নীলিম করকা
আইয়ুব আহমেদ দুলাল
২য় কিস্তি
(৩)
শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। গোপীবাগ থেকে খিলগাঁও বেশী দুরে নয়। সিহাব বিকেলে স্বর্নাদের বাসায় গেল। খুঁজে পেতে তেমন অসুবিধা হয়নি। দোতলায় থাকে ওরা। দরজায় নক করার পর স্বর্না এসে দরজা খুলল।
ঘরে কোন সাজসজ্জা নেই। আগে যেমন ছিল তেমনই সাদামাটা। তিন ভাইবোন নিয়ে বাবা-মায়ের সংসার। বাবাই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। খুব সীমিত বেতনে তিনি একটি বিস্কুট ফ্যাক্টরীতে চাকুরী করেন। সংসারে বেশ টানাটানি অবস্থা। আগে থেকেই তাদের অবস্থা অস্বচ্ছল। স্বর্নার মায়ের একটি সেলাই মেসিন আছে। বাবার সীমিত আয় এবং মায়ের সেলাই কাজ দিয়েই কোন রকম চলে যায়। এদিকে ছেলেমেয়েদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যোগদান করার প্রয়াশ ও প্রেরনা ছিল তার মায়ের। তিনি ছোটবেলা থেকেই ওদেরকে নাচ-গান শেখানোর প্রতি আগ্রহী ছিলেন।
গল্প গুজব হওয়ার পর চা চক্র হল। হঠাৎ কথায় কথায় মনের ভুলে সে তার সাংস্কৃতিক চর্চার কথা বলে ফেলল। অমনি স্বর্না তড়িৎগতিতে তার পুরানো হারমোনিয়ামটা সামনে এনে দিল।
সিহাব একটু ইতস্তত বোধ করল। কারন সে ছিল তখনো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ছাত্র। ওস্তাদের উপদেশ ছিল যতদিন না তিনি অনুমতি দিবেন ততদিন হারমোনিয়াম ব্যবহার করে গান গাওয়া বা স্টেজে উঠা যাবে না। সম্পুর্ন নিষেধ। তবে হারমোনিয়াম ছাড়া ঘরোয়া পরিবেশে খালি গলায় গান গাওয়ার অনুমতি ছিল। ওস্তাদের থিউরী হল- কোন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ছাত্র মানে সারগাম শিক্ষার্থী, কোর্স কমপ্লিট হওয়ার আগে যদি হারমোনিয়াম দিয়ে গান গায় তাহলে তার কণ্ঠের বেজ নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া ষ্টেজে উঠার ব্যাপারে নিষেধ করেছেন। কারন গান গাওয়ার পর যদি একবার হাতেতালি পড়তে শুরু করে তাহলে সারগাম বা সঙ্গীতের প্রয়োজনীয় পাঠ্যসূচী থেকে সে বি”্যুত হবে এবং ঐ হাততালীর দিকেই সে বেশী আকৃষ্ট হবে। ভাল ভাল গান শুনিয়ে দর্শকদের কাছ থেকে বাহবা নেবে এবং একসময় তার কন্ঠের বেজ নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং স্বর্নার অনুরোধে সে গান গাইতে অস্বীকৃতি জানালেও তারা মানতে রাজী হয়নি। বরং অহংকারী, ঢং এবং মুখ ভেংছি দিয়ে স্বর্না উপহাস করতে শুরু করলো। থিউরী দিয়ে কি আর সঙ্গীত প্রেমীদের দমানো যায় ? কাজেই ছাড় না পেয়ে পরিশেষে সিহাব সা পা চেপে ধরে একটি আধুনিক গান গাইল।
গান শুনে পাশের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন এক ভদ্রমহিলা ও একটি মেয়ে। গান চলাকালীন সময়ে তারা এসে চেয়ারে বসলেন। গান শেষ হওয়া মাত্রই চডরপডর হাতেতালি শুরু হয়ে গেল। স্বর্নাকেও গাইতে বলল। স্বর্নাও হারমোনিয়াম বাজাতে অস্বীকৃতি জানাল। কারণ সে ভাল বাজাতে পারতো না। অর্থাৎ গান তোলা শেখেনি। সেও সারগাম শিখছিল। তবে সিহাবের মত উপদেশ ওস্তাদের কাছ থেকে পায়নি। অর্থাৎ একাডেমীতে যাচ্ছে- ছাত্রছাত্রীদের একত্রে বসানো হচ্ছে। সুরে সুরে সবাই মিলে একত্রে গান গাচ্ছে। শুনতেও ভাল লাগছে। গান গেয়ে মনটা একদম প্রফুল্ল হয়ে যায়। পরিশেষে ডায়েরীতে লিখে বাসায় চলে আসে। ব্যশ।
গান শেষে স্বর্না ভদ্র মহিলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তারা দুইজনই স্বর্নার খালাত বোন। সিহাব সালাম দিল। কিন্তু ভদ্রমহিলা হাসতে হাসতে কুটিকুটি। হাসির মাঝে কেমন যেন একটা রহস্য ছিল। তবে রহস্য উম্মোচনে সিহাব অতটা আগ্রহী ছিল না।
ভদ্রমহিলার নাম শিলা এবং সাথে তার ছোটবোন মিলা। সিহাব যখন শিলার কাছে তার হাজবেন্ডের কথা জানতে চাইল তখন সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠল। সিহাব পড়ে গেল এক বিভ্রতকর পরিস্থিতিতে।
‘ আপনারা হাসছেন কেন ?
‘ আরে ব্যাটা, ওর এখনো বিয়ে হয়নি। ও তোরচে বয়সে অনেক ছোট হবে। মাত্র ডিগ্রীতে পড়ে। গায়ে গতরে বেড়ে গেছে, এই যা। - স্বর্নার মা বললেন।
‘ ও আচ্ছা। দেখেতো মনে হয়না। তাছাড়া নাকে নাকফুল।
অট্টহাসির মত ধ্বনি হল আবার। সিহাব নিজেকে কোনমতে সংবরণ করে নিল। লাল হয়ে গেল তার মুখমন্ডল। শিলার স্বাস্থ্য ও তার বেশবুসায় অবিবাহিত মনেই হয়না। তাকে দেখে সিহাব যেভাবে ভুল করেছে, অনেকেই অমন ভুল করে বলে জানিয়েছে স্বর্নার মা। প্রকৃত সত্য হল- শিলার বয়স আসলেই কম। তবে সে অসুস্থ। দীর্ঘদিন ধরে বাতজ্বরে ভুগছে। সেইজন্য তাকে নিয়মিত ঔষধ সেবন করতে হয় এবং প্রতিমাসে একটি করে ইন্জেকশন নিতে হয়। তারই প্রতিক্রিয়ায় শরীরটা ফুলে গেছে। এমনকি ছয় বছর তাকে ঐভাবে চিকিৎসা নিতে হবে।
মিলা খুব চুপচাপ। চুপচাপ থাকতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। সে ইন্টারের ছাত্রী। লাজুকও বটে। সে একটু বেশী ভদ্র; শিলা বলল।
সিহাব যখন তাদের বাসা থেকে বিদায় নিতে প্রস্তুত হল তখন শিলা এসে অনুরোধ করল কাল পরশু যেন একবার আসে। কোন এক বিশেষ প্রয়োজন আছে। সেই বিশেষ প্রয়োজনের কথা তখন আর বলেনি।
দুই তিনদিন পর সিহাব তাদের বাসায় গেল। গেটের সামনে গিয়ে কলিংবেল বাজাল। স্বর্নার ছোটবোন প্রীতি দরজা খুলে দিল। ঘর ফাঁকা ফাঁকা দেখে সিহাব তার খালাত বোনসহ অন্যান্যদের কথা জানতে চাইল। প্রীতি বলল তারা নাকি মার্কেটে গেছে। তাহলে শুধু শুধু এসে কী লাভ হল! সিহাব চলে যাওয়ার স্টেপ নিল।
‘ ভাইয়া, বসেন। আমরা আছি নাহ !
