলাঞ্জলি দিতে হয়। সংগঠনের সহকর্মীরাও সিহাবের সাথে এমন করেছে। অর্থাৎ সিহাবকে দিয়ে তাদের ক্ষতিটা পুষিয়ে নিয়েছে। সিহাব সহজ সরল ছেলে, তাই প্যাঁচ বুঝতে সময় লেগেছে। নাটক, থিয়েটার, ফ্যাশনশো সবই ঘেঁটেঘুঁটে পরিশেষে গানের ওস্তাদ ধরেছে। কাজেই টাকাটা দেওয়ার সময় সে মনে মনে ফি-সাবিলিল্লাহ বলেই দিয়েছে।
দুইদিন পর সুজন আবার সিহাবের বাসায় এলো। বলল স্বর্না যেতে বলেছে।
‘ পরে গেলে হবে না ?
‘ না এক্ষুনি যেতে হবে। আমাদের বাসা হয়েই অফিসে যাবেন।
সিহাব ওদের বাসায় গেল। স্বর্না সিহাবকে দেখে মিটিমিটি হাসছিল।
‘ ভাইয়া, আপনার জন্য একটা গুড নিউজ আছে।
‘ কী, জলদি বল।
‘ এটা জলদি করার বিষয় নয়।
শালিকা যেমন দুলাভাইয়ের সঙ্গে গাল, নাক, মুখ, চোখ নৃত্য করে কথা বলে স্বর্নাও সেইভাবে বলছিল।
‘ এই জন্যই কি ডেকেছ ?
‘ হ্যাঁ। তবে বুঝতে পারছি আপনি এখন ব্যস্ত। অফিসে যাওয়ার পথে আছেন। এই নিন একশ টাকা। বাকী টাকা পরে দেবো। আর দুই নম্বর বিষয়টা পরে বলবো। যদি সম্ভব হয় সন্ধ্যায় আসবেন। বিষয়টা অত্যন্ত কন্ফিডেন্সিয়াল এবং গুরুত্বপুর্ন।
সিহাব সেদিন আর যায়নি। পরেরদিন সন্ধ্যায় গেল। টিভিতে প্রচার হবে এমন একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের নাম বলে রেকর্ডিং অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্যে একটা টিকিট দিলেন স্বর্নার মা। স্বর্না তার মায়ের পাশে অন্য একটা চেয়ারে বসে তখনো মিটিমিটি হাসছিল। শিলা নেই। সে তার কোন এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গেছে। মিলা চলে গেল গ্রামের বাড়ীতে। তার কলেজ খোলা, পরীক্ষা নাকি সন্নিকটে।
‘ স্বর্না, কী বলবে বল।
‘ বলবো ভাইয়া, বলবো।
সেদিনও স্বর্না বলেনি। এ নিয়ে সিহাবের তেমন কোন আগ্রহ ছিলনা। কারণ যেই বয়সে ভাবাবেগ থাকে, কৌতুহল থাকে, সেই সময় বা পরিস্থিতি সিহাব বেশ আগেই অতিক্রম করে গেছে। প্রেম করেছে, ছ্যাক খেয়েছে, ছ্যাক দিয়েছে, বাকী নেই কিছুই।
সুজনের জম্মদিন। জম্মদিনের দাওয়াত দিয়ে গেল স্বর্না ও শিলা। শিলাকে দেখেতো সিহাব বলেই ফেলল- আপনি এখনো আছেন ? সে কিছু না বলে স্মীত হাস্যে মাথা নাড়াল। সেখানে তেমন আর গলাবাজী করেনি শিলা। কারণ সিহাব ব্যাচেলর থাকে। আশেপাশে রুমমেটরা ছিল। তাদের সামনে চঞ্চলতা বেমানান।
সিহাব সুজনের জম্মদিনের নেমন্ত্রনে গেল। গিয়ে দেখে তেমন কোন মেহমান নেই। দুই একটা অপরিচিত মুখ, শিলা, মিলা আর ওরা নিজেরাই। ছোটখাট একটি কেক এনে জম্মদিন পালন করলো। খাঁচা ভর্তি একটা ফুলের তোড়া ছাড়া উল্লেখ করার মত তেমন কোন উপহার সিহাব নেয়নি। তাই দেখেই ওরা মহাখুশী। হৈ চৈ করে নেচে উঠলো এবং স্বর্নার ক্যাছক্যাছানী শুরু হয়ে গেল।
‘ ভাইয়া, আরো আগে আসলেন না কেন ? আমরা ছবি তুলতাম !
‘ তোল, মানা করছে কে ?
‘ এখনতো কেক কাটা হয়ে গেছে।
‘ সবার প্লেট থেকে কেক তুলে নিয়ে জোড়া লাগিয়ে আবার কাটো।
‘ (হি হি হি ---) ধুর মিয়া, আপনি একটা কিপ্টা। অন্য কেউ হলে এক্ষুনি গিয়ে আরেকটা কেক নিয়ে আসতো।
‘ হ্যাঁ, যদি সে পাগল হয়।
সমস্বরে হেসে উঠলো সবাই। জানো আপু, ভাইয়াকে কথায় হারানো কঠিন। স্বর্না শিলাকে বলা মাত্রই শিলা একটা ধমক দিয়ে বলল- তোকে আর হারাতে হবে না, উনাকে বসতে দে!
অনুষ্টান শেষে উল্টাপাল্টা আসর। গল্পগুজব, হাসাহাসি, উচ্চকন্ঠ, চড়-থাপ্পড় সব কিছুই চলছিল। স্বর্না, শিলা ও মিলা ধাঁধার আসর বসিয়েছিল। একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করছিল আর পিঠের উপর থাপ্পড় মারছিল। দন্ত প্রদর্শনতো আছেই। সিহাবকেও দু’একটা ধাঁধা ধরল। সে একটিও পারেনি। সিহাবও তাদেরকে একটা অংকের খেলা দিয়েছিল। স্বর্না ও শিলা অপারগতা প্রকাশ করল এবং সেটি মিলিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল মিলার উপর। কারণ মিলা ভাল ছাত্রী এবং তাদের বিশ্বাস সে অংকটা মেলাতে পারবে। মিলা চেষ্টা করে অংকটা পেরেছিল ঠিকই কিন্তু তার ফলাফলে সে লজ্জা পেল। সেই ধাঁধাঁর সুত্র ধরেই মিলা বেশ ইজি হয়ে গেল। জড়তা অনেকটাই হ্রাস পেল। ধাঁধাঁটির উত্তর ছিল একটি প্রেমাত্বক বাক্য। যা দেখে মিলার চোখ মুখ বিবর্ন হয়ে গিয়েছিল। স্বর্না সবাইকে পড়ে শোনাল।
ধাঁধাঁর আসরকে এড়িয়ে সিহাব এক পর্যায়ে শিলার সাথে গল্পে লিপ্ত হল। কারন ওর সাথেই সিহাবের ভাল জমতো। অর্থাৎ ওদের দুজনে যখন কথা বলতো তখন কথার মারপ্যাঁচে কেউ কাউকে হারাতে পারতো না সহজে। সিহাব এই বিষয়গুলো ভালই পারতো এবং এন্জয় করতো।
সিহাবের মনে যে প্রশ্নটি বেশী ঘুরপাক খাচ্ছিল সেটা শিলার কাছে পুনরায় জানতে চাইল। কেন সে ছেলেদের পছন্দ করে না? জবাবে শিলা তার এক বান্ধবীর কথা উল্লেখ করে একটি নাতিদীর্ঘ কাহিনী বর্ননা করল। অর্থাৎ জেমি’র জীবনে ঘটে যাওয়া একটি প্রেম কাহিনী।
জেমি ছিল শিলার প্রিয় বান্ধবী। সে রোকনের সাথে প্রেম করতো। রোকন দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম ছিল এবং কাজে কর্মে আচার ব্যবহারে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করা যেত বা তার উপর নির্ভর হওয়া যেত। জেমি তাকে খুব ভালবাসত। বন্ধুমহলের কেউ কখনো ওদের বিচ্ছেদ কামনা করেনি বা ভাবতে পারেনি। রোকনও তাকে ভালবাসত প্রচন্ড রকমের। ওদের মাঝে কোন বিরোধ ছিলনা। কোন রকমের ভুল বোঝাবুঝিও ছিলনা। হঠাৎ একদিন সংবাদ এলো রোকন বিয়ে করে জাপান চলে গেছে। ঘটনাটা ঘটেছিল এক সপ্তাহের মধ্যে। বুঝে উঠতে পারেনি কেউ। আকাশ ভেঙ্গে পড়ল জেমি’র মাথায়। সে একা অসহায় হয়ে গেল। সান্তনা পাওয়ার ভাষা ছিলনা। পারিবারিক কোন প্রতিবন্ধকতাও ছিলনা। অথচ রোকন এমন বেঈমানী করলো! এই ঘটনার পর থেকে জেমি দুঃশ্চিন্তায় অনেকটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ল। তার দুঃসময়ে একমাত্র শিলাই বন্ধু বা বান্ধবী হিসাবে তার পাশে দাঁড়াল। খুব কাছ থেকেই শিলা তার কষ্ট দেখেছে, তার আনন্দে হেসেছে, তার দুঃখে কেঁদেছে। আর সেই কারণেই শিলা ছেলেদের অপছন্দ করে বলে জানিয়েছে।
তবে কোন্ পরিস্থিতিতে রোকন বিয়ে করলো বা কেনইবা এমন ঘটনা ঘটাল, এর পিছনে রোকনের কোন বাধ্যবাদকতা ছিল কিনা- এসব বিষয়ে খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি কেউ। বরং সিহাবের এহেন প্রশ্নের জবাবে শিলা খুবই বিরক্তি বোধ করলো। ক্ষেপে গেল। মুহুর্তেই রক্তবর্ন হয়ে গেল তার চোখ। চীট, বাটপার, ইতর, অসভ্য, ছোটলোক ইত্যাদি বলে রোকনকে গালমন্দ করলো। সিহাব বাস্তবতার আলোকে বিভিন্ন লজিক দিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু সে মোটেই পাত্তা দেয়নি। মনে হল যেন জেমি নয় শিলাই রোকন কর্তৃক প্রতারিত হয়েছে।
‘ আচ্ছা, আপনি কি ছেলেদের সত্যিই ঘৃনা করেন? আপনি কি কখনো বিয়ে করবেন না ?
‘ নিজ ইচ্ছায় করবো না। তবে ফ্যামিলির চাপ সামলাতে না পারলে হয়ত কোন অপদার্থ পুরুষকে বিয়ে করতে হবে।
‘ তখন সেই পুরুষটিকে আপনি কিভাবে মেনে নেবেন ?
‘ লোক দেখানোভাবে মেনে নেব হয়ত। কিন্তু নিজের স্বাধীনতা আগেই কেড়ে নেব।
‘ দিবা স্বপ্নে বিভোর আপনি। জীবনটাকে যেভাবে ভাবছেন এত সহজ বা কন্টকমুক্ত নয়। বরং এর চেয়েও নব্বই ভাগ বেশী কণ্টকাকীর্ণ। সুতরাং এভাবে বলা উচিত নয়।
‘ জি-হাঁ, এমনই করবো।
‘ পারবেন না। ভাগ্যের মারপ্যাঁচে আপনি হেরে যাবেন। ঠিক আছে, বাদ দিন সেসব কথা। রোকন যাক অরন্যরোদনে। আচ্ছা, আপনি কি কখনো প্রেম করেছেন ? -শিহাব বলল।
‘ না। কখনো করিনি, করবোও না।
‘ মানুষ কখন কোন পরিস্থিতিতে প্রেমে পড়ে যায়, সেটা কি জানেন ?
‘ প্রয়োজন নেই।
‘ হঠাৎ যদি আপনি কারো প্রেমে পড়ে যান, তখন কি আপনি আপনার ঘৃনাটা পুরুষ প্রজাতির বিরুদ্ধে প্রকাশ করতে পারবেন ?
‘ যা আমি ঘৃনা করি। যার প্রতি রয়েছে আমার অনীহা এবং অবজ্ঞা, তার সাথে প্রেম(?), প্রশ্নই উঠেনা।
‘ তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন যে, প্রেম ইচ্ছে করেই হয়। মুখ দিয়ে ভালবাসি বললেই ভালবাসা হয়, কিংবা কাউকে পছন্দ হলেই বা নজর পড়লেই কি ভালবাসা হয়ে যায় ?
‘ তা নয়তো কী ?
‘ আসলে এ বিষয়ে আপনি একদম অজানা বলতে হবে। কারণ মানুষ কে কখন কোন পরিস্থিতিতে কার প্রেমে পড়ে যায় কেউ বলতে পারেনা। এটা অনুভূতির ব্যাপার। এর কোন এ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগে না, এটা হয়ে যায়।
‘ অসম্ভব, তবুও পুরুষের উপর কখনোই আমার ভালবাসা জম্মাবে না।
‘ অবিশ্বাস্য। এটা আপনার ওষ্টকথা। মেয়েরা জোর গলায় এসব বলে এক ধরনের ভালমী দেখায়, যেন তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়। অথবা এটা হবে কারো সাথে প্রেম করার পূর্বাভাস।
‘ ইসসস্। কইছে আপনেরে।
‘ কওয়া লাগে না। এমনিতেই বোঝা যায়। মেয়েরা মুখে বলে এক, অন্তরে থাকে আরেক। আমি জানি আপনি সারাক্ষন বিয়ের কথা ভাবছেন। সব মেয়েরাই ভাবে। এটা মেয়েদের দৈনন্দিন কমন ভাবনা। আপনিও ভাবছেন। সুখের স্বপ্ন দেখছেন। সংসার, ছেলে-মেয়ে, দেবর-ননদ, শশুর-শাশুড়ী এসব নিয়েই ভাবছেন।
সিহাব অযথা আর কথা বাড়ায়নি। সে শুধু একবার শিলার আপাদমস্তক দেখে নিল। এরপর থেকে ঘন ঘন স্বর্নাদের বাসায় যেতে লাগল। বিভিন্ন বিষয়ে একটু একটু করে কথা বলতে লাগল এবং ধীরে ধীরে শিলার চোখে মুখের ঘোলা ভাবটাও সরে যেতে লাগল। তাই সুযোগ পেলেই সিহাব সময় দিতো। আধাঘন্টা একঘন্টা গল্প করেও যেন শিলার মন ভরতো না। এক সময় সিহাব হয়ে গেল তার শুকপাখি।
শিলা শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিল বিধায় সিহাব মাঝে মাঝে ঔষধ এনে দিত। স্বর্নাদের বাসায় যাওয়ার সময় এটা ওটা নিয়ে যেতো। ওদের সাথে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে যেত। বাহিরে বেড়াতে যেতো। শিলা তখন মোটেই সিহাবের সঙ্গচ্যুত হত না। একদম ছায়ায় ছায়ায় লেগে থাকত।
এরই মাঝে মিলা স্বর্নার মাধ্যমে সিহাবকে পছন্দ করার কথা জানাল। স্বর্নার সেই রহস্যময় হাসির অর্থ ছিল এটাই। মিলা তখন গ্রামের বাড়ীতে। স্বর্না বিষয়টি তার মাকেও জানিয়ে দিয়েছিল। তিনি হাসিমুখে গ্রহন করেছিলেন। ইতিমধ্যে শিলাও জেনে গেছে। সেও আপত্তি করেনি। কিন্তু সিহাব তাতে রাজী ছিল কিনা কেউ জানতে চায়নি। সিহাব বারবার স্বর্নাকে বলেছিল মিলাকে বাড়ী থেকে নিয়ে আসতে। কিন্তু মিলার লেখাপড়ার ক্ষতি হবে ভেবে সে আসেনি। কাজেই সিহাব বলেছিল- দুর থেকে প্রেম হয় না।
একদিন শিলা, সিহাবসহ ওরা সবাই বিকেলে ছাদে উঠল। সেখানে গিয়ে সুজন ও প্রীতি ছুটোছুটি শুরু করে দিল। স্বর্না অন্য ছাদে দাঁড়ানো একটি ছেলের সাথে ফিল্ডিং মারছিল। এ সুযোগে শিলা ও সিহাব সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে পুডুর পুডুর গল্প জুড়ে দিল।
‘ আচ্ছা, মিলা কবে আসবে ? - সিহাব শিলাকে জিজ্ঞাসা করল।
‘ জানিনা, আগামী সপ্তাহে আসতে পারে।
‘ ধুর, এভাবে কি প্রেম হয় ? মিলা আমাকে পছন্দ করে, হয়ত ভালও বাসে। কিন্তু সেই ভাললাগাকে পরিপক্ক করার জন্যেতো সাক্ষাতের প্রয়োজন। প্রস্তাব পাওয়ার আগে দেখেছি একরকম, আর প্রস্তাব পাওয়ার পরে তাকে দেখতে কেমন দেখায় অনুভব করতে ইচ্ছে করে। আসলে মিলা একটু চুপচাপ থাকেতো, মনে হয় ওর সাথে ভাল জমবে না। আপনি হলে অবশ্য ভালই জমতো।
একথা শোনার পর শিলার চেহারায় যেন প্রদীপ জ্বলে উঠল। তার কঠোর হিংসাত্মক বা ঘৃনাত্বক মনোভাব ম্লান হয়ে গেল। এমনকি ঐ কথার পরিপ্রেক্ষিতে সে আগের মত কোন প্রতিবাদ বা দ্বিমত পোষন করেনি। বরং আরো ঘনিষ্ঠভাবে আড্ডা দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলো। পর পর দ’ুতিন দিন দেখা না হলে খোঁজ নিত। সিহাবের ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয়ে খুটে খুটে প্রশংসা করতে লাগল। সারাক্ষন শুধু সিহাব। সিহাব ছাড়া যেন আর কোন কথা নেই।
সিহাবের যতœ নিতে শুরু করলো রীতিমত। আসামাত্র বসতে দিত, চা করে দিত, না খাইয়ে যেতে দিত না। অনেকটা জামাই আদর। স্বর্নার মা মিলার কথা ভেবেই সাড়া দিতেন। একদিন শুক্রবার প্রীতির নাচের ক্লাস ছিল। সেদিন তাদের সাথে সিহাবকেও যেতে হয়েছিল। প্রীতির সাপ্তাহিক নাচের ক্লাস হত ঢাকা জর্জকোটের পাশে জেলা পরিষদ ভবনে। নিচতলায় ক্লাস হত। ঐদিন প্রীতিকে নিয়ে যেতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল। তাই টিচার তাকে শাস্তিস্বরুপ কিছুক্ষন বসিয়ে রেখেছিলেন। পাশেই চেয়ার ও বেঞ্চে অভিভাবকগন বসে ছিলেন। স্বর্নার মা ও স্বর্না সেখানে বসা ছিল। ছোট ছোট বাচ্চারা তবলার তালে তালে একযোগে নাচছে- ধা গে তে টে না গে ধিন্ না। তালের সাথে যদি কারো মিল না হয় তাহলে টিচার সামনে গিয়ে নিজে নেচে দেখিয়ে দেন এবং বুঝিয়ে দেন। তারপর নির্দেশ মোতাবেক তারা আবার শুরু করে। শিলা তখন সিহাবকে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। বসার মতো উপযুক্ত জায়গা ছিল না। হয়তো সিঁড়ির উপর বসতে পারতো। কিন্তু তার ইচ্ছে হয়নি। খুব বোর ফিল করছিল।
‘ চলেন, জগন্নাথ থেকে ঘুরে আসি। আমাদের ক্যাম্পাস।
শিলা যেতে রাজী হল। তারপর স্বর্নাকে ডেকে নিয়ে সিহাবের পিছে পিছে গেল। সিহাব যেতে যেতে আড়চোখে তাকিয়ে দেখছিল শিলার হাস্যোজ্জল চেহারা। বেশ উৎফুল্ল সে। সিহাব বুঝতে পেরেছে যে, শিলার মনের জানালা খুলে গেছে। ফাইনালের পূর্ব প্রস্তুতি চলছে। তাই সে নিজের সাথে কমপেয়ার করেছে শিলাকে। কিসের মধ্যে কী ? সে শিলার পাশে একদম বেমানান। কোথায় পঞ্চান্ন কেজি ওজনের লিক্লিকে সিহাব আর কোথায় পঁচাশি কেজি ওজনের কঠিন শিলা। সিহাব মনে প্রাণে গ্রহন করতে পারেনি। তবে বুঝতে পেরেছিল যে, শিলা তার প্রেমে পড়েছে। এটা ছিল তার জন্যে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। শিলার জন্যে খুব আপসোস হল।
জেলা পরিষদের গেট পার হয়ে সোজা হেঁটে গেল পশ্চিম দিকে। ন্যাশনাল হস্পিটালের গেটের সামনে কয়েকটি রিক্সা দাঁড়ান ছিল। তারা সেই রিক্সা যট পার হয়নি। বরং রাস্তা পার হয়ে বিপরীত দিকে ফুটপাতে গিয়ে উঠল। সেখান থেকে বরাবর হেঁটে চলে গেল।
কলেজ গেটের পাশে এবং ভিতরে লম্বা বেঞ্চের উপর পুলিশ সদস্যরা বসে ছিল। অন্য দিনের তুলনায় সংখ্যায় একটু বেশীই মনে হল। গেটের একসাইড বন্ধ, আরেক সাইড খোলা। আসা যাওয়ায় কোন বাধা নেই।
সিহাবের পরনে ছিল পাঞ্জাবী। সিল্কি চুল কাঁধ পর্যন্ত লম্বা ছিল। ক্যাম্পাসে প্রবেশের পর বাতাসে তার পাঞ্জাবী ও চুল এলোমেলোভাবে উড়তে লাগল। এসব বিষয়ে ছেলেদের তোয়াক্কা না করলেও চলে। কিন্তু মেয়েদের তোয়াক্কা করতে হয়, কারণ ঐ বাতাসই ছেলেদেরকে মেয়েদের দিকে তাকানোর আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। যদিও সেদিন কাম্পাসে কোন সাধারণ ছাত্রছাত্রী ছিলনা। তবে ছাত্রনেতাদের আনাগোনাসহ হাতে গোনা কয়েকটি জুটি দেখা গিয়েছিল।
হঠাৎ সিহাব হাঁটুর উপর থেকে পাঞ্জাবী টেনে নিয়ে মুখে কিছু একটা মুছতেছিল। অমনি শিলা ধমক দিল। সিহাব অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে তার খবরদারীর মুভমেন্ট লক্ষ্য করল। দেখল, মোটামুটি সাইজে এসে গেছে। সিহাব মনে মনে আনন্দিত। এমতাবস্থায় সিহাবের এক ক্লাসমেট আদনান এসে সামনে দাঁড়াল।
‘ তুই এখানে, এখন এসেছিস কেন ?
‘ এমনি এসেছি।
‘ চলে যা। জলদি।
‘ কেন ?
‘ সকালে পেপার পড়িসনি ?
‘ না তো ।
‘ ঐ দ্যাখ। কর্ণারে তাকা।
আদনান সিহাবকে বিল্ডিংএর পিছনের দিকে ছিপায় তাকাতে বলল। সিহাব চম্কে উঠল। বুকটা কেঁপে উঠল। আড়ালে কয়েকজনকে দেখা গেল। সবাই সজ্জিত। গতরাতে ক্যাম্পাস দখলের লড়াই হয়েছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মাঝে। সকালে জাতীয় দৈনিকগুলোতে সংবাদ বেরিয়েছে। সিহাব সেদিন সকালে পত্রিকা পড়েনি। তাই তার জানা ছিল না। তড়িগড়ি তারা ফিরে গেল জেলা পরিষদের দিকে।
স্বর্নাকে তার মায়ের কাছে রুমের ভিতরে পাঠিয়ে দিয়ে শিলা সিহাবকে নিয়ে পুনরায় বারান্দায় বসে খোশগল্পে মেতে উঠল। তার কথা বলার স্বরে একটা কাঁপুনী কাঁপুনী ভাব ছিল। ঘামছিল শিলা। হ্যান্ড-ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে অনবরত মুছতেছিল। এতে তার মুখের মেকাপ সব উঠে গিয়ে সিদ্ধ আলুর মত দেখাচ্ছিল। লিপস্টিক লাগানো ঠোঁটে টিস্যু ঘর্ষনের ফলে রঙটা ফেটে গিয়ে মরা গাছে ঝুলে থাকা শষার বাকলের মতো মনে হল। অথচ তার কিছুক্ষন আগেও ছিল টাটকা কমলালেবুর কোষের মতো। আবেগময় মুহুর্ত না হলে হয়ত কমলালেবুর ঐ কোষ দুটো তরতাজাই থাকত। কিন্তু তার কপালের ঐ নীল টিপ তখনো নীল ছিল। একটুও পরিবর্তন হয়নি। সিহাব তখন মুগ্ধ হয়ে ঐ টিপের দিকেই তাকিয়ে ছিল। শিলার তখন লাল টকটকে চেহারা।
‘ ভাবছি জেমিকে কী জবাব দেব ?
‘ কেন কী হয়েছে ?
‘ বুঝ না কী হয়েছে ? ওর সাথে আমার ওয়াদা ভঙ্গ হয়েছে।
‘ কী রকম ওয়াদা।
সিহাব না বোঝার ভান করল। শিলার মুখ থেকে শোনার জন্যে সে ইনিয়ে বিনিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল। মিটিমিটি হাসছিল সিহাব। পারেনা উচ্চস্বরে অট্রহাসি দিয়ে দেওয়াল ফাটিয়ে দেয়। শিলার দিকে তাকিয়ে দেখল তার প্রফুল্লতা। চোখ মুখ তরঙ্গায়িত। দেহের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেন আনন্দে নাচছিল। মনে মনে সিহাব বলল- ছেলেদের পছন্দ করো না (?) করবা করবা ভালমত করবা, প্রেমও করবা, ভালও লাগবে, একেবারে কচি ডাবের পানির মত মনে হবে।
‘ প্রেম করতে খুব মজা। তাই নাহ্ ?
‘ কী জানি !
‘ আচ্ছা মিলাকে কীভাবে সামাল দেবে? সে তো আমাকে অফার করেছিল তোমার আগে। ছোট বোনের পছন্দের জিনিষ বড় বোন নিয়ে যাবে, ব্যাপারটা কেমন হবে ?
এই প্রশ্নের বিপরীতে শিলা কোন জবাব দেয়নি। তবে ছোটবোনের জিনিষটা হাতিয়ে নেওয়ার কথা শুনে একটু বিচলিত বোধ করল।
‘ এটা কোন সমস্যা নয়। আমরা বোনেরা সবাই ফ্রি মাইন্ডেড। মিলাকে সামাল দিতে অসুবিধা হবে না। ওকে মেনেজ করা খুব সহজ।
‘ মিলাকে সহজ সরল পেয়ে ওর পছন্দের জিনিষ পর্যন্ত কেড়ে নেবে- এটা কী ঠিক হবে ?
‘ এটা কোন ব্যাপার না। ও আমার কথার উপর কিছু বলবে না ?
‘ বড় বোন হিসাবে সে তোমাকে শ্রদ্ধা করে। সেজন্য হয়ত তোমার জন্যে সে তার ভাললাগাকে বিসর্জন দেবে। আর সেই সুযোগ তুমি কাজে লাগাবে ? তোমাকে সমীহ করা মানে এই নয় যে, সে দুর্বল। দুর্বলতা মনে করে তুমি তাকে কাজে লাগাতে পারো না। তাকে ঠকানো তোমার উচিত হবে না।
‘ কী বলতে চাও তুমি ? তুমি কী তাহলে ---
‘ না, ঠিক তা নয়। আমি বলতে চাচ্ছি যে, মিলা হয়ত তোমার সিদ্ধান্তে বাধা দেবে না। তাই বলে তোমার কিন্তু বোঝা উচিত যে, তারও একটা মন আছে। সে যেমন তোমার জন্যে সেক্রিফাইজ করতে প্রস্তুত আছে বলে মনে কর, তেমনি তোমারও উচিত তার জন্যে সেক্রিফাইজ করা। বরং তার উপর তোমার দায়িত্ব আরো বেশী। তা না করে যদি তার শিকারটা নিজের স্বার্থে কাজে লাগাও তাহলে তো রীতিমত স্বার্থপরতা হয়ে গেল। নিজের ছোটবোনের সাথে দিনে দুপুরে এমন প্রতারণা ?
শিলাকে একটু চিন্তিত মনে হল। তারপর হেসে উঠে ঐ একই কথা বলল- এটা কোন ব্যাপার না। মিলা খুব ভাল মেয়ে। ওর কোন অসুবিধা হবে না। আমি ঠিক মেনেজ করে নেব। শুনে শিহাবের চোখ দুটো ছোট হয়ে গেল। সে শিলার দিকে তাকিয়ে দেখে তার মাধুরী মেশানো সজীবতা। মিলা কষ্ট পাবে তাতে তার কোন অনুশোচনা নেই। বরং মনে হল যে, সে বুঝি নায়ককে নিয়ে এক্ষুনি গান গাওয়া শুরু করে দেবে- “আমার স্বপ্ন যে সত্যি হল আজ-- ”। প্রেম কী তাহলে স্বার্থপর হয় ? নাকি প্রেমিক প্রেমিকা স্বার্থপর হয় ? এই প্রশ্নের জবাব হয়ত স্বার্থপর প্রেমিক প্রেমিকারাই দিতে পারে। তবে এক্ষেত্রে প্রেমের যে অপব্যবহার হল তাতে কোন সন্দেহ নেই। মূলতঃ প্রেম সবার জন্যই সমান। কেউ সঠিক প্রয়োগ করে, আর কেউ অপপ্রয়োগ করে। কেউ এর মর্যাদা বোঝে, কেউ বোঝে না। যারা বোঝে না তারা একে নিয়ে ভলিবল খেলে, আর যারা বুঝে তারা বুক পকেটে এঁটে রাখে।
সিহাব ভলিবল খেলার দলে নয়। তবে এটা ছেলেদের প্রতি শিলার বিদ্বেষী মনোভাবের প্রতিবাদমাত্র। তারই প্রতিশোধ হিসাবে প্রেমের পাঠ শেখানোর জন্যে বলা যায় ভলিবল খেলোয়াড় হিসাবেই সিহাবের মাঠে নামা। তবে শিলা নবপ্রেমে বিভোর ছিল। তাই সে সিহাবকে বুঝতে পারেনি।
সিহাবের এমএ পরীক্ষা সন্নিকটে। জগন্নাথ থেকে নৈশ শাখায় মাষ্টার্স পরীক্ষার্থী সে। তাই দৈনন্দিন কর্তব্য কর্ম-রুটিনের পাশাপাশি লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত ছিল। এদিকে শিলা প্রতিদিনই তার পথ চেয়ে বসে থাকে। দুই দিন দেখা না হলেই শিলা অস্থির হয়ে পড়ে। সংবাদ পাঠায়। কিন্তু সিহাব অতটা গুরুত্ব দেয়না। তার তেমন আগ্রহও ছিল না, থাকার কথাও নয়। শিলাতো একদম প্রেমের জলে হাবুডুবু খেতে খেতে বাড়ীর কথা ভুলেই গেছে। বিভিন্ন অযুহাতে সে ঢাকায় তার খালার বাসায় অবস্থান করছিল। ওদের বিষয়টা একসময় স্বর্না জেনে গেল। সে তার মাকে জানাল। তিনি প্রথমে একটু বিচলিত ও রাগাম্বিত হলেও পরক্ষনে মেনে নিয়েছেন। কারন বোনদের মাঝে মিলার পজিশন ছিল দ্বিতীয়। সুতরাং শিলার সিরিয়াল আগে। তবুও স্বর্না বাঁধা দিয়েছিল। সে মোটেও সমর্থন দেয়নি, মানতে চায়নি। কারণ মিলার পক্ষে সে। মিলাই তাকে ব্যবহার করেছে। স্বর্না হল মিলার মেন্টাল পার্টনার। কাজেই স্বর্না প্রতিবাদ করলেও তার মা প্রকৃতপক্ষে মিলার প্রতি অবিচারই করেছেন। একবারও তার মানষিক অবস্থা নিয়ে ভাবেননি। তিনি বুঝতেও চাননি।
স্বর্নাকে দিয়েই মিলা শুরু করেছিল তার প্রথম ভালবাসা। সেই স্বর্নার কাছ থেকেই শুনেছে তার ভালবাসা ছিনতাইয়ের সংবাদ। ছিনতাই করলো তারই বড় বোন। শুনে খুবই কষ্ট পেল সে। নীরবে নিবৃত্যে রাতভর শুধু কেঁদেছে। কিন্তু তার সেই কান্নাজল কাউকে শীতল করতে পারেনি। শিলাকেও টলাতে পারেনি। খালা ছিল কঠিন পাহাড়। এক্ষেত্রে তার বাবা-মায়ের তেমন কোন ভুমিকা ছিল না। কারণ শিলা ছিল বিবাহযোগ্যা এবং তার খালা হলেন সবার বড়। সেই হিসাবে তিনি তাদের পরিবারে একটি বিশেষ সম্মান বহন করতেন। যেই সম্মানের কাছে মিলা ছিল অসহায়। কাজেই বুকের উপর পাথর চাপা দেওয়া ছাড়া তার কোন গত্যান্তর ছিল না। কেঁদে কেঁদে শুধু একটা কথাই বলেছিল- অভিভাবকরা বুঝি এমন হয় ?
সিহাবের পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর পরই সারাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিল। রুটিন অনুযায়ী প্রথম বিষয় পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঠিক পনের দিন পর দ্বিতীয় বিষয় পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। অফিস থেকেও ছুটি নিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিষয় পরীক্ষা হওয়ার চার-পাঁচ দিন আগে থেকেই বন্যার পানি বিপদসীমা ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঐরকম পরিস্থিতিতে পরীক্ষা এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিল। কারন বেশীর ভাগ পরীক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থাৎ ঢাকার বাহির থেকে এসে পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতো। তাছাড়া মানবতার উপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সকলেরই সহানুভুতি দেখানো একান্ত কর্তব্য।
যাইহোক সেই সপ্তাহে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হল। ক্রমান্বয়ে আরো বিপজ্জনক হয়ে পড়ল। রাস্তাঘাট তলিয়ে ঢাকার সাথে সারাদেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। পরীক্ষার তারিখ আরো এক সপ্তাহ পিছিয়ে গেল। তাতেও কিছু হলনা। পরিশেষে কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্যে পরীক্ষা পিছিয়ে দিল। হঠাৎ সংবাদ এলো সিহাবের ভিসা এসে গেছে। যেতে হবে মধ্যপ্রাচ্যে। বিশ্বখ্যাত একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানীতে তার চাকুরী হয়ে গেছে। শুনে পরিবারের সবাই খুশী। কিন্তু সিহাব খুশী হতে পারেনি বরং বিমূঢ় হয়ে গেল। যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল। কারণ তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মাষ্টার্স কমপ্লিট করা। এটা তার সারাজীবনের সাধনা, জীবনের সর্বশেষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। সেশনযট মিলে পাঁচ পাঁচটি বৎসর এর পিছনে শ্রম দিয়েছে, সময় দিয়েছে, অর্থ ব্যয় করেছে অথচ শেষ পর্যায়ে একদম তীরে এসে তরীডুবি। কিছুতেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারেনি। সে বিদেশযাত্রা প্রত্যাখ্যান করল। কিন্তু তার ফ্যামিলির কর্তাব্যক্তিগন তার সেই প্রত্যাখ্যান নাকচ করে দিল। সে উপেক্ষা করতে পারেনি। চেষ্টা করেও বেঁকে বসতে পারেনি। কারণ পরিবারের বড় ছেলেরা হয়ত দায়িত্ব উপেক্ষা করতে পারেনা।
নীলিম করকা
আইয়ুব আহমেদ দুলাল
নীলিম করকা
(১)
পুরানো ঢাকার রাস্তায় এতো জ্যাম সিহাব রিক্সায় বসে থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে গেছে। কিছুক্ষন পর পর রিক্সা একটু এগিয়ে যায় আবার দাঁড়িয়ে থাকে অনেক সময় ধরে। পাশেই একটি ঘোড়ার গাড়ী। পুরানো ঢাকার ঐতিহ্য ঐ ঘোড়ার গাড়ী। তবে বর্তমানে রাস্তায় গুটিকয়েক দেখা যায়। ঘোড়াগুলোও পুরানো। জরাজীর্ন, রোগাক্রান্ত। সিহাব দেখল ঘোড়ার গাড়ীতে চলমান দুইটি ঘোড়ার মধ্যে একটি হাড্ডিসার, আরেকটি মোটামুটি নাদুস-নুদুস ও পরিচ্ছন্ন। পিছনে এক গুচ্ছ লেজ, বেশ ভালই দেখাচ্ছিল।
‘ বাহ্, ঘোড়াটার লেজতো বেশ সুন্দর ! - সিহাব বলল।
‘ হ ভাই, এমন সুন্দর ঘোড়া পুরান ঢাহায় অহন আর নজরে পড়ে না। যেইগুলো আছে হেইগুলো দ্যাখ্লে মনে অয় সোমালিয়াত্তন আইছে। - রিক্সাচালক বলল।
সিহাবের খুব হাসি পেল।
‘ তুমি আবার সোমালিয়া চেনো নাকি ?
‘ চিনুম না ক্যান ? ঐ দ্যাশে অহন দুর্ভিক্ষ ছলতিছে, টিভিতে দেহিছি। অভাবী মানুষগুলাইন কত কষ্টে আছে! দেখ্লে মনে অয় হ্যারা পিথিবীর বাইরে অন্য কোনহানে বাস করে।
‘ কেন, তোমার এমন মনে হয় কেন ?
‘ হুনেন ভাই, পিথিবীতে থাকলে তো কেউ না কেউ তাগরে দেখ্তো।
‘ অবশ্যই দেখে, কেউ না কেউ তো দ্যাখে।
‘ দ্যাহে না ভাই, দ্যাহে না, বুঝাই যায়। এই দুন্যেত কেউ কারোরে দেহে না। সবাই যার যার ধান্দায় থাহে।
‘ কে বলল তোমাকে ? মানুষইতো মানুষের জন্যে।
‘ ভাই, ঐ কথাগুলাইন আম্নেগ বইয়ের ভিত্তে রাহেন। মানুষ যদি মাইনষের লাইগাই অইতো তাইলে বুশ খান্কির পোলায় সাদ্দামের গোয়ায় বাঁশ না দিয়া ঐ অভাবী মানুষগুলার মাথার উপর বাঁশের মাছা’তো বানাইয়া দিবার পারে। পারে না কন্ ?
‘ হ্যা পারে। কিন্তু মাঁচায় থাকলে হবে, খাওয়া লাগবে না ? খাবার দেবে কে ?
‘ ক্যা, ব্লেয়ার ছোদানীর পোলায় কী করবো ? হ্যায় দিতে পারবো না ?
রিক্সাচালকের কথা শুনে অবাক হল সিহাব। একজন খেটে খাওয়া লোক। রিক্সাচালনা যার পেশা। সারাদিন সে ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে সংসারের ব্যয়ভাব যোগান দেয়। তার চিন্তাধারা রিক্সা আর সংসার এই দুইয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকার কথা। তারওতো সংসারে অভাব কম নয়। অথচ তার চিন্তাশক্তি ছড়িয়ে গেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। একেই বলে মনুষ্যত্ব। প্রকৃত অর্থে যাদের থাকা উচিত তাদের নেই কেন? এটা সকলেরই প্রশ্ন। রিক্সাওলার অকপট প্রকাশ ভঙ্গিতে সিহাব তখনো মিটিমিটি হাসছিল।
জ্যাম একটু হাল্কা হওয়া মাত্র আইল্যান্ড থেকে একসারি সরে গিয়ে দুই তিনটা রিক্সা ওভারটেক করে এগিয়ে গেল ঐ ঘোড়ার পাড়ীটি। ফলে সিহাব ঐ গাড়ী থেকে আরো দুইতিনটা রিক্সার পিছনে পড়ে গেল।
এক পর্যায়ে যানজটের মধ্যে রিক্সার ফাঁক দিয়ে ঐ পরিচ্ছন্ন ঘোড়াটির লেজ তার নজরে পড়ল। তার কাছে বেশ ভালই লাগছিল। যানযট পুনরায় কিছুটা হাল্কা হলে রিক্সাচালক সুযোগ বুঝে ফাঁকফোকড় পেরিয়ে চার-পাঁটটা রিক্সা পিছনে ফেলে সামনে চলে গেল। সিহাব ব্যাপারটা বেশ এন্জয় করল। পিকুলিয়র টাইপের রিক্সাচালক। ভালমন্দ নানান কথা তার মুখে শোভা পাচ্ছিল। হঠাৎ সে পিছন ফিরে সিহাবের দিকে তাকিয়ে বলল- ‘ভাই, এই দ্যাহেন ঘোড়ার লেজ।
সিহাব ফিরে তাকাল। লক্ষ্য করল ঐ ঘোড়ার লেজের দিকে। কিন্তু হায়! তাকিয়ে দেখে ওটা ঘোড়া নয়, একজন রূপসী রমনী। তার চুলগুলো ঐ ঘোড়ার লেজের মতই। পার্থক্য করা কঠিন। খুব আপসোস হল। মনে প্রশ্ন জাগলো- কেন মেয়েরা নিজেদের চুলগুলোকে রাঙিয়ে ঘোড়ার লেজের মত করে ফেলে। কেমন দেখায়! রাঙানো ঐ চুলগুলোকে কী রঙে প্রকাশ করা যায়! বাংলায় বললে বাদামী আর ইংরেজীতে ব্রাউন, মেহেদী কালারও বলা যায়, তবে গোবরে কালার বললে পারফেক্ট হয়। যেভাবেই বলা হোক না কেন, আসলে কেমন দেখায় ? মেহেদী লাগিয়ে চুলের প্রকৃত রংটাকে পরিবর্তন করে ফেলে। সে ক্ষেত্রে সাদা চুলটাকে ভাল মানায়, বিশেষ করে বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের পাকা চুল।
মুসলমানদের জন্যে মেহেদী ব্যবহার করা একটা উত্তম কাজ। তবে শরীরের বিশেষ কয়েকটি স্থানে, যেখানে ব্যবহার করলে আদব কায়দা ও পবিত্রতা ঠিক থাকবে। হয়ত কোথাও লেখা নেই, তবুও সুন্নত বললে বোধহয় ভুল হবে না এবং ওয়াজে হুজুরদের মুখে সুন্নত হিসাবেই বলতে শুনেছি। কারণ নবী করিম (সঃ) দাঁড়িতে ও চুলে মেহেদী ব্যবহার করেছিলেন। সেই হিসাবে আমরাও ব্যবহার করতে পারি। তবে কালো চুলে বা কালো দাঁড়িতে ব্যবহার করলে তেমন একটা বুঝা যায় না। সাদা হলেই ভাল দেখায়। কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান যুগের মেয়েরা পবিত্রতা রক্ষা করে মেহেদী ব্যবহার করেনা। তারা ব্যবহার করে ওয়েষ্টার্ন ষ্টাইল হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করার জন্যে। অর্থাৎ আধুনিক হওয়ার অপচেষ্টা মাত্র। তাই তারা চুলে, হাতে, এমনকি পায়েও মেহেদী ব্যবহার করে থাকে। মুলতঃ পায়ে মেহেদী ব্যবহার করা মোটেই উচিত নয়। এটা কমনসেন্সের বিষয়। যা নবী করিম (সঃ) এর দাঁড়িতে শোভা পেয়েছিল, তা কীভাবে মুসলিম উম্মার পায়ে স্থান পায় বোধগম্য নয়।
শোনা যায়, প্রকৃতির অবদান কালো চুলে যদি মেহেদীর রঙটা ফুটে না ওঠে তাহলে বিউটি পারলারে ব্যবহৃত হয় ¯িপরিট জাতীয় এক ধরনের কেমিক্যাল। যা চুলে লাগানো মাত্রই ধোঁয়া উঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে ওয়াশ করে ফেলে। অর্থাৎ চুলের প্রকৃত কালারটাকে পুঁড়িয়ে ফেলা হয়। তারপর ব্যবহার করে এক ধরনের রঙ। সেই রঙ দিয়েই সাজে বিভিন্ন স্টাইলে। পরনের পোশাক যদি হয় লাল তাহলে মেচিং করে চুলের রঙটা করা হয় লালসে। যদি নীল হয় তাহলে চুলের রঙ নীলসে করা হয়। ব্রাউন কালার সব পোশাকের সঙ্গেই চালিয়ে নিতে হয়, কিছুই করার থাকে না। কারণ ওটা ফিক্সড কালার। সেক্ষেত্রে প্রকৃত রঙ কালো আর থাকে না।
পশ্চিমা দেশের মেয়েদের চুল বাদামী, চেহারা সাদা। মানে- ত্বক লালসে কিংবা দুধে আলতা অথবা সাদাও বলা যায়। প্রকৃতিগতভাবেই এর উৎপত্তি। তাদের পোশাক-আশাক কৃষ্টি-কালসার সেই রকম। বাদামী চুল ও খোলামেলা পোশাক তাদেরই মানায়। বাঙালী মেয়েরা যদি কৃত্রিম ভাবে ঐ বেস ধারন করে তাহলে কতটুকু মানানসই হয়, একটু বিবেক খরচা করলেই বোঝা যায়। তাছাড়া ফর্সা মেয়েরা যদি চুল লালসে বানাতে পাটা-পুতার সহায়তা নিয়ে সাজুগুজু করে তাহলে মোটামুটি ভালই দেখায়। কিন্তু পাইকারী হারে যদি সবাই ঐ বেস গ্রহন করে বা অফর্সা ত্বকের মেয়েরাও যদি ঐ বেস নেয় তাহলে কেমন দেখায় ? মূলতঃ অনিজিনালের কোন বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে নিগ্রোরাই নিশ্চিন্ত।
বড় বিচিত্র আমাদের দেশের নারীরা। তারা স্বাধীনতা চায়। পশ্চিমা দেশের পোশাকে সুন্দরী প্রতিযোগীতায় অংশ নেয়। এ কেমন সুন্দরী ? যে যত খোলামেলা ও স্বল্প পোশাক পরিধান করে উম্মুক্ত মঞ্চে নিজের দেহকে প্রদর্শন করবে সেইই নাকি সুন্দরী। সব অবিচার মেনে নিচ্ছি আমরা। অথচ এই নারীদের মর্যাদা অনেক। সব ধর্মই নারীকে মর্যাদার আসন দিয়েছে। একজন নারীই হচ্ছেন মা, বোন, প্রেমিকা, স্ত্রী অথবা মেয়ে। মেয়েরা হচ্ছে পুরুষের অঙ্গ থেকে তৈরী। তাদের স্থান পুরুষের হৃদয়ে, হৃদপিন্ড জুড়ে। হৃদয়ের ঐ সিংহাসনটা একজন নারীর জন্যে নির্মিত। নারী হচ্ছে পুরুষের প্রেরণা। একজন পুরুষের জীবনে কোন বিশেষ নারীর আবির্ভাব না ঘটলেও একজন মায়ের আবির্ভাবতো ঘটেই। কারণ তিনিও একজন নারী। মায়ের প্রেরনাই প্রথম। সুতরাং নারী ছাড়া পুরুষ অচল। তাইতো যুগে যুগে এই পৃথিবী জুড়ে কবি, সাহিত্যিকরা যতটুকুই অবদান রেখে গেছেন তার সবটুকুই ঐ নারী বা মেয়েদের নিয়ে। অথচ ক’জন নারী আছেন যারা পুরুষদের নিয়ে কাব্য বা সাহিত্যচর্চা করেছেন ? হ্যা করেছেন, তবে সেটা পুরুষ প্রজাতি থেকে মুক্তি চেয়ে, স্বাধীনতা চেয়ে। অথচ তারা একটুও অনুভব করেন না যে, একজন পুরুষের যেমন নারী প্রয়োজন তেমনি নারীর জন্যও পুরুষ প্রয়োজন। একজন পুরুষ ব্যতিত কোন নারী নারীই নয়। পুরুষ আছে বলেই নারীদের এতো মূল্যায়ন। পুরুষ আছে বলেই নারীরা তাকে ভালবাসার লোভ দেখিয়ে ভেড়া বানিয়ে মজা নেওয়ার সুযোগ পায়। যেন কিচ্ছু বোঝে না।
ঘুরে ফিরে সিহাবের ঐ একই আপসোস। মেয়েদের চুল কেন ঘোড়ার লেজের মতো ? কালোর মাঝে খারাবী কোথায় ? এক সময় এই চুলকেই কালো করার জন্যে মেয়েরা সাধনা করতো। চুলের যতেœ বিভোর থাকতো। লম্বা ঘন কালো চুলের জন্য বান্ধবীদের মাঝে প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যেতো। লম্বা চুলো বান্ধবীকে দেখলে অন্য বান্ধবীরা হিংসা করতো। ঘন কালো কেশের নিমিত্তে প্রচার মাধ্যমগুলোতে বেশী বেশী বিজ্ঞাপন প্রচার হত। বিভিন্ন ধরনের প্রসেস ও তেলের বিজ্ঞাপন দেওয়া হত। সেসব বিজ্ঞাপনে মেয়েদের জন্যে লোভনীয় বিষয় ছিল ‘ঘন কালো কেশ’। সেই কেশ নিয়েই শিল্পীরা গেয়েছেন বিভিন্ন গান- মেঘ কালো আঁধার কালো, আর যে কলঙ্ক কালো------ তার চেয়ে কালো কন্যা তোমার মাথার চুল--- / তোমার কাজল কেশ ছড়ালে বলে এই রাত এতো মধুর --- / কবি লিখেছেন- চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা --- ইত্যাদি। কিন্তু বর্তমানে মেয়েদের মান্কি কালার চুল নিয়ে কী লিখবেন বা কী গাইবেন বিশেষজ্ঞ শিল্পী, কবি, সাহিত্যিকরাই ভাল জানেন। তবে নুতন করে কালো কেশ নিয়ে যদি কাব্য করা হয় তাহলে বর্তমানের সাথে তার তেমন মিল খুঁজে পাওয়া যাবেনা। ফলে বিষয়টা হাস্যকর হয়ে যাবে। তবে বাঙালী মেয়েরা যতই মডার্ন হতে চাক্ না কেন- তা সবসময়ই বেমানান দেখাবে। কারণ বাঙালী নারীরা চিরকালই বার’হাত কাপড় আর ঘন কালো কেশেই মানানসই।
(২)
অফিস থেকে বেরিয়ে রিক্সার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিল সিহাব। একটি রিক্সাও যেতে রাজী হয়নি। বাবুবাজার থেকে ইসলামপুরের রাস্তাটি পুরোপুরি জ্যাম। ফাঁকফোকড় দিয়ে একটি মানবদেহ এগিয়ে যাবে সেই অবস্থাও নেই। রাস্তার পাশে শ্রমিকেরা কাপড়ের গাইট যত্রতত্রভাবে রেখেছে। রিক্সা-ভ্যান অথবা পিক-আপ ভ্যানে উঠানামা করছে। মাটির সাথে লাগোয়া ঠেলাগাড়ী তো আছেই। যাও একটু আধটু ফাঁকফোকড় রয়েছে তাতে রিক্সা ডুকিয়ে বানিয়ে রেখেছে ফাকাক্কা বাঁধ। কোন রকমে জ্যাম অতিক্রম করে সিহাব পাটুয়াটুলী হয়ে সদরঘাট মোড়ে গিয়ে দাঁড়াল। সেখানে গিয়েও গন্তব্যে পৌছার মত কোন যানবাহন পায়নি। গাড়ীর আওয়াজ আর রিক্সার টুংটাং শব্দে রীতিমত অতিষ্ট। ধুলোবালিতো আছেই। সিহাব নাকে রুমাল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষন পর পর টেম্পো আসলেও জায়গামত পৌঁছার আগেই ফুল হয়ে যায়। হঠাৎ সিহাবের লক্ষ্য স্থির হয়ে গেল। চেনা চেনা মনে হল মহিলাকে।
‘ খালাম্মা স্লামালিকুম, কেমন আছেন ?
‘ ভাল। কিন্তু ----
‘ চিনতে পারেন নি ! আমি সিহাব, গোপীবাগ আপনাদের বাসার কাছে--।
‘ ও হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। কেমন আছ বাবা ?
‘ জ্বি ভাল। এটা কে, স্বর্না নাহ্ ?
‘ হ্যাঁ।
‘ ওয়াও, বড় হয়ে গেছো ! কেমন আছ ?
‘ জ্বি ভাইয়া, ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন ?
ওরা খিলগাঁও যাবে। সিহাবের গন্তব্য গোপীবাগ। কিন্তু যাওয়ার মত কোন বাহন ছিলনা। স্বর্নাদের বাসা আগে গোপীবাগেই ছিল। ঠিক সিহাবদের পাশের ফ্ল্যাটে। প্রয়োজনের তাগিদে তারা বাসা পরিবর্তন করে চলে গেল খিলগাঁও তালতলা। অনেকদিন পর দেখা হল।
এবার সিহাব পড়ল আরেক ঝামেলায়। এতসময় ধরে একটা রিক্সাই পায়নি। এখন খুঁজছে দুইটা।
‘ খালাম্মা, কোথা থেকে এলেন ?
‘ বুলবুল ললিতকলা একাডেমী থেকে।
‘ ও, স্বর্না এখনো গান শিখছে ? ভাল, খুব ভাল। ধরে রাখতে পারলে একদিন কাজে লাগবে। এতো ধৈর্য্যইবা কয়জনের আছে। চালিয়ে যাও। ছেড়ো না, একদিন ইন্শাল্লাহ সফল হবে।
‘ তুমি কোন ক্লাসে পড় ?
‘ নাইনে।
‘ ভেরী গুড।
স্বর্না সিহাবের অনেক জুনিয়র। চোখের সামনেই বড় হয়েছে। কিন্তু বয়ঃসন্ধি ও বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে ওর চেহারা, চাহনী, গড়ন সব কিছুর মাঝে একটা পরিবর্তন এসেছে। যা খুবই আকর্ষনীয় এবং নজর কাড়ার মত। কিন্তু সেই একই অবস্থা। চুলগুলো রাঙা। একদম গোবরে কালার।
হঠাৎ গুলিস্থানের দিক থেকে একটা ট্যাম্পো এলো। একদম খালি। সিহাব বুঝে উঠার আগেই স্বর্না ও তার মা লাফিয়ে উঠে গেল। সিহাবকে একটু যুদ্ধ করেই উঠতে হয়েছে, কারণ ততক্ষনে যাত্রীদের গুতাগুতি শুরু হয়ে গেছে। ট্যাম্পো প্রায় ঘন্টাখানিক লাগিয়ে গুলিস্থান এসে পৌছাল। তারপর ওরা একটি রিক্সায় করে খিলগাঁও চলে গেল। যাওয়ার সময় সিহাবকে বাসার লোকেশন দিয়ে গেল।
সিহাব নিজেও গান গাইতো। তার টিচার ছিলেন ওস্তাদ আকতার সাদমানী। কিন্তু সেকথা তাদের বলেনি। সিহাব রিক্সায় চড়ে গোপীবাগের দিকে যেতে লাগল। হঠাৎ স্বর্নার ডাগর ডাগর চোখ এবং গালে টোল পড়া হাসি নজরে ভেসে উঠল। তার মনে পড়ল সেই গানটি যা সে গেয়েছিল তারই বান্ধবী, অর্থাৎ সিহাবের ছোট বোনের জম্মদিনে। তখন সে পড়তো ক্লাস সিক্সে- ‘আমার গানের মালা আমি করবো কারে দান’। স্বর্না যখন গান গাইছিল তখন সিহাব মাথাটা এগিয়ে দিল। সবাই হেসে উঠল। পরে হাসির জন্যে স্বর্না আর গাইতেই পারেনি।
১০.৭.০৮
নির্যাতন সব সময়ই অন্যায় ::আইয়ুব আহমেদ দুলাল
নির্যাতন সব সময়ই অন্যায়
নির্যাতন সব সময়ই অন্যায়। ছ্যাঁকা দেয়া, গরম তেল ছোড়া, চোখে মরিচ দেয়া, এলোপাতাড়ি মারধর করে ক্ষতবিক্ষত করাÑ এসব এসিড নিক্ষেপের চেয়েও কম নয়। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে যথাযথভাবে এসবের বিচার হওয়া উচিত। এমনকি এসিড নিক্ষেপের মতো কঠিন আইনটি যদি এ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় তাহলে হয়তো এ ধরনের নির্যাতন কিছুটা হলেও কমে যেতো। মূলত এর কোনোটাই আমাদের কাম্য নয়। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব থাকবে, মূল্যবোধ থাকবে, কোনো হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা থাকবে নাÑ একটি সুন্দর পবিত্র মন নিয়ে সুবিশাল এই সুন্দর পৃথিবীকে দেখবে, মানুষ মানুষের উপকারে আসবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আমাদের দেশে এমন অনেক এলাকা রয়েছে যেখানকার অধিবাসীরা বেসরকারি সংস্থা থেকে মাত্র দুই হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করে সংসার চালাচ্ছে এবং কিস্তিও প্রতিশোধ করছে। সিডরের পর টিভিতে এমন ধরনের ভিডিও ফুটেজ দেখে অবাক হয়েছিলাম। দুই-এক হাজার টাকা লোন নিয়ে অর্থ উপার্জন করে সংসারের ব্যয়ভার বহন করেও লোনের কিস্তি শোধ করেÑ এটা কিভাবে সম্ভব? আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি। যেখানে একটি সাধারণ পরিবারের কলেজপড়–য়া ছেলের হাত খরচও এর চেয়ে বেশি লেগে যায়। ধনীর দুলালের কথা বাদই দিলাম। তাদের আয়ের উৎস যেমন প্রশস্ত, খরচের কথা আর কি বলবো! যাই হোক, আমার কাছে অবাস্তব হলেও বাস্তবে এটা সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব। দেখা যায়, ঋণ গ্রহিতারা শুধু ওই ঋণের দুই হাজার টাকার ওপর নির্ভরশীল নয়Ñ পাশাপাশি দিনমজুরি, কৃষিকাজ, রিকশাচালনা ইত্যাদি করে থাকে। সে হিসেবে বাংলাদেশে অনেক ধনী কিংবা সচ্ছল পরিবার রয়েছে যারা ইচ্ছে করলে মাত্র ২০ হাজার টাকা দিয়ে ১০টি পরিবারকে বিনা বিড়ম্বনায় সাবলম্বী করে দিতে পারে।
আমার এই সহজ-সরল অভিব্যক্তি শুনে আমার এক বন্ধু বলল, সেটা নাকি সম্ভব নয়। মানুষ নাকি শক্তের ভক্ত, নরমের যম। নিঃশর্তে দান করলে সেটার সঠিক প্রয়োগ হয় না, তার মর্মও তারা বোঝার চেষ্টা করে না। কিন্তু শর্তসাপেক্ষে অর্থ দিলে সেগুলোর সঠিক প্রয়োগ হয়, কষ্টেশিষ্টে হলেও সেই টাকা শোধ করার চিন্তা তাদের মাথায় থাকে এবং সময়মতো উপার্জন করে পরিশোধ করে ফেলে। বন্ধু বললোÑ আমিও অমন দরদ দেখাতে গিয়ে ধরা খেয়েছি, বিনা লাভে টাকা ধার দিয়ে আসল টাকাই পাইনি, বরং শত্রু হতে হয়েছে। তাই এখন আর লাভ ছাড়া টাকা দিই না। আমি ঠাট্টা করে বললাম, তার মানে তুই সুদ খাস। সে বললো, সুদ বলছিস কেন? আমার পয়সা খাটিয়ে তারা আয় করছে, সেখান থেকে লভ্যাংশ দিচ্ছে। ক্ষুদ্র ঋণও বলতে পারিস, শুনতে ভালো শোনা যায়।
তারপরও একটা বিষয় জোর দিয়ে বলা যায়, মানুষের চেষ্টা আছে। হয়তো সঠিক উৎস খুঁজে পায় না। তবুও কেউ অন্যের কাছে হাত পেতে করুণার পাত্র হতে চায় না। প্রয়োজনে নিজেতো গায়ে খাটে, স্ত্রীকেও কাজে খাটায়। স্ত্রীকে মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে দেয় কিংবা গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মহিলাদেরও দিনমজুর হিসেবে মাঠে-ময়দানে কাজ করতে দেখা যায়। এরপরও যদি জীবন ও জীবিকা নির্বাহে হিমশিম খেতে হয় তাহলে সন্তানের মায়া ভুলে গিয়ে নিজের ছোট ছোট শিশুদের সচ্ছল পরিবারে পরিচর কিংবা পরিচারিকা হিসেবে দু’বেলা দুমুঠো পেটে-ভাতে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য পাঠিয়ে দেয়। বর্তমান বাজারের যে লাগামহীন তথা অভিভাবকহীন অবস্থা এতে করে দৈনন্দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে যে দ্বিগুণ-ত্রিগুণ পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, সেই অর্থ জোগান দিতে কি ওই ঋণে পাওয়া দুই হাজার টাকা খাটিয়ে আয় করা সম্ভব হবে? নাকি রিকশাভাড়া দ্বিগুণ পাবে অথবা দিনমজুরি দ্বিগুণ পাবেÑ কোনো নিশ্চয়তা আছে? এ রকম পরিস্থিতিতে হয়তো উপায় খুঁজে না পেয়ে অসহায় গরিব মানুষেরা জীবন বাঁচাতে আবার গ্রামাঞ্চলে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরবে, দিন দিন গৃহভৃত্যের সংখ্যা বেড়ে যাবে, কারো কারো অভাবে স্বভাব নষ্ট হবে এবং (পয়সা বাঁচাতে) আগের মতো পায়ে হেঁটে দীর্ঘপথ পাড়ি দেবে (স্বাস্থ্যের জন্য ভালো)।
এক সময় কৃতদাস প্রথা ছিল। দাস-দাসী কেনাবেচা হতো। সেই দাস বা দাসীকে যেভাবে খুশি সেভাবে ব্যবহার করা হতো। এরপর কালক্রমে সেই প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবুও পৃথিবীর কোথাও কোথাও এখনো প্রচলন রয়েছে বলে শোনা যায়। দাস-দাসী, ভৃত্য, চাকর, চাকরানী, কাজের লোক, কাজের মেয়ে, ঝি, পরিচর, পরিচারিকা ইত্যাদি শব্দ একটি আরেকটির প্রতিশব্দ মাত্র। লিঙ্গভেদে এর মানে হচ্ছে সেবক কিংবা সেবিকা। সেবক মানে হচ্ছে- যে সেবা বা পরিচর্যা করে। সেবক শব্দটিকে ব্যবহার না করে যদি একটু গরিবি ভাষায় ‘চাকর’ ব্যবহার করি তাহলে ভেবে দেখি চাকরের কাজ কি! চাকরের কাজ হলোÑ মুনিবের আদেশ পালন করা বা নির্দেশ মোতাবেক কাজ করা। তার ভালোমন্দ লক্ষ্য রাখা, প্রয়োজনে হাত-পা টিপে দেয়া বা শারীরিক পরিচর্যা করা অর্থাৎ যা যা আদেশের আওতায় পড়ে। আদেশ অনুযায়ী সেই কাজে যদি সামান্য নড়চড় হয় তাহলে দেখতে হয় রক্তচক্ষু। কারণ সে তার অধীনস্ত কর্মচারী, চাকর বা হুকুমের গোলাম। দুঃখজনক হলেও সত্য, মুনিব সেই ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে অনেক সময় মনুষ্যত্ব হারিয়ে শুরু করে শারীরিক কিংবা মানুষিক নির্যাতন। মুখ বুঝে সবই সয়ে যেতে হয় কর্মচারী বা চাকর হওয়ার অপরাধে। তার সেই সহ্য ক্ষমতা দেখে মুনিব আরো বেশি মজা পায়। একটুও ভাবে না যে, সেটা তার দুর্বলতা নয় বরং সম্মান বা সমীহ। চোর পেটাতে তো মজাই লাগে, চুপচাপ সয়ে যায়, কোনো বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয় না বিধায় চামচিকাও খাদে পড়া হাতিকে লাথি মারার মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। সেই মনিব যখন ঘরে আসে তখন সেখানেও চলে একই অবস্থা।
তার মানে অফিসে যারা কাজ করে তারা হলো মালিকের কর্মচারী। মালিক তাকে কথায় কথায় সেকেন্ডে সেকেন্ডে ধমক, রাগারাগি, গালাগালি, ফাইল ছুড়ে ফেলা ইত্যাদি দুর্ব্যবহারের মাধমে মানুষিক নির্যাতন চালায়। জীবন ও জীবিকার তাগিদে কর্মচারীরা সেগুলো সয়ে নেয়। সেই নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত থাকার জন্যই মানুষ তেলমারা পদ্ধতি আবিষ্কার করে নিয়েছে। তাতেও তেমন কাজ হয় না বিধায় ইউনিয়ন শুরু করেছে। যার মাধ্যমে তারা সম্মিলিতভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে পারে।
যানবাহনে যারা কাজ করে তারা হলো যাত্রীর সেবক। এক সময় তারা যাত্রীদের সেবায় নিয়োজিত ছিল। কিন্তু এখন পট পরিবর্তন হয়েছে। এখন উল্টো যাত্রী হয়েও যানবাহনের স্টাফদের (পথযান) সেবা করার উপক্রম হয়ে যায়। তানা হলে বারডেমের কর্মচারীর মতো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে, ইচ্ছামতো ভাড়া নেবে, ইচ্ছামতো ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে গাড়ি চালাবে, মহিলাদের গায়ে হাত দিয়ে ঠেলে তুলবে, যাত্রীদের ধরে পেটাবে। উল্টো হলো কেন? কারণ তাদেরও ইউনিয়ন আছে।
হাসপাতালে যারা কাজ করে তারা হলো রোগীর সেবক। অথচ তাদের তেল মেরে, হাতের ভেতর কিছু ধরিয়ে দিয়ে চুম্মাচাটি মেরে রোগীর কাছে আনতে হয়। তানা হলে মানব জীবনের পরোয়া তাদের মধ্যে জাগ্রত হয় না। তারাও তাদের ইচ্ছামতো কর্তব্য কাজে যোগ দেয়। তাদেরও ইউনিয়ন আছে।
বাসায় যারা কাজ করে তারা হলো ওই বাসার চাকর। মালিকের অফিসের সেই দুর্ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া এসে পড়ে ঘরে। মুনিবরানী চাকর বা চাকরানীর ওপর দিয়ে সে ক্ষমতা চালায়। তানা হলে মুনিবী শোভা পায় না। দেশের প্রায় প্রতিটি সেক্টরে ইউনিয়ন আছে বিধায় এখন যার যার স্থানে সবাই রাজা। কিন্তু বাসার কাজের মেয়েদের কোনো ইউনিয়ন নেই, তাই তারা নির্যাতিত হচ্ছে!
ধনী লোকের বড় বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের চাকর থাকে। সেখানে বিভাগ অনুযায়ী চাকর বা কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়। যেমন রান্না-বান্নার জন্য আলাদা কুক, মালি আলাদা, পরিচ্ছন্নতাকর্মী আলাদা, বাসার সদস্যদের ভালোমন্দ দেখার জন্য আলাদা নার্স, আলাদা দারোয়ান, বাজারঘাট করার জন্য আলাদা কর্মচারী ইত্যাদি ক্যাটাগরির গৃহভৃত্য রাখা হয়। আর সাধারণ পরিবার অর্থাৎ যাদের বাড়িটা ছোট, অথবা ছোট ভাড়া বাসা, কিংবা ছোট ফ্ল্যাট নিয়ে যারা থাকে তাদের বাড়িতে একটিমাত্র পরিচর বা পরিচারিকা থাকে। ধনী লোকের বড় বাড়ির মতো তাদের অতগুলো কর্মচারী প্রয়োজন পড়ে না, তাই একজনই থাকে। কিন্তু কাজ করতে হয় ওই বড়লোকের বাড়ির অতগুলো কর্মচারীর বা চাকরের সমান, পরিধি হয়তো ছোট। তাকে বাজারঘাট করার পর ঠিকমতো হিসাব বুঝিয়ে দিতে হয়, বাসার সর্বপ্রকার ধোয়ামোছাসহ রান্না-বান্না করতে হয়, কলিংবেল বাজলে দরজা খুলতে হয়, টবে পানি দিতে হয়, সদস্যদের টুকিটাকি কাজে সহায়তা করতে হয়, শিশুদের দেখেশুনে রাখতে হয় ইত্যাদি। তাকে খেতে ও ঘুমাতে দেয়া হয় চুলার গরমে উত্তপ্ত হয়ে থাকা কিচেনের ফ্লোরে, ছেঁড়া মশারির বত্রিশ জায়গায় সেলাই করা থাকে। পরিবারের সবার খাওয়া শেষ হলে তাকে খেতে হয়। বেঁচে যাওয়া খাদ্য থেকেও খেতে দেয়া হয় না, ফ্রিজে রেখে দেয়। তার খাদ্য কাঁচা-মরিচ, তলানি ডাল, সঙ্গে হয়তো উচ্ছিষ্ট কিছুটা। থালা-বাটি সব আলাদা, এমনকি ছেঁড়াবেড়া জামা-কাপড় পরতে দেয়া হয়, যা দিয়ে ঠিকমতো আব্রু ঢাকা মুশকিল হয়ে পড়ে। একটি পরিবারের সব কাজ একা একজন পরিচারিকার পক্ষে করা কতোটুকু সম্ভব বোধগম্য হওয়া উচিত। এছাড়া ভিন্ন পরিবেশে প্রথম প্রথম একটু সমস্যা হতেই পারে। তার ওপর যদি একটু উনিশ থেকে বিশ হয় তাহলে চলে শারীরিক নির্যাতন। অশ্রাব্য গালাগাল তো থাকেই। সেই অশ্রাব্য ও অশালীন শব্দগুলো তাদের ছোট ছোট শিশুরা শোনে, শেখে এবং তারাও ওই শব্দগুলো ব্যবহার করে, তথা নির্যাতনের পন্থাগুলো অনুকরণ করে। সেই নির্যাতনকারীরা সবাই সমাজের ভদ্রবেশী শিক্ষিত সচেতন সভ্য মানুষ। যাদের কেউ কেউ আবার সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে গিয়ে শিশু অধিকারের কথা বলে, কিন্তু দেখা যায় নিজেই তাকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। শিশুশ্রম বন্ধের কথা বলে, কিন্তু শিশুটি কেন পরিশ্রম করে, তার ঘরে যে অভাব, সে অভাব ঘোচানোর কোনো ব্যবস্থা করে না। বলে শিশুদের শিক্ষিত ও সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে- পেটে নেই ভাত, শিক্ষিত হওয়ার পরিবেশ পাবে কোথায়? সচেতন হবে তো পরে, যখন তার পেট শান্তি তথা দুনিয়া শান্তিতে চলবে। বলতে তো সবাই পারে, শিশুদের জন্য এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। সেই হবেটা কবে? বলেই যেন দায়িত্ব শেষ।
আমরা সব সময়ই পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে গৃহপরিচারিকার ওপর নির্মম, নৃশংস ও অমানবিক নির্যাতনের চিত্র দেখে থাকি। সত্যিই সেসব চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ এবং দুঃখজনক। দেখামাত্র শিউরে উঠতে হয়। একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ ঠিক থাকতে পারবে কি না সন্দেহ। এমনকি যাদের হার্টে সমস্যা আছে তাদের জন্য হয়তো আরো ভয়াবহ ব্যাপার। মনে প্রশ্ন জাগেÑ কিভাবে একজন সুস্থ সচেতন শিক্ষিত মানুষ অমন একটা শিশুকে পিটিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেয় কিংবা গায়ে আগুনের ছ্যাঁকা দিয়ে ঝলসে দিতে পারে? মানুষের মধ্যে থেকে কি দিন দিন মানবতা হারিয়ে যাচ্ছে? স্নেহ, মায়া, মমতা কি লোপ পাচ্ছে? মানুষ কি বিবেকহীন হয়ে যাচ্ছে? নাকি দিন দিন সভ্য না হয়ে উম্মাদ হয়ে যাচ্ছে?
একটি গরিব ঘরের ছেলে কিংবা মেয়ে অভাবের তাড়নায় একমুঠো অন্নের জন্য সচ্ছল পরিবারে গৃহস্থালির কাজ নিয়ে শহরে আসে। তাদের বাবা-মা বুকে পাথর বেঁধে সন্তানকে বড়লোকদের বাসায় পাঠায়। মনে করে তাদের মেয়ে শহরের বড়লোকের বাসায় আছে, ভালো আছে, সুখে আছে, দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পাচ্ছে, ভালো কাপড় পরতে পারছে। কিন্তু তারা জানে না তাদের মেয়েকে ওই কথিত বড়লোকের বেটি কিংবা বউতে পিটিয়ে চামড়া ছাড়িয়ে নিচ্ছে। তার প্রথম অপরাধ হলো সে গরিব। অন্যান্য অপরাধ হলো- তার পেটে খিদে বেশি, তাই শুধু খায় (সামান্য খেয়েও গৃহকর্ত্রীর ভাষায় সে রাক্ষস)। পকেট শূন্য, তাই হয়তো বাজার থেকে পয়সা বাছিয়ে পকেটে রেখেছে (গৃহকর্ত্রীর ভাষায় হলো- চোর, গুষ্টিশুদ্ধ চোর)। একটি গ্লাস ভেঙে গেছে (গৃহকর্ত্রীর ভাষায়- অন্ধ নাকি, চোক্ষের মাথা খেয়েছিস? দেয় চোখে একটা খোঁচা)। এছাড়া সোফার কোণায় সামান্য একটু ময়লা লেগে আছে, হয়তো টিভির দিকে উঁকি দিয়েছে, তাদের শিশুর খেলনা ধরেছে, ডাক দেয়ার পর আসতে দেরি করেছে, মুক্ত বাতাসের দিকে তাকিয়েছে কিংবা গুন গুন করে গান গেয়েছে, হাল্কা একটু তর্ক করেছে, মাইর খেয়ে একটু কেঁদেছে (কেঁদেছে কেন)Ñ এই ধরনের উছিলায় তার ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। অথচ একজন সচেতন মানুষ হিসেবে ইচ্ছা করলে ওসব হিংস্রতা বা পাশবিকতা পরিহার করে বিষয়গুলো সহজভাবে গ্রহণ করে নিতে পারে। একটি ছোট্ট শিশু, খিদে পেয়েছে তাই সামান্য খাদ্য খেয়েছে, পুরোটা কিন্তু খায়নি। পুরোটা পকেটে নেয়নি। টিভি দেখতে ইচ্ছা করেছে তাই তাকিয়েছে। প্রতিটি মানুষের জীবনে বিনোদনের প্রয়োজন আছে। সারাদিনের খাটাখাটুনির পর একটু টিভি দেখলে কি হয়? শিশুদের কৌতূহলী চঞ্চল মন ধনী-গরিব বুঝে নাÑ এটা বিবেকে রাখা উচিত। অসতর্কতাবশত আসবাবপত্র ভাঙতেই পারে, তার জন্য তার শরীর ক্ষতবিক্ষত করা বা ছ্যাঁকা দেয়ার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। অথচ বিড়ালের গায়ে লেগেও অনেক কিছু ভেঙে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়, নিজেরা তো ভাঙেই তার হিসেবে নেই, রাস্তায় ছিনতাইকারীতে ছিনিয়ে নিয়ে যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঢের বেশি নষ্ট হয়ে যায়, স্ত্রী-স্বামীতে ঝগড়া করে তার চেয়েও বেশি ভেঙে ফেলে। সেখানে অতোটুকুন একটি গরিব শিশু কাজ করতে সক্ষম হোক বা না হোকÑ কোনো কিছু নষ্ট হলে তা তুলনামূলকভাবে ছোটই হয়ে থাকে, বরং তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে এমনকি বিষয়টা ভালোমতো বুঝিয়ে দিলে আনন্দ মনে সে কাজ করতে পারে। আর নির্যাতন করলে তার মনে সব সময় ভীতি কাজ করবে এবং সেই ভয় নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আরো বেশি নষ্ট করে ফেলবে। নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য একটু শাসনের প্রয়োজন আছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাকে ঝলসে দিতে হবে। পরিবেশগত অভ্যাস পরিবর্তন হতে হয়তো একটু সময় লাগতে পারে অস্বাভাবিক কিছু নয়।
এতোটুকু বিসর্জন বা স্বার্থত্যাগ ইচ্ছা করলে সব গৃহকর্ত্রীই করতে পারে। কিন্তু করে না। এর পেছনে কোনো সঠিক যুক্তি নেই। সবই হলো লোক দেখানো স্ট্যাটাস, মুনিবী ভাব, অর্থের দম্ভ, অহঙ্কার ও খাছালত। সব গৃহকর্ত্রীর মন কিন্তু এক নয়। কারো কারো মনে ন্যূনতম মনুষ্যত্ব থাকে। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে সেই মনুষ্যত্বও এক সময় হারিয়ে ফেলে। দেখা যায়, সকালে শিশুকে স্কুলে নিয়ে ক্লাসে দিয়ে অভিভাবকরা বাইরে অপেক্ষা করে। অনেক অভিভাবকই সেখানে অবস্থান করে এবং গল্পগুজব করে সময় কাটায়। সেই গল্পের মধ্যে কাজের লোকের প্রসঙ্গ উঠে আসে। নাকমুখ ত্যাড়া-ব্যাকা করে বলে, আমি কাজের লোকেরে ফস্কি দেই না, ফস্কি দিলেই মাথায় উঠে। আজো মেরেছি। একদম কথা শুনতে চায় না। আমার সাহেবতো বলে আমি অতো মারি কেন? আমি তাকে উল্টো ধমক দিয়ে ঠা-া করে ফেলি। বলি, কাজের লোককে তো আর তুমি চালাও না, আমি চালাই। এতো সহজ না ওদের সোজা করে রাখা। সেদিন আমার জিদ উঠে গিয়েছিল। হাতের কাছে বেলুন ছিল মেরে দিয়েছি, বেলুন ভেঙে যাওয়ার পর চামুচ দিয়ে মেরেছি। ব্যস, সোজা হয়ে গেছে।
জনৈক গৃহিণীর সেই গালগল্প শুনে সদ্য শহুরে বাসরত সাদাসিধে মনের গৃহিণীও তাকে অনুকরণ করে এবং সুযোগ বুঝে প্রতিবেশীর কাছে চাপা মারতে থাকে, যা একসময় অভ্যাসে পরিণত হয় এবং ঘটে যায় অপ্রীতিকর ঘটনা।
আমরা সিনেমায় দেখেছি কাজের মেয়ে গৃহকর্ত্রীর নির্যাতন সয়ে সয়ে বেঁচে থাকে কিংবা ওই বাসায় অবস্থান করে দীর্ঘদিন। শত অত্যাচারের পরও ইচ্ছা থাকাসত্ত্বেও সেই বাড়ির কাজ ছেড়ে যেতে পারে না। কারণ নানাবিধ হয়ে থাকে। হয়তো সে এতিম, গরিব, অসহায়, নিঃস্ব অথবা কোনো সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাধ্য হয়েই তাকে থাকতে হচ্ছে। থাকা-খাওয়া, পরাসহ বেতন ছাড়া কিংবা মাসিক চার-পাঁচশ টাকা বেতন দিয়ে গৃহে রেখে তাকে দিয়ে একটি সংসারের পুরো কাজ করানো হয়। সেই কাজ করতে গিয়ে সামান্য ত্রুটি হলেই চড়-থাপ্পড়, উষ্টা-লাথি, হাতের কাছে যা থাকে তা দিয়ে প্রহার চলতে থাকে। সেসব নির্যাতন করার পরও আরো কিছু ব্যবস্থা থাকে। যেমন খুনতি দিয়ে ছ্যাঁকা দেয়া, চুল কেটে দেয়া, গরম তেল গায়ে ছোড়া, গরম পানি ছোড়া, ইস্ত্রি দিয়ে ছ্যাঁকা দেয়া, মরিচের গুঁড়ো চোখে দেয়া, ধাতব পদার্থ দিয়ে আঘাত করা ইত্যাদি। সিনেমার কাহিনী (বাস্তব থেকেই ক্লু নেয়া হয়) অনুযায়ী সেই কাজের মেয়ে সব নির্যাতন নীরবে সয়ে সয়ে একদিন হঠাৎ করে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। নেপথ্যে নায়ক তাকে সহায়তা করে এবং ঠিক ওই একই ধরনের নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া ফলায় গৃহকর্ত্রীর ওপর। এবার বোঝ ঠেলা! পত্র-পত্রিকা কিংবা টিভিতে প্রায়ই গৃহপরিচারিকার ওপর নির্যাতন শীর্ষক সংবাদ দেখা যায়, যা অত্যন্ত নির্মম, নৃশংস ও অমানবিক, লোমহর্ষক ও দুঃখজনকতো বটেই। সেসব দৃশ্য দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় সিনেমার ওই কাজের মেয়ের মতো যদি বাস্তবে হতো তাহলে এ দেশের অহঙ্কারী, রূপের আবরণে লুক্কায়িত অসংযত, নির্দয়, অকোমল, স্বল্পবিদ্যায় ভয়ঙ্করী, অবৈধ পয়সায় লালিত গৃহকর্ত্রীদের অবস্থা কি হতো!
যাই হোক, নির্যাতন সব সময়ই অন্যায়। ছ্যাঁকা দেয়া, গরম তেল ছোড়া, চোখে মরিচ দেয়া, এলোপাতাড়ি মারধর করে ক্ষতবিক্ষত করাÑ এসব এসিড নিক্ষেপের চেয়েও কম নয়। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে যথাযথভাবে এসবের বিচার হওয়া উচিত। এমনকি এসিড নিক্ষেপের মতো কঠিন আইনটি যদি এ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় তাহলে হয়তো এ ধরনের নির্যাতন কিছুটা হলেও কমে যেতো।
মূলত এর কোনোটাই আমাদের কাম্য নয়। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব থাকবে, মূল্যবোধ থাকবে, কোনো হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা থাকবে নাÑ একটি সুন্দর পবিত্র মন নিয়ে সুবিশাল এই সুন্দর পৃথিবীকে দেখবে, মানুষ মানুষের উপকারে আসবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ayubahmedd@gmail.com
Ref: http://www.jaijaidin.com/printversion.php?nid=79482
নির্যাতন সব সময়ই অন্যায়। ছ্যাঁকা দেয়া, গরম তেল ছোড়া, চোখে মরিচ দেয়া, এলোপাতাড়ি মারধর করে ক্ষতবিক্ষত করাÑ এসব এসিড নিক্ষেপের চেয়েও কম নয়। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে যথাযথভাবে এসবের বিচার হওয়া উচিত। এমনকি এসিড নিক্ষেপের মতো কঠিন আইনটি যদি এ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় তাহলে হয়তো এ ধরনের নির্যাতন কিছুটা হলেও কমে যেতো। মূলত এর কোনোটাই আমাদের কাম্য নয়। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব থাকবে, মূল্যবোধ থাকবে, কোনো হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা থাকবে নাÑ একটি সুন্দর পবিত্র মন নিয়ে সুবিশাল এই সুন্দর পৃথিবীকে দেখবে, মানুষ মানুষের উপকারে আসবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আমাদের দেশে এমন অনেক এলাকা রয়েছে যেখানকার অধিবাসীরা বেসরকারি সংস্থা থেকে মাত্র দুই হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করে সংসার চালাচ্ছে এবং কিস্তিও প্রতিশোধ করছে। সিডরের পর টিভিতে এমন ধরনের ভিডিও ফুটেজ দেখে অবাক হয়েছিলাম। দুই-এক হাজার টাকা লোন নিয়ে অর্থ উপার্জন করে সংসারের ব্যয়ভার বহন করেও লোনের কিস্তি শোধ করেÑ এটা কিভাবে সম্ভব? আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি। যেখানে একটি সাধারণ পরিবারের কলেজপড়–য়া ছেলের হাত খরচও এর চেয়ে বেশি লেগে যায়। ধনীর দুলালের কথা বাদই দিলাম। তাদের আয়ের উৎস যেমন প্রশস্ত, খরচের কথা আর কি বলবো! যাই হোক, আমার কাছে অবাস্তব হলেও বাস্তবে এটা সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব। দেখা যায়, ঋণ গ্রহিতারা শুধু ওই ঋণের দুই হাজার টাকার ওপর নির্ভরশীল নয়Ñ পাশাপাশি দিনমজুরি, কৃষিকাজ, রিকশাচালনা ইত্যাদি করে থাকে। সে হিসেবে বাংলাদেশে অনেক ধনী কিংবা সচ্ছল পরিবার রয়েছে যারা ইচ্ছে করলে মাত্র ২০ হাজার টাকা দিয়ে ১০টি পরিবারকে বিনা বিড়ম্বনায় সাবলম্বী করে দিতে পারে।
আমার এই সহজ-সরল অভিব্যক্তি শুনে আমার এক বন্ধু বলল, সেটা নাকি সম্ভব নয়। মানুষ নাকি শক্তের ভক্ত, নরমের যম। নিঃশর্তে দান করলে সেটার সঠিক প্রয়োগ হয় না, তার মর্মও তারা বোঝার চেষ্টা করে না। কিন্তু শর্তসাপেক্ষে অর্থ দিলে সেগুলোর সঠিক প্রয়োগ হয়, কষ্টেশিষ্টে হলেও সেই টাকা শোধ করার চিন্তা তাদের মাথায় থাকে এবং সময়মতো উপার্জন করে পরিশোধ করে ফেলে। বন্ধু বললোÑ আমিও অমন দরদ দেখাতে গিয়ে ধরা খেয়েছি, বিনা লাভে টাকা ধার দিয়ে আসল টাকাই পাইনি, বরং শত্রু হতে হয়েছে। তাই এখন আর লাভ ছাড়া টাকা দিই না। আমি ঠাট্টা করে বললাম, তার মানে তুই সুদ খাস। সে বললো, সুদ বলছিস কেন? আমার পয়সা খাটিয়ে তারা আয় করছে, সেখান থেকে লভ্যাংশ দিচ্ছে। ক্ষুদ্র ঋণও বলতে পারিস, শুনতে ভালো শোনা যায়।
তারপরও একটা বিষয় জোর দিয়ে বলা যায়, মানুষের চেষ্টা আছে। হয়তো সঠিক উৎস খুঁজে পায় না। তবুও কেউ অন্যের কাছে হাত পেতে করুণার পাত্র হতে চায় না। প্রয়োজনে নিজেতো গায়ে খাটে, স্ত্রীকেও কাজে খাটায়। স্ত্রীকে মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে দেয় কিংবা গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মহিলাদেরও দিনমজুর হিসেবে মাঠে-ময়দানে কাজ করতে দেখা যায়। এরপরও যদি জীবন ও জীবিকা নির্বাহে হিমশিম খেতে হয় তাহলে সন্তানের মায়া ভুলে গিয়ে নিজের ছোট ছোট শিশুদের সচ্ছল পরিবারে পরিচর কিংবা পরিচারিকা হিসেবে দু’বেলা দুমুঠো পেটে-ভাতে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য পাঠিয়ে দেয়। বর্তমান বাজারের যে লাগামহীন তথা অভিভাবকহীন অবস্থা এতে করে দৈনন্দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে যে দ্বিগুণ-ত্রিগুণ পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, সেই অর্থ জোগান দিতে কি ওই ঋণে পাওয়া দুই হাজার টাকা খাটিয়ে আয় করা সম্ভব হবে? নাকি রিকশাভাড়া দ্বিগুণ পাবে অথবা দিনমজুরি দ্বিগুণ পাবেÑ কোনো নিশ্চয়তা আছে? এ রকম পরিস্থিতিতে হয়তো উপায় খুঁজে না পেয়ে অসহায় গরিব মানুষেরা জীবন বাঁচাতে আবার গ্রামাঞ্চলে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরবে, দিন দিন গৃহভৃত্যের সংখ্যা বেড়ে যাবে, কারো কারো অভাবে স্বভাব নষ্ট হবে এবং (পয়সা বাঁচাতে) আগের মতো পায়ে হেঁটে দীর্ঘপথ পাড়ি দেবে (স্বাস্থ্যের জন্য ভালো)।
এক সময় কৃতদাস প্রথা ছিল। দাস-দাসী কেনাবেচা হতো। সেই দাস বা দাসীকে যেভাবে খুশি সেভাবে ব্যবহার করা হতো। এরপর কালক্রমে সেই প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবুও পৃথিবীর কোথাও কোথাও এখনো প্রচলন রয়েছে বলে শোনা যায়। দাস-দাসী, ভৃত্য, চাকর, চাকরানী, কাজের লোক, কাজের মেয়ে, ঝি, পরিচর, পরিচারিকা ইত্যাদি শব্দ একটি আরেকটির প্রতিশব্দ মাত্র। লিঙ্গভেদে এর মানে হচ্ছে সেবক কিংবা সেবিকা। সেবক মানে হচ্ছে- যে সেবা বা পরিচর্যা করে। সেবক শব্দটিকে ব্যবহার না করে যদি একটু গরিবি ভাষায় ‘চাকর’ ব্যবহার করি তাহলে ভেবে দেখি চাকরের কাজ কি! চাকরের কাজ হলোÑ মুনিবের আদেশ পালন করা বা নির্দেশ মোতাবেক কাজ করা। তার ভালোমন্দ লক্ষ্য রাখা, প্রয়োজনে হাত-পা টিপে দেয়া বা শারীরিক পরিচর্যা করা অর্থাৎ যা যা আদেশের আওতায় পড়ে। আদেশ অনুযায়ী সেই কাজে যদি সামান্য নড়চড় হয় তাহলে দেখতে হয় রক্তচক্ষু। কারণ সে তার অধীনস্ত কর্মচারী, চাকর বা হুকুমের গোলাম। দুঃখজনক হলেও সত্য, মুনিব সেই ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে অনেক সময় মনুষ্যত্ব হারিয়ে শুরু করে শারীরিক কিংবা মানুষিক নির্যাতন। মুখ বুঝে সবই সয়ে যেতে হয় কর্মচারী বা চাকর হওয়ার অপরাধে। তার সেই সহ্য ক্ষমতা দেখে মুনিব আরো বেশি মজা পায়। একটুও ভাবে না যে, সেটা তার দুর্বলতা নয় বরং সম্মান বা সমীহ। চোর পেটাতে তো মজাই লাগে, চুপচাপ সয়ে যায়, কোনো বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয় না বিধায় চামচিকাও খাদে পড়া হাতিকে লাথি মারার মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। সেই মনিব যখন ঘরে আসে তখন সেখানেও চলে একই অবস্থা।
তার মানে অফিসে যারা কাজ করে তারা হলো মালিকের কর্মচারী। মালিক তাকে কথায় কথায় সেকেন্ডে সেকেন্ডে ধমক, রাগারাগি, গালাগালি, ফাইল ছুড়ে ফেলা ইত্যাদি দুর্ব্যবহারের মাধমে মানুষিক নির্যাতন চালায়। জীবন ও জীবিকার তাগিদে কর্মচারীরা সেগুলো সয়ে নেয়। সেই নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত থাকার জন্যই মানুষ তেলমারা পদ্ধতি আবিষ্কার করে নিয়েছে। তাতেও তেমন কাজ হয় না বিধায় ইউনিয়ন শুরু করেছে। যার মাধ্যমে তারা সম্মিলিতভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে পারে।
যানবাহনে যারা কাজ করে তারা হলো যাত্রীর সেবক। এক সময় তারা যাত্রীদের সেবায় নিয়োজিত ছিল। কিন্তু এখন পট পরিবর্তন হয়েছে। এখন উল্টো যাত্রী হয়েও যানবাহনের স্টাফদের (পথযান) সেবা করার উপক্রম হয়ে যায়। তানা হলে বারডেমের কর্মচারীর মতো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে, ইচ্ছামতো ভাড়া নেবে, ইচ্ছামতো ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে গাড়ি চালাবে, মহিলাদের গায়ে হাত দিয়ে ঠেলে তুলবে, যাত্রীদের ধরে পেটাবে। উল্টো হলো কেন? কারণ তাদেরও ইউনিয়ন আছে।
হাসপাতালে যারা কাজ করে তারা হলো রোগীর সেবক। অথচ তাদের তেল মেরে, হাতের ভেতর কিছু ধরিয়ে দিয়ে চুম্মাচাটি মেরে রোগীর কাছে আনতে হয়। তানা হলে মানব জীবনের পরোয়া তাদের মধ্যে জাগ্রত হয় না। তারাও তাদের ইচ্ছামতো কর্তব্য কাজে যোগ দেয়। তাদেরও ইউনিয়ন আছে।
বাসায় যারা কাজ করে তারা হলো ওই বাসার চাকর। মালিকের অফিসের সেই দুর্ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া এসে পড়ে ঘরে। মুনিবরানী চাকর বা চাকরানীর ওপর দিয়ে সে ক্ষমতা চালায়। তানা হলে মুনিবী শোভা পায় না। দেশের প্রায় প্রতিটি সেক্টরে ইউনিয়ন আছে বিধায় এখন যার যার স্থানে সবাই রাজা। কিন্তু বাসার কাজের মেয়েদের কোনো ইউনিয়ন নেই, তাই তারা নির্যাতিত হচ্ছে!
ধনী লোকের বড় বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের চাকর থাকে। সেখানে বিভাগ অনুযায়ী চাকর বা কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়। যেমন রান্না-বান্নার জন্য আলাদা কুক, মালি আলাদা, পরিচ্ছন্নতাকর্মী আলাদা, বাসার সদস্যদের ভালোমন্দ দেখার জন্য আলাদা নার্স, আলাদা দারোয়ান, বাজারঘাট করার জন্য আলাদা কর্মচারী ইত্যাদি ক্যাটাগরির গৃহভৃত্য রাখা হয়। আর সাধারণ পরিবার অর্থাৎ যাদের বাড়িটা ছোট, অথবা ছোট ভাড়া বাসা, কিংবা ছোট ফ্ল্যাট নিয়ে যারা থাকে তাদের বাড়িতে একটিমাত্র পরিচর বা পরিচারিকা থাকে। ধনী লোকের বড় বাড়ির মতো তাদের অতগুলো কর্মচারী প্রয়োজন পড়ে না, তাই একজনই থাকে। কিন্তু কাজ করতে হয় ওই বড়লোকের বাড়ির অতগুলো কর্মচারীর বা চাকরের সমান, পরিধি হয়তো ছোট। তাকে বাজারঘাট করার পর ঠিকমতো হিসাব বুঝিয়ে দিতে হয়, বাসার সর্বপ্রকার ধোয়ামোছাসহ রান্না-বান্না করতে হয়, কলিংবেল বাজলে দরজা খুলতে হয়, টবে পানি দিতে হয়, সদস্যদের টুকিটাকি কাজে সহায়তা করতে হয়, শিশুদের দেখেশুনে রাখতে হয় ইত্যাদি। তাকে খেতে ও ঘুমাতে দেয়া হয় চুলার গরমে উত্তপ্ত হয়ে থাকা কিচেনের ফ্লোরে, ছেঁড়া মশারির বত্রিশ জায়গায় সেলাই করা থাকে। পরিবারের সবার খাওয়া শেষ হলে তাকে খেতে হয়। বেঁচে যাওয়া খাদ্য থেকেও খেতে দেয়া হয় না, ফ্রিজে রেখে দেয়। তার খাদ্য কাঁচা-মরিচ, তলানি ডাল, সঙ্গে হয়তো উচ্ছিষ্ট কিছুটা। থালা-বাটি সব আলাদা, এমনকি ছেঁড়াবেড়া জামা-কাপড় পরতে দেয়া হয়, যা দিয়ে ঠিকমতো আব্রু ঢাকা মুশকিল হয়ে পড়ে। একটি পরিবারের সব কাজ একা একজন পরিচারিকার পক্ষে করা কতোটুকু সম্ভব বোধগম্য হওয়া উচিত। এছাড়া ভিন্ন পরিবেশে প্রথম প্রথম একটু সমস্যা হতেই পারে। তার ওপর যদি একটু উনিশ থেকে বিশ হয় তাহলে চলে শারীরিক নির্যাতন। অশ্রাব্য গালাগাল তো থাকেই। সেই অশ্রাব্য ও অশালীন শব্দগুলো তাদের ছোট ছোট শিশুরা শোনে, শেখে এবং তারাও ওই শব্দগুলো ব্যবহার করে, তথা নির্যাতনের পন্থাগুলো অনুকরণ করে। সেই নির্যাতনকারীরা সবাই সমাজের ভদ্রবেশী শিক্ষিত সচেতন সভ্য মানুষ। যাদের কেউ কেউ আবার সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে গিয়ে শিশু অধিকারের কথা বলে, কিন্তু দেখা যায় নিজেই তাকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। শিশুশ্রম বন্ধের কথা বলে, কিন্তু শিশুটি কেন পরিশ্রম করে, তার ঘরে যে অভাব, সে অভাব ঘোচানোর কোনো ব্যবস্থা করে না। বলে শিশুদের শিক্ষিত ও সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে- পেটে নেই ভাত, শিক্ষিত হওয়ার পরিবেশ পাবে কোথায়? সচেতন হবে তো পরে, যখন তার পেট শান্তি তথা দুনিয়া শান্তিতে চলবে। বলতে তো সবাই পারে, শিশুদের জন্য এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। সেই হবেটা কবে? বলেই যেন দায়িত্ব শেষ।
আমরা সব সময়ই পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে গৃহপরিচারিকার ওপর নির্মম, নৃশংস ও অমানবিক নির্যাতনের চিত্র দেখে থাকি। সত্যিই সেসব চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ এবং দুঃখজনক। দেখামাত্র শিউরে উঠতে হয়। একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ ঠিক থাকতে পারবে কি না সন্দেহ। এমনকি যাদের হার্টে সমস্যা আছে তাদের জন্য হয়তো আরো ভয়াবহ ব্যাপার। মনে প্রশ্ন জাগেÑ কিভাবে একজন সুস্থ সচেতন শিক্ষিত মানুষ অমন একটা শিশুকে পিটিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেয় কিংবা গায়ে আগুনের ছ্যাঁকা দিয়ে ঝলসে দিতে পারে? মানুষের মধ্যে থেকে কি দিন দিন মানবতা হারিয়ে যাচ্ছে? স্নেহ, মায়া, মমতা কি লোপ পাচ্ছে? মানুষ কি বিবেকহীন হয়ে যাচ্ছে? নাকি দিন দিন সভ্য না হয়ে উম্মাদ হয়ে যাচ্ছে?
একটি গরিব ঘরের ছেলে কিংবা মেয়ে অভাবের তাড়নায় একমুঠো অন্নের জন্য সচ্ছল পরিবারে গৃহস্থালির কাজ নিয়ে শহরে আসে। তাদের বাবা-মা বুকে পাথর বেঁধে সন্তানকে বড়লোকদের বাসায় পাঠায়। মনে করে তাদের মেয়ে শহরের বড়লোকের বাসায় আছে, ভালো আছে, সুখে আছে, দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পাচ্ছে, ভালো কাপড় পরতে পারছে। কিন্তু তারা জানে না তাদের মেয়েকে ওই কথিত বড়লোকের বেটি কিংবা বউতে পিটিয়ে চামড়া ছাড়িয়ে নিচ্ছে। তার প্রথম অপরাধ হলো সে গরিব। অন্যান্য অপরাধ হলো- তার পেটে খিদে বেশি, তাই শুধু খায় (সামান্য খেয়েও গৃহকর্ত্রীর ভাষায় সে রাক্ষস)। পকেট শূন্য, তাই হয়তো বাজার থেকে পয়সা বাছিয়ে পকেটে রেখেছে (গৃহকর্ত্রীর ভাষায় হলো- চোর, গুষ্টিশুদ্ধ চোর)। একটি গ্লাস ভেঙে গেছে (গৃহকর্ত্রীর ভাষায়- অন্ধ নাকি, চোক্ষের মাথা খেয়েছিস? দেয় চোখে একটা খোঁচা)। এছাড়া সোফার কোণায় সামান্য একটু ময়লা লেগে আছে, হয়তো টিভির দিকে উঁকি দিয়েছে, তাদের শিশুর খেলনা ধরেছে, ডাক দেয়ার পর আসতে দেরি করেছে, মুক্ত বাতাসের দিকে তাকিয়েছে কিংবা গুন গুন করে গান গেয়েছে, হাল্কা একটু তর্ক করেছে, মাইর খেয়ে একটু কেঁদেছে (কেঁদেছে কেন)Ñ এই ধরনের উছিলায় তার ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। অথচ একজন সচেতন মানুষ হিসেবে ইচ্ছা করলে ওসব হিংস্রতা বা পাশবিকতা পরিহার করে বিষয়গুলো সহজভাবে গ্রহণ করে নিতে পারে। একটি ছোট্ট শিশু, খিদে পেয়েছে তাই সামান্য খাদ্য খেয়েছে, পুরোটা কিন্তু খায়নি। পুরোটা পকেটে নেয়নি। টিভি দেখতে ইচ্ছা করেছে তাই তাকিয়েছে। প্রতিটি মানুষের জীবনে বিনোদনের প্রয়োজন আছে। সারাদিনের খাটাখাটুনির পর একটু টিভি দেখলে কি হয়? শিশুদের কৌতূহলী চঞ্চল মন ধনী-গরিব বুঝে নাÑ এটা বিবেকে রাখা উচিত। অসতর্কতাবশত আসবাবপত্র ভাঙতেই পারে, তার জন্য তার শরীর ক্ষতবিক্ষত করা বা ছ্যাঁকা দেয়ার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। অথচ বিড়ালের গায়ে লেগেও অনেক কিছু ভেঙে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়, নিজেরা তো ভাঙেই তার হিসেবে নেই, রাস্তায় ছিনতাইকারীতে ছিনিয়ে নিয়ে যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঢের বেশি নষ্ট হয়ে যায়, স্ত্রী-স্বামীতে ঝগড়া করে তার চেয়েও বেশি ভেঙে ফেলে। সেখানে অতোটুকুন একটি গরিব শিশু কাজ করতে সক্ষম হোক বা না হোকÑ কোনো কিছু নষ্ট হলে তা তুলনামূলকভাবে ছোটই হয়ে থাকে, বরং তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে এমনকি বিষয়টা ভালোমতো বুঝিয়ে দিলে আনন্দ মনে সে কাজ করতে পারে। আর নির্যাতন করলে তার মনে সব সময় ভীতি কাজ করবে এবং সেই ভয় নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আরো বেশি নষ্ট করে ফেলবে। নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য একটু শাসনের প্রয়োজন আছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাকে ঝলসে দিতে হবে। পরিবেশগত অভ্যাস পরিবর্তন হতে হয়তো একটু সময় লাগতে পারে অস্বাভাবিক কিছু নয়।
এতোটুকু বিসর্জন বা স্বার্থত্যাগ ইচ্ছা করলে সব গৃহকর্ত্রীই করতে পারে। কিন্তু করে না। এর পেছনে কোনো সঠিক যুক্তি নেই। সবই হলো লোক দেখানো স্ট্যাটাস, মুনিবী ভাব, অর্থের দম্ভ, অহঙ্কার ও খাছালত। সব গৃহকর্ত্রীর মন কিন্তু এক নয়। কারো কারো মনে ন্যূনতম মনুষ্যত্ব থাকে। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে সেই মনুষ্যত্বও এক সময় হারিয়ে ফেলে। দেখা যায়, সকালে শিশুকে স্কুলে নিয়ে ক্লাসে দিয়ে অভিভাবকরা বাইরে অপেক্ষা করে। অনেক অভিভাবকই সেখানে অবস্থান করে এবং গল্পগুজব করে সময় কাটায়। সেই গল্পের মধ্যে কাজের লোকের প্রসঙ্গ উঠে আসে। নাকমুখ ত্যাড়া-ব্যাকা করে বলে, আমি কাজের লোকেরে ফস্কি দেই না, ফস্কি দিলেই মাথায় উঠে। আজো মেরেছি। একদম কথা শুনতে চায় না। আমার সাহেবতো বলে আমি অতো মারি কেন? আমি তাকে উল্টো ধমক দিয়ে ঠা-া করে ফেলি। বলি, কাজের লোককে তো আর তুমি চালাও না, আমি চালাই। এতো সহজ না ওদের সোজা করে রাখা। সেদিন আমার জিদ উঠে গিয়েছিল। হাতের কাছে বেলুন ছিল মেরে দিয়েছি, বেলুন ভেঙে যাওয়ার পর চামুচ দিয়ে মেরেছি। ব্যস, সোজা হয়ে গেছে।
জনৈক গৃহিণীর সেই গালগল্প শুনে সদ্য শহুরে বাসরত সাদাসিধে মনের গৃহিণীও তাকে অনুকরণ করে এবং সুযোগ বুঝে প্রতিবেশীর কাছে চাপা মারতে থাকে, যা একসময় অভ্যাসে পরিণত হয় এবং ঘটে যায় অপ্রীতিকর ঘটনা।
আমরা সিনেমায় দেখেছি কাজের মেয়ে গৃহকর্ত্রীর নির্যাতন সয়ে সয়ে বেঁচে থাকে কিংবা ওই বাসায় অবস্থান করে দীর্ঘদিন। শত অত্যাচারের পরও ইচ্ছা থাকাসত্ত্বেও সেই বাড়ির কাজ ছেড়ে যেতে পারে না। কারণ নানাবিধ হয়ে থাকে। হয়তো সে এতিম, গরিব, অসহায়, নিঃস্ব অথবা কোনো সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাধ্য হয়েই তাকে থাকতে হচ্ছে। থাকা-খাওয়া, পরাসহ বেতন ছাড়া কিংবা মাসিক চার-পাঁচশ টাকা বেতন দিয়ে গৃহে রেখে তাকে দিয়ে একটি সংসারের পুরো কাজ করানো হয়। সেই কাজ করতে গিয়ে সামান্য ত্রুটি হলেই চড়-থাপ্পড়, উষ্টা-লাথি, হাতের কাছে যা থাকে তা দিয়ে প্রহার চলতে থাকে। সেসব নির্যাতন করার পরও আরো কিছু ব্যবস্থা থাকে। যেমন খুনতি দিয়ে ছ্যাঁকা দেয়া, চুল কেটে দেয়া, গরম তেল গায়ে ছোড়া, গরম পানি ছোড়া, ইস্ত্রি দিয়ে ছ্যাঁকা দেয়া, মরিচের গুঁড়ো চোখে দেয়া, ধাতব পদার্থ দিয়ে আঘাত করা ইত্যাদি। সিনেমার কাহিনী (বাস্তব থেকেই ক্লু নেয়া হয়) অনুযায়ী সেই কাজের মেয়ে সব নির্যাতন নীরবে সয়ে সয়ে একদিন হঠাৎ করে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। নেপথ্যে নায়ক তাকে সহায়তা করে এবং ঠিক ওই একই ধরনের নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া ফলায় গৃহকর্ত্রীর ওপর। এবার বোঝ ঠেলা! পত্র-পত্রিকা কিংবা টিভিতে প্রায়ই গৃহপরিচারিকার ওপর নির্যাতন শীর্ষক সংবাদ দেখা যায়, যা অত্যন্ত নির্মম, নৃশংস ও অমানবিক, লোমহর্ষক ও দুঃখজনকতো বটেই। সেসব দৃশ্য দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় সিনেমার ওই কাজের মেয়ের মতো যদি বাস্তবে হতো তাহলে এ দেশের অহঙ্কারী, রূপের আবরণে লুক্কায়িত অসংযত, নির্দয়, অকোমল, স্বল্পবিদ্যায় ভয়ঙ্করী, অবৈধ পয়সায় লালিত গৃহকর্ত্রীদের অবস্থা কি হতো!
যাই হোক, নির্যাতন সব সময়ই অন্যায়। ছ্যাঁকা দেয়া, গরম তেল ছোড়া, চোখে মরিচ দেয়া, এলোপাতাড়ি মারধর করে ক্ষতবিক্ষত করাÑ এসব এসিড নিক্ষেপের চেয়েও কম নয়। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে যথাযথভাবে এসবের বিচার হওয়া উচিত। এমনকি এসিড নিক্ষেপের মতো কঠিন আইনটি যদি এ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় তাহলে হয়তো এ ধরনের নির্যাতন কিছুটা হলেও কমে যেতো।
মূলত এর কোনোটাই আমাদের কাম্য নয়। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব থাকবে, মূল্যবোধ থাকবে, কোনো হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা থাকবে নাÑ একটি সুন্দর পবিত্র মন নিয়ে সুবিশাল এই সুন্দর পৃথিবীকে দেখবে, মানুষ মানুষের উপকারে আসবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ayubahmedd@gmail.com
Ref: http://www.jaijaidin.com/printversion.php?nid=79482
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাদম্বরী ঘটনার অন্তরালে ২
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাদম্বরী
ঘটনার অন্তরালে ২
ছাদের উপর কাদম্বরীর সাজানো বাগানে সন্ধ্যাবেলা বসত পরিপাটী গানের আসর। মাদুরের ওপর তাকিয়া, রুপোর রেকাবে ভিজে রুমালের ওপর বেলীফুলের গোড়ের মালা, গ্লাসভর্তি বরফপানি, বাটা ভর্তি ছাচি পান সাজানো থাকতো সবার জন্য। কাদম্বরী সেজে গুজে বসতেন সেখানে, জ্যোতিরিন্দ্র বাজাতেন বেহালা, রবীন্দ্রনাথ ধরতেন গান, যার আবেশ হয়তো সে ছাদকে অতিক্রম করে আরো চারধার ছুয়ে যেতো, “ফুলের বনে যার পাশে যাই, তারেই লাগে ভালো .........”। কিশোর রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক সৌন্দর্য চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে এই পরিবেশ, এই সৌন্দর্য দৃষ্টি কল্পনার একান্ত প্রয়োজন ছিল, যা আমরা পরে রবীন্দ্রনাথের লেখায় ফিরে ফিরে দেখতে পাই। কাদম্বরী নিজেও ভালো গায়িকা ছিলেন, বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ জগন্মোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের পৌত্রী তিনি, গান ছিল তার রক্তে। তিনি আসার সাথে সাথে তিনতলায় শুধু পিয়ানো আসেনি, জ্যোতিরিন্দ্রের আর রবীন্দ্রনাথের অনুশীলনও শুরু হয়ে গিয়েছিল। শুধু গানই ছিলো না, সেখানে বসত রীতিমতো সাহিত্যপাঠের আসর। আসরে যোগ দিতেন বাড়ীর অনেকে, বাইরে থেকে আসতেন অক্ষয় চৌধুরী ও তার স্ত্রী শরৎকুমারী, জানকীনাথ, আর মাঝে মাঝে আসতেন কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী। জ্যোতিরিন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও স্বর্নকুমারী ছিলেন এই সভার স্থায়ী সদস্য। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী’র কবিতা কাদম্বরী খুব ভালোবাসতেন। তাকে প্রায়ই দাওয়াত করে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতেন তিনি, কবির নিজের কবিতার কয়েকটি লাইন লিখে, আসন বুনে কবিকে উপহার দেন কাদম্বরী দেবী।
কাদম্বরী একজন সুঅভিনেত্রীও ছিলেন। নাট্যরসিক জ্যোতিরিন্দ্রের মন আরো উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল গুনবতী স্ত্রীকে পেয়ে। একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে মাটির উঠোনে জ্যোতিরিন্দ্রের লেখা প্রহসন “এমন কর্ম আর করব না”তে প্রথম অভিনয় করলেন কাদম্বরী। রবীন্দ্রনাথ নায়কের ভূমিকায় ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিলেত যাত্রার আগে এই প্রহসনটি সফলভাবে অভিনীত হয়। এরপরে “বসন্ত উৎসব” , “মানময়ী”তেও কাদম্বরী ভাল অভিনয় করেছিলেন। কাদম্বরীর প্রধান পরিচয় তিনি অসাধারন একজন সাহিত্য প্রেমিক ছিলেন। তিনি শুধু সময় কাটাবার জন্য বই পড়তেন না, তিনি এক কথায় সেগুলোকে উপভোগ করতেন। তবে নিজে পড়ার চেয়ে শুনতে ভালোবাসতেন বেশী। দুপুরে রবীন্দ্রনাথ পড়ে শোনাতেন তাকে, হাত পাখা নিয়ে হাওয়া করতেন কাদম্বরী। “ভারতী” পত্রিকা নিয়েও তার ভাবনা ছিল। ছাপার হরফে “ভারতী”তে কোথাও তার নাম নেই সত্যিই কিন্তু তিনিই ছিলেন ওই পত্রিকার প্রান। তিনি মারা যাওয়ার পর সেটা আরো প্রকট হয়ে সকলের কাছে ধরা পড়ে। দ্বিজেন্দ্রনাথ সম্পাদক, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দেখাশোনা করতেন, রবীন্দ্রনাথ লিখতেন তাহলে কাদম্বরী কি করতেন? শরৎকুমারীর ভাষায়, তিনি ছিলেন “ফুলের তোড়ার বাধন”। সবাইকে একসঙ্গে তিনি বেধে রাখতেন, সবার অলক্ষ্যে। বাধন যেদিন ছিড়ল, সেদিনই সবাই সেটি অনুভব করল।
রবীন্দ্রমানস গঠনে এই নারীর দান চিরস্মরনীয়। তার কবি হয়ে ওঠার মূলে আন্তরিক চেষ্টায় ছিলেন কাদম্বরী। কাদম্বরী সব সময় রবীন্দ্রনাথকে উসকে দিতেন, “ রবি সবচেয়ে কালো দেখতে, গলার যে কি অবস্থা, ওর চেয়ে সত্য ভালো গায়, ও কোনদিন গাইতেই পারবে না”। আরো বলতেন, “কোনকালে বিহারী চক্রবর্তীর মতো লিখতেও পারবে না”। রবীন্দ্রনাথের তখন শুধু চেষ্টা থাকতো কি করে এমন হবেন যে, বউদিদি আর কোন দোষ খুজে পাবেন না তার মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ তখন বুঝতে পারতেন না, সেই সাধনাটিই করছে কাদম্বরী, যাতে কেউ কোনদিন রবীন্দ্রনাথের দোষ খুজে না পায়। যখন রবীন্দ্রনাথ এটি উপলব্ধি করলেন তখন চিরতরে হারিয়ে গেছেন বউদিদি। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার প্রদীপে তেল সলতে লাগিয়ে আলো জ্বালাবার কাজ তখন সারা। কিন্তু প্রিয় বউদিদি তখন চির অন্ধকারে, হয়তো তাই কবির কন্ঠে বাজে,
নয়ন সমুখে তুমি নাই
নয়নেরই মাঝখানে নিয়েছো যে ঠাই
রবীন্দ্রনাথের বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই তার অকাল মৃত্যু হয়। ঘটনাটা আকস্মিক হলেও অভাবনীয় নয়। তীব্র অভিমানীনি কাদম্বরী এর আগেও আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। তিনি প্রচন্ড ইন্ট্রোভার্ট, সেন্টিমেন্টাল ও স্কিজোফ্রেনিক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়তো তার মন বেদনার একটা কারন ছিল কিন্তু সেটার কারন বালিকা মৃনালিনী ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে কাদম্বরীর বিপুল উৎসাহ ছিল। কিন্তু তারপর আকস্মিকভাবেই তিনি চুপ করে গেলেন, কেনো? তাহলে কি পাত্রী নির্বাচন নিয়ে মতান্তর হয়েছিল তার কারো সাথে? ভবতারিণীকে মৃনালিনী করে তোলার ভার নীপময়ী মতান্তরে জ্ঞানদানন্দিনী পেলেন কেনো? প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, “কাদম্বরীর আকস্মিক মৃত্যুর কারন হচ্ছে, মহিলাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের পরিনাম”। সম্ভবত জ্ঞানদানন্দিনীর সাথেই তার মতান্তর হয়। হয়তো আরো কারন ছিল। কিন্তু বহিঃপ্রকাশ ঘটল এই সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এই সুরসিকা, রুচিশীলা, প্রতিভাময়ী নারীর জীবনেও শান্তির অভাব ছিল। সন্তানহীনতার ব্যাথা তার এই অভিমানকে হয়তো আরো তীব্র করে তুলেছিল। সেকালে বন্ধ্যা নারী ছিলেন উপেক্ষার পাত্রী। সমাজে সংসারে কোথাও তার তেমন কোন কদর ছিল না। কাদম্বরীও ঠাকুরবাড়ীর বৃহৎ সংসারে তার নিজের যথার্থ স্থানটি কখনও পাননি। নিজের এই মর্মজ্বালার কথা তিনি কাউকে প্রকাশ করে বলতেও পারেন নি। এই জন্য কাদম্বরীর মৃত্যুর পর সমসাময়িক অনেক লেখক কবিই তাদের লেখায় জ্যোতিরিন্দ্রকে দায়ী করেছিল। নিঃসন্তান স্ত্রীর শুন্যতা ভরিয়ে দেয়ার জন্য স্বামীর যতোখানি মনোযোগের প্রয়োজন ছিল তিনি হয়তো তা ছিলেন না।
(চলবে)
০৪.০৭.০৮
ঘটনার অন্তরালে ২
ছাদের উপর কাদম্বরীর সাজানো বাগানে সন্ধ্যাবেলা বসত পরিপাটী গানের আসর। মাদুরের ওপর তাকিয়া, রুপোর রেকাবে ভিজে রুমালের ওপর বেলীফুলের গোড়ের মালা, গ্লাসভর্তি বরফপানি, বাটা ভর্তি ছাচি পান সাজানো থাকতো সবার জন্য। কাদম্বরী সেজে গুজে বসতেন সেখানে, জ্যোতিরিন্দ্র বাজাতেন বেহালা, রবীন্দ্রনাথ ধরতেন গান, যার আবেশ হয়তো সে ছাদকে অতিক্রম করে আরো চারধার ছুয়ে যেতো, “ফুলের বনে যার পাশে যাই, তারেই লাগে ভালো .........”। কিশোর রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক সৌন্দর্য চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে এই পরিবেশ, এই সৌন্দর্য দৃষ্টি কল্পনার একান্ত প্রয়োজন ছিল, যা আমরা পরে রবীন্দ্রনাথের লেখায় ফিরে ফিরে দেখতে পাই। কাদম্বরী নিজেও ভালো গায়িকা ছিলেন, বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ জগন্মোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের পৌত্রী তিনি, গান ছিল তার রক্তে। তিনি আসার সাথে সাথে তিনতলায় শুধু পিয়ানো আসেনি, জ্যোতিরিন্দ্রের আর রবীন্দ্রনাথের অনুশীলনও শুরু হয়ে গিয়েছিল। শুধু গানই ছিলো না, সেখানে বসত রীতিমতো সাহিত্যপাঠের আসর। আসরে যোগ দিতেন বাড়ীর অনেকে, বাইরে থেকে আসতেন অক্ষয় চৌধুরী ও তার স্ত্রী শরৎকুমারী, জানকীনাথ, আর মাঝে মাঝে আসতেন কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী। জ্যোতিরিন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও স্বর্নকুমারী ছিলেন এই সভার স্থায়ী সদস্য। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী’র কবিতা কাদম্বরী খুব ভালোবাসতেন। তাকে প্রায়ই দাওয়াত করে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতেন তিনি, কবির নিজের কবিতার কয়েকটি লাইন লিখে, আসন বুনে কবিকে উপহার দেন কাদম্বরী দেবী।
কাদম্বরী একজন সুঅভিনেত্রীও ছিলেন। নাট্যরসিক জ্যোতিরিন্দ্রের মন আরো উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল গুনবতী স্ত্রীকে পেয়ে। একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে মাটির উঠোনে জ্যোতিরিন্দ্রের লেখা প্রহসন “এমন কর্ম আর করব না”তে প্রথম অভিনয় করলেন কাদম্বরী। রবীন্দ্রনাথ নায়কের ভূমিকায় ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিলেত যাত্রার আগে এই প্রহসনটি সফলভাবে অভিনীত হয়। এরপরে “বসন্ত উৎসব” , “মানময়ী”তেও কাদম্বরী ভাল অভিনয় করেছিলেন। কাদম্বরীর প্রধান পরিচয় তিনি অসাধারন একজন সাহিত্য প্রেমিক ছিলেন। তিনি শুধু সময় কাটাবার জন্য বই পড়তেন না, তিনি এক কথায় সেগুলোকে উপভোগ করতেন। তবে নিজে পড়ার চেয়ে শুনতে ভালোবাসতেন বেশী। দুপুরে রবীন্দ্রনাথ পড়ে শোনাতেন তাকে, হাত পাখা নিয়ে হাওয়া করতেন কাদম্বরী। “ভারতী” পত্রিকা নিয়েও তার ভাবনা ছিল। ছাপার হরফে “ভারতী”তে কোথাও তার নাম নেই সত্যিই কিন্তু তিনিই ছিলেন ওই পত্রিকার প্রান। তিনি মারা যাওয়ার পর সেটা আরো প্রকট হয়ে সকলের কাছে ধরা পড়ে। দ্বিজেন্দ্রনাথ সম্পাদক, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দেখাশোনা করতেন, রবীন্দ্রনাথ লিখতেন তাহলে কাদম্বরী কি করতেন? শরৎকুমারীর ভাষায়, তিনি ছিলেন “ফুলের তোড়ার বাধন”। সবাইকে একসঙ্গে তিনি বেধে রাখতেন, সবার অলক্ষ্যে। বাধন যেদিন ছিড়ল, সেদিনই সবাই সেটি অনুভব করল।
রবীন্দ্রমানস গঠনে এই নারীর দান চিরস্মরনীয়। তার কবি হয়ে ওঠার মূলে আন্তরিক চেষ্টায় ছিলেন কাদম্বরী। কাদম্বরী সব সময় রবীন্দ্রনাথকে উসকে দিতেন, “ রবি সবচেয়ে কালো দেখতে, গলার যে কি অবস্থা, ওর চেয়ে সত্য ভালো গায়, ও কোনদিন গাইতেই পারবে না”। আরো বলতেন, “কোনকালে বিহারী চক্রবর্তীর মতো লিখতেও পারবে না”। রবীন্দ্রনাথের তখন শুধু চেষ্টা থাকতো কি করে এমন হবেন যে, বউদিদি আর কোন দোষ খুজে পাবেন না তার মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ তখন বুঝতে পারতেন না, সেই সাধনাটিই করছে কাদম্বরী, যাতে কেউ কোনদিন রবীন্দ্রনাথের দোষ খুজে না পায়। যখন রবীন্দ্রনাথ এটি উপলব্ধি করলেন তখন চিরতরে হারিয়ে গেছেন বউদিদি। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার প্রদীপে তেল সলতে লাগিয়ে আলো জ্বালাবার কাজ তখন সারা। কিন্তু প্রিয় বউদিদি তখন চির অন্ধকারে, হয়তো তাই কবির কন্ঠে বাজে,
নয়ন সমুখে তুমি নাই
নয়নেরই মাঝখানে নিয়েছো যে ঠাই
রবীন্দ্রনাথের বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই তার অকাল মৃত্যু হয়। ঘটনাটা আকস্মিক হলেও অভাবনীয় নয়। তীব্র অভিমানীনি কাদম্বরী এর আগেও আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। তিনি প্রচন্ড ইন্ট্রোভার্ট, সেন্টিমেন্টাল ও স্কিজোফ্রেনিক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়তো তার মন বেদনার একটা কারন ছিল কিন্তু সেটার কারন বালিকা মৃনালিনী ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে কাদম্বরীর বিপুল উৎসাহ ছিল। কিন্তু তারপর আকস্মিকভাবেই তিনি চুপ করে গেলেন, কেনো? তাহলে কি পাত্রী নির্বাচন নিয়ে মতান্তর হয়েছিল তার কারো সাথে? ভবতারিণীকে মৃনালিনী করে তোলার ভার নীপময়ী মতান্তরে জ্ঞানদানন্দিনী পেলেন কেনো? প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, “কাদম্বরীর আকস্মিক মৃত্যুর কারন হচ্ছে, মহিলাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের পরিনাম”। সম্ভবত জ্ঞানদানন্দিনীর সাথেই তার মতান্তর হয়। হয়তো আরো কারন ছিল। কিন্তু বহিঃপ্রকাশ ঘটল এই সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এই সুরসিকা, রুচিশীলা, প্রতিভাময়ী নারীর জীবনেও শান্তির অভাব ছিল। সন্তানহীনতার ব্যাথা তার এই অভিমানকে হয়তো আরো তীব্র করে তুলেছিল। সেকালে বন্ধ্যা নারী ছিলেন উপেক্ষার পাত্রী। সমাজে সংসারে কোথাও তার তেমন কোন কদর ছিল না। কাদম্বরীও ঠাকুরবাড়ীর বৃহৎ সংসারে তার নিজের যথার্থ স্থানটি কখনও পাননি। নিজের এই মর্মজ্বালার কথা তিনি কাউকে প্রকাশ করে বলতেও পারেন নি। এই জন্য কাদম্বরীর মৃত্যুর পর সমসাময়িক অনেক লেখক কবিই তাদের লেখায় জ্যোতিরিন্দ্রকে দায়ী করেছিল। নিঃসন্তান স্ত্রীর শুন্যতা ভরিয়ে দেয়ার জন্য স্বামীর যতোখানি মনোযোগের প্রয়োজন ছিল তিনি হয়তো তা ছিলেন না।
(চলবে)
০৪.০৭.০৮
৪.৭.০৮
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা :: ওয়াসিম খান পলাশ
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও
কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা
ওয়াসিম খান পলাশ
কেয়ারটেকার সরকার হলো একটি অস্থায়ী সরকার। জনগনের ভোটে নির্বাচিত কোন সরকার তাদের নির্ধারিত মেয়াদ উর্ত্তীন হলে এই অস্থায়ী সরকার অন্তরবর্তীকালীন সময়ের জন্য ক্ষমতা গ্রহন করে। তাদের প্রধান কাজ হলো একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যামে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে বলা হয় চীফ এডভাইজার। প্রেসিডেন্ট দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে তাদের পছন্দ মত নিরপেক্ষ কোন ব্যক্তিকে চীফ এডভাইজার নিয়োগ দিয়ে থাকেন। চীফ এডভাইজার আবার প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টরে তার প্রয়োজন মত এডভাইজার নিয়োগ দিয়ে থাকেন। যদি কোন কারনে রাজনৈতিক দলগুলো কোন ব্যাক্তিকে মনোনীত করতে ব্যর্থ হয় সে ক্ষেত্রে দেশের প্রেসিডেণ্ট তার পছন্দ মত যে কাউকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন।
১৯৯০ সালে প্রথমবারের মত বাংলাদেশের ইতিহাসে কেয়ার টেকার সরকার পদ্ধতি চালু হয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামাতের সর্ম্মিলিত দাবীর প্রেক্ষিতে কেয়ার টেকার সরকার পদ্ধতি চালু হয়। পরবর্তীতে জাতীয় সংসদে আইনটি পাশ করা হয়। বাংলাদেশের প্রথম কেয়ার টেকার সরকারের প্রধান ছিলেন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জনাব শাহাবুদ্দীন আহমেদ। তার তত্ত্বাবধানে ১৯৯১ সালে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান হন।তার অধিনে নির্বাচনে বিএনপি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠা লাভ করে এবং স রকার গঠন করে। ২০০৬ সালে চতুর্থবারের মতো কেয়ারটেকার সরকার গঠিত হয়। ফকরুদ্দীন আহমেদ ও তার দশজন এডভাইজার অন্তরর্বতীকালীন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার এডভাইজার পরিবর্তন ও পুননিয়োগ দেয়া ।
বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যক্রম অতীতের তিনটি তত্ত্বাবধায়ক থেকে অনেকটা ভিন্ন । দায়িত্ব গ্রহনের পর পরই সরকার দূর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়। এবং সেন্ট্রাল ব্যাংকের মাধ্যমে সন্দেহ ভাজনদের ব্যাংক একাউন্টের লেনদেনের বৈধতা ও সঞ্চিত ুঅর্থ বৈধ উপায়ে অর্জিত কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। এতেই কেচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসলো । দলের নেত্রী সহ বিগত সরকার গুলোর মন্ত্রী, পার্টির নেতা, দলীয় কর্মী ও তাদের আত্বীয় স্বজনরা অবৈধ উপায়ে শত শত কোটি টাকার সম্পদের লুটপাট ধরা পড়ে যায়। দেশে-বিদেশে বিলাস বহুল বাড়ি,বিদেশি ব্যাংকে নামে-বেনামে শত, হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি জাতির কাছে ফাস হয়ে যায়। এই প্রথম বারের মত জাতি জানতে পারলো, জনগন এতদিন যাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছেন,গরীব জনগন যাদের কাছে দেশটি আমানত রেখেছেন আর তারাই কিনা ভিতরে ভিতরে লুটেপুটে খাচ্ছে। আন্তজার্তিক পরিসংখানে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই দুর্নীতিতে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে নাম লিখিয়েছে। দেশের অসহায় জনগন জেনেও দুর্নীতিবাজদের বিচার চাওয়ার সাহস পায়নি। কার কাছেই বা বিচার চাইবে জনগন । চারিদিকে, সর্বোচ্চ লেবেল পর্যন্ত এদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। এমনকি বিচার বিভাগও ছিল এদের হাতে।
একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রথম ও প্রধান শর্ত একটি সুষ্ঠ গনতান্ত্রিক শাসন ব্যাবস্থা, রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি সন্মান ও শ্রদ্ধা। বাংলাদেশে এখন দরকার একটি অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে গনতান্ত্রিক পক্রি য়া চালু করা। আর সত্যিকার দুর্নীতিবাজদের বিচার কার্য সম্পন্ন করা। দুর্নীতিবাজদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করা না গেলে পরবর্তীতে এদের দল ক্ষমতায় গেলে এরা পার পেয়ে যাবে। ফলে সোনার বাংলা আবার বিশ্ব মান চিত্রে দূর্নীতিতে প্রথম স্থান অধিকার করবে।
বাংলাদেশের রাজনীতি বরাবই উত্তপ্ত। রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই সুস্থ রাজনৈতিক কাঠামো ও রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরী করতে পারেনি। স্বদিচ্ছার অভাব, পরস্পর রেষারেষি, প্রতিটি সেক্টরে দূনীতি, সরকারি অর্থ লোপাট, চাদাবাজি, সন্ত্রাস এসব কারনে দেশ আজ নিয়ন্ত্রনহীন। যে দেশের রাজনীতিবিদরাই চরম দূনীতিবাজ, হাজার হাজার কোটি টাকা লুট-পাট করে দেশে-বিদেশে বিলাস- বহুল প্রাসাদ, কোটি টাকার গাড়ী আর বিদেশী ব্যাংকে দেশীয় রিজার্ভ পাচার করেছেন আর যাই হোক তারা দেশের উন্নয়ন কখনোই চিন্তা করতে পারেন না।খেটে খাওয়া সাধারন মানুষ আর জাতির সাথে তারা বেঈমানি করেছেন। আজ যদি তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়ও ,তারপরও স্বদিচ্ছা নিয়ে এগুলে এ দেশ ঠিক হতে অনেক বছর লেগে যেতে পারে । প্রশাসন আর দলের তৃনমূল পর্যায় পর্যন্ত যে দুর্নীতির বীজ ছড়িয়ে গেছে, এই মহামারী ঠেকাতে আর দেরি না করে এখনই জাতিকে যোগ্য ব্যক্তির সন্ধান করতে হবে। ভাল , পেশাজীবি ও সন্মান জনক পেশার লোকদের রাজনীতিতে প্রবেশ এবং নির্বাচনে অংশগ্রহন আইন পাশ করতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেকটি ব্যাপার অত্যন্ত জরুরী তা হলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিদের একটি শিক্ষাগত নির্ধারন করা। তবে সবকিছুই গনতান্ত্রিক ধারায় হতে হবে।
পৃথিবীর মানচিত্রে অত্যন্ত ক্ষুদ্র এই দেশটি বিশাল জনসংখ্যার ভারে এমনিতেই ক্লান্ত। তার উপর মহামারী,খড়া, বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগে প্রতিনিয়ত অত্যাচারিত। মানুষ না খেয়ে, অর্ধানাহারে দিন যাপন করে। নেই নিজস্ব জমি, মাথা গোজার বাসস্থান। আর শিক্ষা। শিক্ষার কথা এরা চিন্তাই করতে পারে না।
ক্ষুধা এদের শিক্ষাকে স্পর্শ করতে পারেনি। অনেকে কাজের আশায় চলে যান দুরের কোন শহরে, আবাস গারেন স্যাতস্যাতে দুর্গন্ধময় কোন বস্তিতে। জীবিকা হিসাবে বেছে নেন দিন মজুরের কাজ – যোগালি, রিকশাচালক বা গার্মন্টের শ্রমিক হিসাবে।
যে দেশে এত সমস্যা, এত কিছুর অভাব, সম্পদ বলতে কিছুই নেই , গ্যাস যা ছিল তাও আবার শেষ হয়ে আসছে। আর সেদেশের রাজনীতিবিদরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনিদের পর্যায়ে। কোন মুলধন ছাড়াই শ্রেষ্ঠ হওয়া যায়।
ছোট বেলায় স্কুল লেভেলে পড়ার সময় সবার ভিতর একটা ্স্বপ্ন থাকে। যাকে বলে এইম ইন লাইফ। আমাদের স্কুল জীবনেও বিভিন্ন সময় শিক্ষকরা বা নিজেরাই একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করতাম বড় হয়ে কে কি হবে। কেউ বিজ্ঞানী, কেউ ডাক্তার, কেউবা ইঞ্জিনিয়ার আবার কেঊ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এখনো তাই । ব্যাতিক্রম শুধুমাত্র রাজনীতিবিদের বেলায়। রাজনীতিবিদরা তাদের ছেলেবেলায় কি কখনো ভেবেছিলেন তারা বড় হয়ে রাজনীতিবিদ হবেন, তা না হয় ভাবলেনই, ভাবতেই পারেন। কিন্তু তারা কখনো কি ভেবেছেন মানুষ খুন করে, দেশের সম্পদ লুট করে কোটিপতি হবেন। কোন দিনও না। ঐ বয়সটাতে এরকম চিন্তা আসতে পারেই না। যারা মেধাবী তারা তো ঠিকই দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রী নিয়ে কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বিজ্ঞানী আবার কেউ বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে ,কেউবা প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
তাহলে রাজনীতি করছেন কারা। সাধারন মানের লোকগুলো, যারা মেধার দিক দিয়ে ইতিমধ্যেই ছিটকে পড়েছেন তারা। তাদের দূরদর্শিতাই বা কতটুকু। একজন ভালো ছাত্র হতে গেলে যেমন একাডেমিক পরিক্ষায় ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করতে হয়,একাডেমিক সার্টিফিকেট থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ্দের কজনের এরকম ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্টের সার্টিফিকেট আছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধরা হয় যে যত বেশী বছর রাজনীতি করেছেন সে তত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, সে রাজনীতিতে বুদ্ধিজীবি। আসলে এ ধারনাটা ভুল। বাসায় বই পড়ে বা অভিজ্ঞতা দিয়ে যদি বুদ্ধির মান দন্ড নির্ধারন করা যেত তাহলে প রীক্ষায় পাশ ফেলের ব্যাপার থাকতো না। জ্ঞানের পরিধিটা আসলে একাডেমিক পরীক্ষার মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়। একসেপশনাল কোন কিছুকে যদি উদাহারন হিসেবে ধরা হয় তাহলে সেটা হবে মহা ভূল।
আমাদের নেত্রীরা ক্ষমতায় থাকাকালে বিদেশ থেকে অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রী পেয়েছেন। তাদের এই অনারারী ডক্টরেট ডিগ্রীর মাপকাঠি জাতিই যাচাই করবেন আশা করি। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে,বড় আয়োজন করে, বিশাল বাহিনী নিয়ে ডিগ্রী আনতে গিয়েছিলেন তারা। পৃথিবীর একটি অনুন্নত ও গরীব দেশের মানুষেরা ভেবেছিলেন এই বুঝি এগুতে শুরু করলো দেশ।।মনে আশার হাতছানি। কেইবা ভেবেছিলো এই আশার আলোর পিছনে ছিল তাদের অদৃশ্য থাবা।
আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের অনেকেরই কিন্তু নিজেদের সন্তানদের রাজনীতিবিদ বানানোর ইচ্ছে পোষন করেন। অনেকে আবার নিজের বখে যাওয়া সন্তানকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। অনেকটা বখে যাওয়া সন্তানকে যদি রাজনীতিতে প্রোভাইড করার চেষ্টা করেন তাহলে দেশের উন্নতি কিভাবে হবে। কিভাবে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি হবে। তাহলে কি আমরা আর আমাদের ইতিহাস লিখতে পারবো না। স্বাধীনতার ৩৭ টি বছর কি তাহলে ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসেবে লিপিবদ্ধ হবে। ভারতীয় উপমহাদেশে এক সময় যে জাদরেল ও যোগ্য রাজনীতিবিদ তৈরী হয়েছিল সেই স্বর্নযুগ হয়তো আর কখনোই ফিরে আসবে না।
Mail : polashsl@yahoo.fr
প্যারিস . ০২.০৭.০৮
কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা
ওয়াসিম খান পলাশ
কেয়ারটেকার সরকার হলো একটি অস্থায়ী সরকার। জনগনের ভোটে নির্বাচিত কোন সরকার তাদের নির্ধারিত মেয়াদ উর্ত্তীন হলে এই অস্থায়ী সরকার অন্তরবর্তীকালীন সময়ের জন্য ক্ষমতা গ্রহন করে। তাদের প্রধান কাজ হলো একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যামে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে বলা হয় চীফ এডভাইজার। প্রেসিডেন্ট দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে তাদের পছন্দ মত নিরপেক্ষ কোন ব্যক্তিকে চীফ এডভাইজার নিয়োগ দিয়ে থাকেন। চীফ এডভাইজার আবার প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টরে তার প্রয়োজন মত এডভাইজার নিয়োগ দিয়ে থাকেন। যদি কোন কারনে রাজনৈতিক দলগুলো কোন ব্যাক্তিকে মনোনীত করতে ব্যর্থ হয় সে ক্ষেত্রে দেশের প্রেসিডেণ্ট তার পছন্দ মত যে কাউকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন।
১৯৯০ সালে প্রথমবারের মত বাংলাদেশের ইতিহাসে কেয়ার টেকার সরকার পদ্ধতি চালু হয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামাতের সর্ম্মিলিত দাবীর প্রেক্ষিতে কেয়ার টেকার সরকার পদ্ধতি চালু হয়। পরবর্তীতে জাতীয় সংসদে আইনটি পাশ করা হয়। বাংলাদেশের প্রথম কেয়ার টেকার সরকারের প্রধান ছিলেন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জনাব শাহাবুদ্দীন আহমেদ। তার তত্ত্বাবধানে ১৯৯১ সালে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান হন।তার অধিনে নির্বাচনে বিএনপি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠা লাভ করে এবং স রকার গঠন করে। ২০০৬ সালে চতুর্থবারের মতো কেয়ারটেকার সরকার গঠিত হয়। ফকরুদ্দীন আহমেদ ও তার দশজন এডভাইজার অন্তরর্বতীকালীন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার এডভাইজার পরিবর্তন ও পুননিয়োগ দেয়া ।
বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যক্রম অতীতের তিনটি তত্ত্বাবধায়ক থেকে অনেকটা ভিন্ন । দায়িত্ব গ্রহনের পর পরই সরকার দূর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়। এবং সেন্ট্রাল ব্যাংকের মাধ্যমে সন্দেহ ভাজনদের ব্যাংক একাউন্টের লেনদেনের বৈধতা ও সঞ্চিত ুঅর্থ বৈধ উপায়ে অর্জিত কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। এতেই কেচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসলো । দলের নেত্রী সহ বিগত সরকার গুলোর মন্ত্রী, পার্টির নেতা, দলীয় কর্মী ও তাদের আত্বীয় স্বজনরা অবৈধ উপায়ে শত শত কোটি টাকার সম্পদের লুটপাট ধরা পড়ে যায়। দেশে-বিদেশে বিলাস বহুল বাড়ি,বিদেশি ব্যাংকে নামে-বেনামে শত, হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি জাতির কাছে ফাস হয়ে যায়। এই প্রথম বারের মত জাতি জানতে পারলো, জনগন এতদিন যাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছেন,গরীব জনগন যাদের কাছে দেশটি আমানত রেখেছেন আর তারাই কিনা ভিতরে ভিতরে লুটেপুটে খাচ্ছে। আন্তজার্তিক পরিসংখানে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই দুর্নীতিতে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে নাম লিখিয়েছে। দেশের অসহায় জনগন জেনেও দুর্নীতিবাজদের বিচার চাওয়ার সাহস পায়নি। কার কাছেই বা বিচার চাইবে জনগন । চারিদিকে, সর্বোচ্চ লেবেল পর্যন্ত এদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। এমনকি বিচার বিভাগও ছিল এদের হাতে।
একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রথম ও প্রধান শর্ত একটি সুষ্ঠ গনতান্ত্রিক শাসন ব্যাবস্থা, রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি সন্মান ও শ্রদ্ধা। বাংলাদেশে এখন দরকার একটি অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে গনতান্ত্রিক পক্রি য়া চালু করা। আর সত্যিকার দুর্নীতিবাজদের বিচার কার্য সম্পন্ন করা। দুর্নীতিবাজদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করা না গেলে পরবর্তীতে এদের দল ক্ষমতায় গেলে এরা পার পেয়ে যাবে। ফলে সোনার বাংলা আবার বিশ্ব মান চিত্রে দূর্নীতিতে প্রথম স্থান অধিকার করবে।
বাংলাদেশের রাজনীতি বরাবই উত্তপ্ত। রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই সুস্থ রাজনৈতিক কাঠামো ও রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরী করতে পারেনি। স্বদিচ্ছার অভাব, পরস্পর রেষারেষি, প্রতিটি সেক্টরে দূনীতি, সরকারি অর্থ লোপাট, চাদাবাজি, সন্ত্রাস এসব কারনে দেশ আজ নিয়ন্ত্রনহীন। যে দেশের রাজনীতিবিদরাই চরম দূনীতিবাজ, হাজার হাজার কোটি টাকা লুট-পাট করে দেশে-বিদেশে বিলাস- বহুল প্রাসাদ, কোটি টাকার গাড়ী আর বিদেশী ব্যাংকে দেশীয় রিজার্ভ পাচার করেছেন আর যাই হোক তারা দেশের উন্নয়ন কখনোই চিন্তা করতে পারেন না।খেটে খাওয়া সাধারন মানুষ আর জাতির সাথে তারা বেঈমানি করেছেন। আজ যদি তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়ও ,তারপরও স্বদিচ্ছা নিয়ে এগুলে এ দেশ ঠিক হতে অনেক বছর লেগে যেতে পারে । প্রশাসন আর দলের তৃনমূল পর্যায় পর্যন্ত যে দুর্নীতির বীজ ছড়িয়ে গেছে, এই মহামারী ঠেকাতে আর দেরি না করে এখনই জাতিকে যোগ্য ব্যক্তির সন্ধান করতে হবে। ভাল , পেশাজীবি ও সন্মান জনক পেশার লোকদের রাজনীতিতে প্রবেশ এবং নির্বাচনে অংশগ্রহন আইন পাশ করতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেকটি ব্যাপার অত্যন্ত জরুরী তা হলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিদের একটি শিক্ষাগত নির্ধারন করা। তবে সবকিছুই গনতান্ত্রিক ধারায় হতে হবে।
পৃথিবীর মানচিত্রে অত্যন্ত ক্ষুদ্র এই দেশটি বিশাল জনসংখ্যার ভারে এমনিতেই ক্লান্ত। তার উপর মহামারী,খড়া, বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগে প্রতিনিয়ত অত্যাচারিত। মানুষ না খেয়ে, অর্ধানাহারে দিন যাপন করে। নেই নিজস্ব জমি, মাথা গোজার বাসস্থান। আর শিক্ষা। শিক্ষার কথা এরা চিন্তাই করতে পারে না।
ক্ষুধা এদের শিক্ষাকে স্পর্শ করতে পারেনি। অনেকে কাজের আশায় চলে যান দুরের কোন শহরে, আবাস গারেন স্যাতস্যাতে দুর্গন্ধময় কোন বস্তিতে। জীবিকা হিসাবে বেছে নেন দিন মজুরের কাজ – যোগালি, রিকশাচালক বা গার্মন্টের শ্রমিক হিসাবে।
যে দেশে এত সমস্যা, এত কিছুর অভাব, সম্পদ বলতে কিছুই নেই , গ্যাস যা ছিল তাও আবার শেষ হয়ে আসছে। আর সেদেশের রাজনীতিবিদরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনিদের পর্যায়ে। কোন মুলধন ছাড়াই শ্রেষ্ঠ হওয়া যায়।
ছোট বেলায় স্কুল লেভেলে পড়ার সময় সবার ভিতর একটা ্স্বপ্ন থাকে। যাকে বলে এইম ইন লাইফ। আমাদের স্কুল জীবনেও বিভিন্ন সময় শিক্ষকরা বা নিজেরাই একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করতাম বড় হয়ে কে কি হবে। কেউ বিজ্ঞানী, কেউ ডাক্তার, কেউবা ইঞ্জিনিয়ার আবার কেঊ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এখনো তাই । ব্যাতিক্রম শুধুমাত্র রাজনীতিবিদের বেলায়। রাজনীতিবিদরা তাদের ছেলেবেলায় কি কখনো ভেবেছিলেন তারা বড় হয়ে রাজনীতিবিদ হবেন, তা না হয় ভাবলেনই, ভাবতেই পারেন। কিন্তু তারা কখনো কি ভেবেছেন মানুষ খুন করে, দেশের সম্পদ লুট করে কোটিপতি হবেন। কোন দিনও না। ঐ বয়সটাতে এরকম চিন্তা আসতে পারেই না। যারা মেধাবী তারা তো ঠিকই দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রী নিয়ে কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বিজ্ঞানী আবার কেউ বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে ,কেউবা প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
তাহলে রাজনীতি করছেন কারা। সাধারন মানের লোকগুলো, যারা মেধার দিক দিয়ে ইতিমধ্যেই ছিটকে পড়েছেন তারা। তাদের দূরদর্শিতাই বা কতটুকু। একজন ভালো ছাত্র হতে গেলে যেমন একাডেমিক পরিক্ষায় ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করতে হয়,একাডেমিক সার্টিফিকেট থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ্দের কজনের এরকম ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্টের সার্টিফিকেট আছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধরা হয় যে যত বেশী বছর রাজনীতি করেছেন সে তত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, সে রাজনীতিতে বুদ্ধিজীবি। আসলে এ ধারনাটা ভুল। বাসায় বই পড়ে বা অভিজ্ঞতা দিয়ে যদি বুদ্ধির মান দন্ড নির্ধারন করা যেত তাহলে প রীক্ষায় পাশ ফেলের ব্যাপার থাকতো না। জ্ঞানের পরিধিটা আসলে একাডেমিক পরীক্ষার মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়। একসেপশনাল কোন কিছুকে যদি উদাহারন হিসেবে ধরা হয় তাহলে সেটা হবে মহা ভূল।
আমাদের নেত্রীরা ক্ষমতায় থাকাকালে বিদেশ থেকে অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রী পেয়েছেন। তাদের এই অনারারী ডক্টরেট ডিগ্রীর মাপকাঠি জাতিই যাচাই করবেন আশা করি। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে,বড় আয়োজন করে, বিশাল বাহিনী নিয়ে ডিগ্রী আনতে গিয়েছিলেন তারা। পৃথিবীর একটি অনুন্নত ও গরীব দেশের মানুষেরা ভেবেছিলেন এই বুঝি এগুতে শুরু করলো দেশ।।মনে আশার হাতছানি। কেইবা ভেবেছিলো এই আশার আলোর পিছনে ছিল তাদের অদৃশ্য থাবা।
আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের অনেকেরই কিন্তু নিজেদের সন্তানদের রাজনীতিবিদ বানানোর ইচ্ছে পোষন করেন। অনেকে আবার নিজের বখে যাওয়া সন্তানকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। অনেকটা বখে যাওয়া সন্তানকে যদি রাজনীতিতে প্রোভাইড করার চেষ্টা করেন তাহলে দেশের উন্নতি কিভাবে হবে। কিভাবে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি হবে। তাহলে কি আমরা আর আমাদের ইতিহাস লিখতে পারবো না। স্বাধীনতার ৩৭ টি বছর কি তাহলে ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসেবে লিপিবদ্ধ হবে। ভারতীয় উপমহাদেশে এক সময় যে জাদরেল ও যোগ্য রাজনীতিবিদ তৈরী হয়েছিল সেই স্বর্নযুগ হয়তো আর কখনোই ফিরে আসবে না।
Mail : polashsl@yahoo.fr
প্যারিস . ০২.০৭.০৮
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)