৪.৭.০৮

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা :: ওয়াসিম খান পলাশ

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও
কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা


ওয়াসিম খান পলাশ


কেয়ারটেকার সরকার হলো একটি অস্থায়ী সরকার। জনগনের ভোটে নির্বাচিত কোন সরকার তাদের নির্ধারিত মেয়াদ উর্ত্তীন হলে এই অস্থায়ী সরকার অন্তরবর্তীকালীন সময়ের জন্য ক্ষমতা গ্রহন করে। তাদের প্রধান কাজ হলো একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যামে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে বলা হয় চীফ এডভাইজার। প্রেসিডেন্ট দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে তাদের পছন্দ মত নিরপেক্ষ কোন ব্যক্তিকে চীফ এডভাইজার নিয়োগ দিয়ে থাকেন। চীফ এডভাইজার আবার প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টরে তার প্রয়োজন মত এডভাইজার নিয়োগ দিয়ে থাকেন। যদি কোন কারনে রাজনৈতিক দলগুলো কোন ব্যাক্তিকে মনোনীত করতে ব্যর্থ হয় সে ক্ষেত্রে দেশের প্রেসিডেণ্ট তার পছন্দ মত যে কাউকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন।

১৯৯০ সালে প্রথমবারের মত বাংলাদেশের ইতিহাসে কেয়ার টেকার সরকার পদ্ধতি চালু হয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামাতের সর্ম্মিলিত দাবীর প্রেক্ষিতে কেয়ার টেকার সরকার পদ্ধতি চালু হয়। পরবর্তীতে জাতীয় সংসদে আইনটি পাশ করা হয়। বাংলাদেশের প্রথম কেয়ার টেকার সরকারের প্রধান ছিলেন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জনাব শাহাবুদ্দীন আহমেদ। তার তত্ত্বাবধানে ১৯৯১ সালে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান হন।তার অধিনে নির্বাচনে বিএনপি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠা লাভ করে এবং স রকার গঠন করে। ২০০৬ সালে চতুর্থবারের মতো কেয়ারটেকার সরকার গঠিত হয়। ফকরুদ্দীন আহমেদ ও তার দশজন এডভাইজার অন্তরর্বতীকালীন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার এডভাইজার পরিবর্তন ও পুননিয়োগ দেয়া ।

বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যক্রম অতীতের তিনটি তত্ত্বাবধায়ক থেকে অনেকটা ভিন্ন । দায়িত্ব গ্রহনের পর পরই সরকার দূর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়। এবং সেন্ট্রাল ব্যাংকের মাধ্যমে সন্দেহ ভাজনদের ব্যাংক একাউন্টের লেনদেনের বৈধতা ও সঞ্চিত ুঅর্থ বৈধ উপায়ে অর্জিত কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। এতেই কেচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসলো । দলের নেত্রী সহ বিগত সরকার গুলোর মন্ত্রী, পার্টির নেতা, দলীয় কর্মী ও তাদের আত্বীয় স্বজনরা অবৈধ উপায়ে শত শত কোটি টাকার সম্পদের লুটপাট ধরা পড়ে যায়। দেশে-বিদেশে বিলাস বহুল বাড়ি,বিদেশি ব্যাংকে নামে-বেনামে শত, হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি জাতির কাছে ফাস হয়ে যায়। এই প্রথম বারের মত জাতি জানতে পারলো, জনগন এতদিন যাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছেন,গরীব জনগন যাদের কাছে দেশটি আমানত রেখেছেন আর তারাই কিনা ভিতরে ভিতরে লুটেপুটে খাচ্ছে। আন্তজার্তিক পরিসংখানে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই দুর্নীতিতে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে নাম লিখিয়েছে। দেশের অসহায় জনগন জেনেও দুর্নীতিবাজদের বিচার চাওয়ার সাহস পায়নি। কার কাছেই বা বিচার চাইবে জনগন । চারিদিকে, সর্বোচ্চ লেবেল পর্যন্ত এদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। এমনকি বিচার বিভাগও ছিল এদের হাতে।

একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রথম ও প্রধান শর্ত একটি সুষ্ঠ গনতান্ত্রিক শাসন ব্যাবস্থা, রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি সন্মান ও শ্রদ্ধা। বাংলাদেশে এখন দরকার একটি অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে গনতান্ত্রিক পক্রি য়া চালু করা। আর সত্যিকার দুর্নীতিবাজদের বিচার কার্য সম্পন্ন করা। দুর্নীতিবাজদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করা না গেলে পরবর্তীতে এদের দল ক্ষমতায় গেলে এরা পার পেয়ে যাবে। ফলে সোনার বাংলা আবার বিশ্ব মান চিত্রে দূর্নীতিতে প্রথম স্থান অধিকার করবে।

বাংলাদেশের রাজনীতি বরাবই উত্তপ্ত। রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই সুস্থ রাজনৈতিক কাঠামো ও রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরী করতে পারেনি। স্বদিচ্ছার অভাব, পরস্পর রেষারেষি, প্রতিটি সেক্টরে দূনীতি, সরকারি অর্থ লোপাট, চাদাবাজি, সন্ত্রাস এসব কারনে দেশ আজ নিয়ন্ত্রনহীন। যে দেশের রাজনীতিবিদরাই চরম দূনীতিবাজ, হাজার হাজার কোটি টাকা লুট-পাট করে দেশে-বিদেশে বিলাস- বহুল প্রাসাদ, কোটি টাকার গাড়ী আর বিদেশী ব্যাংকে দেশীয় রিজার্ভ পাচার করেছেন আর যাই হোক তারা দেশের উন্নয়ন কখনোই চিন্তা করতে পারেন না।খেটে খাওয়া সাধারন মানুষ আর জাতির সাথে তারা বেঈমানি করেছেন। আজ যদি তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়ও ,তারপরও স্বদিচ্ছা নিয়ে এগুলে এ দেশ ঠিক হতে অনেক বছর লেগে যেতে পারে । প্রশাসন আর দলের তৃনমূল পর্যায় পর্যন্ত যে দুর্নীতির বীজ ছড়িয়ে গেছে, এই মহামারী ঠেকাতে আর দেরি না করে এখনই জাতিকে যোগ্য ব্যক্তির সন্ধান করতে হবে। ভাল , পেশাজীবি ও সন্মান জনক পেশার লোকদের রাজনীতিতে প্রবেশ এবং নির্বাচনে অংশগ্রহন আইন পাশ করতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেকটি ব্যাপার অত্যন্ত জরুরী তা হলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিদের একটি শিক্ষাগত নির্ধারন করা। তবে সবকিছুই গনতান্ত্রিক ধারায় হতে হবে।

পৃথিবীর মানচিত্রে অত্যন্ত ক্ষুদ্র এই দেশটি বিশাল জনসংখ্যার ভারে এমনিতেই ক্লান্ত। তার উপর মহামারী,খড়া, বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগে প্রতিনিয়ত অত্যাচারিত। মানুষ না খেয়ে, অর্ধানাহারে দিন যাপন করে। নেই নিজস্ব জমি, মাথা গোজার বাসস্থান। আর শিক্ষা। শিক্ষার কথা এরা চিন্তাই করতে পারে না।
ক্ষুধা এদের শিক্ষাকে স্পর্শ করতে পারেনি। অনেকে কাজের আশায় চলে যান দুরের কোন শহরে, আবাস গারেন স্যাতস্যাতে দুর্গন্ধময় কোন বস্তিতে। জীবিকা হিসাবে বেছে নেন দিন মজুরের কাজ – যোগালি, রিকশাচালক বা গার্মন্টের শ্রমিক হিসাবে।

যে দেশে এত সমস্যা, এত কিছুর অভাব, সম্পদ বলতে কিছুই নেই , গ্যাস যা ছিল তাও আবার শেষ হয়ে আসছে। আর সেদেশের রাজনীতিবিদরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনিদের পর্যায়ে। কোন মুলধন ছাড়াই শ্রেষ্ঠ হওয়া যায়।

ছোট বেলায় স্কুল লেভেলে পড়ার সময় সবার ভিতর একটা ্স্বপ্ন থাকে। যাকে বলে এইম ইন লাইফ। আমাদের স্কুল জীবনেও বিভিন্ন সময় শিক্ষকরা বা নিজেরাই একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করতাম বড় হয়ে কে কি হবে। কেউ বিজ্ঞানী, কেউ ডাক্তার, কেউবা ইঞ্জিনিয়ার আবার কেঊ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এখনো তাই । ব্যাতিক্রম শুধুমাত্র রাজনীতিবিদের বেলায়। রাজনীতিবিদরা তাদের ছেলেবেলায় কি কখনো ভেবেছিলেন তারা বড় হয়ে রাজনীতিবিদ হবেন, তা না হয় ভাবলেনই, ভাবতেই পারেন। কিন্তু তারা কখনো কি ভেবেছেন মানুষ খুন করে, দেশের সম্পদ লুট করে কোটিপতি হবেন। কোন দিনও না। ঐ বয়সটাতে এরকম চিন্তা আসতে পারেই না। যারা মেধাবী তারা তো ঠিকই দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রী নিয়ে কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বিজ্ঞানী আবার কেউ বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে ,কেউবা প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।

তাহলে রাজনীতি করছেন কারা। সাধারন মানের লোকগুলো, যারা মেধার দিক দিয়ে ইতিমধ্যেই ছিটকে পড়েছেন তারা। তাদের দূরদর্শিতাই বা কতটুকু। একজন ভালো ছাত্র হতে গেলে যেমন একাডেমিক পরিক্ষায় ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করতে হয়,একাডেমিক সার্টিফিকেট থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ্দের কজনের এরকম ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্টের সার্টিফিকেট আছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধরা হয় যে যত বেশী বছর রাজনীতি করেছেন সে তত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, সে রাজনীতিতে বুদ্ধিজীবি। আসলে এ ধারনাটা ভুল। বাসায় বই পড়ে বা অভিজ্ঞতা দিয়ে যদি বুদ্ধির মান দন্ড নির্ধারন করা যেত তাহলে প রীক্ষায় পাশ ফেলের ব্যাপার থাকতো না। জ্ঞানের পরিধিটা আসলে একাডেমিক পরীক্ষার মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়। একসেপশনাল কোন কিছুকে যদি উদাহারন হিসেবে ধরা হয় তাহলে সেটা হবে মহা ভূল।

আমাদের নেত্রীরা ক্ষমতায় থাকাকালে বিদেশ থেকে অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রী পেয়েছেন। তাদের এই অনারারী ডক্টরেট ডিগ্রীর মাপকাঠি জাতিই যাচাই করবেন আশা করি। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে,বড় আয়োজন করে, বিশাল বাহিনী নিয়ে ডিগ্রী আনতে গিয়েছিলেন তারা। পৃথিবীর একটি অনুন্নত ও গরীব দেশের মানুষেরা ভেবেছিলেন এই বুঝি এগুতে শুরু করলো দেশ।।মনে আশার হাতছানি। কেইবা ভেবেছিলো এই আশার আলোর পিছনে ছিল তাদের অদৃশ্য থাবা।


আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের অনেকেরই কিন্তু নিজেদের সন্তানদের রাজনীতিবিদ বানানোর ইচ্ছে পোষন করেন। অনেকে আবার নিজের বখে যাওয়া সন্তানকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। অনেকটা বখে যাওয়া সন্তানকে যদি রাজনীতিতে প্রোভাইড করার চেষ্টা করেন তাহলে দেশের উন্নতি কিভাবে হবে। কিভাবে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি হবে। তাহলে কি আমরা আর আমাদের ইতিহাস লিখতে পারবো না। স্বাধীনতার ৩৭ টি বছর কি তাহলে ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসেবে লিপিবদ্ধ হবে। ভারতীয় উপমহাদেশে এক সময় যে জাদরেল ও যোগ্য রাজনীতিবিদ তৈরী হয়েছিল সেই স্বর্নযুগ হয়তো আর কখনোই ফিরে আসবে না।

Mail : polashsl@yahoo.fr

প্যারিস . ০২.০৭.০৮

কোন মন্তব্য নেই:

morou kobita