‘ তোমরা মানে ?
‘ মানে আমি আর মিলা আপু আছি। আমাদের সাথে গল্প করেন।
‘ কী গল্প করবো তোমার সাথে ! তুমি তো হাট্টিমাটিম টিম।
‘ কেন আমি ছোট বলে আমাকে পছন্দ হয়না ?
‘ হবে না কেন ? তুমি ছোট কোথায় ? তুমি তো অ-নে-ক বড়।
‘ মজা করেন নাহ ?
‘ আরে পাক্নী মজা করবো কেন ? তুমি কোন্ ক্লাসে নাহ ?
‘ ক্লাস থ্রি। পরীক্ষায় তিন বিষয়ে ফেল করেছি -হা।
‘ হা হা হা --। ফেল করে আবার বাহাদুরী দেখাও।
‘ এটা কয় জনে পারে বলেন ?
‘ থাক্ তোমাকে আর পাকামো করতে হবে না। এখন বল তোমার আম্মুসহ কখন আসবে ?
‘ দেরী হবে। কিছুক্ষন আগেই তো গেল- মিলা বলল।
এতক্ষন পর মিলার মুখে খই ফুটল। প্রথম থেকেই সে কথা বলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ভেতর থেকে বের হয়নি। তার ভাব দেখেই বুঝা গেছে। এইটুকু কথা বলতে গিয়েও লাল হয়ে গেল।
‘ তোমরা যাওনি কেন ?
‘ আপনি আসবেন, তাই আমরা রয়ে গেছি।
‘ কী করে জানো আমি আসবো ?
মিলা কোন উত্তর করেনি। সিহাব মিলার জড়তা দেখে তার সাথে আরেকটু ইজি হওয়ার চেষ্টা করলো।
‘ তুমি কিসে পড় ?
‘ ইন্টারমিডিয়েট ফার্ষ্ট ইয়ার।
‘ কোন গ্র“পে।
‘ আর্স।
‘ তোমার পার্টস আছে ?
মৃদু হাসল মিলা। - কেন, একথা বললেন কেন ?
‘ না এমনিই। শুনেছি আর্সে যারা পড়ে তাদের নাকি পার্টস থাকে না। তাই জানতে চাইলাম সত্য না মিথ্যা।
মিলা তবুও ইজি হতে পারেনি। তার এ্যাটিটিউড দেখে বুঝা গেল সে আড্ডা মারা বা গল্প করায় অভ্যস্ত নয়। তাছাড়া ইন্টার প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা মুলত গল্পবাজ বা আড্ডাটাকে বেশী মাত্রায় প্রাধান্য দেয়। নবজীবন, নব উদ্দীপনা, নব পরিবেশ, নব ইমেজ বিরাজ করে তাদের মাঝে। কিন্তু মিলার মাঝে তেমন কিছু দেখা যায়নি বরং সংকোচের মাত্রা ছিল বেশী। তবে সামনে থেকে সরেও যায়নি। সে সিহাব ও প্রীতির ট্যাসটেসে কথাগুলো উপভোগ করছিল। মিটিমিটি হাসছিল।
মিলা চা করে নিয়ে এলো। চায়ে চিনি একটু বেশী পড়েছে। সিহাব সেটাকে শরবত বলায় মিলা মুখটা মলিন করে সরে গেল। আড়ালে গিয়ে প্রীতিকে ডাক দিল। প্রীতি ভেতর থেকে এসে সিহাবকে ধমকের সুরে বলল- ভাইয়া, মিলা আপু চা বানিয়েছে। আপনি এটাকে শরবত বলবেন না। আপুর খুব জিদ, হ্যাঁ।
‘ ওরে বাবা, ভয় পেয়েছি। জিদ হলে কী করে ?
‘ খুব রাগ হয়।
‘ কিছু ছুড়ে টুড়ে মারে নাকি ?
‘ হ্যাঁ, তাও মারে।
‘ ও ভাই গো, তাহলে আমি পালাই।
সিহাব উঠে যেতে চাইল।
‘ ধুরো ভাইয়া, কী যে বলেন। বসেন না। একটা গান শুনান।
‘ তোমাদের বাসায় কেউ নেই এখন গান হবে না। আমি বরং যাই। পরে আসব।
সিহাব চলে গেল। চার পাঁচ দিন পর আবার এলো। সেদিন ছুটির দিন। বাসায় সবাই ছিল। বিকেল চারটার মতো বাজে। সবাই খোশগল্পে মেতে ছিল। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। স্বর্না দরজা খুলে দিয়ে একটি ব্যাগ বহন করে কিচেনের দিকে নিয়ে গেল। তার বাবা বাজার করে বাসায় ফিরলেন। সিহাবকে দেখে অবাক হলেন। বিশ্বাসই করতে পারেননি। তারপর কুশলাদী বিনিময় করে তিনি প্রেস হওয়ার জন্যে বাথরুমে চলে গেলেন।
শিলা বলল- আপনি আম্মার সাথে কথা বলেন আমরা কিচেনে যাই।
খালাম্মাকে ওরা আম্মা বলে। আর নিজের মাকে আম্মু বলে। যাইহোক শিলা ও মিলা স্বর্নাকে সাহায্য করতে কিচেনে চলে গেল। তাদের হন্তদন্ত অবস্থা দেখে সিহাব ভদ্রতার খাতিরে নিষেধ করল যেন কোন কিছুর আয়োজন না করে। স্বর্নার মা তখন খিক্ খিক্ করে হেসে উঠলেন।
‘ তোমার জন্যে আয়োজন না করলেও আমাদের জন্যে করতে হবে।
‘ মানে ?
‘ মানে আমরা এখনো খাইনি। এই মাত্র বাজার এলো।
স্বর্নার মার ঠোঁট পাতলা। নির্ধিদ্বায় সব কথা বলে ফেলেন। নিজের সংসারে অভাব, না খেয়ে ঘুমিয়ে থাকা, আধাপেট খেয়ে থাকা তাদের স্বাভাবিক রুটিন। তিনিই এসব বলেন। সিহাব খুব লজ্জ্বায় পড়ে গেল। আড়চোখে একবাব রুমটা দেখে নিল। টানাটানির সংসার, ঠিকমত খাবার জোটে না, পরতে পারে না, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ ঠিকমত বহন করতে পারেনা অথচ তিনি সন্তানদের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেন। অবশ্য সব বাবা মা’ই ছেলেমেয়েদের উজ্জল ভবিষ্যৎ কামনার্থে আত্মত্যাগী হয়ে থাকেন। তারাও তাই করছেন। তবে এ লাইনে প্রচুর খরচ এবং অনেক সাধনার ব্যাপার। বড় মেয়ে গান শেখে, ছোট মেয়ে নাচ শেখে আর ছেলেটাকে শেখানো হচ্ছে মার্শাল আর্ট। আসলে ইট, বালি, সিমেন্টের জোড়াতালি দিয়েই তৈরী হয় ইমারত। অভাবের মাঝে থেকে যদি তাদের কেউ একজন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তবেই কষ্ট সার্থক। তাছাড়া শ্রম কখনো বিফলে যায় না, এটাই হয়ত তাদের পথপ্রদর্শক।
অতি অল্প সময়ের মধ্যে রাঁধুনীরা সংক্ষেপে খিচুড়ী বানিয়ে নিয়ে এলো। সিহাব চলে যেতে চেয়েও পারেনি। অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে হল। লজ্জা ও সংকোচ নিয়ে সিহাবকে তাদের সাথে খেতে হল। কারণ তাদের না খেয়ে থাকার বিষয়টা জানার পর সিহাব না পারছিল উঠে আসতে, না পারছিল কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই গল্প করতে বসে পড়ল। সবারই চোখমুখ সজীব হয়ে উঠল। অতৃপ্তির কোন ছোঁয়া তাদের মাঝে ছিল না। ক্ষুধা পেটে কি আর গল্প জমে! ক্ষুধা নিবারণ করে তাই নিশ্চিন্তে আরাম করে বসল। শিলা যেন কৃত্রিম শক্তি সঞ্চয় করল। শিলাদের পারিবারিক অবস্থা অবশ্য স্বর্নাদের মত নয়। তারা বেশ স্বচ্ছল। তাদের পোশাক আশাকেও বিলাসিতার ছোঁয়া রয়েছে।
‘ সেদিন চলে গেলেন কেন ? শিলা বলল।
‘ ফাঁকা বাসায় কী করবো ? আসতে বলে তো আপনারা হাওয়া হয়ে গেলেন।
‘ একটি বিশেষ প্রয়োজনে মার্কেটে গেলাম। আপনাকে প্রয়োজন ছিল মিলার। সে গান বাজনা খুব পছন্দ করে। আপনার একটি গান শুনেই সে মুগ্ধ। তাই আমাকে বলল আপনাকে বলতে যেন আর একদিন এসে গান শুনিয়ে যান।
‘ কই মিলা তো কিছুই বলেনি। আমি এলাম আর সে ঐ চেয়ারে চুপচাপ বসে ছিল। প্রীতিও তো কিছু বলেনি। সেতো বানরের মত শুধু লাফালাফি করছিল। চুপচাপ বসে থাকতে ভাল লাগছিল না, তাই চলে গেলাম। ভালই তো হত যদি মিলা আমাকে গান গাইতে বলতো। তাহলে নির্জনে নিবৃত্তে গান গাইতাম। আর তাছাড়া আমি মনে করেছি আপনিই বোধহয় গান শুনতে চেয়েছেন। আমাকে আসতে বলার পেছনে এছাড়া আর কোন কারণ দেখিনি। মিলার কথা মনেই আসেনি। মিলা তো কথাই বলে না, খুব লজ্জা পায়।
‘ ও এমনই। চুপচাপ থাকে সারাক্ষন। কোন ঝুট-ঝামেলার মাঝে নেই। ঠিক আছে আজ একটা শুনিয়ে দিন।
‘ মুড নেই, আরেকদিন।
(৪)
চাকুরীর সুবাধে স্বর্নার বাবা পুনরায় বাসা পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি চাকুরী করেন মুগ্দা পাড়ায়। তাই যাতায়াতের সুবিধা বিবেচনা করে বাসা নিলেন মানিকনগর শেষ প্রান্তে। ভাড়া তেমন বেশী নয়, সাবলেট বাসা। গোপীবাগ থেকে সিহাব মাঝে মধ্যে সেখানে যেত। স্বর্নার সাথে এক সঙ্গে মাঝে মাঝে গান বাজনা করতো। স্বর্না শুধু গান গাইতে পারত। যদিও সারগাম সম্পর্কে তেমন আইডিয়া ছিলনা। সিহাব মাঝে মাঝে তাকে সারগাম সম্পর্কে তালিম দিতো। সেই সুত্র থেকেই শিলা ও মিলার সাথে তার দেখা হত। মিলার সাথে তেমন একটা কথা হত না। কারণ ঐ একটাই, সে বড়দের কাছ থেকে সবসময় নিজেকে আড়াল করে রাখে। শিলা ওসবের ধারধারি না। সে এতো চঞ্চল যে, কথা বলতো ঠাস ঠাস, আর হাসতো ফ্রি ষ্টাইলে দাঁত কেলিয়ে। একদিন কথায় কথায় সিহাব লক্ষ্য করলো যে, শিলা তার সাথে কেমন জানি অনীহা নিয়ে কথা বলছে। তার আচরনে কিছুটা তুচ্ছ তাচ্ছিল্যতা রয়েছে। সিহাব এ বিষয়টা লক্ষ্য করে তার সাথে আরো বেশী বেশী মেশার চেষ্টা করলো। এক পর্যায়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলো- সে কি সবার সাথেই এভাবে কথা বলেন ?
‘ কীভাবে বলি ?
‘ এইযে কথার মাঝে একটা তুচ্ছ তুচ্ছ ভাব।
‘ না।
‘ তাহলে ?
‘ ছেলেদের আমি পছন্দ করিনা। সেজন্যই আমার ভিতর থেকে আপনা আপনি অনীহা ভাবটা বেরিয়ে আসে।
‘ হ্যাঁ, আপনার সংকোচহীন এপ্রোজ দেখে তাইই মনে হয়। সত্যতা স্বীকারের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু কারণটা কি জানতে পারি ?
‘ কী জানতে চান ?
‘ ছেলেদের আপনি পছন্দ করেন না, নাকি সহ্য করতে পারেন না।
‘ দুটোই।
‘ মানে ?
‘ পছন্দ করিনা, কারণ ছেলেরা স্বার্থপর। আর সহ্য করতে পারিনা, তার কারণ ওরা প্রতারক।
‘ ছেলেরা কী ক্ষতি করেছে, আপনার ?
‘ অপূরনীয় ক্ষতি।
‘ জানতে পারি ?
‘ কেন বলবো আপনাকে ? আপনিও তো সেই প্রজাতির।
‘ সে জন্যেই জানতে চাই। ছেলেরা স্বার্থপর, প্রতারক অথচ আমার সাথে প্রায় ঘন্টা দু’য়েক হতে চলল গল্প করছেন।
‘ আপনি এখন আমাদের মেহমান। ভদ্রতার খাতিরে কথা বলছি।
‘ সেই কথার মাঝে যদি অনীহা প্রকাশ পায় তাহলে কী সেটাকে ভদ্রতা বলা যায়? নাকি সেটা হবে শিষ্টাচারের পরিবর্তে নিষ্টাচার অথবা ভ্রষ্টাচার।
সিহাবের কথা শুনে চুপসে গেল শিলা। লাল হয়ে গেল তার মুখমন্ডল। সরি, আপনি কিছু মনে করবেন না, আসলে আমি বিষয়টা ওভাবে বলিনি- শিলা বলল।
‘ যাইহোক সেটা আপনার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার।
ক্রমাম্বয়ে শিলার আচরনে অনীহা ভাব কিছুটা কেটে গেল। সে বেশ শালীনতাবোধ বজায় রেখে কথা বলার চেষ্টা করলো। এক পর্যায়ে সিহাব তাকে আর অবজ্ঞা করার সুযোগ না দিয়ে সেদিনের মত চলে গেল।
প্রায় দশ-বারদিন পর এমনি এক ছুটির দিনে শিহাবকে স্বর্নার মা সংবাদ দিয়ে পাঠালেন। সকাল বেলা। সিহাব তখনো বিছানা ছাড়েনি। সুজন গিয়ে ডেকে তুলল।
‘ ভাইয়া, আম্মা আপনাকে এক্ষুনি যেতে বলেছেন, খুব জরুরী।
সুজন সংবাদটা দিয়েই চলে গেল। জরুরী ভিত্তিতে তলব করা হলেও সিহাব অতটা পাত্তা দেয়নি। বাথরুম সেরে গোসল করে ধীরে সুস্থ্যে মহল্লার গলি বেয়ে হেটে গেল তাদের বাসায়। গিয়ে দেখে সবাই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি, যার জন্যে জরুরী তলব করতে পারে !
‘ কী হয়েছে খালাম্মা ?
স্বর্না ও তার মা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ইশারায় কী যেন বলতে চাইল। বলতে গিয়ে একটু ইতস্তত বোধ করলো। এপর্যায়ে স্বর্নার মা বললেন- সিহাব, তোমার কাছে চারশ টাকা হবে ?
শুনে সিহাবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বলল- টাকার প্রয়োজন ছিল, সুজনের কাছে বললেই পারতেন, তাহলে আর আমাকে আসতে হত না।
‘ কেন, তুমি কী আমার বাসায় আসবে না ?
‘ আসব না কেন ? তার জন্যে একটা মানষিক প্রস্তুতি প্রয়োজন, তাই নাহ ?
‘ তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজন ছিল তাই ----।
সিহাব চারশ টাকা বের করে দিল। তবে টাকাটা ফেরৎ পাওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিল না, এটা সে ভাল করেই জানত। এ লাইনে যারা থাকে তাদের হাতে টাকা পয়সা গেলে ফেরৎ আসে না, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। সবাইতো আর সমান নয়। এ ব্যাপারে সিহাবের যথেষ্ট আইডিয়া ছিল। সে একদম পরিপূর্ন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। সে সাংস্কৃতিক জগতে নিজেকে স্থান দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পূর্নতা পায়নি। কারণ ছিল পিছুটান। নাটক বা গান বাজনা এসব সবাইকে দিয়ে হয়না। উত্তোরাধিকার সুত্রে অভিনেতা বা গায়ক নায়ক হওয়া সহজ। ভিন্ন পরিবেশ থেকে এসে স্থান পাওয়া খুবই দুরুহ। এ ধরনের ছেলেদের কাছ থেকে তাই সংশ্লিষ্ট সংগঠনের কর্তারা তাদের সরলতার সুযোগ কাজে লাগিযে হাতিয়ে নেয় টাকা পয়সা। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে লোন নিয়ে আর ফেরৎ দেয়না। চাওয়াও যায় না। বাদ হয়ে যাওয়ার হুমকি থাকে। তাই শখ পূরণের আশায় সেটা জলাঞ্জলি দিতে হয়। সংগঠনের সহকর্মীরাও সিহাবের সাথে এমন করেছে। অর্থাৎ সিহাবকে দিয়ে তাদের ক্ষতিটা পুষিয়ে নিয়েছে। সিহাব সহজ সরল ছেলে, তাই প্যাঁচ বুঝতে সময় লেগেছে। নাটক, থিয়েটার, ফ্যাশনশো সবই ঘেঁটেঘুঁটে পরিশেষে গানের ওস্তাদ ধরেছে। কাজেই টাকাটা দেওয়ার সময় সে মনে মনে ফি-সাবিলিল্লাহ বলেই দিয়েছে।
দুইদিন পর সুজন আবার সিহাবের বাসায় এলো। বলল স্বর্না যেতে বলেছে।
‘ পরে গেলে হবে না ?
‘ না এক্ষুনি যেতে হবে। আমাদের বাসা হয়েই অফিসে যাবেন।
সিহাব ওদের বাসায় গেল। স্বর্না সিহাবকে দেখে মিটিমিটি হাসছিল।
‘ ভাইয়া, আপনার জন্য একটা গুড নিউজ আছে।
‘ কী, জলদি বল।
‘ এটা জলদি করার বিষয় নয়।
শালিকা যেমন দুলাভাইয়ের সঙ্গে গাল, নাক, মুখ, চোখ নৃত্য করে কথা বলে স্বর্নাও সেইভাবে বলছিল।
‘ এই জন্যই কি ডেকেছ ?
‘ হ্যাঁ। তবে বুঝতে পারছি আপনি এখন ব্যস্ত। অফিসে যাওয়ার পথে আছেন। এই নিন একশ টাকা। বাকী টাকা পরে দেবো। আর দুই নম্বর বিষয়টা পরে বলবো। যদি সম্ভব হয় সন্ধ্যায় আসবেন। বিষয়টা অত্যন্ত কন্ফিডেন্সিয়াল এবং গুরুত্বপুর্ন।
সিহাব সেদিন আর যায়নি। পরেরদিন সন্ধ্যায় গেল। টিভিতে প্রচার হবে এমন একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের নাম বলে রেকর্ডিং অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্যে একটা টিকিট দিলেন স্বর্নার মা। স্বর্না তার মায়ের পাশে অন্য একটা চেয়ারে বসে তখনো মিটিমিটি হাসছিল। শিলা নেই। সে তার কোন এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গেছে। মিলা চলে গেল গ্রামের বাড়ীতে। তার কলেজ খোলা, পরীক্ষা নাকি সন্নিকটে।
‘ স্বর্না, কী বলবে বল।
‘ বলবো ভাইয়া, বলবো।
সেদিনও স্বর্না বলেনি। এ নিয়ে সিহাবের তেমন কোন আগ্রহ ছিলনা। কারণ যেই বয়সে ভাবাবেগ থাকে, কৌতুহল থাকে, সেই সময় বা পরিস্থিতি সিহাব বেশ আগেই অতিক্রম করে গেছে। প্রেম করেছে, ছ্যাক খেয়েছে, ছ্যাক দিয়েছে, বাকী নেই কিছুই।
সুজনের জম্মদিন। জম্মদিনের দাওয়াত দিয়ে গেল স্বর্না ও শিলা। শিলাকে দেখেতো সিহাব বলেই ফেলল- আপনি এখনো আছেন ? সে কিছু না বলে স্মীত হাস্যে মাথা নাড়াল। সেখানে তেমন আর গলাবাজী করেনি শিলা। কারণ সিহাব ব্যাচেলর থাকে। আশেপাশে রুমমেটরা ছিল। তাদের সামনে চঞ্চলতা বেমানান।
সিহাব সুজনের জম্মদিনের নেমন্ত্রনে গেল। গিয়ে দেখে তেমন কোন মেহমান নেই। দুই একটা অপরিচিত মুখ, শিলা, মিলা আর ওরা নিজেরাই। ছোটখাট একটি কেক এনে জম্মদিন পালন করলো। খাঁচা ভর্তি একটা ফুলের তোড়া ছাড়া উল্লেখ করার মত তেমন কোন উপহার সিহাব নেয়নি। তাই দেখেই ওরা মহাখুশী। হৈ চৈ করে নেচে উঠলো এবং স্বর্নার ক্যাছক্যাছানী শুরু হয়ে গেল।
‘ ভাইয়া, আরো আগে আসলেন না কেন ? আমরা ছবি তুলতাম !
‘ তোল, মানা করছে কে ?
‘ এখনতো কেক কাটা হয়ে গেছে।
‘ সবার প্লেট থেকে কেক তুলে নিয়ে জোড়া লাগিয়ে আবার কাটো।
‘ (হি হি হি ---) ধুর মিয়া, আপনি একটা কিপ্টা। অন্য কেউ হলে এক্ষুনি গিয়ে আরেকটা কেক নিয়ে আসতো।
‘ হ্যাঁ, যদি সে পাগল হয়।
সমস্বরে হেসে উঠলো সবাই। জানো আপু, ভাইয়াকে কথায় হারানো কঠিন। স্বর্না শিলাকে বলা মাত্রই শিলা একটা ধমক দিয়ে বলল- তোকে আর হারাতে হবে না, উনাকে বসতে দে!
অনুষ্টান শেষে উল্টাপাল্টা আসর। গল্পগুজব, হাসাহাসি, উচ্চকন্ঠ, চড়-থাপ্পড় সব কিছুই চলছিল। স্বর্না, শিলা ও মিলা ধাঁধার আসর বসিয়েছিল। একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করছিল আর পিঠের উপর থাপ্পড় মারছিল। দন্ত প্রদর্শনতো আছেই। সিহাবকেও দু’একটা ধাঁধা ধরল। সে একটিও পারেনি। সিহাবও তাদেরকে একটা অংকের খেলা দিয়েছিল। স্বর্না ও শিলা অপারগতা প্রকাশ করল এবং সেটি মিলিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল মিলার উপর। কারণ মিলা ভাল ছাত্রী এবং তাদের বিশ্বাস সে অংকটা মেলাতে পারবে। মিলা চেষ্টা করে অংকটা পেরেছিল ঠিকই কিন্তু তার ফলাফলে সে লজ্জা পেল। সেই ধাঁধাঁর সুত্র ধরেই মিলা বেশ ইজি হয়ে গেল। জড়তা অনেকটাই হ্রাস পেল। ধাঁধাঁটির উত্তর ছিল একটি প্রেমাত্বক বাক্য। যা দেখে মিলার চোখ মুখ বিবর্ন হয়ে গিয়েছিল। স্বর্না সবাইকে পড়ে শোনাল।
ধাঁধাঁর আসরকে এড়িয়ে সিহাব এক পর্যায়ে শিলার সাথে গল্পে লিপ্ত হল। কারন ওর সাথেই সিহাবের ভাল জমতো। অর্থাৎ ওদের দুজনে যখন কথা বলতো তখন কথার মারপ্যাঁচে কেউ কাউকে হারাতে পারতো না সহজে। সিহাব এই বিষয়গুলো ভালই পারতো এবং এন্জয় করতো।
সিহাবের মনে যে প্রশ্নটি বেশী ঘুরপাক খাচ্ছিল সেটা শিলার কাছে পুনরায় জানতে চাইল। কেন সে ছেলেদের পছন্দ করে না? জবাবে শিলা তার এক বান্ধবীর কথা উল্লেখ করে একটি নাতিদীর্ঘ কাহিনী বর্ননা করল। অর্থাৎ জেমি’র জীবনে ঘটে যাওয়া একটি প্রেম কাহিনী।
জেমি ছিল শিলার প্রিয় বান্ধবী। সে রোকনের সাথে প্রেম করতো। রোকন দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম ছিল এবং কাজে কর্মে আচার ব্যবহারে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করা যেত বা তার উপর নির্ভর হওয়া যেত। জেমি তাকে খুব ভালবাসত। বন্ধুমহলের কেউ কখনো ওদের বিচ্ছেদ কামনা করেনি বা ভাবতে পারেনি। রোকনও তাকে ভালবাসত প্রচন্ড রকমের। ওদের মাঝে কোন বিরোধ ছিলনা। কোন রকমের ভুল বোঝাবুঝিও ছিলনা। হঠাৎ একদিন সংবাদ এলো রোকন বিয়ে করে জাপান চলে গেছে। ঘটনাটা ঘটেছিল এক সপ্তাহের মধ্যে। বুঝে উঠতে পারেনি কেউ। আকাশ ভেঙ্গে পড়ল জেমি’র মাথায়। সে একা অসহায় হয়ে গেল। সান্তনা পাওয়ার ভাষা ছিলনা। পারিবারিক কোন প্রতিবন্ধকতাও ছিলনা। অথচ রোকন এমন বেঈমানী করলো! এই ঘটনার পর থেকে জেমি দুঃশ্চিন্তায় অনেকটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ল। তার দুঃসময়ে একমাত্র শিলাই বন্ধু বা বান্ধবী হিসাবে তার পাশে দাঁড়াল। খুব কাছ থেকেই শিলা তার কষ্ট দেখেছে, তার আনন্দে হেসেছে, তার দুঃখে কেঁদেছে। আর সেই কারণেই শিলা ছেলেদের অপছন্দ করে বলে জানিয়েছে।
তবে কোন্ পরিস্থিতিতে রোকন বিয়ে করলো বা কেনইবা এমন ঘটনা ঘটাল, এর পিছনে রোকনের কোন বাধ্যবাদকতা ছিল কিনা- এসব বিষয়ে খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি কেউ। বরং সিহাবের এহেন প্রশ্নের জবাবে শিলা খুবই বিরক্তি বোধ করলো। ক্ষেপে গেল। মুহুর্তেই রক্তবর্ন হয়ে গেল তার চোখ। চীট, বাটপার, ইতর, অসভ্য, ছোটলোক ইত্যাদি বলে রোকনকে গালমন্দ করলো। সিহাব বাস্তবতার আলোকে বিভিন্ন লজিক দিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু সে মোটেই পাত্তা দেয়নি। মনে হল যেন জেমি নয় শিলাই রোকন কর্তৃক প্রতারিত হয়েছে।
‘ আচ্ছা, আপনি কি ছেলেদের সত্যিই ঘৃনা করেন? আপনি কি কখনো বিয়ে করবেন না ?
‘ নিজ ইচ্ছায় করবো না। তবে ফ্যামিলির চাপ সামলাতে না পারলে হয়ত কোন অপদার্থ পুরুষকে বিয়ে করতে হবে।
‘ তখন সেই পুরুষটিকে আপনি কিভাবে মেনে নেবেন ?
‘ লোক দেখানোভাবে মেনে নেব হয়ত। কিন্তু নিজের স্বাধীনতা আগেই কেড়ে নেব।
‘ দিবা স্বপ্নে বিভোর আপনি। জীবনটাকে যেভাবে ভাবছেন এত সহজ বা কন্টকমুক্ত নয়। বরং এর চেয়েও নব্বই ভাগ বেশী কণ্টকাকীর্ণ। সুতরাং এভাবে বলা উচিত নয়।
‘ জি-হাঁ, এমনই করবো।
‘ পারবেন না। ভাগ্যের মারপ্যাঁচে আপনি হেরে যাবেন। ঠিক আছে, বাদ দিন সেসব কথা। রোকন যাক অরন্যরোদনে। আচ্ছা, আপনি কি কখনো প্রেম করেছেন ? -শিহাব বলল।
‘ না। কখনো করিনি, করবোও না।
‘ মানুষ কখন কোন পরিস্থিতিতে প্রেমে পড়ে যায়, সেটা কি জানেন ?
‘ প্রয়োজন নেই।
‘ হঠাৎ যদি আপনি কারো প্রেমে পড়ে যান, তখন কি আপনি আপনার ঘৃনাটা পুরুষ প্রজাতির বিরুদ্ধে প্রকাশ করতে পারবেন ?
‘ যা আমি ঘৃনা করি। যার প্রতি রয়েছে আমার অনীহা এবং অবজ্ঞা, তার সাথে প্রেম(?), প্রশ্নই উঠেনা।
‘ তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন যে, প্রেম ইচ্ছে করেই হয়। মুখ দিয়ে ভালবাসি বললেই ভালবাসা হয়, কিংবা কাউকে পছন্দ হলেই বা নজর পড়লেই কি ভালবাসা হয়ে যায় ?
‘ তা নয়তো কী ?
‘ আসলে এ বিষয়ে আপনি একদম অজানা বলতে হবে। কারণ মানুষ কে কখন কোন পরিস্থিতিতে কার প্রেমে পড়ে যায় কেউ বলতে পারেনা। এটা অনুভূতির ব্যাপার। এর কোন এ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগে না, এটা হয়ে যায়।
‘ অসম্ভব, তবুও পুরুষের উপর কখনোই আমার ভালবাসা জম্মাবে না।
‘ অবিশ্বাস্য। এটা আপনার ওষ্টকথা। মেয়েরা জোর গলায় এসব বলে এক ধরনের ভালমী দেখায়, যেন তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়। অথবা এটা হবে কারো সাথে প্রেম করার পূর্বাভাস।
‘ ইসসস্। কইছে আপনেরে।
‘ কওয়া লাগে না। এমনিতেই বোঝা যায়। মেয়েরা মুখে বলে এক, অন্তরে থাকে আরেক। আমি জানি আপনি সারাক্ষন বিয়ের কথা ভাবছেন। সব মেয়েরাই ভাবে। এটা মেয়েদের দৈনন্দিন কমন ভাবনা। আপনিও ভাবছেন। সুখের স্বপ্ন দেখছেন। সংসার, ছেলে-মেয়ে, দেবর-ননদ, শশুর-শাশুড়ী এসব নিয়েই ভাবছেন।
সিহাব অযথা আর কথা বাড়ায়নি। সে শুধু একবার শিলার আপাদমস্তক দেখে নিল। এরপর থেকে ঘন ঘন স্বর্নাদের বাসায় যেতে লাগল। বিভিন্ন বিষয়ে একটু একটু করে কথা বলতে লাগল এবং ধীরে ধীরে শিলার চোখে মুখের ঘোলা ভাবটাও সরে যেতে লাগল। তাই সুযোগ পেলেই সিহাব সময় দিতো। আধাঘন্টা একঘন্টা গল্প করেও যেন শিলার মন ভরতো না। এক সময় সিহাব হয়ে গেল তার শুকপাখি।
শিলা শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিল বিধায় সিহাব মাঝে মাঝে ঔষধ এনে দিত। স্বর্নাদের বাসায় যাওয়ার সময় এটা ওটা নিয়ে যেতো। ওদের সাথে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে যেত। বাহিরে বেড়াতে যেতো। শিলা তখন মোটেই সিহাবের সঙ্গচ্যুত হত না। একদম ছায়ায় ছায়ায় লেগে থাকত।
এরই মাঝে মিলা স্বর্নার মাধ্যমে সিহাবকে পছন্দ করার কথা জানাল। স্বর্নার সেই রহস্যময় হাসির অর্থ ছিল এটাই। মিলা তখন গ্রামের বাড়ীতে। স্বর্না বিষয়টি তার মাকেও জানিয়ে দিয়েছিল। তিনি হাসিমুখে গ্রহন করেছিলেন। ইতিমধ্যে শিলাও জেনে গেছে। সেও আপত্তি করেনি। কিন্তু সিহাব তাতে রাজী ছিল কিনা কেউ জানতে চায়নি। সিহাব বারবার স্বর্নাকে বলেছিল মিলাকে বাড়ী থেকে নিয়ে আসতে। কিন্তু মিলার লেখাপড়ার ক্ষতি হবে ভেবে সে আসেনি। কাজেই সিহাব বলেছিল- দুর থেকে প্রেম হয় না।
একদিন শিলা, সিহাবসহ ওরা সবাই বিকেলে ছাদে উঠল। সেখানে গিয়ে সুজন ও প্রীতি ছুটোছুটি শুরু করে দিল। স্বর্না অন্য ছাদে দাঁড়ানো একটি ছেলের সাথে ফিল্ডিং মারছিল। এ সুযোগে শিলা ও সিহাব সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে পুডুর পুডুর গল্প জুড়ে দিল।
‘ আচ্ছা, মিলা কবে আসবে ? - সিহাব শিলাকে জিজ্ঞাসা করল।
‘ জানিনা, আগামী সপ্তাহে আসতে পারে।
‘ ধুর, এভাবে কি প্রেম হয় ? মিলা আমাকে পছন্দ করে, হয়ত ভালও বাসে। কিন্তু সেই ভাললাগাকে পরিপক্ক করার জন্যেতো সাক্ষাতের প্রয়োজন। প্রস্তাব পাওয়ার আগে দেখেছি একরকম, আর প্রস্তাব পাওয়ার পরে তাকে দেখতে কেমন দেখায় অনুভব করতে ইচ্ছে করে। আসলে মিলা একটু চুপচাপ থাকেতো, মনে হয় ওর সাথে ভাল জমবে না। আপনি হলে অবশ্য ভালই জমতো।
একথা শোনার পর শিলার চেহারায় যেন প্রদীপ জ্বলে উঠল। তার কঠোর হিংসাত্মক বা ঘৃনাত্বক মনোভাব ম্লান হয়ে গেল। এমনকি ঐ কথার পরিপ্রেক্ষিতে সে আগের মত কোন প্রতিবাদ বা দ্বিমত পোষন করেনি। বরং আরো ঘনিষ্ঠভাবে আড্ডা দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলো। পর পর দ’ুতিন দিন দেখা না হলে খোঁজ নিত। সিহাবের ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয়ে খুটে খুটে প্রশংসা করতে লাগল। সারাক্ষন শুধু সিহাব। সিহাব ছাড়া যেন আর কোন কথা নেই।
সিহাবের যতœ নিতে শুরু করলো রীতিমত। আসামাত্র বসতে দিত, চা করে দিত, না খাইয়ে যেতে দিত না। অনেকটা জামাই আদর। স্বর্নার মা মিলার কথা ভেবেই সাড়া দিতেন। একদিন শুক্রবার প্রীতির নাচের ক্লাস ছিল। সেদিন তাদের সাথে সিহাবকেও যেতে হয়েছিল। প্রীতির সাপ্তাহিক নাচের ক্লাস হত ঢাকা জর্জকোটের পাশে জেলা পরিষদ ভবনে। নিচতলায় ক্লাস হত। ঐদিন প্রীতিকে নিয়ে যেতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল। তাই টিচার তাকে শাস্তিস্বরুপ কিছুক্ষন বসিয়ে রেখেছিলেন। পাশেই চেয়ার ও বেঞ্চে অভিভাবকগন বসে ছিলেন। স্বর্নার মা ও স্বর্না সেখানে বসা ছিল। ছোট ছোট বাচ্চারা তবলার তালে তালে একযোগে নাচছে- ধা গে তে টে না গে ধিন্ না। তালের সাথে যদি কারো মিল না হয় তাহলে টিচার সামনে গিয়ে নিজে নেচে দেখিয়ে দেন এবং বুঝিয়ে দেন। তারপর নির্দেশ মোতাবেক তারা আবার শুরু করে। শিলা তখন সিহাবকে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। বসার মতো উপযুক্ত জায়গা ছিল না। হয়তো সিঁড়ির উপর বসতে পারতো। কিন্তু তার ইচ্ছে হয়নি। খুব বোর ফিল করছিল।
‘ চলেন, জগন্নাথ থেকে ঘুরে আসি। আমাদের ক্যাম্পাস।
শিলা যেতে রাজী হল। তারপর স্বর্নাকে ডেকে নিয়ে সিহাবের পিছে পিছে গেল। সিহাব যেতে যেতে আড়চোখে তাকিয়ে দেখছিল শিলার হাস্যোজ্জল চেহারা। বেশ উৎফুল্ল সে। সিহাব বুঝতে পেরেছে যে, শিলার মনের জানালা খুলে গেছে। ফাইনালের পূর্ব প্রস্তুতি চলছে। তাই সে নিজের সাথে কমপেয়ার করেছে শিলাকে। কিসের মধ্যে কী ? সে শিলার পাশে একদম বেমানান। কোথায় পঞ্চান্ন কেজি ওজনের লিক্লিকে সিহাব আর কোথায় পঁচাশি কেজি ওজনের কঠিন শিলা। সিহাব মনে প্রাণে গ্রহন করতে পারেনি। তবে বুঝতে পেরেছিল যে, শিলা তার প্রেমে পড়েছে। এটা ছিল তার জন্যে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। শিলার জন্যে খুব আপসোস হল।
জেলা পরিষদের গেট পার হয়ে সোজা হেঁটে গেল পশ্চিম দিকে। ন্যাশনাল হস্পিটালের গেটের সামনে কয়েকটি রিক্সা দাঁড়ান ছিল। তারা সেই রিক্সা যট পার হয়নি। বরং রাস্তা পার হয়ে বিপরীত দিকে ফুটপাতে গিয়ে উঠল। সেখান থেকে বরাবর হেঁটে চলে গেল।
কলেজ গেটের পাশে এবং ভিতরে লম্বা বেঞ্চের উপর পুলিশ সদস্যরা বসে ছিল। অন্য দিনের তুলনায় সংখ্যায় একটু বেশীই মনে হল। গেটের একসাইড বন্ধ, আরেক সাইড খোলা। আসা যাওয়ায় কোন বাধা নেই।
সিহাবের পরনে ছিল পাঞ্জাবী। সিল্কি চুল কাঁধ পর্যন্ত লম্বা ছিল। ক্যাম্পাসে প্রবেশের পর বাতাসে তার পাঞ্জাবী ও চুল এলোমেলোভাবে উড়তে লাগল। এসব বিষয়ে ছেলেদের তোয়াক্কা না করলেও চলে। কিন্তু মেয়েদের তোয়াক্কা করতে হয়, কারণ ঐ বাতাসই ছেলেদেরকে মেয়েদের দিকে তাকানোর আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। যদিও সেদিন কাম্পাসে কোন সাধারণ ছাত্রছাত্রী ছিলনা। তবে ছাত্রনেতাদের আনাগোনাসহ হাতে গোনা কয়েকটি জুটি দেখা গিয়েছিল।
হঠাৎ সিহাব হাঁটুর উপর থেকে পাঞ্জাবী টেনে নিয়ে মুখে কিছু একটা মুছতেছিল। অমনি শিলা ধমক দিল। সিহাব অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে তার খবরদারীর মুভমেন্ট লক্ষ্য করল। দেখল, মোটামুটি সাইজে এসে গেছে। সিহাব মনে মনে আনন্দিত। এমতাবস্থায় সিহাবের এক ক্লাসমেট আদনান এসে সামনে দাঁড়াল।
‘ তুই এখানে, এখন এসেছিস কেন ?
‘ এমনি এসেছি।
‘ চলে যা। জলদি।
‘ কেন ?
‘ সকালে পেপার পড়িসনি ?
‘ না তো ।
‘ ঐ দ্যাখ। কর্ণারে তাকা।
আদনান সিহাবকে বিল্ডিংএর পিছনের দিকে ছিপায় তাকাতে বলল। সিহাব চম্কে উঠল। বুকটা কেঁপে উঠল। আড়ালে কয়েকজনকে দেখা গেল। সবাই সজ্জিত। গতরাতে ক্যাম্পাস দখলের লড়াই হয়েছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মাঝে। সকালে জাতীয় দৈনিকগুলোতে সংবাদ বেরিয়েছে। সিহাব সেদিন সকালে পত্রিকা পড়েনি। তাই তার জানা ছিল না। তড়িগড়ি তারা ফিরে গেল জেলা পরিষদের দিকে।
স্বর্নাকে তার মায়ের কাছে রুমের ভিতরে পাঠিয়ে দিয়ে শিলা সিহাবকে নিয়ে পুনরায় বারান্দায় বসে খোশগল্পে মেতে উঠল। তার কথা বলার স্বরে একটা কাঁপুনী কাঁপুনী ভাব ছিল। ঘামছিল শিলা। হ্যান্ড-ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে অনবরত মুছতেছিল। এতে তার মুখের মেকাপ সব উঠে গিয়ে সিদ্ধ আলুর মত দেখাচ্ছিল। লিপস্টিক লাগানো ঠোঁটে টিস্যু ঘর্ষনের ফলে রঙটা ফেটে গিয়ে মরা গাছে ঝুলে থাকা শষার বাকলের মতো মনে হল। অথচ তার কিছুক্ষন আগেও ছিল টাটকা কমলালেবুর কোষের মতো। আবেগময় মুহুর্ত না হলে হয়ত কমলালেবুর ঐ কোষ দুটো তরতাজাই থাকত। কিন্তু তার কপালের ঐ নীল টিপ তখনো নীল ছিল। একটুও পরিবর্তন হয়নি। সিহাব তখন মুগ্ধ হয়ে ঐ টিপের দিকেই তাকিয়ে ছিল। শিলার তখন লাল টকটকে চেহারা।
‘ ভাবছি জেমিকে কী জবাব দেব ?
‘ কেন কী হয়েছে ?
‘ বুঝ না কী হয়েছে ? ওর সাথে আমার ওয়াদা ভঙ্গ হয়েছে।
‘ কী রকম ওয়াদা।
সিহাব না বোঝার ভান করল। শিলার মুখ থেকে শোনার জন্যে সে ইনিয়ে বিনিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল। মিটিমিটি হাসছিল সিহাব। পারেনা উচ্চস্বরে অট্রহাসি দিয়ে দেওয়াল ফাটিয়ে দেয়। শিলার দিকে তাকিয়ে দেখল তার প্রফুল্লতা। চোখ মুখ তরঙ্গায়িত। দেহের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেন আনন্দে নাচছিল। মনে মনে সিহাব বলল- ছেলেদের পছন্দ করো না (?) করবা করবা ভালমত করবা, প্রেমও করবা, ভালও লাগবে, একেবারে কচি ডাবের পানির মত মনে হবে।
‘ প্রেম করতে খুব মজা। তাই নাহ্ ?
‘ কী জানি !
‘ আচ্ছা মিলাকে কীভাবে সামাল দেবে? সে তো আমাকে অফার করেছিল তোমার আগে। ছোট বোনের পছন্দের জিনিষ বড় বোন নিয়ে যাবে, ব্যাপারটা কেমন হবে ?
এই প্রশ্নের বিপরীতে শিলা কোন জবাব দেয়নি। তবে ছোটবোনের জিনিষটা হাতিয়ে নেওয়ার কথা শুনে একটু বিচলিত বোধ করল।
‘ এটা কোন সমস্যা নয়। আমরা বোনেরা সবাই ফ্রি মাইন্ডেড। মিলাকে সামাল দিতে অসুবিধা হবে না। ওকে মেনেজ করা খুব সহজ।
‘ মিলাকে সহজ সরল পেয়ে ওর পছন্দের জিনিষ পর্যন্ত কেড়ে নেবে- এটা কী ঠিক হবে ?
‘ এটা কোন ব্যাপার না। ও আমার কথার উপর কিছু বলবে না ?
‘ বড় বোন হিসাবে সে তোমাকে শ্রদ্ধা করে। সেজন্য হয়ত তোমার জন্যে সে তার ভাললাগাকে বিসর্জন দেবে। আর সেই সুযোগ তুমি কাজে লাগাবে ? তোমাকে সমীহ করা মানে এই নয় যে, সে দুর্বল। দুর্বলতা মনে করে তুমি তাকে কাজে লাগাতে পারো না। তাকে ঠকানো তোমার উচিত হবে না।
‘ কী বলতে চাও তুমি ? তুমি কী তাহলে ---
‘ না, ঠিক তা নয়। আমি বলতে চাচ্ছি যে, মিলা হয়ত তোমার সিদ্ধান্তে বাধা দেবে না। তাই বলে তোমার কিন্তু বোঝা উচিত যে, তারও একটা মন আছে। সে যেমন তোমার জন্যে সেক্রিফাইজ করতে প্রস্তুত আছে বলে মনে কর, তেমনি তোমারও উচিত তার জন্যে সেক্রিফাইজ করা। বরং তার উপর তোমার দায়িত্ব আরো বেশী। তা না করে যদি তার শিকারটা নিজের স্বার্থে কাজে লাগাও তাহলে তো রীতিমত স্বার্থপরতা হয়ে গেল। নিজের ছোটবোনের সাথে দিনে দুপুরে এমন প্রতারণা ?
শিলাকে একটু চিন্তিত মনে হল। তারপর হেসে উঠে ঐ একই কথা বলল- এটা কোন ব্যাপার না। মিলা খুব ভাল মেয়ে। ওর কোন অসুবিধা হবে না। আমি ঠিক মেনেজ করে নেব। শুনে শিহাবের চোখ দুটো ছোট হয়ে গেল। সে শিলার দিকে তাকিয়ে দেখে তার মাধুরী মেশানো সজীবতা। মিলা কষ্ট পাবে তাতে তার কোন অনুশোচনা নেই। বরং মনে হল যে, সে বুঝি নায়ককে নিয়ে এক্ষুনি গান গাওয়া শুরু করে দেবে- “আমার স্বপ্ন যে সত্যি হল আজ-- ”। প্রেম কী তাহলে স্বার্থপর হয় ? নাকি প্রেমিক প্রেমিকা স্বার্থপর হয় ? এই প্রশ্নের জবাব হয়ত স্বার্থপর প্রেমিক প্রেমিকারাই দিতে পারে। তবে এক্ষেত্রে প্রেমের যে অপব্যবহার হল তাতে কোন সন্দেহ নেই। মূলতঃ প্রেম সবার জন্যই সমান। কেউ সঠিক প্রয়োগ করে, আর কেউ অপপ্রয়োগ করে। কেউ এর মর্যাদা বোঝে, কেউ বোঝে না। যারা বোঝে না তারা একে নিয়ে ভলিবল খেলে, আর যারা বুঝে তারা বুক পকেটে এঁটে রাখে।
সিহাব ভলিবল খেলার দলে নয়। তবে এটা ছেলেদের প্রতি শিলার বিদ্বেষী মনোভাবের প্রতিবাদমাত্র। তারই প্রতিশোধ হিসাবে প্রেমের পাঠ শেখানোর জন্যে বলা যায় ভলিবল খেলোয়াড় হিসাবেই সিহাবের মাঠে নামা। তবে শিলা নবপ্রেমে বিভোর ছিল। তাই সে সিহাবকে বুঝতে পারেনি।
সিহাবের এমএ পরীক্ষা সন্নিকটে। জগন্নাথ থেকে নৈশ শাখায় মাষ্টার্স পরীক্ষার্থী সে। তাই দৈনন্দিন কর্তব্য কর্ম-রুটিনের পাশাপাশি লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত ছিল। এদিকে শিলা প্রতিদিনই তার পথ চেয়ে বসে থাকে। দুই দিন দেখা না হলেই শিলা অস্থির হয়ে পড়ে। সংবাদ পাঠায়। কিন্তু সিহাব অতটা গুরুত্ব দেয়না। তার তেমন আগ্রহও ছিল না, থাকার কথাও নয়। শিলাতো একদম প্রেমের জলে হাবুডুবু খেতে খেতে বাড়ীর কথা ভুলেই গেছে। বিভিন্ন অযুহাতে সে ঢাকায় তার খালার বাসায় অবস্থান করছিল। ওদের বিষয়টা একসময় স্বর্না জেনে গেল। সে তার মাকে জানাল। তিনি প্রথমে একটু বিচলিত ও রাগাম্বিত হলেও পরক্ষনে মেনে নিয়েছেন। কারন বোনদের মাঝে মিলার পজিশন ছিল দ্বিতীয়। সুতরাং শিলার সিরিয়াল আগে। তবুও স্বর্না বাঁধা দিয়েছিল। সে মোটেও সমর্থন দেয়নি, মানতে চায়নি। কারণ মিলার পক্ষে সে। মিলাই তাকে ব্যবহার করেছে। স্বর্না হল মিলার মেন্টাল পার্টনার। কাজেই স্বর্না প্রতিবাদ করলেও তার মা প্রকৃতপক্ষে মিলার প্রতি অবিচারই করেছেন। একবারও তার মানষিক অবস্থা নিয়ে ভাবেননি। তিনি বুঝতেও চাননি।
স্বর্নাকে দিয়েই মিলা শুরু করেছিল তার প্রথম ভালবাসা। সেই স্বর্নার কাছ থেকেই শুনেছে তার ভালবাসা ছিনতাইয়ের সংবাদ। ছিনতাই করলো তারই বড় বোন। শুনে খুবই কষ্ট পেল সে। নীরবে নিবৃত্যে রাতভর শুধু কেঁদেছে। কিন্তু তার সেই কান্নাজল কাউকে শীতল করতে পারেনি। শিলাকেও টলাতে পারেনি। খালা ছিল কঠিন পাহাড়। এক্ষেত্রে তার বাবা-মায়ের তেমন কোন ভুমিকা ছিল না। কারণ শিলা ছিল বিবাহযোগ্যা এবং তার খালা হলেন সবার বড়। সেই হিসাবে তিনি তাদের পরিবারে একটি বিশেষ সম্মান বহন করতেন। যেই সম্মানের কাছে মিলা ছিল অসহায়। কাজেই বুকের উপর পাথর চাপা দেওয়া ছাড়া তার কোন গত্যান্তর ছিল না। কেঁদে কেঁদে শুধু একটা কথাই বলেছিল- অভিভাবকরা বুঝি এমন হয় ?
সিহাবের পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর পরই সারাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিল। রুটিন অনুযায়ী প্রথম বিষয় পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঠিক পনের দিন পর দ্বিতীয় বিষয় পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। অফিস থেকেও ছুটি নিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিষয় পরীক্ষা হওয়ার চার-পাঁচ দিন আগে থেকেই বন্যার পানি বিপদসীমা ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঐরকম পরিস্থিতিতে পরীক্ষা এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিল। কারন বেশীর ভাগ পরীক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থাৎ ঢাকার বাহির থেকে এসে পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতো। তাছাড়া মানবতার উপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সকলেরই সহানুভুতি দেখানো একান্ত কর্তব্য।
যাইহোক সেই সপ্তাহে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হল। ক্রমান্বয়ে আরো বিপজ্জনক হয়ে পড়ল। রাস্তাঘাট তলিয়ে ঢাকার সাথে সারাদেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। পরীক্ষার তারিখ আরো এক সপ্তাহ পিছিয়ে গেল। তাতেও কিছু হলনা। পরিশেষে কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্যে পরীক্ষা পিছিয়ে দিল। হঠাৎ সংবাদ এলো সিহাবের ভিসা এসে গেছে। যেতে হবে মধ্যপ্রাচ্যে। বিশ্বখ্যাত একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানীতে তার চাকুরী হয়ে গেছে। শুনে পরিবারের সবাই খুশী। কিন্তু সিহাব খুশী হতে পারেনি বরং বিমূঢ় হয়ে গেল। যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল। কারণ তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মাষ্টার্স কমপ্লিট করা। এটা তার সারাজীবনের সাধনা, জীবনের সর্বশেষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। সেশনযট মিলে পাঁচ পাঁচটি বৎসর এর পিছনে শ্রম দিয়েছে, সময় দিয়েছে, অর্থ ব্যয় করেছে অথচ শেষ পর্যায়ে একদম তীরে এসে তরীডুবি। কিছুতেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারেনি। সে বিদেশযাত্রা প্রত্যাখ্যান করল। কিন্তু তার ফ্যামিলির কর্তাব্যক্তিগন তার সেই প্রত্যাখ্যান নাকচ করে দিল। সে উপেক্ষা করতে পারেনি। চেষ্টা করেও বেঁকে বসতে পারেনি। কারণ পরিবারের বড় ছেলেরা হয়ত দায়িত্ব উপেক্ষা করতে পারেনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন