নির্যাতন সব সময়ই অন্যায়
নির্যাতন সব সময়ই অন্যায়। ছ্যাঁকা দেয়া, গরম তেল ছোড়া, চোখে মরিচ দেয়া, এলোপাতাড়ি মারধর করে ক্ষতবিক্ষত করাÑ এসব এসিড নিক্ষেপের চেয়েও কম নয়। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে যথাযথভাবে এসবের বিচার হওয়া উচিত। এমনকি এসিড নিক্ষেপের মতো কঠিন আইনটি যদি এ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় তাহলে হয়তো এ ধরনের নির্যাতন কিছুটা হলেও কমে যেতো। মূলত এর কোনোটাই আমাদের কাম্য নয়। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব থাকবে, মূল্যবোধ থাকবে, কোনো হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা থাকবে নাÑ একটি সুন্দর পবিত্র মন নিয়ে সুবিশাল এই সুন্দর পৃথিবীকে দেখবে, মানুষ মানুষের উপকারে আসবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আমাদের দেশে এমন অনেক এলাকা রয়েছে যেখানকার অধিবাসীরা বেসরকারি সংস্থা থেকে মাত্র দুই হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করে সংসার চালাচ্ছে এবং কিস্তিও প্রতিশোধ করছে। সিডরের পর টিভিতে এমন ধরনের ভিডিও ফুটেজ দেখে অবাক হয়েছিলাম। দুই-এক হাজার টাকা লোন নিয়ে অর্থ উপার্জন করে সংসারের ব্যয়ভার বহন করেও লোনের কিস্তি শোধ করেÑ এটা কিভাবে সম্ভব? আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি। যেখানে একটি সাধারণ পরিবারের কলেজপড়–য়া ছেলের হাত খরচও এর চেয়ে বেশি লেগে যায়। ধনীর দুলালের কথা বাদই দিলাম। তাদের আয়ের উৎস যেমন প্রশস্ত, খরচের কথা আর কি বলবো! যাই হোক, আমার কাছে অবাস্তব হলেও বাস্তবে এটা সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব। দেখা যায়, ঋণ গ্রহিতারা শুধু ওই ঋণের দুই হাজার টাকার ওপর নির্ভরশীল নয়Ñ পাশাপাশি দিনমজুরি, কৃষিকাজ, রিকশাচালনা ইত্যাদি করে থাকে। সে হিসেবে বাংলাদেশে অনেক ধনী কিংবা সচ্ছল পরিবার রয়েছে যারা ইচ্ছে করলে মাত্র ২০ হাজার টাকা দিয়ে ১০টি পরিবারকে বিনা বিড়ম্বনায় সাবলম্বী করে দিতে পারে।
আমার এই সহজ-সরল অভিব্যক্তি শুনে আমার এক বন্ধু বলল, সেটা নাকি সম্ভব নয়। মানুষ নাকি শক্তের ভক্ত, নরমের যম। নিঃশর্তে দান করলে সেটার সঠিক প্রয়োগ হয় না, তার মর্মও তারা বোঝার চেষ্টা করে না। কিন্তু শর্তসাপেক্ষে অর্থ দিলে সেগুলোর সঠিক প্রয়োগ হয়, কষ্টেশিষ্টে হলেও সেই টাকা শোধ করার চিন্তা তাদের মাথায় থাকে এবং সময়মতো উপার্জন করে পরিশোধ করে ফেলে। বন্ধু বললোÑ আমিও অমন দরদ দেখাতে গিয়ে ধরা খেয়েছি, বিনা লাভে টাকা ধার দিয়ে আসল টাকাই পাইনি, বরং শত্রু হতে হয়েছে। তাই এখন আর লাভ ছাড়া টাকা দিই না। আমি ঠাট্টা করে বললাম, তার মানে তুই সুদ খাস। সে বললো, সুদ বলছিস কেন? আমার পয়সা খাটিয়ে তারা আয় করছে, সেখান থেকে লভ্যাংশ দিচ্ছে। ক্ষুদ্র ঋণও বলতে পারিস, শুনতে ভালো শোনা যায়।
তারপরও একটা বিষয় জোর দিয়ে বলা যায়, মানুষের চেষ্টা আছে। হয়তো সঠিক উৎস খুঁজে পায় না। তবুও কেউ অন্যের কাছে হাত পেতে করুণার পাত্র হতে চায় না। প্রয়োজনে নিজেতো গায়ে খাটে, স্ত্রীকেও কাজে খাটায়। স্ত্রীকে মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে দেয় কিংবা গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মহিলাদেরও দিনমজুর হিসেবে মাঠে-ময়দানে কাজ করতে দেখা যায়। এরপরও যদি জীবন ও জীবিকা নির্বাহে হিমশিম খেতে হয় তাহলে সন্তানের মায়া ভুলে গিয়ে নিজের ছোট ছোট শিশুদের সচ্ছল পরিবারে পরিচর কিংবা পরিচারিকা হিসেবে দু’বেলা দুমুঠো পেটে-ভাতে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য পাঠিয়ে দেয়। বর্তমান বাজারের যে লাগামহীন তথা অভিভাবকহীন অবস্থা এতে করে দৈনন্দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে যে দ্বিগুণ-ত্রিগুণ পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, সেই অর্থ জোগান দিতে কি ওই ঋণে পাওয়া দুই হাজার টাকা খাটিয়ে আয় করা সম্ভব হবে? নাকি রিকশাভাড়া দ্বিগুণ পাবে অথবা দিনমজুরি দ্বিগুণ পাবেÑ কোনো নিশ্চয়তা আছে? এ রকম পরিস্থিতিতে হয়তো উপায় খুঁজে না পেয়ে অসহায় গরিব মানুষেরা জীবন বাঁচাতে আবার গ্রামাঞ্চলে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরবে, দিন দিন গৃহভৃত্যের সংখ্যা বেড়ে যাবে, কারো কারো অভাবে স্বভাব নষ্ট হবে এবং (পয়সা বাঁচাতে) আগের মতো পায়ে হেঁটে দীর্ঘপথ পাড়ি দেবে (স্বাস্থ্যের জন্য ভালো)।
এক সময় কৃতদাস প্রথা ছিল। দাস-দাসী কেনাবেচা হতো। সেই দাস বা দাসীকে যেভাবে খুশি সেভাবে ব্যবহার করা হতো। এরপর কালক্রমে সেই প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবুও পৃথিবীর কোথাও কোথাও এখনো প্রচলন রয়েছে বলে শোনা যায়। দাস-দাসী, ভৃত্য, চাকর, চাকরানী, কাজের লোক, কাজের মেয়ে, ঝি, পরিচর, পরিচারিকা ইত্যাদি শব্দ একটি আরেকটির প্রতিশব্দ মাত্র। লিঙ্গভেদে এর মানে হচ্ছে সেবক কিংবা সেবিকা। সেবক মানে হচ্ছে- যে সেবা বা পরিচর্যা করে। সেবক শব্দটিকে ব্যবহার না করে যদি একটু গরিবি ভাষায় ‘চাকর’ ব্যবহার করি তাহলে ভেবে দেখি চাকরের কাজ কি! চাকরের কাজ হলোÑ মুনিবের আদেশ পালন করা বা নির্দেশ মোতাবেক কাজ করা। তার ভালোমন্দ লক্ষ্য রাখা, প্রয়োজনে হাত-পা টিপে দেয়া বা শারীরিক পরিচর্যা করা অর্থাৎ যা যা আদেশের আওতায় পড়ে। আদেশ অনুযায়ী সেই কাজে যদি সামান্য নড়চড় হয় তাহলে দেখতে হয় রক্তচক্ষু। কারণ সে তার অধীনস্ত কর্মচারী, চাকর বা হুকুমের গোলাম। দুঃখজনক হলেও সত্য, মুনিব সেই ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে অনেক সময় মনুষ্যত্ব হারিয়ে শুরু করে শারীরিক কিংবা মানুষিক নির্যাতন। মুখ বুঝে সবই সয়ে যেতে হয় কর্মচারী বা চাকর হওয়ার অপরাধে। তার সেই সহ্য ক্ষমতা দেখে মুনিব আরো বেশি মজা পায়। একটুও ভাবে না যে, সেটা তার দুর্বলতা নয় বরং সম্মান বা সমীহ। চোর পেটাতে তো মজাই লাগে, চুপচাপ সয়ে যায়, কোনো বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয় না বিধায় চামচিকাও খাদে পড়া হাতিকে লাথি মারার মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। সেই মনিব যখন ঘরে আসে তখন সেখানেও চলে একই অবস্থা।
তার মানে অফিসে যারা কাজ করে তারা হলো মালিকের কর্মচারী। মালিক তাকে কথায় কথায় সেকেন্ডে সেকেন্ডে ধমক, রাগারাগি, গালাগালি, ফাইল ছুড়ে ফেলা ইত্যাদি দুর্ব্যবহারের মাধমে মানুষিক নির্যাতন চালায়। জীবন ও জীবিকার তাগিদে কর্মচারীরা সেগুলো সয়ে নেয়। সেই নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত থাকার জন্যই মানুষ তেলমারা পদ্ধতি আবিষ্কার করে নিয়েছে। তাতেও তেমন কাজ হয় না বিধায় ইউনিয়ন শুরু করেছে। যার মাধ্যমে তারা সম্মিলিতভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে পারে।
যানবাহনে যারা কাজ করে তারা হলো যাত্রীর সেবক। এক সময় তারা যাত্রীদের সেবায় নিয়োজিত ছিল। কিন্তু এখন পট পরিবর্তন হয়েছে। এখন উল্টো যাত্রী হয়েও যানবাহনের স্টাফদের (পথযান) সেবা করার উপক্রম হয়ে যায়। তানা হলে বারডেমের কর্মচারীর মতো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে, ইচ্ছামতো ভাড়া নেবে, ইচ্ছামতো ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে গাড়ি চালাবে, মহিলাদের গায়ে হাত দিয়ে ঠেলে তুলবে, যাত্রীদের ধরে পেটাবে। উল্টো হলো কেন? কারণ তাদেরও ইউনিয়ন আছে।
হাসপাতালে যারা কাজ করে তারা হলো রোগীর সেবক। অথচ তাদের তেল মেরে, হাতের ভেতর কিছু ধরিয়ে দিয়ে চুম্মাচাটি মেরে রোগীর কাছে আনতে হয়। তানা হলে মানব জীবনের পরোয়া তাদের মধ্যে জাগ্রত হয় না। তারাও তাদের ইচ্ছামতো কর্তব্য কাজে যোগ দেয়। তাদেরও ইউনিয়ন আছে।
বাসায় যারা কাজ করে তারা হলো ওই বাসার চাকর। মালিকের অফিসের সেই দুর্ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া এসে পড়ে ঘরে। মুনিবরানী চাকর বা চাকরানীর ওপর দিয়ে সে ক্ষমতা চালায়। তানা হলে মুনিবী শোভা পায় না। দেশের প্রায় প্রতিটি সেক্টরে ইউনিয়ন আছে বিধায় এখন যার যার স্থানে সবাই রাজা। কিন্তু বাসার কাজের মেয়েদের কোনো ইউনিয়ন নেই, তাই তারা নির্যাতিত হচ্ছে!
ধনী লোকের বড় বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের চাকর থাকে। সেখানে বিভাগ অনুযায়ী চাকর বা কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়। যেমন রান্না-বান্নার জন্য আলাদা কুক, মালি আলাদা, পরিচ্ছন্নতাকর্মী আলাদা, বাসার সদস্যদের ভালোমন্দ দেখার জন্য আলাদা নার্স, আলাদা দারোয়ান, বাজারঘাট করার জন্য আলাদা কর্মচারী ইত্যাদি ক্যাটাগরির গৃহভৃত্য রাখা হয়। আর সাধারণ পরিবার অর্থাৎ যাদের বাড়িটা ছোট, অথবা ছোট ভাড়া বাসা, কিংবা ছোট ফ্ল্যাট নিয়ে যারা থাকে তাদের বাড়িতে একটিমাত্র পরিচর বা পরিচারিকা থাকে। ধনী লোকের বড় বাড়ির মতো তাদের অতগুলো কর্মচারী প্রয়োজন পড়ে না, তাই একজনই থাকে। কিন্তু কাজ করতে হয় ওই বড়লোকের বাড়ির অতগুলো কর্মচারীর বা চাকরের সমান, পরিধি হয়তো ছোট। তাকে বাজারঘাট করার পর ঠিকমতো হিসাব বুঝিয়ে দিতে হয়, বাসার সর্বপ্রকার ধোয়ামোছাসহ রান্না-বান্না করতে হয়, কলিংবেল বাজলে দরজা খুলতে হয়, টবে পানি দিতে হয়, সদস্যদের টুকিটাকি কাজে সহায়তা করতে হয়, শিশুদের দেখেশুনে রাখতে হয় ইত্যাদি। তাকে খেতে ও ঘুমাতে দেয়া হয় চুলার গরমে উত্তপ্ত হয়ে থাকা কিচেনের ফ্লোরে, ছেঁড়া মশারির বত্রিশ জায়গায় সেলাই করা থাকে। পরিবারের সবার খাওয়া শেষ হলে তাকে খেতে হয়। বেঁচে যাওয়া খাদ্য থেকেও খেতে দেয়া হয় না, ফ্রিজে রেখে দেয়। তার খাদ্য কাঁচা-মরিচ, তলানি ডাল, সঙ্গে হয়তো উচ্ছিষ্ট কিছুটা। থালা-বাটি সব আলাদা, এমনকি ছেঁড়াবেড়া জামা-কাপড় পরতে দেয়া হয়, যা দিয়ে ঠিকমতো আব্রু ঢাকা মুশকিল হয়ে পড়ে। একটি পরিবারের সব কাজ একা একজন পরিচারিকার পক্ষে করা কতোটুকু সম্ভব বোধগম্য হওয়া উচিত। এছাড়া ভিন্ন পরিবেশে প্রথম প্রথম একটু সমস্যা হতেই পারে। তার ওপর যদি একটু উনিশ থেকে বিশ হয় তাহলে চলে শারীরিক নির্যাতন। অশ্রাব্য গালাগাল তো থাকেই। সেই অশ্রাব্য ও অশালীন শব্দগুলো তাদের ছোট ছোট শিশুরা শোনে, শেখে এবং তারাও ওই শব্দগুলো ব্যবহার করে, তথা নির্যাতনের পন্থাগুলো অনুকরণ করে। সেই নির্যাতনকারীরা সবাই সমাজের ভদ্রবেশী শিক্ষিত সচেতন সভ্য মানুষ। যাদের কেউ কেউ আবার সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে গিয়ে শিশু অধিকারের কথা বলে, কিন্তু দেখা যায় নিজেই তাকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। শিশুশ্রম বন্ধের কথা বলে, কিন্তু শিশুটি কেন পরিশ্রম করে, তার ঘরে যে অভাব, সে অভাব ঘোচানোর কোনো ব্যবস্থা করে না। বলে শিশুদের শিক্ষিত ও সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে- পেটে নেই ভাত, শিক্ষিত হওয়ার পরিবেশ পাবে কোথায়? সচেতন হবে তো পরে, যখন তার পেট শান্তি তথা দুনিয়া শান্তিতে চলবে। বলতে তো সবাই পারে, শিশুদের জন্য এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। সেই হবেটা কবে? বলেই যেন দায়িত্ব শেষ।
আমরা সব সময়ই পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে গৃহপরিচারিকার ওপর নির্মম, নৃশংস ও অমানবিক নির্যাতনের চিত্র দেখে থাকি। সত্যিই সেসব চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ এবং দুঃখজনক। দেখামাত্র শিউরে উঠতে হয়। একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ ঠিক থাকতে পারবে কি না সন্দেহ। এমনকি যাদের হার্টে সমস্যা আছে তাদের জন্য হয়তো আরো ভয়াবহ ব্যাপার। মনে প্রশ্ন জাগেÑ কিভাবে একজন সুস্থ সচেতন শিক্ষিত মানুষ অমন একটা শিশুকে পিটিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেয় কিংবা গায়ে আগুনের ছ্যাঁকা দিয়ে ঝলসে দিতে পারে? মানুষের মধ্যে থেকে কি দিন দিন মানবতা হারিয়ে যাচ্ছে? স্নেহ, মায়া, মমতা কি লোপ পাচ্ছে? মানুষ কি বিবেকহীন হয়ে যাচ্ছে? নাকি দিন দিন সভ্য না হয়ে উম্মাদ হয়ে যাচ্ছে?
একটি গরিব ঘরের ছেলে কিংবা মেয়ে অভাবের তাড়নায় একমুঠো অন্নের জন্য সচ্ছল পরিবারে গৃহস্থালির কাজ নিয়ে শহরে আসে। তাদের বাবা-মা বুকে পাথর বেঁধে সন্তানকে বড়লোকদের বাসায় পাঠায়। মনে করে তাদের মেয়ে শহরের বড়লোকের বাসায় আছে, ভালো আছে, সুখে আছে, দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পাচ্ছে, ভালো কাপড় পরতে পারছে। কিন্তু তারা জানে না তাদের মেয়েকে ওই কথিত বড়লোকের বেটি কিংবা বউতে পিটিয়ে চামড়া ছাড়িয়ে নিচ্ছে। তার প্রথম অপরাধ হলো সে গরিব। অন্যান্য অপরাধ হলো- তার পেটে খিদে বেশি, তাই শুধু খায় (সামান্য খেয়েও গৃহকর্ত্রীর ভাষায় সে রাক্ষস)। পকেট শূন্য, তাই হয়তো বাজার থেকে পয়সা বাছিয়ে পকেটে রেখেছে (গৃহকর্ত্রীর ভাষায় হলো- চোর, গুষ্টিশুদ্ধ চোর)। একটি গ্লাস ভেঙে গেছে (গৃহকর্ত্রীর ভাষায়- অন্ধ নাকি, চোক্ষের মাথা খেয়েছিস? দেয় চোখে একটা খোঁচা)। এছাড়া সোফার কোণায় সামান্য একটু ময়লা লেগে আছে, হয়তো টিভির দিকে উঁকি দিয়েছে, তাদের শিশুর খেলনা ধরেছে, ডাক দেয়ার পর আসতে দেরি করেছে, মুক্ত বাতাসের দিকে তাকিয়েছে কিংবা গুন গুন করে গান গেয়েছে, হাল্কা একটু তর্ক করেছে, মাইর খেয়ে একটু কেঁদেছে (কেঁদেছে কেন)Ñ এই ধরনের উছিলায় তার ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। অথচ একজন সচেতন মানুষ হিসেবে ইচ্ছা করলে ওসব হিংস্রতা বা পাশবিকতা পরিহার করে বিষয়গুলো সহজভাবে গ্রহণ করে নিতে পারে। একটি ছোট্ট শিশু, খিদে পেয়েছে তাই সামান্য খাদ্য খেয়েছে, পুরোটা কিন্তু খায়নি। পুরোটা পকেটে নেয়নি। টিভি দেখতে ইচ্ছা করেছে তাই তাকিয়েছে। প্রতিটি মানুষের জীবনে বিনোদনের প্রয়োজন আছে। সারাদিনের খাটাখাটুনির পর একটু টিভি দেখলে কি হয়? শিশুদের কৌতূহলী চঞ্চল মন ধনী-গরিব বুঝে নাÑ এটা বিবেকে রাখা উচিত। অসতর্কতাবশত আসবাবপত্র ভাঙতেই পারে, তার জন্য তার শরীর ক্ষতবিক্ষত করা বা ছ্যাঁকা দেয়ার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। অথচ বিড়ালের গায়ে লেগেও অনেক কিছু ভেঙে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়, নিজেরা তো ভাঙেই তার হিসেবে নেই, রাস্তায় ছিনতাইকারীতে ছিনিয়ে নিয়ে যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঢের বেশি নষ্ট হয়ে যায়, স্ত্রী-স্বামীতে ঝগড়া করে তার চেয়েও বেশি ভেঙে ফেলে। সেখানে অতোটুকুন একটি গরিব শিশু কাজ করতে সক্ষম হোক বা না হোকÑ কোনো কিছু নষ্ট হলে তা তুলনামূলকভাবে ছোটই হয়ে থাকে, বরং তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে এমনকি বিষয়টা ভালোমতো বুঝিয়ে দিলে আনন্দ মনে সে কাজ করতে পারে। আর নির্যাতন করলে তার মনে সব সময় ভীতি কাজ করবে এবং সেই ভয় নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আরো বেশি নষ্ট করে ফেলবে। নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য একটু শাসনের প্রয়োজন আছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাকে ঝলসে দিতে হবে। পরিবেশগত অভ্যাস পরিবর্তন হতে হয়তো একটু সময় লাগতে পারে অস্বাভাবিক কিছু নয়।
এতোটুকু বিসর্জন বা স্বার্থত্যাগ ইচ্ছা করলে সব গৃহকর্ত্রীই করতে পারে। কিন্তু করে না। এর পেছনে কোনো সঠিক যুক্তি নেই। সবই হলো লোক দেখানো স্ট্যাটাস, মুনিবী ভাব, অর্থের দম্ভ, অহঙ্কার ও খাছালত। সব গৃহকর্ত্রীর মন কিন্তু এক নয়। কারো কারো মনে ন্যূনতম মনুষ্যত্ব থাকে। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে সেই মনুষ্যত্বও এক সময় হারিয়ে ফেলে। দেখা যায়, সকালে শিশুকে স্কুলে নিয়ে ক্লাসে দিয়ে অভিভাবকরা বাইরে অপেক্ষা করে। অনেক অভিভাবকই সেখানে অবস্থান করে এবং গল্পগুজব করে সময় কাটায়। সেই গল্পের মধ্যে কাজের লোকের প্রসঙ্গ উঠে আসে। নাকমুখ ত্যাড়া-ব্যাকা করে বলে, আমি কাজের লোকেরে ফস্কি দেই না, ফস্কি দিলেই মাথায় উঠে। আজো মেরেছি। একদম কথা শুনতে চায় না। আমার সাহেবতো বলে আমি অতো মারি কেন? আমি তাকে উল্টো ধমক দিয়ে ঠা-া করে ফেলি। বলি, কাজের লোককে তো আর তুমি চালাও না, আমি চালাই। এতো সহজ না ওদের সোজা করে রাখা। সেদিন আমার জিদ উঠে গিয়েছিল। হাতের কাছে বেলুন ছিল মেরে দিয়েছি, বেলুন ভেঙে যাওয়ার পর চামুচ দিয়ে মেরেছি। ব্যস, সোজা হয়ে গেছে।
জনৈক গৃহিণীর সেই গালগল্প শুনে সদ্য শহুরে বাসরত সাদাসিধে মনের গৃহিণীও তাকে অনুকরণ করে এবং সুযোগ বুঝে প্রতিবেশীর কাছে চাপা মারতে থাকে, যা একসময় অভ্যাসে পরিণত হয় এবং ঘটে যায় অপ্রীতিকর ঘটনা।
আমরা সিনেমায় দেখেছি কাজের মেয়ে গৃহকর্ত্রীর নির্যাতন সয়ে সয়ে বেঁচে থাকে কিংবা ওই বাসায় অবস্থান করে দীর্ঘদিন। শত অত্যাচারের পরও ইচ্ছা থাকাসত্ত্বেও সেই বাড়ির কাজ ছেড়ে যেতে পারে না। কারণ নানাবিধ হয়ে থাকে। হয়তো সে এতিম, গরিব, অসহায়, নিঃস্ব অথবা কোনো সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাধ্য হয়েই তাকে থাকতে হচ্ছে। থাকা-খাওয়া, পরাসহ বেতন ছাড়া কিংবা মাসিক চার-পাঁচশ টাকা বেতন দিয়ে গৃহে রেখে তাকে দিয়ে একটি সংসারের পুরো কাজ করানো হয়। সেই কাজ করতে গিয়ে সামান্য ত্রুটি হলেই চড়-থাপ্পড়, উষ্টা-লাথি, হাতের কাছে যা থাকে তা দিয়ে প্রহার চলতে থাকে। সেসব নির্যাতন করার পরও আরো কিছু ব্যবস্থা থাকে। যেমন খুনতি দিয়ে ছ্যাঁকা দেয়া, চুল কেটে দেয়া, গরম তেল গায়ে ছোড়া, গরম পানি ছোড়া, ইস্ত্রি দিয়ে ছ্যাঁকা দেয়া, মরিচের গুঁড়ো চোখে দেয়া, ধাতব পদার্থ দিয়ে আঘাত করা ইত্যাদি। সিনেমার কাহিনী (বাস্তব থেকেই ক্লু নেয়া হয়) অনুযায়ী সেই কাজের মেয়ে সব নির্যাতন নীরবে সয়ে সয়ে একদিন হঠাৎ করে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। নেপথ্যে নায়ক তাকে সহায়তা করে এবং ঠিক ওই একই ধরনের নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া ফলায় গৃহকর্ত্রীর ওপর। এবার বোঝ ঠেলা! পত্র-পত্রিকা কিংবা টিভিতে প্রায়ই গৃহপরিচারিকার ওপর নির্যাতন শীর্ষক সংবাদ দেখা যায়, যা অত্যন্ত নির্মম, নৃশংস ও অমানবিক, লোমহর্ষক ও দুঃখজনকতো বটেই। সেসব দৃশ্য দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় সিনেমার ওই কাজের মেয়ের মতো যদি বাস্তবে হতো তাহলে এ দেশের অহঙ্কারী, রূপের আবরণে লুক্কায়িত অসংযত, নির্দয়, অকোমল, স্বল্পবিদ্যায় ভয়ঙ্করী, অবৈধ পয়সায় লালিত গৃহকর্ত্রীদের অবস্থা কি হতো!
যাই হোক, নির্যাতন সব সময়ই অন্যায়। ছ্যাঁকা দেয়া, গরম তেল ছোড়া, চোখে মরিচ দেয়া, এলোপাতাড়ি মারধর করে ক্ষতবিক্ষত করাÑ এসব এসিড নিক্ষেপের চেয়েও কম নয়। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে যথাযথভাবে এসবের বিচার হওয়া উচিত। এমনকি এসিড নিক্ষেপের মতো কঠিন আইনটি যদি এ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় তাহলে হয়তো এ ধরনের নির্যাতন কিছুটা হলেও কমে যেতো।
মূলত এর কোনোটাই আমাদের কাম্য নয়। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব থাকবে, মূল্যবোধ থাকবে, কোনো হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা থাকবে নাÑ একটি সুন্দর পবিত্র মন নিয়ে সুবিশাল এই সুন্দর পৃথিবীকে দেখবে, মানুষ মানুষের উপকারে আসবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ayubahmedd@gmail.com
Ref: http://www.jaijaidin.com/printversion.php?nid=79482
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন