কুয়েতে হাজার হাজার বাংলাদেশী শ্রমিকদের ধর্মঘট, ব্যাপক গাড়ি ভাংচুর, পুলিশের ধরপাকড় ও অমানবিক নির্যাতন অব্যাহত
মোঃ সেলিম রেজা, কুয়েত থেকে
শ্রমিক বিভিন্ন দাবী আদায়ের লক্ষ্যে কুয়েতে নতুন করে ধর্মঘট শুরু হয়েছে যার কারণে ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করছে শ্রমিকদের মাঝে। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকা গুলোতে সাধারণ মানুষের চলাফেরায় বিঘœ ঘটে। কুয়েতে ন্যাশনাল ক্লিনিং কোম্পানি, আল-আবরাজ, আল-তুয়েক, আল-জোহরা, সুইডিশ, আব্দুল হামিদ, কেয়ার সার্ভিস ক্লিনিং কোং কুয়েত, আল-রওয়াদসহ মোট ১০টি কোম্পানিতে কর্মরত নারী-পুরুষ বাংলাদেশী শ্রমিকরা নতুন করে ধর্মঘট শুরু করেছে, তাদের বেতন ভাতা বাড়ানো সহ নানা সুযোগ সুবিধার দাবীতে। এসব কোম্পানির শ্রমিকরা কুয়েতের বিভিন্ন সরকারী, আধা-সরকারী ও মালিকানাধিন কোম্পানি গুলোর সেবা বিভাগে কাজ করত। এ নিয়ে কুয়েতে বাংলাদেশী নিম্ন আয়ের শ্রমিকদের মাঝ টানা উত্তেজনা বিরাজ করছে। এদিকে শ্রমিকরা এক সময় বিক্ষুদ্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। ব্যাপক গাড়ী ভাংচুর চালায়। ঐ সময় পুরো এলাকায় ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পুলিশ শত চেষ্টা করেও শ্রমিকদের নিবৃত্ত করতে পারে নাই। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের ডেকে আনা হয় ঘটনাস্থলে। শ্রমিকরা এসব ভাংচুর চালায় বাংলাদেশী অধ্যুসিত এলাকা হিসেবে পরিচিত জিলিব আল সুয়েখ এর হাসাবিয়া এলাকায়। অন্যদিকে আজ সকাল থেকে শ্রমিকরা আবারো জোটবদ্ধভাবে রাস্তায় নেমে আসে। এ মূহুর্তে পুলিশ এবং সেনা সদস্যরা পুরা এলাকা ঘিরে রাখে। সেখানে দ্রুতবাসের শ্রম সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দকী সহ উর্ধতন কর্মকর্তারা এবং স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন এবং শ্রম অধিদপ্তরের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত রয়েছেন। হ্যান্ড মাইকে শ্রমিকদের আন্দোলনের পথ পরিহার করে ফিরে যাওয়ার আহবান জানাচ্ছে। সেই সাথে তাদের দেওয়া সকল দাবী-দাওয়া মেনে নেয়া হবে বলে আশ্বস্থ করছে। তারপরও শ্রমিকরা ব্যারাকে ফিরে যেতে চাইছে না। ব্যাপক আতঙ্ক বিরাজ করছে গোটা কুয়েতে। পুলিশ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে গত রাত থেকে। এদিকে একটি বিশ্বস্থ সূত্র জানায় কোম্পানির হয়ে বাংলাদেশী যেসব এরিয়া ম্যানেজার ও সুপারভাইজাররা শ্রমিকদের নানাভাবে হয়রানি করত তাদের চিন্নিত করে গতরাতে বেদম প্রহার করেছে বিক্ষুদ্ধ শ্রমিকরা। বর্তমানে ঐসব বাংলাদেশী ম্যানেজার এবং শ্রমিকরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তারমধ্যে অনেকের অবস্থা আশংকাজনক। বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্নস্থানের ব্যারাক গুলোর আশে-পাশে ব্যাপক পুলিশ মোতায়ন রয়েছে, যাতে করে আইন-শৃংখলার অতিরিক্ত অবনতি না ঘটে। ধর্মঘট থেকে শ্রমিকদের নিবৃত্ত করতে দূতাবাসের সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করেছে কুয়েতের শ্রম ও সমাজ কল্যাণ সহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রানালয় এবং মালিকপক্ষ। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী শ্রমিকদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে বৈঠক করেছে। তাদের সমস্যাগুলো চিন্নিত করে রাতেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং মালিকপক্ষের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করে শ্রমিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েক দফা দাবী দাওয়া উত্তাপন করেন। অন্যদিকে কেয়ার সার্ভিস, ন্যাশনাল রিয়েলষ্ট্যাট, আল-আবরাক কোম্পানীর প্রায় সাত হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক নতুন করে ৮টি কোম্পানীর শ্রমিকদের সাথে ধর্মঘটে অংশ গ্রহণ করতে পারে এমন খবরের তথ্য ফাঁস হয়ে যায় কুয়েত প্রশাসনের কাছে। এসব শ্রমিকদের ধর্মঘট থেকে বিরত রাখতে শ্রম অধিদপ্তরের উর্ধতন কর্মকর্তারা দূতাবাসের সহযোগিতা কামনা করে। শ্রমিকরা ঐ সময় তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ৬ দফা দাবীনামা পেশ করে শ্রম সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকীর কাছে। সচিব এই ৬ দফা দাবী নিয়ে দফায়-দফায় বৈঠক করেন সংশ্লিষ্ট কুয়েতী কর্মকর্তা ও মালিকপক্ষের সাথে। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পান দূতাবাস। দূতাবাস তড়িৎ গতিতে শ্রম মন্ত্রানালয় এবং মালিক পক্ষের উপস্থিতিতে এই ৭ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিকদের সাথে ওপেন সভা করে জিলিব আল সুয়েখের একটি খোলা মাঠে। হাজার হাজার শ্রমিকদের সামনে তাদের ১৮ দিনার বেতন থেকে ৪০ দিনার বেতন নির্ধারন, থাকার ব্যবস্থা উন্নতি করন, ব্যাংকের মাধ্যমে তাদের বেতন পরিশোধ, ভিসা নবায়নের জন্য কোন ফি নেওয়া থেকে বিরত থাকা, দুই বছর অন্তর-অন্তর ছুটিতে যাওয়ার জন্য টিকেট এবং ছুটির পূর্ণ হিসাব প্রদান। এবং কোম্পানিতে দূর্নীতিবাজ এরিয়া ম্যানেজার এবং সুপারভাইজারদের শাস্তির ব্যবস্থার দাবীগুলো মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন কর্তৃপক্ষ। সেই সাথে মালিক পক্ষের কাছ থেকে এই ৬ দফা দাবী মেনে নেওয়ার স্বাক্ষর নেওয়া হয়। যার কারণে এইসব শ্রমিকরা নতুন করে আজকের এই ১০টি ধর্মঘটি কোম্পানীর শ্রমিকদের সাথে ধর্মঘটে যাওয়া থেকে বিরত থাকে। বিশেষ করে এইসব কোম্পানীর শ্রমিকরা কুয়েতের বিভিন্ন সরকারী মন্ত্রানালয়ের সেবা বিভাগে কাজ করত। হাজার হাজার শ্রমিকদের উপস্থিতিতে এ ধরনের একটি আলোচনা এক বিরল ঘটনা, এটি আগে কখনো দেখা যায়নি কুয়েতে। এছাড়া দূতাবাসের পাশাপাশি এখানকার মানবাধিকার সংগঠন গুলোর পূর্ণ সমর্থন রয়েছ শ্রমিকদের প্রতি। যার কারণে শ্রমিকরা অতি সহজে আন্দোলনের মাধ্যমে বহু-বছরের দাবীগুলো বিনা বাধায় আদায় করে নিতে পারছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো শ্রমিকদের এই আন্দোলনের অবস্থা দেখে সিকাগো শ্রম আন্দোলনের সাথে তুলনা করেছে। অনেকে মনে করছেন এই আন্দোলনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে কুয়েতের ভাব-মূর্তি বিষণভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন